রজব ১৪২৮   ||   আগস্ট ২০০৭

মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেবের সাক্ষাৎকার

ইসলামী উলূমের রচনাকর্ম ও সংকলন যেদিন থেকে শুরু হয়েছে, সেদিন থেকেই সেগুলোর তাহকীক বা সম্পাদনাও শুরু হয়েছে। আর এ তাহকীক মুদ্রিত কিতাব ও অমুদ্রিত পাণ্ডুলিপি উভয় ক্ষেত্রেই চলেছে।-- মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

 

[মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক [জন্ম ১৩৮৯ হিঃ]। চাঁদপুর শাহরাস্তির খেড়িহর মাদরাসায় শুরু থেকে মেশকাত পর্যন্ত অধ্যয়ন। করাচির বিন্নৌরি টাউনের জামিআতুল উলূম আল ইসলামিয়ায় তাকমীল ১৪০৮ হিঃ। ঐ জামিআতেই হযরত মাওলানা আব্দুর রশীদ নুমানী রহ.-এর তত্ত্বাবধানে তাখাসসুস ফিল হাদীস (উলূমুল হাদীস বিষয়ে উচ্চতর পাঠ গ্রহণ) করেন শাওয়াল ১৪০৮ থেকে শাওয়াল ১৪১১ হি. পর্যন্ত। দারুল উলূম করাচিতে হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দা.বা.-এর তত্ত্বাবধানে তাখাসসুস ফিল ইফতা (ফাতোয়া বিষয়ে উচ্চতর পাঠ গ্রহণ) করেন যিলকদ ১৪১১ হি. থেকে ১৪১৪ হি. মুহাররম পর্যন্ত। ১৪১৪ হি. সফর থেকে ১৪১৬ হি. এর রজব পর্যন্ত রিয়াদে শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.-এর তত্ত্বাবধানে উচ্চতর উলূমুল হাদীস ও ইলমী গবেষণার কাজে আড়াই বছর অতিবাহিত করেন। এর পরের শাওয়াল ঢাকায় উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা ও দাওয়াহ প্রতিষ্ঠান মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ার প্রতিষ্ঠা হয়। এ প্রতিষ্ঠানের আমীনুত তালীম ও উলূমুল হাদীস অনুষদ প্রধানের দায়িত্ব পালন এবং এখনও এ দায়িত্বে নিয়োজিত। গত ১৪২৬ হিঃ এর মুহাররম থেকে ঐ প্রতিষ্ঠানের মুখপত্র মাসিক আল কাউসার-এর তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন। ইসলামী উলূম, হাদীস নিয়ে বিভ্রান্তির উন্মোচন, বিদআতসহ দ্বীনের পোশাকে প্রচলিত বহু বাতিলের স্বরূপ বিশে­ষণে গবেষণাধর্মী শতাধিক মৌলিক নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ। উলূমুল হাদীস বিষয়ে মৌলিক আরবী গ্রন্থ আল মাদখাল ইলা উলূমিল হাদীসিশ শারীফভিত্তিহীন বর্ণনাসমূহের উপর বাংলা গ্রন্থ প্রচলিত জাল হাদীসএবং ইলমে তাসাওউফ বিষয়ে বাংলা গ্রন্থ তাসাওউফ তত্ত্ব ও বিশ্লেষণতার তিনটি সাড়া জাগানো গ্রন্থ।

প্রধানত উলূমুল হাদীসকে বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে ফিক্হ, সীরাত, উসূল ও ইসলামী উলূমের অন্যান্য শাখায় গবেষণারত এই চল্লিশ ছোঁয়া তারুণ্যদীপ্ত সাধক, বিনয়ী ও প্রাজ্ঞ আলেমে দ্বীন বাংলাদেশ, উপমহাদেশসহ পৃথিবীর বহু বরেণ্য মুহাক্কিক ও হাক্কানী বুযুর্গ আলেমের মহব্বত ও শফকতের ছায়ায় দ্বীনী উলূমের গবেষণা ও চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। তার গবেষণা ও মনোযোগের বিশেষ একটি বিষয় হল, আকাবির-আসলাফের মুদ্রিত-অমুদ্রিত বিভিন্ন কিতাবের তাহকীক; পরিভাষায় যাকে বলে তাহকীকুত তুরাস। এরই মধ্যে পৃথিবীর বহু কুতুবখানায় সংরক্ষিত শত বছর থেকে নিয়ে হাজার বছর আগেরও দুর্লভ বহু অমূল্য পান্ডুলিপির সন্ধান নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন। সেসব পান্ডুলিপি কিংবা তার অনুলিপি উদ্ধার, তাহকীক-সম্পাদনার পর সেগুলো যথার্থ যত্নে প্রকাশের একটি মিশন তার সামনে। ইসলামী উলূমের ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রায় অপ্রচলিত ও অচর্চিত একটি বিষয়ে তার চিন্তা, পদক্ষেপ ও ভবিষ্যৎপ্রোগ্রাম জানতে তার মুখোমুখি বসেছিলেন মাসিক আলকাউসার-এর নির্বাহী সম্পাদক শরীফ মুহাম্মদ।]

* তুরাসে ইসলামী ও তাহকীকুত তুরাস বিষয়টি কী?

** সালাফ বা পূর্ববর্তী ইসলামী মনীষীগণের রেখে যাওয়া ইলমী মীরাস বা উত্তরাধিকার, যা তারা কিতাবী আকৃতিতে রেখে গিয়েছেন। হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে যে উলূমে নবুওয়াত বা নববী ইলম সাহাবায়ে কেরাম অর্জন করেছেন এবং তাঁরা ও পরবর্তী সালাফগণ এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যা বলেছেন ও লিখেছেন তা বিভিন্ন আঙ্গিকে সংরক্ষিত রয়েছে সেসব আঙ্গিকের অন্যতম হল কিতাবী আকৃতি। প্রথমদিকে এগুলো ছিল মাখতূতাত বা পান্ডুলিপির আকৃতিতে, পরবর্তীতে মুদ্রিত (মাতবূআত) গ্রন্থে রূপান্তর করার কাজ শুরু হয়। এই প্রক্রিয়াটিতে সতর্কতা, যাচাই-বাছাই এবং পর্যাপ্ত তাহকীকের ব্যবস্থা করা হত। এ কারণে এক পর্যায়ে এটি একটি স্বতন্ত্র বিষয় বা শাস্ত্রে পরিণত হয়ে গিয়েছে। এভাবেই তুরাসনিয়ে তাহকীক করার একটি ধারাবাহিকতা শুরু হয়ে যায়। তুরাসে ইসলামীনিয়ে তাহকীক নীতি কী হবে? কোনো একটি পান্ডুলিপি বা গ্রন্থকে কখন তুরাসের

অন্তভুর্ক্ত করা হবে? তুরাসের মাপকাঠি কী? পান্ডুলিপি পর্যায়ের কোনো তুরাস মুদ্রণে নিতে হলে কী কী উসূল বা নীতি অনুসরণ করতে হবে? এই তুরাসটি যেই লেখকের বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, আসলেও সেটি তার কিনা? এই কপিটি বাস্তবেই লেখকের মূল কপি বা তার অনুলিপি কিনা? অনুলিপি হলে তার নির্ভরযোগ্যতা কতুটুকু? এসব প্রশ্নের উত্তর খঁুজে পেতে অনেক স্বতন্ত্র কিতাবাদি রচিত হয়েছে। তুরাসে ইসলামীর তাহকীক বা সম্পাদনার ক্ষেত্রে ওই কিতাবগুলোতে বর্ণিত মূলনীতি অনুসরণ করতে হয়।

প্রাচীন কোনো পাণ্ডুলিপি পর্যায়ের তুরাস কি এখন যে কেউ মুদ্রিতরূপে প্রকাশ করতে পারেন?

** ইলমী গভীরতার পাশাপাশি তুরাসের বিষয় ও মূলনীতি জানা থাকা, দীর্ঘ অধ্যবসায়, যাচাই-বাছাই ও গবেষণা করা এবং আমানতদারী বজায় রেখে এ কাজ করার চেষ্টা যারা করেন তারা সফল হন। যে কোনো প্রকাশক ইচ্ছা করলেই এটা করতে পারেন না। করলে তাতে প্রচুর ভুলত্রুটি ও অসামঞ্জস্য থেকে যায়। মূলত: ইলমী অবস্থানের গভীরতা ও আমানতদারী ছাড়া একাজ হুট করে করা উচিৎ নয়।

আমরা শুনেছি প্রাচ্যবিদদের হাতে ইসলামী উলূমের বহু পান্ডুলিপি মুদ্রিত হয়ে গ্রন্থরূপ নিয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা কতটুকু?

** প্রাচ্যবিদরা ইসলামী তুরাস নিয়ে কিছু কাজ করেছেন। কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা যে, তুরাসে ইসলামী নিয়ে তাহকীকের সূচনা তাদের হাতে হয়েছে এবং পরবর্তীতে তাদের দেখাদেখি মুসলিম গবেষকরাও সে পথে গিয়েছেন। মিসরের প্রখ্যাত গবেষক আলেম আহমদ শাকের এ রকম ভুল ধারণা ব্যক্ত করেছিলেন। ইয়াহইয়া ইবনে আদম (২০৩ হি.) সংকলিত কিতাবুল খারাজ-এর ভূমিকায় আহমদ শাকের প্রাচ্যবিদ বা মুস্তাশরিকদেরকে তাহকীকে তুরাসেরসূচনাকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। পরবর্তীতে জামে তিরমিযীতাহকীক করে প্রকাশ করার সময় তুরাসের তাহকীক বিষয়ে ঐতিহাসিক বাস্তবতা তার কাছে উদ্ভাসিত হলে তিনি তাঁর পূর্ব মত থেকে ফিরে আসেন। আসলে তাহকীকে তুরাস এর কাজ মুসলিম মনীষীগণই আগে শুরু করেছেন। আর এটি একটি স্বাভাবিক বিষয়। কারণ, তুরাস তো মুসলমানদের। সুতরাং এর প্রতি তাদের আগ্রহ অমুসলিমদের চেয়ে বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাহকীকুত তুরাসের বেশ কয়েকটি দিক রয়েছে-

১. তাওসীকুন নস ও তাসহীহুহু (ভাষ্যের বিশুদ্ধতা যাচাই ও সম্পাদনা)

২. যাবতুন নস (বিশুদ্ধ পাঠের বিবরণ)

৩. আল মুরাজাআ ওয়াততাখরীজ (উৎসের বিবরণ)

৪. তালীক (টীকা লিখন)

৫. তারকীম (যতি চিহ্নের ব্যবহার)

৬. ফাহরাসা (নির্ঘণ্টায়ন/ইন্ডেক্সিং)

এসব কটিরই সূচনা হয় মুসলিম মনীষীদের হাতে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মৌলিক বিষয় হল প্রথম চারটি, যেগুলোতে প্রাচ্যবিদদের কোনো স্বাতন্ত্র্যই নেই। তাদের কাছে ভালো কিছু যদি থাকে তবে তা মুসলিম মনীষীদের কাছ থেকেই ধার করে নেওয়া।

থাকল তারকীম ও ফাহরাসার কথা। এগুলোরও সূচনা হয় মুসলমানদেরই হাতে। তারকীমের মূল ভিত্তি হল ইলমুল আওকাফএবং ইলমুল ফাওয়াসেল।যা ইস্তেশরাক অস্তিত্বে আসার হাজার বছরেরও বেশি আগে মুসলিম মনীষীদের হাতেই সূচিত হয়। এমনিভাবে ফাহরাসার ভিত্তি হল আইম্মায়ে হাদীসের আসমায়ে রিজালের ওই সব গ্রন্থের উপর যেগুলো আরবী বর্ণমালার বর্ণনাক্রমানুসারে বিন্যস্ত। আর এ ধরনের গ্রন্থগুলোর সংকলন শুরু হয়েছে হিজরী তৃতীয় শতাব্দী বা তারও কিছু আগ থেকে। তবে, তুরাসে ইসলামী নিয়ে তাহকীক করার মূলনীতিগুলো আয়ত্ত করে নেওয়ার কারণে তারা এ বিষয়ে কিছু কিছু কাজ করতে পেরেছে। তুরাসের তাহকীক যে প্রাচ্যবিদদের বহু আগে মুহাদ্দিসীনদের হাতে হয়েছে এ তথ্য ও যুক্তিপূর্ণ আলোচনাটি আহমদ শাকের যে ভূমিকাটিতে লিখেছেন সেই ভূমিকাটির তাহকীক করেছেন শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.।

* তুরাসের প্রয়োজনীয়তা ইলমী ক্ষেত্রে কতটুকু?

** এর প্রয়োজনীয়তা তো প্রশ্নাতীত। দ্বীনের উৎস কুরআন ও সুন্নাহকে আল্লাহ তাআলা যেমন হেফাযত করেছেন তেমনি এ দুউৎসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে উলামায়ে সালাফ যে মহান খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন সেগুলোও আল্লাহ তাআলা হেফাযত করেছেন। দ্বীনের বাহক বা মাধ্যম দু ধরনের। ১. রিজালে দ্বীন-ইসলামী মনীষীগণ ২. কুতুবে দ্বীন-দ্বীনী বিষয়ে লিখিত কিতাবসমূহ। সুতরাং এটা পরিষ্কার তুরাসে ইসলামী যাকে বলা হয় তার প্রয়োজনীয়তা এবং ইলমে দ্বীনের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা প্রায় সমান।

* দ্বীনের বহু প্রয়োজনীয় ও প্রামাণ্যগ্রন্থ মুদ্রিত অবস্থায় বিদ্যমান। এ অবস্থায় পূর্বযুগের পান্ডুলিপি (মাখতুতাত) নিয়ে তাহকীক করা ও মুদ্রণের ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?

** পান্ডুলিপি নিয়ে তাহকীক ও গবেষণার এ প্রক্রিয়াতেই বর্তমানে প্রাপ্ত কিতাবগুলো আমরা পেয়েছি। এগুলোও সেভাবেই এসেছে। এখনকার কিতাবগুলো অবশ্যই প্রয়োজন পূরণ করছে। কিন্তু এগুলোকে এমনভাবে যথেষ্ট মনে করার প্রয়োজন নেই যে, আমাদের সামনে পূর্ব যুগের বহু নির্ভরযোগ্য কিতাবের পান্ডুলিপি উদ্ধার ও তা নিয়ে কাজ করার সুযোগ থাকলেও তা করা যাবে না। এ ছাড়া তুরাস নিয়ে তাহকীক বা গবেষণার যে বিষয়টি রয়েছে তা মুদ্রিত কিতাবাদি নিয়েও তো চলছে। তাহকীকে তুরাস মানেই কেবল অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা নয়। মুদ্রিত-অমুদ্রিত উভয় পর্যায়ের তুরাস নিয়েই তাহকীক চলে এবং এর প্রয়োজনও রয়েছে এবং এসব তাহকীকের দ্বারা বহু ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত হয়। বহু ফায়দা হয়।

* তাহকীকুত তুরাসের বিষয়টি তো সম্ভবত এ কারণেও উদ্ভাবিত হয়েছে যে, আগের যুগের লেখকগণ তাদের হাতে কিতাব মুদ্রণ করে যেতে পারেননি। পরবর্তীতে একশ-দুশ বা আরো শত শত বছর পরে সেই পান্ডুলিপি কেউ উদ্ধার করে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। তখন প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই ও তাহকীকের কাজ করেছেন?

** তাহকীকুত্ তুরাসের এ কাজ লেখক নিজে তার পান্ডুলিপি প্রকাশ করে গেলেও চলেছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। যেমন তাহের আল জাযায়েরী (মৃত্যু ১৩৩৮ হিজরী) ১৩২৮ হিজরীতে তার লিখিত তাওজীহুন নযরকিতাবটি ছেপেছিলেন। পরবর্তীতে ১৪১৬ হিজরীতে সেই কিতাবটিকেই তাহকীক করে দুখণ্ডে প্রকাশ করেছেন শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.। সে কাজে শায়খের হেদায়াত ও নির্দেশে কিছু কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। প্রায় শতাধিক ভুল তাতে সংশোধিত হয়েছে এবং বহু জায়গায় হাশিয়া ও টিকা-টিপ্পনি যুক্ত করা হয়েছে। তাই লেখক নিজে প্রকাশ করে যেতে পারেননি বলেই তাহকীকের এ ধারার উদ্ভব এমন নয়। বরং সত্য হচ্ছে এই যে, ইসলামী উলূমের সংকলন-রচনাকর্ম বা তাসনীফ যেদিন থেকে শুরু হয়েছে সেদিন থেকেই তাহকীক বা গবেষণা শুরু হয়েছে। আর এ তাহকীক মুদ্রিত কিতাব ও অমুদ্রিত পান্ডুলিপি উভয় ক্ষেত্রেই চলেছে। আর এটাও জরুরিও ছিল।

* তাহকীকুত্ তুরাস নিয়ে প্রথম ধারণা ও অবগতি আপনি কিভাবে পেলেন?

** করাচির ইউসুফ বিন্নেীরি টাউনে উলূমুল হাদীস নিয়ে তাখাসসুসে অধ্যয়নকালে এ বিষয়ে ধারণার সূচনা। আমাদের পাঠ্য একটি কিতাব ছিল হযরত মাওলানা আব্দুল হাই লখনৌভির রহ. লিখিত। সে কিতাবে নামের সঙ্গে লেখা দেখলাম-হাক্কাকাহু, খাররাজা নূসূসাহু, ওয়া আল্লাকা আলাইহিএখানে শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ,-এর নাম। কিতাব লিখেছেন মাওলানা লখনৌভী। আর তাতে তাহকীক, তাখরীজ ও তালীক করেছেন শায়খ আবু গুদ্দাহ। বিষয়টি কী? প্রথমে কৌতূহলী হলাম। এরপর হযরত মাওলানা আব্দুর রশীদ নুমানী রহ.-এর তত্ত্বাবধানে কাজ করা ও এবিষয়ে কিতাবাদি পাঠ করার সুযোগ হয়েছে। এরপর যখন শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.-এর তত্ত্বাবধানে রিয়াদে কাজ করার সুযোগ হয়েছে সেখানে এ বিষয়ে শায়খ নছর আল হোরীনীর লেখা আলমাতালিউন নাছরিয়্যা লিল মাতাবিইল মিসরিয়্যা কিতাবটি দেখার সুযোগ হয়েছে। এ কাজে শায়খ আবু গুদ্দাহর পূর্ববর্তী ছিলেন শায়খ আব্দুস সালাম হারুন রহ.। এ বিষয়ে তার লেখা দুটি কিতাবও রয়েছে। ১.তাহকীকুননুসূস ও নাশরিহা ২. কুতুফুন আদাবিয়্যা ফী তাহকীকিত্তুরাস।

* পান্ডুলিপি আকারে তুরাসে ইসলামী পৃথিবীর কোথায় কোথায় বিদ্যমান বলে আপনি জানেন?

** হিজায, মিসর, সিরিয়া, ইরাক, তুর্কিস্তান ও হিন্দুস্তানের কোনো কোনো কুতুবখানায় মাখতুতাতের যখীরা বা পান্ডুলিপির ভাণ্ডার বিদ্যমান। তুর্কিস্তানে পাণ্ডুলিপি আছে বেশি। ইসলামী দারুল খেলাফত বাগদাদ থেকে স্থানান্তরিত হয়ে যাওয়ায় ওখানে বেশি পান্ডুলিপি জমা হয়েছে। এছাড়াও মাগরিবের দেশগুলোর মধ্যে মরক্কো ও স্পেনেও বহু পান্ডুলিপি বিদ্যমান। ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশের প্রচুর পান্ডলিপি রয়েছে। কিন্তু তাও মুসলিম বিশ্ব থেকে নেওয়া। তাই কেন্দ্রীয় অবস্থান সেখানকার নেই।

এসব পাণ্ডুলিপির মধ্যে রয়েছে হাদীস, ফিকহ, সীরাত, তারীখ ও আদব বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডুলিপি।

* তাহকীকে তুরাসের কাজ আপনি কোথায় কী কী করেছেন?

** হযরত শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. এ কাজ করেছেন বহু বছর যাবৎ। আড়াই বছর তাঁর খেদমতে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। হযরত শায়খের হেদায়েত ও নেগারানিতে এ সময়ের মধ্যে ২৩টির মতো কিতাবের তাহকীকে আমার শামিল হওয়ার তাওকীক হয়েছে। যেমন- যাফারুল আমানী, আল ইনতিকা, ছালাছু রাসায়েল, আল ইমাম ইবনু মাজাহ ওয়া কিতাবুহুম সুনান ইত্যাদি।

* তুরাস নিয়ে তাহকীক বা গবেষণার কাজগুলো করার সাধারণ প্রক্রিয়া কী?

** নির্ধারিত উসূল ও নীতিমালা রয়েছে। কিছু কিতাবের নাম ইতোমধ্যে বলেছি সেগুলো পড়তে হবে। তাসহীহুল কুতুব-এর হাশিয়ায় আরো ১৭টি কিতাবের নাম রয়েছে। সেগুলোও দেখা যেতে পারে। আসলে এ বিষয়ে নিয়মনীতি জানাই বড় কথা নয়, নিয়মতো বহু কিতাবেই পাওয়া যাবে। এর সঙ্গে মূলত:  গভীর ইলম ও প্রজ্ঞা থাকতে হবে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে কাজ করছেন এমন কোনো প্রাজ্ঞ শায়খের অধীনে ও সংশ্রবে থেকে কাজ করার অভিজ্ঞতাও লাগবে।

* পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য কে কে এখন এ কাজে যুক্ত আছেন?

** মদীনা মুনাওওয়ারায় শায়খ মুহাম্মদ আওওয়ামা এবং বৈরুতের মুআসসাসাতুর রিসালায় কাজ করছেন শায়খ শুয়াইব আরনাউত।

* এ ধরনের তুরাস যা পান্ডুলিপি পর্যায়ে রয়েছে, মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকায় কিছু কি আনতে পেরেছেন? এবং কোনো কোনোটার কাজ কি চলছে?

** ইতোমধ্যে এখানে বেশকিছু পান্ডুলিপির সিডি, ফটো এবং কিছু মূল পান্ডুলিপিও সংগৃহীত হয়েছে। আদ দুররূল মুখতার-এর বিখ্যাত অথচ অমুদ্রিত একটি ষোল খণ্ডের ব্যাখ্যাগ্রন্থের অনুলিপি (মূল পান্ডুলিপি থেকে) ও আমাদের হাতে আছে। আরো কিছু সংগ্রহ হচ্ছে এবং হবে ইনশাআল্লাহ। এ ক্ষেত্রে তাহকীকের কাজ করার যে এরাদা আমাদের রয়েছে, তার জন্য বড় পরিসরের জায়গা, বড় ও স্বতন্ত্র কুতুবখানা দরকার। যেটা আমাদের এখানে আপাতত সংকুলানযোগ্য নয় এবং স্বতন্ত্র ব্যবস্থাপনাও নেই। যে বিষয়ের কিতাব বা পান্ডুলিপির তাহকীক চলবে, সে বিষয় এবং তার সংশি­ষ্ট বিষয়গুলোর শত শত কিতাব সংগ্রহ করে কাজে বসতে হবে। এ কাজের উপযোগী লোক দরকার। কারণ, এটা এমন কাজ  যে, আদদুররুল মুখতারের যে ব্যাখ্যা গ্রন্থের কথা উল্লেখিত হয়েছে এ ধরনের একেকটি কিতাবের যথাযথ তাহকীকের কাজ যোগ্যতাসম্পন্ন দশ-পনের জনের একটি পরিষদকে কাজ করতে হবে চার-পাঁচ বছর। ইতোমধ্যে মারকাযের শিক্ষাসমাপনকারী অনেকেই এ কাজের উপযুক্ত রয়েছেন। কিন্তু গভীর অধ্যবসায়পূর্ণ এ কাজে যাদের যুক্ত করতে হবে তাদেরও তো ফারেগ করে নেওয়ার মতো ব্যবস্থাপনা দরকার। আসলে আমাদের এখানকার এ বিষয়ক কাজ এগিয়ে নিতে আল্লাহ তাআলার খাস ফযল ও করম দরকার। এ ধরনের কাজের প্রতি উৎসাহী ও আগ্রহী সবার তাই দুআও চাই।

* হালাকুখার আক্রমণে বাগদাদে বহু পান্ডুলিপি ধবংস হয়েছে বলে বলা হয়ে থাকে।

** হ্যাঁ, সে সময় বাগদাদে ও মা ওয়ারাউন্নাহার অঞ্চলে বহু কিতাব, বহু পান্ডুলিপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আল্লাহর ইচ্ছায় সেগুলোর অনেক বিকল্প এখনো রয়ে গেছে। সেগুলোও থাকলে ভালো হত। কিন্তু না থাকায় ইসলামী উলূম ও প্রজ্ঞার জগতে মৌলিক কোনো দুরূহতা বা জটিলতা নেই। যেসব পান্ডুলিপি এখনো দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে সেগুলো উদ্ধার ও যথাযথ তাহকীকের মাধ্যমে মুদ্রিত হলে ইলমী জগতের আরো অনেক ফায়দা হবে। আল্লাহ তাআলা সহজ করুন, কবুল করুন।

 

 

 

advertisement