যিলকদ ১৪৪৪   ||   জুন ২০২৩

আত্মহত্যা : বাঁচতে দরকার দ্বীন কেন্দ্রিক প্রশান্তির ঝরনাধারা

মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ

জীবনের প্রতি হতাশা ও বিরক্তির একটি চরম অসংযত প্রকাশ হল আত্মহত্যা। মনের মধ্যে ইহকালীন জীবন কেন্দ্রিক নানারকম অলীক স্বপ্নজাল ছিঁড়ে গেলে কিংবা জীবনে ক্লান্তি নেমে এলে পালিয়ে গিয়ে বাঁচার যে ভুল পরিণতিটি আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে তৈরি হয় আত্মহত্যাকারী সেটি দেখে যেতে পারে না। কিংবা ফিরে এসে সেটি জানাতেও পারে না। অথচ আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে হতাশা কিংবা দুর্দশার সমাপ্তি হয় না তার; বরং পরকালীন আযাব ও দুর্দশা আরও বেড়ে যায়। হতাশা কেন্দ্রিক পরিত্রাণ-উত্তেজনা তাকে নিজের ইহকালীন জীবনকে নিজের হাতে শেষ করে দিতে উদ্বুদ্ধ করলেও অনন্ত পরকালের জন্য সেটি আরও চরম বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মৃত্যু মানুষকে শেষ করে দেয়। মৃত্যুর পর যার যার পরকালীন সাজা-জাযার পর্যায় শুরু হয়। কিন্তু আত্মহত্যা ইহকালীন দুভোর্গের চেয়েও বড় দুভোর্গ ও শাস্তির মধ্যে মানুষকে অবধারিতভাবে নিক্ষেপ করে। আত্মহত্যা কষ্টের চক্রকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

আত্মহত্যা হচ্ছে নিজ ইচ্ছায় নিজ চেষ্টায় নিজেকে হত্যা করা। ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত বড় অপরাধ কবীরা গুনাহ। মানুষ জীবনের মালিক না। জীবন ও প্রাণের মালিক আল্লাহ। এজন্য সে কাউকেই হত্যা করতে পারে না; নিজেকেও না। কুরআনে কারীম ও হাদীস শরীফের বেশ কিছু বর্ণনা ও ঘটনায় শাশ্বত এ বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। কিন্তু ঐতিহাসিক যুগ থেকেই মানবসমাজে অপরাপর বড় কিছু পাপের মতো এই পাপের ব্যাধিটির চর্চাও ছিল। আধুনিক সময়কালে যেন পলায়ন চেষ্টার এই পাপের মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। কথিত উন্নত রাষ্ট্রের বাইরে ব্যাধির মতো এই পাপটি ছড়িয়ে পড়ার কথা আগে শোনা যেত না, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশেও প্রায়-প্রায়ই আত্মহত্যার বেদনাদায়ক খবরটি শিরোনাম হয়ে যাচ্ছে সংবাদমাধ্যমে। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা ও মানসিক পরিস্থিতির সঙ্গে আত্মহত্যার মতো অসুস্থ ও বিনাশী অধ্যায়ের যোগসূত্র সামনে আসছে।

সামাজিক মাধ্যমের বিস্তারের বাঁধবন্ধনহীন এই সময়ে ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যা করার প্রবণতাও তৈরি হয়েছে। কেউ নোটিশ দিয়ে আত্মহত্যা করছে, কেউ তো সরাসরি আত্মহত্যার দৃশ্য প্রচার করার ব্যবস্থা করেই দড়িতে ঝুলে পড়ছে। হতাশা, অভিমান, পলায়ন-চেষ্টার পাশাপাশি এ যেন নিজেকে ধ্বংস করতে করতেও সহানুভূতি-হিরো হওয়ার একটি দুঃখী প্রদর্শনী। শহুরে অল্প বয়সী তরুণ-তরুণী, শিক্ষার্থী শ্রেণিটির মধ্যেই এজাতীয় ঘটনা বেশি ঘটছে। সংশ্লিষ্ট পরিবার, নিকটজন ও গোটা সমাজের মধ্যেই এসব দুঃখজনক ঘটনার নেতিবাচক প্রভাবটি পড়ছে বড় আকারে।

দুই।

আত্মহত্যার মতো জীবনবিনাশী সিদ্ধান্তের দিকে কেন ধাবিত হচ্ছে মানুষ; সংখ্যাটি অতি অতি অল্প হলেও? ঘটনার আগে-পরের বিভিন্ন পরিস্থিতি ও চিত্র বিশ্লেষণ করে এর বাহ্যিক কিংবা সহজ-অনুভবযোগ্য কারণ হিসেবে সমাজতাত্ত্বিক ও মনোবিদরা বলছেন, হতাশা ও অভিমান হচ্ছে এর প্রধান দুটি কারণ। নিজের জীবন কিংবা মনের পরাজিত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে ধরে রাখতে না চাওয়া এবং চলমান এ দুর্দশার কবল থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাটাই এখানে মুখ্য। কেউ কেউ দুঃখ ও অভিমানের পর্বটিকে অপরের জন্য অথবা সমাজের জন্য দুর্বিসহ স্মারক হিসেবে পেশ করতেও এমন সর্বনাশা পথে পা বাড়াচ্ছে। আত্মহত্যাকালীন নোট, লিখিত কৈফিয়ত, পোস্ট কিংবা সামাজিক মাধ্যমের সরাসরি চিত্রও এসব বিবেচনা সামনে এনেছে।

ব্যক্তি মানুষ ও একজন মুসলিম হিসেবে আত্মহত্যাকারী এ-পর্যায়ে নিজেকে কতটা দুর্ভাগা ও বিপদগ্রস্ত করে তুলল, বরাবরের মতো এসব প্রসঙ্গ ঘটনা-বিশ্লেষণে খুব একটা জায়গা পায়নি। একইসঙ্গে এসব আত্মবিনাশী দুর্ঘটনার প্রচার সমাজের ঝুঁকিপূর্ণ তারুণ্য এবং আপাত বিষণ্ণ ও হতাশ মধ্যবয়সী লোকজনের মনস্তত্ত্বে কতটা খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে সে আলোচনাও আসেনি।

আত্মবিভোর, আত্মমগ্ন হওয়ার প্রযুক্তি এখন ঘরে ঘরে, হাতে হাতে। একইসঙ্গে মুহূর্তেই দুনিয়াব্যাপী আত্মপ্রচারের খোলা ময়দান। কল্পিত সাফল্য থেকে নিঃসঙ্গ দূরত্ব এবং একাকী হতাশা যাপনের ভুবনে দুআ-মুনাজাত-আল্লাহর ওপর ভরসা স্থাপনের অনুপস্থিতি নিস্ফল প্রান্তিক এক প্রতিশোধী অভিমানের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া, সামাজিকমাধ্যম-মগ্নতার এই স্থির ও ক্ষিপ্র সময়ে হঠাৎ তীব্র অবসাদ এবং হঠাৎই সেই অবসাদ ও বঞ্চনার অভিমানী প্রকাশ; এভাবেই অতি সাম্প্রতিক তারুণ্যের ভুল সমাপনী চিন্তার নাম আত্মহত্যা। সীমিত সামর্থে্যর দুনিয়ায় অতিলাভ এবং অতিলোভের পরাজয়কে মানতে না পারাও এই বিয়োগান্তক পাপাচারের পেছনে ভূমিকা রাখছে। শোকর-সবরের দিগন্তটিকে অন্ধকারে রেখেই নিজেকে নিজে হত্যা করে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে আত্মহত্যা তাই বেদনার এবং পাপের, অভিমানের এবং অসুস্থতার। সবর-শোকর ও তাওয়াক্কুলের সবক হৃদয় জুড়ে জাগ্রত না থাকার একটি দুঃখী দুনিয়াবি পরিণতি।

তিন।

অস্থিরতা ও চূড়ান্ত আত্মবিনাশের পযার্য় থেকে বাঁচতে এবং বেঁচে থাকতে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের সহজ কিছু করণীয় কী হতে পারে? উলামায়ে উম্মত সব রকম মনোদৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধির চিকিৎসায় যে কথা বলেন, মুসলিম জীবনের সাফল্য ও পরিচযার্ হচ্ছে দ্বীন। দ্বীনের জরুরি আমলগুলো সুন্দরভাবে পালন করা। এবাদতের নিয়ম, ধারা ও যত্নের সুরক্ষা দেওয়া। দুনিয়ার জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব ও উত্থান-পতন সম্পর্কে সচেতন ও প্রশান্ত থাকার চেষ্টা করা। আখেরাতের জীবনের সাফল্যকে অনিবার্য প্রধান সাফল্য হিসেবে বিবেচনা মন-মগজে সচল ও জাগ্রত রাখা। প্রযুক্তি ও বিনোদন কেন্দ্রিক আত্মপ্রসাদ ও অতি স্বপ্নবাদিতা কেন্দ্রিক নিঃসঙ্গ বিভোরতা থেকে বের হয়ে আসা। দ্বীন ও সুস্থ সমাজের পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত থাকা, নেক মানুষ, পরিবার, মসজিদ, দাওয়াত এবং তাযকীরের পরিধির সঙ্গে মিলে থাকা। মূলত নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে মনে-প্রশান্ত এবং মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে আল্লাহ তাআলার বিতরণে সন্তুষ্টি ধরে রাখা এবং আখেরাতের নাজাত ও কামিয়াবি সামনে নিয়ে প্রসন্ন ও হাসিমুখ জীবনযাপনের কোনো বিকল্প নেই। দরকার ইস্তিগফার ও দুআয় মনোযোগী থাকা। আল্লাহ তাআলার কাছে মাফ চাইতে থাকা আর তাঁর দরবারে চোখের পানি ঝরিয়ে দুআ করতে থাকার মধ্য দিয়ে মুমিন বান্দা পেতে পারেন সবচেয়ে বড় প্রশান্তি, সান্ত্বনা এবং সার্বিক বিচারে প্রকৃত সুখের সন্ধান।

পরিবার ও সমাজের বড়দেরও একটি বড় দায়িত্ব রয়েছে দুঃখজনক এই পাপের অধ্যায় বন্ধ কিংবা হ্রাস করার ক্ষেত্রে। নতুন প্রজন্মের সামনে একচ্ছত্র দুনিয়ার ক্যারিয়ার কিংবা যন্ত্র ও ভোগের সংস্কৃতিতে বুঁদ হয়ে থাকার যে ভুল চর্চা সমাজের বুকের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে, সেখানে আত্মাকে শুদ্ধ ও সুখি করার দ্বীনী আবহ উপহার দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। উচিত ভুল পথ, ভুল গন্তব্য, ভুল উত্তেজনা ও নিমগ্নতার জগৎ থেকে সরিয়ে এনে দ্বীন কেন্দ্রিক প্রশান্তির ঝরনায় অবগাহনের সুযোগ করে দেওয়া।

কত তরুণ-তরুণী যে অবৈধ মোহ ও সম্পর্কের টানাপোড়নে এই ভুল পথে পা বাড়ায়! কতজন যে সমাজের চাপ ও চারপাশের জাগতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে যেতে দেখে নিজেকেই হারিয়ে ফেলতে চায়! অথচ আখেরাতে যার বিশ্বাস প্রবল, তার তো জানার কথা, এভাবে জীবন শেষ হয় না, দুঃখ শেষ হয় না, পলায়ন কিংবা অভিমান সফল হয় না। বরং এই আত্মবিনাশ মৃত্যু-পরবতীর্ বড় সর্বনাশের চোরা দরজায় পরিণত হয়। আত্মহত্যা হারাম ও কবীরা গুনাহ, পরকাল-অনন্তকাল এবং সেই অনন্তকালে সব নেকী ও গুনাহের প্রতিদান দেওয়া হবে; আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে শুধুই দৃশ্যের বদল ঘটে, কিছুই শেষ হয় না। এই অমোঘ সত্যটি সব বয়সী মুমিন হৃদয়-মস্তিষ্কে অক্ষত রাখার সর্বব্যাপী পাঠ, উচ্চারণ-অনুধাবন চালু রাখা দরকার। এতে  যেমন বেদনাদায়ক এই পাপের কৌতূহল কমতে পারে, তেমনি কমতে পারে অপরাপর সব পাপাচারের প্রবণতা। 

 

 

advertisement