জুমাদাল আখিরাহ ১৪২৮   ||   জুলাই ২০০৭

দেশ সেবা
অনুতাপ ও অশ্রুর স্রোত

আবু তাশরীফ

গুনাহ ও পাপ করার পর নিয়ম অনুযায়ী অন্তরের বিগলনের সঙ্গে তাওবা করলে বান্দাকে আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করে দেন। বান্দার অনুতাপ ও অশ্রুর পুরস্কার আল্লাহর দরবারে অনেক। যে বান্দা অনুতপ্ত হতে জানেন, আল্লাহর দরবারে কাঁদতে জানেন তার দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনের সাফল্য প্রায় নিশ্চিত। আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত ও অশ্রু ঝরানো বান্দাদের ব্যাপারে দুনিয়ার অপরাপর মানুষেরাও থাকেন স্বস্তিতে। মানুষের ভেতর-বাইরের সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধির জন্য স্বতঃস্ফূর্ত অনুতাপ ও অশ্রুর ভূমিকা বিরাট।

গত কিছুদিন যাবৎ যৌথ বাহিনীর অভিযানে এদেশের বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। এদের অধিকাংশই ছিলেন প্রতাপশালী নেতা ও মন্ত্রী। গ্রেফতার হওয়ার পর জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কেউ কেউ ষড়যন্ত্র, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার এমন সব ঘটনার আত্মস্বীকৃতি দিতে শুরু করেছেন যে, দেশের সেবকদের প্রধান অংশটির নৈতিকতা ও চরিত্র নিয়ে দেশের নাগরিকরা বড় রকম হোঁচট খেয়েছেন। তাদের স্বীকারোক্তি ও অসহায়ত্বের ঘটনা দেখে সবাই কিছুটা থমকেও গেছেন। এরই মধ্যে পত্রপত্রিকা মারফত জানা গেল, দোর্দ- প্রতাপশালী এসব দেশসেবক ও সাবেক মন্ত্রীদের কেউ কেউ জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে তাদের উপস্থিতকালে চোখের পানি ঝরিয়ে নিজের সাফাই গাইছেন, কেউ কেউ ভালো হওয়ার জন্য কাতর কণ্ঠে আরেকবার সুযোগ চাইছেন, আবার কেউ কেউ প্রশাসনের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন। নিরন্তর এই অশ্রুপাত, কাতরতা, ক্ষমা প্রার্থনা, অনুতাপ ও অসহায়ত্বের মধ্যে তাদের কষ্টের দিনগুলো পার হয়ে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে মোটা দাগের বহু দুর্নীতির অভিযোগ ও জিজ্ঞাসাবাদে তাদের এ বিষয়ে স্বীকৃতি দান সত্ত্বেও তাদের এ দুরবস্থার প্রতি মানুষ হিসেবে যে কারো অন্তরে সহানুভূতির জাগ্ররণ স্বাভাবিক। ঝাঁঝালো স্বরে ভাষণ ও ধমক দিয়ে দেশের গতি নিয়ন্ত্রণে যাদের ভূমিকা ছিল, তারা যখন চোখের অশ্রু ছেড়ে দিয়ে কথা বলছেন তখন বুঝতেই পারা যাচ্ছে তারা কম বিপদে নেই। কিন্তু আমাদের জানা নেই, তাদের এ অনুতাপের মূল্য আইন ও প্রশাসনের কঠোরতার সামনে কোনো ভূমিকা তাদের অনুকূলে রাখবে কি না। আমরা জানি না, তাদের এই অশ্রুপাত কতটুকু স্বতঃস্ফূর্ত ও হৃদয়জাত। আমাদের জানা সম্ভব নয় যে, তাদের এ অসহায়ত্বের প্রকাশটা আসলে কার কাছে এবং কেন? আমরা শুধু এতটুকু বুঝি, দুনিয়ার কোনো কঠোর ক্ষমতাসীনের সামনে ক্ষমতাহীন কোনো অভিযুক্ত মানুষের কান্নার দৃশ্যটির চেয়ে মহান পরাক্রমশালী আল্লাহর দরবারে অসহায় বান্দার আর্তির মূল্য অনেক। অপরাধ করে ধরা পড়ে কিংবা বেকায়দায় পড়ে ফেঁসে গিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দেওয়ার চেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত অনুতাপের বিগলিত অশ্রুবিন্দুর মর্যাদা বহু ঊর্দ্ধে। বে-জায়গায় চোখ মোছার চেয়ে উপযুক্ত জায়গায় অশ্রু ছলছল চোখের দামও অমূল্য।

অপ্রত্যাশিত বিপদ ও সংকটে যে কোনো মানুষের চোখে পানি আসতেই পারে। নেতাদের চোখের পানিকেও তাই অস্বাভাবিক বলা যায় না। কিন্তু প্রতাপান্বিত এসব নেতার অসহায়ত্বের অশ্রুবিন্দু দেখতে আমরা অনভ্যস্ত ছিলাম। আমরা অবাক হয়ে দেখতে পেলাম যে, কোনো মানুষের শক্তি-সামর্থ্যই শেষ পর্যন্ত খুবই ক্ষণস্থায়ী, খুবই ভঙ্গুর।

অসহায়ত্ব কি কেবল রাজ্যহারা রাজা কিংবা চেয়ারহারা উজির-নাজিরের মাঝেই সীমাবদ্ধ? নিশ্চয়ই নয়। প্রায় প্রতিটি বান্দার জীবনেই পাপ, তাপ, দুঃখ ও অসহায়ত্বের পর্ব বিদ্যমান। সুতরাং হৃদয়ভেজা অনুতাপ ও বুক ভাসানো অশ্রুপাতের জন্য উপযুক্ত স্থানে (আল্লাহর দরবারে) বহু আগে থেকেই ধর্না দেওয়া উচিত প্রত্যেকের। চোখের পানি জায়গা মতো ঝরাতে পারলে বে-জায়গায় ঝরানোর ক্ষেত্রই আসে কম। তওবা ও অনুতাপের মধ্য দিয়ে যথাস্থানে সে অশ্রুপাতের অভ্যাস আমাদের সবারই গড়ে তোলা উচিত। কিছু বিপদগামী কিংবা বিপদে পড়া রাজনৈতিক নেতার চোখের পানির স্রোত দেখে আমাদের সবার সতর্ক ও শুদ্ধ হওয়ার মনস্থ করতে অসুবিধা কোথায়?

 

 

advertisement