জুমাদাল উলা ১৪২৮   ||   জুন ২০০৭

কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ
সন্তানের জীবন গঠনে মায়ের ভূমিকা

মাহমূদাতুর রহমান

সন্তানের সুন্দর জীবন গঠনে মায়ের ভূমিকা কতখানি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটি শিশু জন্মগ্রহণের পর সর্বপ্রথম মায়ের স্নেহ-ক্রোড়েই প্রতিপালিত হয়। মায়ের বক্ষনিঃসৃত শারাবান তহুরা হয় তার প্রথম খাবার। তারপর ধীরে ধীরে সে চোখ মেলতে থাকে, তার বোধহীন চোখে অনুভবের নতুন আলো ফুটতে থাকে। তখনও সে তার দুগ্ধদাত্রী স্নেহময়ী জননীকে একান্ত নির্ভরতার স্থান ও পরম প্রশান্তির  ঠিকানা বলে বুঝতে শেখে। আধো আধো বুলিতে মায়ের ভাষাতেই তার মুখে প্রথম ভাষা সঞ্চার হয় এবং মায়ের কোলের পাঠশালা থেকেই তার জীবন ও জগতের পাঠ গ্রহণ আরম্ভ হয়। সন্তানের সঙ্গে এই প্রগাঢ় বন্ধনের কারণে সন্তানের লালন-পালন ও তরবিয়তের ভার স্বাভাবিকভাবে মায়ের উপরই অর্পিত হয়। যে মা তার সন্তানকে উত্তম তরবিয়তে গড়ে তুললেন, তার মাঝে ইসলামী আদর্শ ও মনুষ্যত্বের সব নমুনা প্রস্ফুটিত করে তুললেন তিনি শুধু একটি শিশুকেই নয় পরবর্তী একটি বংশকে আলোর পথের পথিক বানালেন। আজ তিনি যে শিশুটিকে উত্তম তরবিয়তে গড়ে তুলছেন ভবিষ্যতে সে-ও একদিন বাবা হবে, মা হবে, তখন সে তার সন্তানদের সে শিক্ষাই দেবে, যে শিক্ষায় সে গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে যে মা এই দায়িত্ব পালনে শিথিলতা করলেন তিনি যে শুধু তার সন্তানেরই জীবন ধ্বংস করলেন তা নয়, বরং তিনি একটি বংশের ধ্বংসের বীজ বপন করলেন। এই দায়িত্বে অবহেলার কারণে কেয়ামতের দিন তাকে আল্লাহ পাকের কাছে জবাবদিহিও করতে হবে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কেয়ামতের দিন প্রত্যেকেই তাদের অধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। পুরুষ তার স্ত্রী সম্পর্কে এবং নারী তার স্বামীর ঘর সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। শৈশবের এই পবিত্রতম সময়ে কোনো মা যদি তার সন্তানদের সামনে সঠিক আচার-আচরণ ও বোধ-বিশ্বাসের নমুনা  উপস্থাপন করতে পারেন তাহলে হতে পারে, তার এই সন্তানই ভবিষ্যতে মুজাদ্দিদে আলফে সানীর মতো সত্যের সৈনিক হবে, ইলিয়াস রহ.-এর মতো দ্বীনের দায়ী হবে কিংবা রাবেয়া বসরীর মতো তাপসী ও জ্ঞানের সাধিকা হবে। নিম্নে দুটি বিষয়ে সম্মানিতা মায়েদের মনোযোগ আকর্ষণ করা হল।

প্রথম বিষয় হল বাচ্চাদের খাবার-দাবার প্রসঙ্গ

অনেক মা-বাবা এদিকে তেমন নজর দেন না। ফলে পরিণতিতে সেই বাচ্চাটাও স্বভাব-চরিত্রে ভালো হয় না। হারাম খাবারের প্রভাবে সে সর্বদা মিথ্যার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। সমাজে যে লোকগুলি বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তাদের অধিকাংশই শৈশবে হারাম ও সন্দেহযুক্ত খাবারে লালিত-পালিত হয়েছে। দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবালের কথা আমরা কে না জানি। তাঁর মহিয়সী মাতা তাঁর বাবার উপার্জনকে সন্দেহযুক্ত মনে করতেন। তাই তিনি শিশু ইকবালকে নিজের বুকের দুধের পরিবর্তে একান্ত হালাল উপার্জনে কেনা ছাগলের দুধ খাওয়াতেন। আল্লাহ পাক মায়ের এই ত্যাগকে বিফল করেননি। আল্লামা ইকবালের ব্যক্তিত্ব এত মকবুল হয়েছিল যে, তা তাঁর মায়ের আশা ও স্বপ্নকেও  ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

পরিণত বয়সে আল্লামা ইকবাল তাঁর মায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলতেন, আমি যে জ্যাতির্ময় ঈমান ইয়াকীনের অধিকারী হয়েছি তার সবই আমার মহিয়সী মায়ের অবদান। আমি জীবনে ভালো যা কিছু অর্জন করতে পেরেছি সবই তাঁর কোলে পাওয়া তরবিয়তের  সোনালী ফসল। কোনো পাঠশালা, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে অন্তর্দৃষ্টি দেয়নি এবং দেয়নি মানবতার জন্য ব্যথিত হৃদয়। আমি যা পেয়েছি তা মায়ের কোলে মায়ের শিক্ষাতেই পেয়েছি।

এমনিভাবে ইতিহাসের পাতায় আমরা আরও যত কীর্তিমান মুমিনের কথা পড়ি তাঁদের সবার মায়েরাই সন্তানের খাবার-দাবারে হালাল-হারাম সম্পর্কে খুবই যত্নশীল ছিলেন।

দ্বিতীয় বিষয় হল ঘরের খাদেমদের সঙ্গে আচরণ

অনেক বাসাবাড়িতে কাজের লোক রাখা হয়ে থাকে। দৈনন্দিন জীবনের সুখে-দুঃখে তারা আমাদের সঙ্গী। ঘামঝরানো শ্রম দিয়ে তারা আমাদের জীবনকে সহজ করে রাখে। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের বাচ্চারা যে ধরনের আচরণ করে থাকে তা কেবল দৃষ্টিকটু ও অশোভনই নয় রীতিমতো অমানবিক। অনেক পরিবারে আমি নিজে দেখেছি, বাচ্চারা কারণে অকারণে কাজের লোকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে, কটুবাক্য বলছে এবং সুযোগ পেলে চড়টা কিলটা খামচিটা দিতে ছাড়ছে না । মা-বাবা, বড় ভাই-বোন এবং পরিবারের অন্যান্য মুরব্বীরা এগুলোকে মোটেই গ্রাহ্য করছেন না। বাইরের কেউ এ নিয়ে কিছু বললে মা-বাবারা সন্তানদের পক্ষ সমর্থন করে বলেন, আমরা কি ওদের এসব শিখিয়ে দিচ্ছি? অবুঝ বাচ্চা, ওরা তো এসব করবেই।

শিশুর অশোভন আচরণের প্রতি এই ছাড়ের মানসিকতা খুবই দুঃখজনক। আর এর কারণ এই যে, আমরাও ঘরের খাদেমদের সঙ্গে মন্দ ব্যবহার করি এবং মন্দ ব্যবহারটাই তাদের প্রাপ্য বলে মনে করি। শিশুরা বড়দের আচরণ থেকে দুর্ব্যবহারের সবক গ্রহণ করে। এর বিপরীতে সে যদি তার মাবাবা ও অন্যদেরকে সুন্দর আচরণ করতে দেখত এবং তারা যদি শিশুটির মনে সহমর্মিতা ও সহানুভূতি জাগিয়ে তুলতেন তবে নিশ্চয় তার আচরণ অন্যরকম  হত।

কাজের লোকদের সঙ্গে বাচ্চাদের আরেকটি আচরণ লক্ষ করা যায়। তা এই যে, পরিবারের বড় থেকে ছোট সব বাচ্চারাই, এমনকি দুই-তিন বছরের যে শিশুটির মাত্র কথা ফুটেছে, সে পর্যন্ত নিজের মায়ের বয়সী, বাবার বয়সী, বড় ভাই-বোনের বয়সী কাজের লোকদের অনায়াসে তুই বলে সম্বোধন করে অথচ মা-বাবা এতে আপত্তির কিছু দেখেন না। বরং কাজের মানুষদের জন্য চাচ্চু, ফুপি, আপু, ভাইয়া ইত্যাদি  কোনো ভদ্র সম্বোধনকে নিজেদের জন্য অপমানকর বলে মনে করেন। একবার এক উচঁু পরিবারে এক বাচ্চা একজন বড় কাজের মেয়েকে আপু ডেকেছিল। এ নিয়ে সে পরিবারে হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল। শেষে সেই মাসুম বাচ্চা, কাজের মেয়ে এবং যে তাকে আপু ডাকতে শিখিয়েছিল এই তিনজনকেই জবাবদিহি করতে হয়েছিল। অথচ এখানে মা-বাবার উচিত ছিল বাচ্চাটাকে পুরস্কৃত করা। এতে বাচ্চাটি উৎসাহিত হত এবং ভদ্রতার যে বীজ তার হৃদয়ে অঙ্কুরিত হচ্ছিল তা পুষ্পিত ও পল্লবিত হত। এর সঙ্গে সেই কাজের মেয়েটির অন্তর থেকে যে দুআ আসত তা তার জীবনে সুন্দর প্রভাব ফেলত। কিন্তু এখন কী হল? বাচ্চাটির মনে যে সুকুমার বৃত্তির প্রস্ফুটন শুরু হয়েছিল তা অঙ্কুরেই বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে হতে পারে তা আর কখনও পূর্ণরূপে বিকশিত হবে না। এভাবে তারা নিজ হাতে সন্তানের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করলেন।

কাজের লোকদের সাথে দুর্ব্যবহারের প্রবণতাটা, আমার মনে হয় ইদানিং ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের পূর্ববর্তী মায়েরা এ বিষয়ে এত কড়া দৃষ্টি দিতেন যে, তা আমাদের আজকের অতি আধুনিক মায়েদের কাছে কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদাবী রহ. তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন, শৈশবে আমার আম্মা আমার দুটি বিষয়ের প্রতি সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য রাখতেন। প্রথমত আমি যেন কখনও নামায কাযা না করি  এবং দ্বিতীয়ত ঘরের কোনো কাজের লোক যেন আমার দ্বারা কষ্ট না পায়। কোনো মজলুমের আহ ধ্বনি যেন আমার ভবিষ্যৎ জীবনকে অন্ধকার না করে । কখনও যদি কোনো কাজের লোকের সাথে অন্যায় আচরণ করে বসতাম তবে যত অপমানই হোক না কেন আম্মা আমাকে তার হাতে ধরে মাফ চাওয়াতেন। আম্মার এই তরবিয়তের ফলে কারও প্রতি জুলুম ও অন্যায় আচরণের প্রতি এমন ভীতি ও ঘৃণা আমার মনে জেগে উঠেছিল যে, আজ পর্যন্ত আমি কারও মনে দুঃখ দেওয়াকে কবীরা গুনাহ মনে করি এবং কখনও কোনো ভুল হয়ে গেলে তা স্বীকার করে নিতে সংকোচ বোধ করি না।  কারওয়ানে যিন্দেগী

আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমদ ছোটবেলায় একবার ঘরের এক খাদিমের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করায় তার মহিয়সী মাতা তার ঘরে যাওয়া ও খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সৈয়দ আহমদ মায়ের মারের ভয়ে খালার বাড়িতে চলে গেলেন। সেখান থেকে তিনদিন পর তার খালা তাকে সাথে করে বাড়িতে নিয়ে আসলেন এবং তার মায়ের কাছে সুপারিশ করলেন। কিন্তু মা তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন এবং বললেন যে, আহমদ চাকরের কাছে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত কোনোমতেই  তাকে ক্ষমা করা হবে না। নিরুপায় বালক অবশেষে চাকরের হাত ধরে ক্ষমা চাইল এবং ঘরে প্রবেশের অনুমতি পেল।

এই মহিয়সী নারী নিজেও ঘরের কাজের লোকদের সঙ্গে খুব সুন্দর ব্যবহার করতেন। তারা কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে নিজে তাদের সেবা করতেন। একবার তিনি অসুস্থ হলে তার জন্য খুব দামী ওষুধ কিনে আনা হল। ঘটনাক্রমে ওই একই রোগে ঘরের এক কাজের মেয়েও শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল। তিনি তার সব ওষুধ মেয়েটিকে দিয়ে দিলেন। তার মনে বিশ্বাস ছিল যে, এই মেয়েটিকে সাহায্য করার বরকতে নিশ্চয় আল্লাহ পাক তাকে ওষুধ ছাড়াই সুস্থ করে দিবেন। সত্যিই কিছুদিন পর তিনি সুস্থ হয়ে গেলেন।

বড় দুঃখ হয় যখন দেখি, মায়েরা তাদের সন্তানদের নিয়ে বড় বড় আশা হৃদয়ে লালন করছেন, কিন্তু তাদের এই সন্তানদের হাতে ঘরের কাজের লোকেরা নানাভাবে নিগৃহীত হচ্ছে। এ যেন ঠিক আমড়া গাছ রোপন করে আপেল আশা করার মতোই হাস্যকর বিষয়। আল্লাহ আমাদের ভালো কাজের তাওফীক দান করুন।

 

 

advertisement