শাওয়াল-যিলকদ ১৪২৮   ||   নভেম্বর ২০০৭

তিন ভাইয়ের গল্প

মাহমুদাতুর রহমান

অনেক অনেক কাল আগের কথা। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনও দুনিয়াতে আসেননি। ইয়ামান নামে এক দেশের নাম শুনেছ না? ওই যে সিলেটের শাহজালাল (রাহ.) যে দেশ থেকে আমাদের দেশে ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন। সেদেশে একজন বড় দয়ালু লোক। তার ছিল তিনটি ছেলে ও একটি বড় ফলের বাগান। এই বাগানে যা উৎপন্ন হত তা দিয়ে তাদের সারা বছরের জীবিকা নির্বাহ হত। গরীবদের প্রতি তিনি খুব সহানুভূতিশীল ছিলেন। বাগানের ফল-ফসল আহরণ করার সময় তিনি তাদেরকে একটি ভাগ দিতেন এবং আশপাশে যেসব ফল ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেত সেগুলো তিনি তাদের জন্য রেখে দিতেন। তারা এবং তাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা সেগুলো কুড়িয়ে নিত। এছাড়া সময় সময় তিনি নানাভাবে তাদের সাহায্য সহযোগিতা করতেন। এজন্য শহরের গরীব দুঃখীরাও তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত। বিপদে আপদে তার কাছ থেকে সাহায্য ও পরামর্শ নিত। কিন্তু তার তিন ছেলের কেউই তাঁর এসব দান-খয়রাত পছন্দ করতো না। আড়ালে তারা তাদের বাবাকে বোকা ও নির্বোধ বলত। এমনি করে অনেক বছর কেটে গেল। সেই দয়ালু ব্যক্তিরও বয়স হয়েছে। একদিন তিনি দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন। তার সব ধন-সম্পদ ও বাগানের উত্তরাধিকারী হল তার তিন ছেলে।

বাগানের ফল আহরণ করার আগের দিন তারা তিন জন মিলে বুদ্ধি করল, আগামী কাল খুব ভোরে আমরা বাগানে যাব, যাতে কোনো গরীব মিসকীন টের পেয়ে বাগানের পাশে ভিড় জমাতে না পারে। তারপর সকাল সকাল সব ফল-ফসল নিয়ে বাড়ি চলে আসব। কোনো মিসকীনকে আমরা আর অংশ দিতে যাব না। যেই কথা সেই কাজ। পরদিন ভালো করে ভোরের আলো ফোটার আগেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে তারা তিন ভাই বাগানের পথ ধরল। চলতে চলতে তারা নিচু স্বরে ফিসফিস করে কথা বলছিল। তাদের মনে ভয় হচ্ছিল, আবার কোনো গরীব মিসকীন টের পেয়ে তাদের পিছু নিয়ে নেয়। কিন্তু এ কি! বাগানের কাছে পৌঁছে তো তাদের চোখ ছানাবড়া। পুরো বাগানের জায়গা জুড়ে কেবল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছাই আর গাছ-পোড়া কয়লার ছড়াছড়ি। কোথাও একটি সবুজ পাতার নিশানাও নেই। মনে হচ্ছে, গত রাতে ভয়াবহ আগুন এবং ঝড়ো হাওয়া এসে বাগানটির এই অবস্থা করে গেছে। তিন ভাই তো ভয়ে আতঙ্কে দিশেহারা। একবার ভাবল, হয়তো তারা পথ ভুল করে এসেছে। চোখ কচলে আবার ভালো করে চারদিকে তাকাল, কই না তো পথ তো ঠিকই আছে। ঐ তো পাশে নাশপাতি বাগান, গম ক্ষেত, যব খেত সব তো আগের মতোই আছে। ওগুলোর উপর যেন আগুনের বা ঝড়ের কোনো ছোঁয়া লাগেনি। ভোরের মৃদু বাতাসে কী সুন্দর করে দুলছে। মাঝখান থেকে তাদের বাগানটির কোনো নাম নিশানা বাকী নেই। কে বিশ্বাস করবে যে, কালও এখানে একটি শ্যামল, সবুজ সুন্দর বাগান ছিল? বাগানের বিস্তীর্ণ শূন্য মাঠের দিকে তাকিয়ে তাদের চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে লাগল। তিন ভাইয়ের মধ্যে যে ছিল মেঝো, জ্ঞান বুদ্ধিতে সে বড় ও ছোট ভাইয়ের চেয়ে ভালো ছিল। সে বলল, "ভাই, তোমরা এখনো বুঝতে পারনি, কেন আমাদের বাগানের এই অবস্থা হয়েছে? ওই যে গরীব মিসকীনদের কোনো অংশ দেব না বলে ঠিক করেছিলাম এজন্যে আল্লাহ শাস্তিস্বরূপ আমাদের বাগান ধ্বংস করে দিয়েছেন। আমরা অসহায় এতীমদের বঞ্চিত করতে চেয়েছিলাম তাই আল্লাহ আমাদের বঞ্চিত করেছেন। চলো আমরা খাঁটি মনে তাঁর কাছে মাফ চাই ও তওবা করি। তওবার বরকতে হতে পারে আবার তিনি আমাদেরকে আমাদের বাগান ফিরিয়ে দেবেন। মেঝো ভাইয়ের কথা শুনে বড় ও ছোট ভাইয়ের চোখের উপর থেকে অন্ধকারের কালো পর্দা সরে গেল। তারা তিন জনই খাঁটি মনে আল্লাহর কাছে তওবা করল ও মাফ চাইল।

এরপর অনেক দিন কেটে গেছে। তিন ভাই এতদিনে আল্লাহ পাকের কাছে কান্নাকাটি করে মাফ চেয়ে আগুনে পোড়া সোনার মতোই নিখাদ ও খাঁটি হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে তারা পূর্বের সেই স্থানে চাষ করে নতুন চারা লাগিয়েছিল ও বীজ বুনেছিল। দেখতে দেখতে চারাগুলো বড় হয়ে গেল এবং বীজ থেকে অঙ্কুর গজিয়ে সেগুলোও লকলকিয়ে বেড়ে উঠল ও ফুল-কুড়িতে ভরে গেল। তারপর যথাসমে ফল আহরণের মওসুম চলে এল। এবার তারা তিন ভাই আর গরীবদের থেকে লুকোচুরি করল না; বরং খুব গুরুত্ব সহকারে ফল আহরণের দিন তাদের সকলকে উপস্থিত থাকতে বলে দিল। নির্দিষ্ট দিনে শহরের সব গরীব মিসকীন বাগানের পাশে এসে জড়ো হল। তিন ভাই তাদের জন্য আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া ফল ছাড়াও প্রচুর পরিমাণে দান করল। তারপরও তাদের যা রয়ে গেল তা পূর্বের সেই বাগানের চেয়ে পরিমাণে অনেক বেশি ছিল। তারা আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করল এবং ভবিষ্যতে কখনও গরীবদের বঞ্চিত করবে না বলে নিয়ত করল। তখন থেকে দিনে দিনে তাদের বাগানের ফল-ফসলে এত বরকত হতে থাকল যে, তাদের বাগানের এক একটা আঙ্গুর বড় বড় আপেলের মতো হতো। বাগানের উৎপন্ন ফল-ফসল দ্বারা তাদের পরিজনের পুরো বছরের জীবিকা নির্বাহ হয়ে আরও অবশিষ্ট থেকে যেত।

 

 

advertisement