শাওয়াল-যিলকদ ১৪২৮   ||   নভেম্বর ২০০৭

খতীব সাহেব স্মরণে

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

রমাযানুল মুবারকের ২৪ তারিখ রাতে (৬ অক্টোবর ২০০৭) ইন্তেকাল হয়ে গেল বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের অন্যতম অভিভাবক, বাইতুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের খতীব হযরত মাওলানা উবায়দুল হকের। সন্ধ্যায় একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে রাতের খাবারের পর তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই চির বিদায় গ্রহণ করেন অস্থায়ী এ নিবাস থেকে।

মাওলানা উবায়দুল হকের জন্ম ১৯২৮ সালে সিলেট জেলায়। প্রাথমিক পড়াশোনা নিজ এলাকায় সম্পন্ন করার পর তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ভারতে পাড়ি জমান। দারুল উলূম দেওবন্দে কৃতিত্বের সাথে দাওরায়ে হাদীস এবং দাওরায়ে তাফসীর সম্পন্ন করেন।

এখানে উস্তাদগণের নিকট তাঁর যোগ্যতা ছিল স্বীকৃত। মুফতী শফী রহ. দারুল উলূম করাচীর জন্য উস্তাদ চেয়ে দেওবন্দে চিঠি পাঠালে তাঁকে মনোনীত করেন দারুল উলূমের উস্তাদগণ। এভাবে তিনি কিছু দিন দারুল উলূম করাচীর উচ্চস্তরের শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকেন। দারুল উলূম করাচীর মুহতামিম হযরত মুফতী রফি উসমানী সাহেবকে এক মজলিসে বলতে শুনেছি, দারুল উলূমে যখন আমরা নিচের জামাতের ছাত্র ছিলাম তখন খতীব সাহেব ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের উপরের শ্রেণীর উস্তাদ। সে যুগে ঢাকার শ্রেষ্ঠ মাদরাসা আশরাফুল উলূম বড়কাটারায় তিনি উচ্চ স্তরের উস্তাদের জিম্মাদারী পালন করেছেন কৃতিত্বের সাথে। অতঃপর এক সময়ে তিনি ঢাকা আলিয়া মাদরাসার শিক্ষকতা শুরু করেন এবং ছাত্রাবাসের সুপারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়ার পর হেড মাওলানা পদে অধিষ্ঠিত হন। দেওবন্দ পড়ুয়া একজন আলেম (যার কোনো সরকারী সনদ নেই) এ পদে আসীন হওয়া তখনকার কোনো কোনো ইর্ষান্বিত মহলের কাছে অপছন্দনীয় ছিল। তারা বিভিন্নভাবে মাওলানা উবায়দুল হককে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। এ ঘটনা বিস্তারিতভাবে অনেকবার শোনার সুযোগ হয়েছে খতীব সাহেবের মুখ থেকে। পূর্ণ সম্মানের সঙ্গে তিনি ঐ চাকুরীর মেয়াদ পূর্ণ করেন। হযরত মাওলানা মুফতী আবদুল মুয়িয রহ.-এর ইন্তেকালের পর বাইতুল মুকাররমের খতীবের পদ শূন্য হলে আশির দশকের প্রথমার্ধে মাওলানা উবায়দুল হক সে পদে আসীন হন। মূলত এরপর থেকেই বিস্তৃত হতে থাকে তাঁর কর্মের পরিধি। সরকারী চাকুরী থেকে অবসর নেওয়ার পর অনেকের জীবনেই হয়ে উঠে সম্পূর্ণ অলস। আবার কেউ কেউ সীমিত পর্যায়ে ছোট খাটো কাজকর্মে সময় কাটান। কিন্তু মাওলানা উবায়দুল হকের ক্ষেত্রে বিষয়টি হয়েছে সম্পূর্ণ উল্টো। বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার পরও বিগত দুই দশকে তিনি আঞ্জাম দিয়েছেন উল্লেখযোগ্য বহু দ্বীনী খেদমত। এ সময়ের মধ্যে তিনি চট্টগ্রামের পটিয়া মাদরাসায়, ঢাকার ফরিদাবাদ মাদরাসায়, সিলেটের দরগাহ মাদরাসায় এবং ঢাকার ফয়জুল উলূম মাদরাসার শাইখুল হাদীস হিসাবে সহীহ বুখারীর দরস দিয়েছেন। মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেছেন ইসলামিয়া ও ফয়জুল উলূম মাদরাসার। আঞ্জাম দিয়েছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব। আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফ্ফুজে খতমে নবুওয়াত বাংলাদেশের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এ ছাড়া অগণিত মাদরাসা, মসজিদ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও সদস্য ছিলেন।

বণার্ঢ্য জীবনের অধিকারী মাওলানা উবায়দুল হক ছিলেন সর্বশ্রেণীর আলেমদের নিকট সমাদৃত। দারুল উলূম দেওবন্দে পড়য়া এবং দেওবন্দী আদর্শের অধিকারী এই মহৎ ব্যক্তিটি সর্বশ্র্রেণীর লোকের শ্রদ্ধা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। মাদরাসার ছাত্রদের আমল-আখলাক এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে তিনি সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন। এমনকি আলিয়া মাদরাসার শিক্ষকতার সময়েও তিনি ছাত্রদের তরবিয়তের ব্যাপারে যত্নবান ছিলেন। ঢাকা আলিয়া মাদরাসার ছাত্রাবাসের এক বিশৃঙ্খল মুহূর্তে তিনি ছাত্রাবাসের প্রভোষ্টের দায়িত্বে নিয়োজিত হন এবং কঠোরভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে স্বক্ষম হন। তখন আলিয়া মাদরাসার দরস দেওয়ার সময় কোনো ছাত্র টুপি ছাড়া বসলে তিনি তাকে রিকশাওয়ালা বলে লজ্জা দিতেন। (এ তথ্য দুটি দিয়েছেন তাঁর সে যুগের শাগরেদ জনাব মাওলানা আবদুর রব) হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. -এর সাথে খতীব সাহেবের গভীর সম্পর্ক ছিল। হুজুরের খলীফাও ছিলেন। হাফেজ্জী হুজুর তাঁর মতকে খুব মূল্য দিতেন এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর পরামর্শ নিতেন। হুজুর বলতেন- মাওলানা উবায়দুল হক হচ্ছেন যীরায় আলেম (সঠিক মতামত প্রদানকারী প্রজ্ঞাবান) ওই সময়ে যখন হাফেজ্জী হুজুর হাকীমুল উম্মত প্রতিষ্ঠিত মজলিসে দাওয়াতুল হকের কাজ বাংলাদেশে প্রথম শুরু করেন তখন খতীব সাহেব এবং বড়কাটারার মুফতী মহিউদ্দীন রহ. মাদরাসা নূরিয়ায় পাহাড়পুরী হুজুরের ছোট্ট কুটিরে এই মজলিসের অফিসিয়াল কাজে বৈঠক করতেন। দাওয়াতুল হকের কাজকে বেগবান করার উদ্দেশ্যে তাদের তিনজনের এই মজলিস মাঝে মাঝেই অনুষ্ঠিত হত। সে সময় থেকেই হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরীকে খতীব সাহেব খুব সম্মান করতেন। ইন্তেকালের কিছুদিন পূর্বে মাওলানা হামীদুল্লাহ সাহেব কর্তৃক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যেখানে দেশের শীর্ষস্থানীয় অনেক বুযুর্গ আলেম উপস্থিত ছিলেন পাহাড়পুরী হুজুর যখন ন্যায় ও সততার ভিত্তিতে ঐক্যের আহ্বান জানান তখন খতীব সাহেব তাঁর বয়ানে এ কথার প্রতি জোর সমর্থন ব্যক্ত করেন। আদর্শবিহীন ঐক্যকে অর্থহীন ও অধিক ক্ষতিকর বলে পাহাড়পুরী হুজুর যে বক্তব্য রেখেছিলেন খতীব সাহেব তার বক্তৃতায়ও তা গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেন।

বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য ও শান্তির জন্য সর্বদা তাঁর প্রাণ কাঁদতো। ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, আফগানসহ বিশ্বের যে যে প্রান্তে মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে তিনি সব জায়গার খোঁজখবর রাখতেন এবং তাদের জন্য দুআ করতেন। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরাক আক্রমণের পর তিনি দেশের পেশাজীবী ও সাংবাদিক সমাজকে নিয়ে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ করেছিলেন।

দেশের আলেমসমাজ তথা ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও দলগুলোর ঐক্যের জন্য তাঁর প্রচেষ্টা ছিল ঐকান্তিক। বহু শ্রম ও সময় তিনি ব্যয় করেছেন এর পিছনে। বহু অনুরোধ-আবদার করে বুঝিয়েছেন রাজনীতিবিদ আলেমদেরকে।

১৯৯৬ পরবর্তী সরকার যখন ইসলামী প্রতিষ্ঠানসমূহ ও ইসলামপন্থীদের দমন ও নির্যাতনের নীতি গ্রহণ করে তখন খতীব সাহেব এর সোচ্চার প্রতিবাদকারী ছিলেন। তাঁকে পদচ্যুত করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের রায়ে তিনি স্বীয় পদে পুনরায় বহাল হন। সরকারের দমন নিপীড়ন তাঁকে হক ও ইনসাফ থেকে বিরত রাখতে পারেনি।

কিছু অবুঝ অতিউৎসাহী লোক কর্তৃক ২০০৫ সালে যখন পুরো দেশে সিরিজ বোমা হামলা হয় এবং ইসলামবিদ্বেষী চিহ্নিত শ্রেণীর লোকেরা এর দায়-দায়িত্ব আলেম-উলামা ও মাদরাসাওয়ালাদের উপর চাপানোর ষড়যন্ত্রে মেতে  উঠেছিল তখন খতীব সাহেব উলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে এহেন কার্যকলাপের জোর প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি ও খুতবা দিয়েছিলেন। এসব কাজ যে ইসলামপরিপন্থী তা তিনি সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তার সাহসী ও সময়োচিত পদক্ষেপ তখন খুব কাজে লেগেছিল। আখেরাতবাসী হওয়ার কিছু দিন পূর্বে দৈনিক প্রথম আলো কর্র্র্তৃক অবমাননাকর কার্টুন প্রকাশের পর তাঁর মন জ্বলে উঠেছিল নবী মহব্বতে। তিনি একে অভিহিত করেছেন খতরনাক বেয়াদবী। চরম ধৃষ্টতা বলে এবং সরকারে উচ্চ মহলে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী উঠিয়েছেন।

 জেনারেল শিক্ষিত সমাজ, পেশাজীবী ও ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাবান ব্যক্তিত্ব। কাউকে সহজেই প্রভাবিত করার মত প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্ব আল্লাহ তাঁকে দিয়েছিলেন।

মারকাযুদ দাওয়া আলইসলামিয়াকে তিনি আন্তরিকভাবে ভালোবাসতেন। এর কার্যক্রমের তিনি একনিষ্ট সমর্থক ছিলেন। মারকাযের মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মালেক সাহেব খতীব সাহেবের অত্যন্ত মহব্বতের পাত্র। মাঝে মাঝে তাঁদের মধ্যে উচ্চতর ইসলামী বিষয়ে মতবিনিময় হতো।

বছর দুয়েক পূর্বে খতীব সাহেব মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ায় তাশরীফ এনে সকলের উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেছিলেন। তালিবে ইলমদেরকে তিনি ইসলামী অর্থব্যবস্থা ও আধুনিক ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ে গবেষণামূলক অধ্যয়নের প্রতি উৎসাহিত করেছিলেন। তিনি বলেছেন, আলেমদেরকে এ দেশের লোকজন পীর-বুযুর্গ হিসাবে শ্রদ্ধা করে, কিন্তু নেতৃত্বের উপযোগী মনে করে না। নিজেদেরকে নেতৃত্বের উপযোগী হিসাবে গড়ে তুলতে সামাজিক কাজে আলেমদেরকে বেশি বেশি অংশগ্রহণ করতে হবে।

মাওলানা উবায়দুল হক সাহেবের অনেক সৎগুণের একটি ছিল অতিথি পরায়ণতা। ভালো খেতে এবং অন্যদেরকে ভালো খাওয়াতে পছন্দ করতেন। তাঁর বাসা থেকে কিছু না খেয়ে কেউ আসতে পারতো না।

সুদমুক্ত ইসলামী অর্থব্যবস্থার জন্য তিনি ব্যাকুল ছিলেন। সম্ভবত এজন্যেই তিনি বহু ইসলামী ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানের শরীয়া কাউন্সিলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। যদিও এসকল প্রতিষ্ঠান সঠিক ও পরিপূর্ণ ইসলামী পন্থায় পরিচালিত না হওয়ার বিষয়ে অনেকেরই অভিযোগ রয়েছে। অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও খতীব সাহেব মনে করতেন অন্তত নামের কারণে হলেও এরা এক সময় পূর্ণ শরীয়া পরিপালনে আগ্রহী হয়ে উঠবে।

খতীব মাওলানা উবায়দুল হক চলে গেছেন। কিন্তু তার ভক্ত-অনুরাগী ও অনুসারীদের জন্য রেখে গেছেন বহু শিক্ষা ও আদর্শ। ৬ দশকেরও বেশি সময় জুড়ে তিনি নিরবিচ্ছন্ন দ্বীনী খেদমত আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত তথা ইসলামের সঠিক আক্বীদা ও শিক্ষার প্রসার করে গেছেন আমরণ। বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য, মুসলিম বিশ্বের শীর্ষ নেতাদের ঐক্য ছিল তার পরম চাওয়া। উলামায়ে কেরাম ও ইসলামপন্থীদের একতাবদ্ধ হওয়া এবং সম্মিলিতভাবে বাতেলের মোকাবেলা করার জন্য আজীবন চেষ্টা করে গেছেন।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর সকল ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসে অধিষ্ঠিত করুন। তাঁর পরিবার-পরিজন ও ভক্ত অনুসারীদের ধৈর্য ধরার তাওফীক দান করুন এবং তাঁর বিয়োগের ক্ষতি থেকে মুসলমানদেরকে হেফাজত করুন। বিশেষত জাতীয় মসজিদের খতীবের দায়িত্বে কোনো মুত্তাকী, পরহেজগার, দুনিয়াবিমুখ হকপন্থী যোগ্য আলেমে দীনকে নিয়োজিত করুন। আমীন।

 

 

advertisement