যিলকদ-যিলহজ্ব ১৪২৮   ||   ডিসেম্বর ২০০৭

সংস্কার
সিইসির ব্যক্তিগত ‘খেয়াল’

ওয়ারিস রব্বানী

১১ জানুয়ারি ০৭ এর পর থেকে দেশে রাজনীতির সংস্কারের নামে অনেক ভাঙ্গাগড়া চলছে। রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ও নীতির রদবদল নিয়ে সরকারের উঁচু পর্যায় থেকে নিয়ে জোরালো কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন বিভিন্ন মহল। গত অক্টোবরের শেষ দিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা সাহেব একটি বামদলীয় প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে দিয়েছেন তাক লাগানো একটি বক্তব্য। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধন না করানো এবং নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়ার ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে তিনি সম্মত। সিইসির এই ব্যক্তিগত খেয়ালের কথা প্রেসে চলে আসে। ধর্ম বিরোধী চক্র নতুন একটি খেলার বস্তু হাতে পেয়ে লাফাতে থাকে। কিন্তু পঁচাত্তরের পর বহুদলীয় গণতন্ত্রের দীর্ঘ ৩২ বছরের এ দেশীয় ইতিহাসে সিইসি সাহেব একটি বড় রকম ধাক্কা মারেন তার এ বক্তব্যে। পশ্চিমঘেষা, ভারতপন্থি ও মেকি বামদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তার এই আগবাড়ানো বক্তব্য বর্তমান সরকারের নির্বাচনী লক্ষ্য ও কর্মতৎপরতাকেই সন্দেহজনক করে তুলেছে।

পার্শ্ববর্তী বড় দেশ ভারতকে বলা হয়, বৃহত্তম ধর্ম নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশ। সেখানকার নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা প্রবাদতুল্য। তারপরও সে দেশে মসজিদ ভাঙ্গার মতো ১০০% সাম্প্রদায়িক ইস্যু নিয়ে সক্রিয় দল বিজেপি নির্বাচনে গিয়ে ক্ষমতায় আসতে পারে, বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারে, সেখানকার নির্বাচন কমিশন শত স্বাধীনতা সত্ত্বেও তাদেরকে বাঁধা দিতে পারে না। এতসব সামনে থাকার পরও আমাদের নির্বাচন কমিশনের প্রধান ব্যক্তিটি তাকে কী ভাবেন? সাম্প্রদায়িকতা তো দূরের কথা, ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির রূপ এখানে যখন কেবল ইসলামী কিছু দাবি-দাওয়ার খ-িত উচ্চারণ সেখানে কার উদ্দেশ্য পূরণে সিইসি সাহেব এ রকম বিদ্বেষী বক্তব্য দিলেন তা বোধগম্য নয়। যে বামদের সঙ্গে তিনি এ কথাগুলো বলেছেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে তারা এক সময় গণবাহিনী গঠনের নামে সিভিল ও আর্মি উভয় সোসাইটিতে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করেছে। তাদের আদর্শের এক ধরনের অনুসারীরা এখনো দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সর্বহারার রাজত্ব কায়েমের স্বপ্নে মানুষ খুনের রাজনীতি করে চলেছে। সে বিষয়ে তাদের কিছু না বলে তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে তার এলার্জি কেন জাহির করলেন এটা সাধারণের বোধগম্য হওয়ার কথা নয়।

এ দেশের সংবিধানে বহুদলীয় গণতন্ত্রের স্বীকৃতি যেমন রয়েছে তেমনি বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম বিষয়েও বিধি অনুচ্ছেদ বিদ্যমান। সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার দাবিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির গ্রহণযোগ্য অনুশীলনও হয়ে এসেছে। এদেশের সিংহভাগ মানুষ ধর্মপ্রাণ। এদেশের কোনো দলই ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারে না। সেখানে সংসদে প্রতিনিধিত্বহীন গলাবাজ ও বিদেশি শক্তির অন্ধকার বিনিয়োগ হালালকারী মাথাগোণা একটি শক্তিকে আশকারা দিয়ে সিইসি নির্বাচন নিয়ে তার আন্তরিকতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছেন বলে কেউ দাবি করলে তাকে কী বলা যেতে পারে?

এদেশের ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর চরিত্র, কর্মপন্থা, ঐক্য-অনৈক্য, সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে অন্য আঙ্গিকে বহু কথারই চর্চা হতে পারে। কিন্তু ধর্মভিত্তিক রাজনীতিরই মূলোৎপাটনের নির্বাচন কমিশনীয় এই খায়েশকে সেই সাধারণ বাদানুবাদের পর্যায়ে দেখার সুযোগ নেই। সুখের কথা, মোটা মাথার মোটা কথায় সরকারের উঁচু মহল যেমন কান দেয়নি তেমনি সংবিধান বিশেষজ্ঞ কোনো কোনো সাবেক বিচারপতি এ ধরনের খেয়াল-খায়েশ পূরণের কোনো সুযোগ যে নেই তা বলে দিয়েছেন।

দেশটাকে যদি কেউ ধর্মকর্মের দিক থেকে তুরষ্ক বানাতে আগ্রহী হয়ে থাকেন এবং সে আগ্রহের মেশিনে তুচ্ছ পার্টস-টুল্স হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার খায়েশ করে থাকেন, তাদেরকে বিনয়ের সঙ্গে প্রথম কথাটি এই বলব যে, এদেশ তুরষ্ক নয়। দ্বিতীয় কথাটি হল, তুরষ্কেও কিন্তু ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও ধর্মীয় কালচার আইন করে নিষিদ্ধ করেও ইসলামী রাজনীতির উৎস ও প্রভাব বন্ধ করা যায়নি। দিন বদলের পালায় তারাই এখন ক্ষমতার বারান্দায়। দেশ তারাই পরিচালনাও করছেন অনেকাংশে। এ দেশে পশ্চিমের বাতাস দেখে পাল তুলে দিলে- অন্তত ধর্মীয় ক্ষেত্রে- সে পাল ছিঁড়ে যাবে বলেই মনে করি।

 

 

advertisement