রবিউল আউয়াল ১৪২৮   ||   এপ্রিল ২০০৭

মানুষের গল্প

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যে সাহাবায়ে কেরাম উত্তম চরিত্রের অনন্য দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছিলেন। নারীপুরুষ সবাই উন্নত গুণাবলির অধিকারী হয়েছিলেন। জীবনযাত্রার বিভিন্ন উপলক্ষে তাদের সেই গুণগুলোর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আমাদের সৌভাগ্য যে, হাদীস ও জীবনী গ্রন্থে সেসব ঘটনা বিশুদ্ধ সূত্রে সংরক্ষিত রয়েছে । এখানে  কিছু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছি।

নিঃস্বের প্রতি সহানুভূতি

সাহাবায়ে কেরাম গরীবদুঃখীর প্রতি এতই সহানুভূতিশীল ছিলেন যে, তাদের দুঃখ দূর হলে তাঁরা নিজেদের দুঃখ ভুলে যেতেন। কোনো কোনো সাহাবী এক দুজন গরীব মানুষকে দস্তরখানে শরীক করা ছাড়া খাবার গ্রহণ করতেন না। কখনো নিজের যৎসামান্য খাদ্যটুকুও  দুঃখী মানুষকে দিয়ে দিতেন। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রা. একদিন রোযা ছিলেন। ইফতারের জন্য ঘরে একটি শুকনা রুটি ছাড়া আর কিছু ছিল না। এক মিসকীন এসে দরজায় দাঁড়ালে  উম্মুল মুমিনীন তাকে ওই রুটিটা দিতে বললেন। খাদেমা বললএকটিমাত্র রুটি, তাও যদি দিয়ে দেন তাহলে ইফতার কী দিয়ে করবেন? উম্মুল মুমিনীন বললেন, আহা, দিয়েই দাওনা। সন্ধ্যায় এক প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে কিছু গোশত হাদিয়া এলে উম্মুল মুমিনীন মেয়েটিকে বললেন, নাও, এই গোশত তোমার রুটি থেকে অনেক ভালো। -মুয়াত্তা ইমাম মালেক

ত্যাগ

একবার একজন আনসারী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসলেন। ঘটনাক্রমে সে সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরে পানি ছাড়া  কিছু ছিল না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণকে বললেন, তোমাদের কেউ কি এর মেহমানদারী করতে পারবে? আবু ত্বালহা রা. আগ্রহ প্রকাশ করলেন এবং মেহমানকে ঘরে নিয়ে গেলেন। কিন্তু তার ঘরেও বাচ্চাদের জন্য রাখা কিছু খাবার ছাড়া আর কিছু ছিল না। আবু ত্বালহা রা. স্ত্রীকে বললেন, ওদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দিবে এবং খাবারটুকু  মেহমানের সামনে রাখবে। আমরাও মেহমানের সঙ্গে বসব কিন্তু খাওয়ার সময় তুমি কোনো ছুতায় বাতি নিভিয়ে দিবে। মেহমান ভাববে, আমরাও তার সঙ্গে খাচ্ছি। স্বামীস্ত্রী  এভাবেই  সামান্য খাবার  দ্বারা মেহমানকে তৃপ্ত করলেন এবং নিজেরা অভুক্ত থাকলেন। সকাল বেলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের দরবারে উপস্থিত হলে নবীজী বললেন, তোমাদের গত রাত্রের কাজ আল্লাহ তাআলা কবূল করেছেন এবং এই আয়াত নাযিল করেছেন-

وَ یُؤْثِرُوْنَ عَلٰۤی اَنْفُسِهِمْ وَ لَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ.

তারা নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও অন্যকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে। -সহীহ মুসলিম

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সাহাবায়ে কেরামের অনুরাগ কেমন ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষভাবে  উম্মুল মুমিনীনগণ এবং তাঁদের মধ্যে হযরত আয়েশা রা.এর কথা তো বলাই বাহুল্য। হযরত আয়েশা রা.এর হুজরায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর রওজা হয়েছে। এরপর আবু বকর রা. ইন্তেকাল করলে তার কবরও সেখানে হল। দুই কবরের পরে যে জায়গাটুকু বাকি ছিল উম্মুল মুমিনীন তা নিজের কবরের জন্য নির্ধারিত করে রেখেছিলেন, কিন্তু যখন উমর রা. ওখানে সমাহিত হওয়ার আবেদন জানালেন তখন তিনি তা তার জন্য ছেড়ে দেন এবং বলেন, আমি এই জায়গাখানি আমার নিজের জন্য সংরক্ষিত রেখেছিলাম কিন্তু আজ আপনার জন্য তা ছেড়ে দিচ্ছি। -সহীহ বুখারী

দানশীলতা ও বদান্যতা

পুরুষ সাহাবীগণ যেমন আল্লাহ সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দান করতেন তদ্রূপ মহিলা সাহাবীগণও তাদের  সামর্থ্য অনুযায়ী দান করতেন। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. এতই দানশীলা ছিলেন যে, যা হাতে আসত তাই দান করে দিতেন। একবার ভাগ্নে আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর খালাকে কিছুটা বাধা দিতে চাইলে তিনি এতই রাগন্বিত হয়েছিলেন যে, তার সঙ্গে কথাবার্তা না বলার কসম করে ফেলেছিলেন। -সহীহ বুখারী

উম্মুল মুমিনীনের বোন আসমা রা.ও দানশীলা ছিলেন। তবে দুই বোনের মধ্যে পার্থক্য এই ছিল যে, হযরত আয়েশা রা. কিছু কিছু করে সঞ্চয় করতেন এবং কিছুটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সঞ্চিত হওয়ার পর তা দান করে দিতেন। কিন্তু আসমা রা. যখন যতটুকু হাতে আসত ততটুকুই দান করতেন। -আলআদাবুল মুফরাদ

একবার ঈদের দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবিয়াগণকে দান করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা তাদের হাতের আঙটি, গলার হার ও অন্যান্য অলঙ্কার খুলে খুলে আল্লাহর রাস্তায় দান করতে আরম্ভ করেন।

প্রতিশোধ না নেওয়া

প্রতিপক্ষ যখন অসুবিধাজনক অবস্থায় পড়ে তখন একে প্রতিশোধ নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ মনে করা হয়, কিন্তু সাহাবায়ে কেরামের অবস্থা ছিল ভিন্নতর। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. ও উম্মুল মুমিনীন হযরত যাইনাব রা. এর মাঝে স্বাভাবিক ইর্ষাপরায়ণতা ছিল। কিন্তু আয়েশা রা. এর জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে অর্থাৎ সেই মিথ্যা অপবাদের ঘটনার সময় যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত যাইনাবকে  তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন  তখন তিনি সুস্পষ্টভাবে  বলেন, কল্যাণ ছাড়া আমি তার মধ্যে আর কিছু দেখিনি। পরিশেষে হযরত আয়েশা রা.এর পবিত্রতা ঘোষণা করে কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হল। উম্মুল মুমিনীন তখন বললেন, তিনি (যাইনাব রা.) যদিও দাম্পত্য  জীবনে আমার প্রতিপক্ষ ছিলেন কিন্তু তাকওয়া ও খোদাভীতির মাধ্যমে আল্লাহ তাকে হেফাযত করেছেন।                -বুখারী (চলবে)

 

 

advertisement