যিলকদ-যিলহজ্ব ১৪২৮   ||   ডিসেম্বর ২০০৭

ভোটার তালিকা ও মহিলাদের ছবি : শরয়ী দৃষ্টিকোণ

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

সারাদেশে ভোটার নিবন্ধনের কাজ শুরু হয়ে গেছে। চলতি নভেম্বরের মধ্যে ঢাকা শহরেও নিবন্ধন কার্যক্রম আরম্ভ হয়েছে। অন্যান্যবারের থেকে এবারের নিবন্ধনকার্যে কয়েকটি নতুনত্ব ও পার্থক্য রয়েছে। যেমন-

১. এবারের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য ভোটারকে বেশ কিছু তথ্য প্রদান করতে হয় যা পূর্বে করতে হতো না।

২. নির্বাচন কমিশনের লোকেরা ভোটারের ছবি তুলে নেয়।

৩. ভোটারের স্বাক্ষরের সাথে সাথে আঙ্গুলের ছাপও প্রদান করতে হয়।

নির্বাচন কমিশনের লোকজন তথ্য যাচাইয়ের কাজ শেষ করার পর নির্ধারিত দিনে নির্ধারিত স্থানে তথ্যদাতা জনগণকে একত্র করে তাদের ছবি তুলে থাকে। এর কিছু দিন পর তাদের দেয়া হয় ন্যাশনাল আইডি কার্ড বা জাতীয় পরিচয়পত্র।

নতুন নিয়মে ভোটার নিবন্ধনের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই এ বিষয়ে ব্যাপকভাবে মাসআলা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। বিশেষত ছবি তোলা ও আঙ্গুলের ছাপ দেওয়ার ব্যাপারে দ্বীনদার শ্রেণীর মুসলমান মা-বোনদের অনীহা ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে এবং তারা এ বিষয়ে শরীয়তের সমাধান জানতে চেয়েছেন।

শরীয়তের দৃষ্টিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দুটি বিষয় এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনতে হয়।

(১) মহিলা-পুরুষ সকলের ছবি উঠানোর বাধ্যবাধকতা।

(২) ভোটার হওয়া ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ।

প্রথমে দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। রাষ্ট্রের ভোটার হওয়া যে কোন নাগরিকের অধিকার এবং এক ধরনের দায়িত্বও বটে। কারণ জাতীয় জীবনে অনেক সময়ে এমন ব্যাপারও এসে দাঁড়ায় যখন ভোটের সময় কোন ভাল ব্যক্তিকে পাশ করানো অথবা অধিক মন্দ ব্যক্তিকে ঠেকানোর  জন্য একটি ভোট অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এখন যদি কোন লোকের নাম ভোটার তালিকাতেই না থাকে তাহলে সে এ দায়িত্ব আদায় করবে কিভাবে? দ্বিতীয়ত নির্বাচন কমিশনের ভাষ্যমতে বর্তমানে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির সাথে সাথে যে ছবিযুক্ত জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হচ্ছে তা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে কাজে আসবে এবং যাদের এ কার্ড থাকবে না তাদেরকে অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যায় পড়তে হবে। অর্থাৎ যারা ছবি উঠানোর সমস্যার কারণে ভোটার হবে না বা জাতীয় পরিচয়পত্র নিবে না তাদেরকে ভবিষ্যতে হয়রানীর শিকার হতে হবে অনিবার্যভাবে।

অন্যদিকে বিশেষ ওজর ছাড়া ছবি উঠানো শরীয়তে নিষিদ্ধ এ কথা সকলেরই জানা রয়েছে। বিশেষত মহিলাদের ক্ষেত্রে পর্দার বিষয়টি জড়িত থাকায় তা আরো সমস্যার কারণ। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় বর্তমান প্রেক্ষাপটে দ্বীনদার শ্রেণীর লোকজন কি করবে? তারা কি ভোটার হবে এবং ছবি উঠিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করবে? না কি এ পর্যায়ে ভোটার তালিকায় নিজেদের অন্তর্ভুক্তি থেকে বিরত থাকবে?

বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে দ্বীনদার মুসলমানদের জন্য মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে ভোটার হওয়া এবং জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করাই জরুরি মনে হয়। কারণ বিশ্বব্যাপী এখন দ্বীনদার শ্রেণীর মুসলমানদের দমন পীড়ন চলছে বিভিন্নভাবে। এখন যদি এ শ্রেণীর লোকজন ভোটার হওয়া থেকে বিরত থাকে তবে ভবিষ্যতে এ অজুহাতে তারা যে কোন সমস্যায় পড়তে পারেন এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এছাড়া পূর্বেই বলা হয়েছে যে জাতীয় পর্যায়ে কোন সময় এ শ্রেণীর লোকদের ভোটের প্রয়োজনীয়তাও তীব্র হয়ে উঠতে পারে, তখন যদি তারা ভোটারই না থাকেন তবে ভোট দিবেন কি ভাবে?

অতএব আমরা মনে করি মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই ভোটার হওয়া উচিত।

আর ছবি তোলার বাধ্যবাধকতার বিষয়টি এক্ষেত্রে ওজর হিসাবে ধর্তব্য হবে। যেমনিভাবে হজ্ব উমরা চিকিৎসা ও অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনে পাসপোর্ট-ভিসার জন্য উলামায়ে কেরাম ফটো উঠানোর অনুমতি প্রদান করেছেন। তবে মহিলাদের ছবি যেন মহিলা দ্বারা উঠানো হয় এবং ঐ সময়ে যেন ঐ স্থানে কোন পুরুষ না থাকে সে ব্যাপারে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। এলাকার গণ্য মান্য ব্যক্তিবর্গ কেন্দ্রের দায়িত্বশীলদেরকে বিষয়টি বুঝালে তারা অবশ্যই এ দাবি মেনে নিবেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আমাদের নিকট এমন তথ্য এসেছে। তবে দুই এক জায়গা থেকে ভোটার নিবন্ধন কার্যে নিয়োজিত ব্যক্তিদের হঠকারিতার খবরও এসেছে। শোনা গেছে, তারা নাকি মহিলার ছবি পুরুষ ক্যামেরাম্যানের দ্বারা উঠাতে নির্দেশ দিচ্ছে এবং মুখখোলা রেখে বোরকা পরিহিত অবস্থায় ছবি উঠাতে অস্বীকার করছে। যদি ঘটনাটি সত্য হয় তবে তা খুবই নিন্দনীয় এবং অনধিকার চর্চার অন্তর্ভুক্ত হবে।

আমরা এ ব্যাপারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য সম্মানিত কমিশনারদ্বয় এবং সেনাবাহিনী-প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, তারা যেন যে কোন কেন্দ্রে মহিলাদের ছবি উঠানোর বিষয়টি একমাত্র মহিলাদের মাধ্যমেই সম্পন্ন করার নির্দেশ প্রদান করেন এবং কোন মহিলাকে যেন ছবি উঠানোর সময় মুখ ম-লের অতিরিক্ত কোন অংশ খুলতে বাধ্য না করা হয় সে বিষয়টিও সুনিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে উপরোল্লেখিত বিষয়গুলোর ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিলেই কেবল এদেশের ধর্মপ্রাণ মা-বোনেরা স্বেচ্ছায় ভোটার হওয়ার জন্য এগিয়ে আসবেন।

 

 

advertisement