জুমাদাল উলা ১৪২৮   ||   জুন ২০০৭

ফিতনা : ১
দেখে আসা ষড়যন্ত্রের ধারাপাত

বোমা যারা ফাটায় গর্দভ হোক আর মতলবী হোক তাদের মাথা ঠান্ডা রেখেই তারা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে যায়। কিন্তু বোমা ফাটার পর বোমাবাজদের চিহ্নিত করার নামে প্রশাসন ও মিডিয়ায় শুরু হয়ে যায় মাথা গরম কথাবার্তার চালাচালি। বোমা বাজদের ট্রেস করতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকতেই যেন যাকে তাকে দোষারোপ করার একটি দূষিত প্রতিযোগিতায় তাদের অনেককে নেমে পড়তে দেখা যায়। গত ২০০৫ এর ১৭ আগষ্টের বোমা, জেএমবির আত্মপ্রকাশ, কয়েকটি আদালতে প্রাণঘাতী বোমা হামলার পর গত এপ্রিলে শীর্ষ জেএমবি নেতা ও জঙ্গিদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এর পরপরই গত ১মে আবার ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে বোমা ফাটানো হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে এর পেছনে কোন-সংগঠনের ভমিকা রয়েছে সে প্রশ্নটি জোরালো হয়ে ওঠছে। জেএমবির নেটওয়ার্কের ব্যাপারে সংগৃহিত সরকারি তথ্য ও মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে আগাগোড়া জঙ্গি কার্যক্রমের একটি চিত্র এখন সবার সামনে। জেএমবি-জঙ্গিবাদ ইস্যু নিয়ে বাজারে কোনো কোনো সাংবাদিকের লেখা বইও প্রকাশিত হয়েছে। জেএমবি বা জঙ্গিবাদী তৎপরতার সঙ্গে কারা জড়িত-এ সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য সামনে থাকা সত্ত্বেও গত ১ মে বোমার ঘটনাটির জন্য কেউ কেউ খুব তীক্ষ্ণ ভাষায় আঙ্গুল তাক করতে শুরু করেছেন কওমী মাদরাসাগুলোর দিকে। কাউকে ধরতে না পারা বা নিশ্চিতভাবে কোনো পক্ষ বা গ্রুপকে চিহ্নিত করতে না পারার জ্বালা মেটানোর জন্যই হয়তো এ মাথা গরম আঙ্গুল তাকের ঘটনা ঘটেছে।

গত ১ মে বোমা ফাটানোর পর জাদীদ আল কায়েদা নামের নতুন একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। জেএমবির আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল কাগজের লিফলেটে। জাদীদ গ্রুপের ঘোষণা দেয়া হলো স্টিলের পাতে। জেএমবির ঘটনার পর যেমন জঙ্গির খোঁজে কওমী মাদরাসাগুলোর দিকে ব্যাপক সন্দেহের তীর ছুঁড়া হয়েছে তেমনি জাদীদ ওয়ালাদের ঘটনার পরও জঙ্গিবাদের উৎস খুঁজতে গিয়ে কওমী মাদরাসাগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। জেএমবির সব শীর্ষনেতা ও নেটওয়ার্কে যেমন কওমী মাদরাসা সংশ্লিষ্ট কাউকে পাওয়া যায়নি নিশ্চিত করে বলা যায় এবারো তেমন কাউকে পাওয়া যাবে না। কিন্তু জঙ্গিবাদ প্রকাশক কোনো ঘটনার সূত্র ধরে পানি ঘোলা করে কওমী মাদরাসা বিরোধী প্রোপাগাণ্ডার সুযোগ নিশ্চয়ই মতলবীরা নষ্ট করতে চাইবে না। মাথা গরম বক্তব্য ও মতলবী প্রচারণা একসাথে হয়ে কোনো কোনো বিদেশী রেডিওর বাংলা অনুষ্ঠান, কোনো কোনো দেশি পত্রিকায় কওমী মাদরাসা বিরোধী একটি সুদূর প্রসারী বিষ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। সরকারের একজন উপদেষ্টাসহ কেউ কেউ অবশ্য এ ঘটনা ঘটার পরপর বর্তমান পরিস্থিতে সরকারের ব্যর্থতা প্রমাণ করা বা নজর ঘুরানোর জন্য এটি একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হতে পারে বলে সন্দেহ ব্যক্ত করেছেন। আসলে এটি জঙ্গিবাদী কোনো ঘটনা, নাকি জঙ্গিবাদী ঘটনা হিসেবে এটাকে চালিয়ে দিয়ে আবারো দেশে জঙ্গি জুজু সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে, এ বিষয়ে এখনই অগ্রীম মীমাংসায় না গিয়ে দোষীদের ধরে শাস্তির মুখোমুখি করা হোক। তাতে ঘটনার পেছনে কে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত কারা সবই প্রকাশ পাবে।

বোমার ঘটনার সপ্তাহ খানেক পর বখশি বাজারের অফিসে সাংবাদিক ডেকে  কাদিয়ানীদের উপর হুমকি ধামকির যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাতে এ অনুমানও করা যেতে পারে যে, কাদিয়ানীদের প্রতি সাধারণ মুসলমানদের যে অনুভূতি ও অবস্থান সেটাও যেন আর প্রকাশিত হতে না পারে এ ঘটনার সূত্র ধরে সেটাও আদায় করতে চাচ্ছে কাদিয়ানীরা। বোমার সঙ্গে স্টিলের পাতের ঘোষণাটিকে প্রভাবশালী এনজিওরা এখন পর্যন্ত তেমন আমলে না নিলেও কাদিয়ানীদের নড়াচড়া থেকে বুঝা যাচ্ছে, এ ঘটনা থেকে তারা একটি বাড়তি বেনিফিট নিতে চেষ্টা করছে। শীর্ষ জঙ্গিদের ফাঁসির পর এরকম একটি ঘটনা ঘটলে বা ঘটালে যে তারা কিছু বাড়তি দাবি-দাওয়া আদায় করার সুযোগ পাবে, তারা তাদের অমুসলিম পরিচিতি চিহ্নিতকারী হক্কানী আলেম-উলামা সম্প্রদায়ের ওপর এক হাত নিতে পারবে-এটা কি তারা আগেভাগেই জানতো? এ ধরনের ঘটনায় তবে কি দূর থেকে তাদেরও ইন্ধন থাকতে পারে? বোমার ঘটনা এবং তার পরের প্রতিক্রিয়া দেখে প্রশ্নগুলো এখন জাগে। কারণ, কিছুদিন আগে ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকায় হেড লাইন হয়েছিল, দেশি-বিদেশি বিশেষ সুবিধা আদায়ের জন্য কাদিয়ানী বিরোধী কোনো কোনো আন্দোলনের ফান্ড সরবরাহ করে কাদিয়ানীরাই। এ তথ্যটির সত্যাসত্য যাচাইসাপেক্ষ হলেও কাদিয়ানীদের পক্ষে কোনো স্যাবোটাজধর্মী আচরণই অসম্ভব নয়। এখানে আরেকটি প্রশ্ন চলে আসে। জেএমবির কর্মকাণ্ডের পর যেমন ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বললেই জেএমবির আদর্শের প্রতি আনুগত্যের অভিযোগ তোলা হতো, এবার কি এনজিওদের দ্বীনধর্ম বিরোধী কোনো কোনো কাজ এবং কাদিয়ানীদের ঈমানের গোড়ায় কুঠারাঘাতের তৎপরতা বন্ধের দাবি কেউ জানালে সেটাকেও জাদীদ আল কায়েদা  ধরনের সংগঠনের অনুসরণরূপে চিহ্নিত করার পথ রচনা করা হল?

চোরকে তো চোর বলতেই হবে। চোরকে খুন করে কেউ অপরাধ করলে তার চূড়ান্ত শাস্তি হওয়াই উচিৎ। সেজন্য তো চোরকে সাধু বলে সম্মান জানানো যাবে না। বোমা ও জ্বালাও পোড়াও নয়, অমুসলিম কাদিয়ানীদের অমুসলিমরূপে সরকারিভাবে চিহ্নিত করার দাবি ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে করেই যাবেন। বোমার ধোঁয়ায় এ দাবি বন্ধ করা তো সম্ভব নয়। আসলে এসব বোমা আর বোমার পেছনের কলকাঠি, বোমার পরের বক্তব্য দেখলে বোঝা যায়-ষড়যন্ত্রের পাতা জালের কাঠি হিসেবে হতাশাগ্রস্ত, বোকা ও অপরিণামদর্শী কিছু কিছু লোক ব্যবহার হলেও এ রশির গোড়া অচেনা বড় কারো হাতে। ষড়যন্ত্রের এ ধারাপাত স্বল্প শিক্ষিতরাও এখন বুঝে। 

গ্রন্থনা : ওয়ারিস রব্বানী   

 

 

advertisement