জুমাদাল আখিরাহ ১৪২৮   ||   জুলাই ২০০৭

দেশ নেতার সততার দৃষ্টান্ত

ইসহাক ওবায়দী

গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে একবার ঢাকা এসেছিলাম। শুক্রবারে ধানমণ্ডি ৭ নং রোডে অবস্থিত বড় মসজিদটিতে জুমার নামায পড়তে গেলাম। মসজিদের খতীব প্রখ্যাত শিক্ষাগুরু ডক্টর মোহম্মদ ইসহাক সাহেবের বড় ছেলে হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ যাকারিয়া আমার একান্ত বন্ধু। মসজিদে প্রবেশ করে দেখি তিনি খুতবার আগের বয়ান করছেন। মুসল্লীদেরকে সম্বোধন করে বলছেন, যদি ইসলাম পছন্দ না হয় তাহলে পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র থেকেও তো দৃষ্টান্ত গ্রহণ করতে পারেন। তাদের মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাংক ব্যলেন্স তো দূরের কথা, কোনো ব্যাংক একাউন্ট পর্যন্ত নেই। নিজস্ব কোনো বাড়ি নেই, নিজস্ব কোনো গাড়ি নেই। আর আমাদের অবস্থা কি? ক্ষমতায় যেতে পারলে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। দরিদ্র দেশকে আরো দরিদ্র বানানো হচ্ছে। জনগণের টাকা এভাবে হাতিয়ে নেওয়ার নজীর মনে হয় বিশ্বের আর কোথাও নেই। ইসলামের কথা না হয় বাদই দিলাম এক অমুসলিম সরকারের অমুসলিম মুখ্যমন্ত্রী যদি এভাবে সততার সঙ্গে দেশ চালাতে পারে তাহলে সততার প্রতীক ইসলামে দীক্ষিত হয়ে আমরা মুসলমানরা কেন তা পারি না? ইসলাম ভালো না লাগলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুকরণ করলেও তো দেশ জাতি বেঁচে যায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি তাঁর গরম বক্তৃতার কারণ বুঝতে পারছিলাম না। আমি দৈনিক পত্রিকার নিয়মিত পাঠক নই। মাঝে মধ্যে হেডলাইন ইত্যাদি দেখে থাকি মাত্র। নামায বাদ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত হলে তিনি একরকম জোর করেই তাঁর গাড়িতে উঠিয়ে বসায় নিয়ে গেলেন।

হাফেয যাকারিয়া ধানমণ্ডিরই ছেলে। ৪ নং রোডে তাঁদের বসত বাড়ি। বহু দিন পর দেখা হওয়ায় অনেক কথাই জমা ছিল। তাই বাড়ির তিনতলায় নিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে কথা বলতে বলতে বিকাল হয়ে গেল। কথার ফাঁকে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আজকের বক্তব্যের বিষয়বস্তু খুব গরম দেখলাম, কারণ কী? তখন তিনি বিষয়টি খুলে বললেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কোনো ব্যাংক ব্যালেন্স তো নেইই, ব্যাংকে কোনো একাউন্ট পর্যন্ত নেই। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর বেতন ভাতা হচ্ছে আট হাজার সামথিং মাস শেষে সরকারের পক্ষ থেকে তাকে একটি মুখ বন্ধ খাম ধরিয়ে দেওয়া হয় যার মধ্যে তার বেতন-ভাতা বাবদ আট হাজারের কিছু বেশি ক্যাশ টাকা থাকে। তিনি খামটি না খুলেই সোজা কোলকাতার আলীমুদ্দীন ষ্ট্রীটে চলে যান এবং খামটি পার্টি অফিসে হস্তান্তর করেন। পার্টি অফিস থেকে দলের সার্বক্ষণিক কর্মী হিসাবে তাকে তিন হাজার দুইশ টাকা মাসে দেওয়া হয়। বুদ্ধদেব বাবুর সহধর্মিনীর নাম মিরা ভট্টাচার্য। তিনি একটি বেসরকারি সংস্থার লাইব্রেরিয়ান/কোম্পানির পুল থেকে সবাই যেভাবে গাড়ি ব্যবহার করেন মিসেস মিরাও সেভাবেই গাড়ি ব্যবহার করছেন। মিরা বলেন, দল এবং দেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় আমি সব সময় আমার স্বামীর পাশে আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকব। মুখ্যমন্ত্রী কোনো ফোন বা মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না। গত ২০০০ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি দুই কামরা বিশিষ্ট একটি ফ্লাটে বসবাস করতেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর এই অতিক্ষুদ্র বাসাটি ছেড়ে তাকে মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাস ভবনে যাওয়ার অনুরোধ করা হলে তিনি তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। নিরাপত্তার কারণে পুলিশ বহুবার তাকে সরকারি বাসভবনে যাওয়ার অনুরোধ করেছে, কিন্তু করলেও তিনি তার ঐ ছোট্ট ফ্লাটে বসবাস করার সিদ্ধান্তেই অটল। আজো তিনি পাখির বাসার মতো ঐ ফ্লাটটিতেই বসবাস করছেন।

পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক নির্বাচনের পূর্বে নির্বাচন কমিশনে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তার ব্যক্তিগত ও পরিবারিক সম্পদের যে ঘোষণা দিয়েছেন সেটা পড়ে এবং জেনে নির্বাচন কমিশনের সদস্য ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলও অবাক হয়েছেন ঘোষণাপত্রে বুদ্ধদেব বাবু তার সম্পদের বিবরণ দিয়েছেন নিম্নরূপ।

১.  ব্যাংক একাউন্ট                           :   নাই

২.  নগদ অর্থ                                   :   নাই

৩.  ব্যাংক বা অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানে আমানত :   নাই

৪.  সঞ্চয়পত্র                                   :   নাই

৫.  মোটর গাড়ি                                :   নাই

৬.  অলংকার                                   :   নাই

৭.  কৃষিজমি                                   :   নাই

৮.  এলআইসি                                 :   নাই

৯.  ভবন-বিল্ডিং                               :   নাই

এই বিবরণটি গত ২০০৬ সালের মে মাসের ১৪ তারিখে ইণ্টারনেটে প্রকাশিত হয়েছে। এরপর আমাদের কোনো কোনো দৈনিকেও প্রকাশিত হয়েছে।

দুর্নীতিতে যখন বাংলাদেশ বিশ্ব রেকর্ড স্থাপন করেছে তখন প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাওয়া যাচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। বাংলাদেশের রাজনীতির রাঘব বোয়ালদের অর্থবিত্তের পরিমাণ যখন শত কোটি বা হাজার কোটি বলে শোনা যায়, তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর অর্থ বিত্ত সম্পর্কে শোনা যায় অবিশ্বাস্য কথা। শুধু বুদ্ধদেব বাবু নন, সিপিএম-এর কেন্দ্রীয় এবং জেলা নেতৃত্বের অসংখ্য নেতার লাইফ ষ্টাইল তাদের মুখ্যমন্ত্রীর মতোই। তারা বিত্তবৈভবের পাহাড় গড়ে তোলায় আগ্রহী নন। তাদের অনেকেই এখনো দ্বিচক্রযান, অর্থাৎ সাইকেলে চলাফেরা করেন। রাজনীতিই তাদের ধ্যান, রাজনীতিই তাদের জ্ঞান, তারা জনগণের মাঝে মিশে গেছেন। মুখ্যমন্ত্রী থেকে নিয়ে পঞ্চায়েতের নেতা পর্যন্ত রয়েছে জনগণের প্রত্যক্ষ সংযোগ। তাই জনগণ সেই যে  ৩০ বছর আগে তাদেরকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, আজো তাদেরকে ক্ষমতায় রেখেছে। ২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জনগণ বামফ্রন্টকে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসন দিয়ে ক্ষমতায় পাঠিয়েছে। ২৯৩ আসন বিশিষ্ট প্রাদেশিক পরিষদে ২৩৫ আসনে বিজয়ী করে অষ্টমবারের মতো ক্ষমতায় পাঠিয়েছে।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের চিত্র মেলে ধরলে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। বাংলাদেশের দুর্নীতির উপাখ্যান সমগ্র পৃথিবীজুড়ে রাষ্ট্র হয়ে গেছে। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব মতে শুধু দুর্নীতি দমন করতে পারলেই জিডিপির ২ শতাংশ সাশ্রয় হবে। এই ২ শতাংশের পরিমাণ ৭ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ বিদেশি সাহায্যের জন্য আমেরিকা ও অন্যান্য দাতা দেশ এবং বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থার কাছে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরছে। সারা বছরে দাতারা বৈদেশিক সাহায্য হিসাবে যে অর্থ রিলিজ করে সেটি বাংলাদেশের দুর্নীতি বাবদ লুণ্ঠিত অর্থের এক তৃতীয়াংশেরও কম। শুধু ঘুষ, দুর্নীতি, সম্পদ পাচার ও টাকা লোপাট করা যদি অর্ধেকও বন্ধ করা যেত তাহলেও বাংলাদেশের জন্য কোনো বিদেশি সাহায্যের প্রয়োজন হত না। সাহায্য দিচ্ছে বলেই পশ্চিমারা আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে বলে দেখা যাচ্ছে। অনুরোধে ঢেঁকি গেলার চেয়েও করুণ ও দুঃখজনকভাবে আমাদের রাষ্ট্রের কাণ্ডারীরা বিদেশি প্রভূত্বকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।

অমুসলিম হয়েও সততার এই দৃষ্টান্ত বিশ্বের সামনে স্থাপন করতে পারল অথচ আমাদের মুসলিম নামধারী লোকেরা ন্যাক্কারজনকভাবে উল্টা দৃষ্টান্তই রেখে যাচ্ছে। এ লজ্জা রাখি কোথায়? ইসলাম মানবতার ধর্ম। ইসলাম ন্যায় ও সততার ধর্ম। ইসলামের সুমহান চরিত্রমাধুরী দেখে একসময় গোটা বিশ্বের মানুষই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। অথচ আজ মুসলিম পরিচয়ে পরিচিত লোকদের দেখে অমুসলিমরা ইসলামে দীক্ষিত হতে সংকোচ বোধ করছে।

আমি বন্ধু মাওলানা যাকারিয়াকে বললাম, এই মসজিদের খেতাবতের দায়িত্ব নিতে একসময় আপনি রাজি হচ্ছিলেন না। আমি আপনাকে বলেছিলাম নেওয়া উচিত। কেননা এই মসজিদে যারা নামায পড়েন তারা সমাজের কর্ণধার ও উচ্চ শ্রেণীর লোক। সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রী-মিনিষ্টারদের কেউ কেউ তো আছেনই, সাবেক কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধানও থাকেন। তাদের কাছে ইসলামের বাণী সঠিকভাবে পৌঁছাবার কোনো সুব্যবস্থা আমাদের কাছে নেই। মিডিয়াতে আমরা দুর্বল। তাই এ সকল মসজিদই আমাদের জন্য বড় ধরনের মিডিয়ার কাজ করতে পারে। আপনি থাকলে তাদের কাছে ইসলামের কিছু সঠিক কথা পৌঁছে যাবে হয়তো। এখন দেখলেন তো! কথাটা ঠিক কি না?

আল্লাহপাক তাঁকে এবং সমস্ত ইমাম সাহেবদেরকে এ ধরনের সাহসী বক্তব্য দিয়ে সমাজকে সচেতন করার তাওফীক দান করুন। সাথে আমাদের জাতীয় নেতাদেরকেও এ সকল বক্তব্য থেকে উপদেশ গ্রহণ করার তাওফীক দিক। আমীন।

 

 

advertisement