যিলকদ ১৪৪৪   ||   জুন ২০২৩

কে তিনি, যিনি আর্তের ডাকে সাড়া দেন?

মাওলানা ফজলুদ্দীন মিকদাদ

কুরআন কারীমের সূরা নামলে আল্লাহ তাআলা বলেছেন

اَمَّنْ يُّجِيْبُ الْمُضْطَرَّ اِذَا دَعَاهُ وَ يَكْشِفُ السُّوْٓءَ وَ يَجْعَلُكُمْ خُلَفَآءَ الْاَرْضِ ءَاِلٰهٌ مَّعَ اللهِ قَلِيْلًا مَّا تَذَكَّرُوْنَ.

তবে কে তিনি, যিনি কোনো আর্ত যখন তাঁকে ডাকে, তার ডাকে সাড়া দেন ও তার কষ্ট দূর করে দেন এবং যিনি তোমাদেরকে পৃথিবীর খলীফা বানান? (তবুও কি তোমরা বলছ) আল্লাহর সঙ্গে অন্য প্রভু আছেন? তোমরা অতি অল্পই উপদেশ গ্রহণ কর।  সূরা নামল (২৭) : ৬২

এ আয়াতটি সূরা নামলের পঞ্চম রুকুতে। সূরা নামলের পুরো পঞ্চম রুকু জুড়েই আল্লাহ তাআলা তাঁর একত্ববাদ ও একচ্ছত্র আধিপত্যের কথা বলেছেন। সেইসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছেন, আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন কে এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন এবং কে সবকিছু সুনিপুণভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন? তারা বলবে, আল্লাহ। তবুও তারা আমার ইবাদত থেকে বিমুখ থাকে।

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, কে তিনি, যিনি কোনো বিপদাক্রান্ত যখন তাঁকে ডাকে, তার ডাকে সাড়া দেন ও দুঃখ-কষ্ট দূর করে দেন? আল্লাহ! একমাত্র আল্লাহ তাআলাই বিপন্নের ডাকে সাড়া দেন এবং বিপদ দূর করে দেন। আল্লাহ তাআলা অন্যত্র আরও বলেছেন, (তরজমা) তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। সূরা মুমিন (৪০) : ৬০

সূরা নামলের উপরিউক্ত আয়াতটির সঙ্গে আরও চারটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা বারংবার বলেছেন, (তবুও কি তোমরা বলছ) আল্লাহর সঙ্গে অন্য প্রভু আছেন?

যিনি একা সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, সবকিছু যার একক ক্ষমতায় পরিচালিত, তাঁর কি কোনো শরীক ও সাহায্যকারী দরকার আছে? নিশ্চয়ই না। তবুও কেউ কেউ ঘোর অবাধ্য হয়ে তাঁর ব্যাপারে শিরক করে। এমন লোকদেরকেই কুরআন কারীমে সবচেয়ে বড় জালেম বলা হয়েছে।

বস্তুত বিপদ-আপদে সবাই অন্তর থেকে তাঁকেই ডাকে। কিন্তু বিপদমুক্ত হয়েই কেউ কেউ আল্লাহকে ভুলে যায়। আল্লাহ তাআলা কুরআনে একাধিক জায়গায় বলেছেন, তোমরা তো বিপদে পড়লে আমাকেই ডাকো, আমিই তোমাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করি। তারপরও তোমাদের মধ্যে অনেকে বিপদমুক্ত হয়ে একে নিজের কৃতিত্ব মনে করে, কেউ আবার শিরকে লিপ্ত হয়। ইরশাদ হচ্ছে

وَ مَا بِكُمْ مِّنْ نِّعْمَةٍ فَمِنَ اللهِ ثُمَّ اِذَا مَسَّكُمُ الضُّرُّ فَاِلَيْهِ تَجْـَٔرُوْنَ،ثُمَّ اِذَا كَشَفَ الضُّرَّ عَنْكُمْ اِذَا فَرِيْقٌ مِّنْكُمْ بِرَبِّهِمْ يُشْرِكُوْنَ.

তোমাদের যে নিআমতই অর্জিত হয়, আল্লাহরই পক্ষ হতে হয়। আবার যখন কোনো দুঃখ-কষ্ট তোমাদেরকে স্পর্শ করে তখন তোমরা তাঁরই কাছে সাহায্য চাও। তারপর তিনি যখন তোমাদের কষ্ট দূর করেন, অমনি তোমাদের মধ্য হতে একটি দল নিজ প্রতিপালকের সাথে শিরক শুরু করে দেয়। সূরা নাহল (১৬) : ৫৩-৫৪

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসহায় ব্যক্তিকে এই দুআ পড়তে শিখিয়েছেন

اللهُمَّ رَحْمَتَكَ أَرْجُو، فَلَا تَكِلْنِي إِلَى نَفْسِي طَرْفَةَ عَيْنٍ، أَصْلِحْ لِي شَأْنِي كُلَّهُ، لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ.

হে আল্লাহ! আমি আপনার রহমতেরই আশা করি। সুতরাং আপনি এক মুহূর্তের জন্যও আমাকে আমার নিজের প্রতি সমর্পণ করবেন না। আপনি আমার সবকিছু ঠিক করে দেন। আপনি ছাড়া আর কোনো মাবূদ নেই। মুসনাদে আহমদ, হাদীস ২০৪৩০

ইবনে কাসীর রাহ. তাঁর তাফসীরগ্রন্থে ইবনে আসাকির রাহ.-এর তারীখে দিমাশকের উদ্ধৃতিতে একটি ঘটনা উল্লেখ করছেন

দামেশকের এক ব্যক্তির একটা গাধা ছিল। সেটা সে ভাড়ায় খাটিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত। একদিন সে মালপত্র নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। একজন এসে বলল, আমাকে অমুক জায়গায় নিয়ে চলো। গাধার মালিক আরও লাভের আশায় তাকেও যাত্রী হিসেবে নিয়ে নিল। শহর পেরোনোর পর আগন্তুক বলল, তুমি আমাকে ওদিক দিয়ে নিয়ে যাও, ওদিক দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি হবে। গাধার মালিক বলল, আমি তো ওই রাস্তা চিনি না।

সে বলল, আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব। অগত্যা গাধার মালিক ওই রাস্তা ধরল।

কিছু দূর যাওয়ার পরে একটা বিরানভূমি পড়ল। আশপাশে কোথাও জনমানবের চিহ্ন নেই। তখন আগন্তুক বলল, থাম, আমি নামব।

গাধাওয়ালা বলল, এখানে কোথায় নামবে! এখানে তো কিছু নেই।

সে আবারও বলল, তুমি থামাও, আমি নামব।

গাধাওয়ালা তার গাধা থামাল। লোকটি গাধার পিঠ থেকে নেমেই কোমড় থেকে খঞ্জর বের করল।

গাধার মালিক ভয় পেয়ে বলল, আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে ছেড়ে দাও, এই গাধা ও সমস্ত মালামাল নিয়ে যাও, আমাকে মেরো না। কিন্তু সে মানল না। বলল, এগুলো তো নেবই, সাথে তোমাকেও হত্যা করব। গাধার মালিক কাকুতি মিনতি করে প্রাণভিক্ষা চাইল। কিন্তু কাজ হল না। তারপর দিশেহারা হয়ে বলল, তাহলে আমাকে অন্তত দুই রাকাত নামায পড়তে দাও।

সে বলল, আচ্ছা, তাড়াতাড়ি কর।

গাধার মালিক নামাযে দাঁড়াল। কিন্তু প্রচণ্ড ভয়ে সে কোনো আয়াতই মনে করতে পারছিল না। এদিকে খঞ্জর হাতে সেই ডাকাত তাকে তাগাদা দিচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ তার মুখে এ আয়াত এসে গেল

اَمَّنْ يُّجِيْبُ الْمُضْطَرَّ اِذَا دَعَاهُ وَ يَكْشِفُ السُّوْٓءَ.

(তবে কে তিনি, যিনি কোনো আর্ত যখন তাঁকে ডাকে, তার ডাকে সাড়া দেন ও কষ্ট দূর করে দেন...)

তারপরই এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। সেই জনমানবহীন উপত্যকায় এক অশ্বারোহী আসল। সে বর্শা দিয়ে ওই যাত্রীরূপী ডাকাতকে হত্যা করল। 

কাজ সেরে অশ্বারোহী চলে যেতে উদ্যত হল। গাধার মালিক তাড়াতাড়ি তার পরিচয় জানতে চেয়ে বলল, কে তুমি আমাকে রক্ষা করলে?

সে বলল, আমি ওই সত্তার বান্দা, যিনি আর্তের ডাকে সাড়া দেন, বিপদগ্রস্তের দুআ শোনেন এবং বিপদ দূর করেন। (তারিখে দিমাশক ৬৮/২৫১; তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩/৩৮৩)   

আল্লাহ তাআলা বিপদ মুসিবতে বান্দাকে পরীক্ষা করেন বান্দা কতটা সবর ও শোকরের পরিচয় দেয়। তাই সব ধরনের বিপদে ধৈর্য ধরা ও একান্ত আল্লাহমুখী হয়ে থাকা বান্দার কর্তব্য। প্রত্যেক মুমিনের এ বিশ্বাস রাখা আবশ্যক, একমাত্র আল্লাহ্ই আর্ত ও বিপন্নের ডাকে সাড়া দেন এবং তিনিই বিপদ দূর করেন।

আপাত দৃষ্টিতে যদি মুসিবত দূর নাও হয়, তবুও মনে রাখতে হবে, তিনি ছোট বিপদের মাধ্যমে বড় বিপদ থেকে উদ্ধার করেন এবং কখনো দুনিয়ার বিপদের মাধ্যমে আখেরাতের কঠিন বিপদ দূর করে দেন। এ অবস্থায় বান্দা সবর ও শোকরের পরিচয় দিলে তিনি গুনাহ মাফ করে সওয়াব দান করেন এবং বান্দার মর্যাদা আরও বাড়িয়ে দেন। 

 

 

advertisement