যিলকদ-যিলহজ্ব ১৪২৮   ||   ডিসেম্বর ২০০৭

দুর্যোগ
হাফেজ খলিলের পথ অনুকরণীয়

খসরূ খান

সিডর নামের শক্তিশালী হ্যারিকেনের আঘাতে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। গত ১৫ নভেম্বর এ তীব্রবেগের ঘূর্ণি বায়ূতে মারা গেছেন হাজার হাজার মানুষ। আবহাওয়া অফিস দুতিন দিন আগ থেকে সতর্কবার্তা দিয়ে গেলেও ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়নি। প্রথম দিন খবর বেরিয়েছিল ৪০০ থেকে ৫০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দুদিন যেতেই মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার অতিক্রম করবে বলে ধারণা ব্যক্ত করা হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ আহত হয়েছেন, বাড়ীঘর ছাড়া হয়েছেন, নিঃস্ব ও স্বজনহারা হয়েছেন। লাশের সৎকারের অভাব এবং বিপন্নদের প্রতি সহায়তা ও ত্রাণের সীমাহীন অপর্যাপ্ততা পরিবেশকে ভারী করেই তুলেনি, বিষাক্তও করে তুলেছে। সৎকারহীন মৃত মানুষ, মরে যাওয়া গবাদি পশুর পঁচন থেকে দুর্গন্ধ আর খাবার-পানির অভাবে চারদিকে হাহাকার। মিডিয়াগুলোতে এ দুযোর্গের যে চিত্র উঠে আসছে এক কথায় তা পিলে চমকানো।

সামান্য ত্রাণ নিয়ে সরকারের উদ্ধার তৎপরতার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু বিপন্ন মানুষকে উদ্ধারে ধনী-নির্ধন মানুষের ব্যক্তিগত উদ্যোগ, সংগঠন-সংস্থা ও রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা এবার দেখা যাচ্ছে না। দেশে জরুরী অবস্থা জারি থাকা, রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে স্থবিরতা ও ভাঙ্গাগড়ার খেলা তাদের সক্রিয়তার পথে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনসমর্থন আদায়ে কিংবা ভোটবাক্স ভরতে কিংবা সদুদ্দেশ্যে, যে কোন কারণেই হোক এ ধরনের দুর্যোগে এদেশের রাজনীতিকদের ঐতিহ্য হচ্ছে বিপন্নদের পাশে দাঁড়ানো। এই পাশে দাঁড়ানোর অভাবটাই এবার প্রকট হয়ে ওঠেছে। গত বন্যার সময়ে এবং গত রমযানের ঈদে বিপন্ন ও দরিদ্র মানুষজনকে এ কারণেই একা থাকতে হয়েছে, সাহায্যহীন দিন পার করতে হয়েছে। সরকারের পক্ষে জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা যে ভূমিকা রেখে চলেছেন, তাকে খাটো না করেই বলা যায় এ ধরনের দুর্যোগকালে জরুরী অবস্থায় শর্তযুক্ত করে হলেও কিছু শিথিলতা দেওয়াটাই অধিক কল্যাণকর ও প্রয়োজনীয় হতো। এতে সর্বশ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ব্যবসায়ী, সংস্থা সক্রিয় হওয়ার প্রেরণা বোধ করতো। বর্তমান সরকারের বিবেচনায় বিষয়টি থাকলে ভালো হয়। কারণ, বিপদ ও দুর্যোগ বলে কয়ে আসে না। জরুরী অবস্থার মেয়াদ সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু আমাদের পক্ষে বলা কঠিন। কিন্তু এ ধরনের বিপদ-আপদ, দুর্যোগে গণমানুষকে সম্পৃক্ত করার পলিসি নেওয়ার সিদ্ধান্ত সরকার এখনই নিয়ে রাখতে পারেন।

এ দুর্যোগের মধ্যেই একটি উজ্জ্বল ও ইতিবাচক ভূমিকার স্বাক্ষর রেখেছেন বাগেরহাটের হাফেজ মাওলানা খলিলুর রহমান। ১৯ নভেম্বর দৈনিক যায়যায়দিনে সুনীল দাসের রিপোর্টে এবং ঐ দিনই রেডিও টুডের সংবাদ ফিচারে জানা গেছে দুতিন দিন ধরে গ্রামের পর গ্রাম মৃত মানুষের জানাযা ও শরীয়া উপায়ে কাফন-দাফনে খলিল সাহেব বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছেন। মুসলমান মৃতদের লাশ জানাযা ও কাফন ছাড়াই কোনো রকম গোর দিয়ে দেওয়ার দুএকটি দৃশ্য দেখে তিনি মনে বড় আঘাত পান। এরপরই শুরু হয় তার উদ্যোগ। শত শত লাশের সৎকারে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেন। বুকভাঙ্গা দুঃখের মধ্যেও সুখের এই খবরটি গোটা জাতির মনে আশার আলো জাগিয়েছে। টাকা-পয়সাই প্রধান বিষয় নয়, ব্যক্তিগত উদ্যোগেও একজন মানুষ দুর্যোগে তার করণীয় নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন। তিনি উজ্জ্বল অনুকরণীয় একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। এ সমাজের বিত্তবান, সামর্থবান, স্বচ্ছল, সক্ষম সব মানুষ যদি এভাবে এগিয়ে আসতেন তাহলে বিপন্ন মানুষের দুঃখের পাহাড়টা ভাগাভাগি হয়ে যেত।

 

 

advertisement