রবিউল আউয়াল ১৪২৮   ||   এপ্রিল ২০০৭

মীলাদুন্নবী ও একটি দুঃখজনক বাস্তবতা

ড. মুহাম্মাদ তাহির আলকাদেরী (রেজভী)

যারা মীলাদুন্নবীর উৎসবকে ঈমানের অঙ্গ বলে আকীদা পোষণ করেন এবং জাকজমকের সাথে মীলাদুন্নবীর জলসাজুলূস করেন তারা নবীর প্রতি ভক্তি-ভালোবাসা প্রদর্শনের জন্যই তা করে থাকেন। নবীভক্তি তো অবশ্যই  প্রশংসনীয়, কিন্তু তাদের কি চিন্তা করা উচিত নয় যেভক্তি মহব্বতের দাবি কী? এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা কী?

হায়, ভক্তি-মহব্বতের দাবিদাররা যদি তা জানত!

এই মুবারক সময়ের পূর্ণ বরকত লাভের জন্য অপরিহার্য হল, এসকল ক্ষেত্রে ভক্তি-মহব্বত প্রদর্শন করতে গিয়ে স্বয়ং নবীজীর শরীয়তের আহকাম ও বিধান যেন কোনোভাবেই লঙ্ঘিত না হয়। 

কিন্তু দুঃখজনক হল, বর্তমানে এক শ্রেণীর জাহেল ও মূর্খ  বিভিন্ন বিদআত ও হারাম কাজ দ্বারা এই মাহফিলকে কলুষিত করছে।

মীলাদমাহফিলে ঢোলতবলা, গান-বাজনা এবং নারী-পুরুষের নাচানাচি ও অবাধ মেলামেশার মতো ঘৃণ্য ও হারাম কর্মকাণ্ড হতে দেখা  যাচ্ছে। অথচ এসব কাজকর্ম থেকে যারা বাধা দেয় তাদেরকে মীলাদ বিরোধী আখ্যা দেওয়া হয় এবং এগুলো পরিহারের ব্যাপারে ভ্রূক্ষেপ করা হয় না। এসব ভণ্ড নবীভক্তদের শক্ত হাতে প্রতিরোধ করা অবশ্য কর্তব্য। অন্যথায় মীলাদ মাহফিলই  হয়ে যাবে  ইসলাম বিরোধী কাজের আখড়া। যে পর্যন্ত এইসব মাহফিলকে  হারাম কাজ থেকে পাকসাফ না করা হবে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদব ও মর্যাদা রক্ষার ব্যবস্থা না করা হবে সে পর্যন্ত আমরা  আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের  সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারব না। মীলাদুন্নবীর মাহফিলগুলো দিন দিন এমনভাবে আদবলেহাজশূন্য হতে চলেছে যে, তাতে  শুধু যে  রহমতের ফেরেশতাদের আগমন বন্ধ থাকে তাই না; বরং এসব মাহফিলের উদ্যোক্তা, আয়োজক ও অংশগ্রহণকারী সকলেই আল্লাহর গযব ও রাসূলের অসন্তুষ্টির উপযুক্ত হয়ে থাকে।

 আফসোসের ব্যাপার হল, এসব গর্হিত কর্মকাণ্ডের  বিরুদ্ধে না কোনো প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়, আর না  নরমে বা গরমে এগুলোকে নির্মূল করার চেষ্টা করা হয়। ধর্মীয় মহলে এ বিষয়ে নীরবতার সবচেয়ে বড় কারণ হল ইল্লামাশাআল্লাহ উদরপূর্তির  ধান্দা । কেননা এইসব রসমরেওয়াজ প্রতিরোধ করতে গেল এখানটাতেই  চোট লাগে।

আমরা মনে করে থাকি, এসব অনৈসলামিক ও শরীয়তগর্হিত কার্যকলাপের প্রতিবাদ করা হলে জলসাজুলূসে আমাদের ধুমধড়াক্কা বক্তৃতা বন্ধ হয়ে যাবে এবং চাঁদার উপার্জনে ভাটা দেখা দিবে, তাই নিজেদের আর্থিক সুবিধা এবং দলীয় স্বার্থে আমরা মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর পবিত্রতা  ও মর্যাদাকে বিনষ্ট করছি।

আল্লাহর ওয়াস্তে  রিসালাতের মর্যাদা ও পবিত্রতাকে সকল ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থের উর্ধ্বে মনে করে নিজেদের কর্মকাণ্ডকে সংশোধন করুন।

প্রশাসনের দায়িত্ব

এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনকে নীরব দর্শক হয়ে থাকা চলবে না; বরং এসব বিষয়ের প্রতিরোধের জন্য  কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কোনো সরকারী ব্যক্তির সামান্য অবমাননা করা হলে প্রশাসন তাকে শায়েস্তা করার সবরকম ব্যবস্থা করে থাকে কিন্তু যখন উরস ও মীলাদের নামে মতলববাজ লোকেরা নাচগানের এবং গাজা ও নেশার আসর জমিয়ে তোলে; এবং মেলা বসিয়ে  আওলিয়ায়ে কেরামের শিক্ষা ও আদর্শের খোলাখুলি বিরুদ্ধাচরণ করে, তখন প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেয় না; বরং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে।  তাদের বিবেক কীভাবে এতে সায় দেয়এসব ধর্মব্যবসায়ীকে কি শায়েস্তা করা প্রশাসনের ধর্মীয় দায়িত্ব নয়?

উরস উপলক্ষে  আউলিয়ায়ে কেরামের  মাযারে উপস্থিত হওয়ার উদ্দেশ্য হল, কুরআন  তেলাওয়াত করা এবং তাদের পবিত্র শিক্ষা ও আদর্শের আলোচনা শুনে সে অনুযায়ী জীবন ও কর্মকে সজ্জিত করা। তদ্রূপ মীলাদুন্নবীর জলসাজুলূস নাত পাঠ, রাসূলের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের আলোচনা এবং শরীয়তসম্মত পন্থায় আনন্দ করার জন্যই আয়োজিত হয়ে থাকে। কিন্তু আফসোস, আল্লামা ইকবালের কথায়-

حقيقت خرافات ميںں كهو گئ + يہ امت روايات ميں كهو گئ

হাকীকত হারিয়ে গেছে গোমরাহীর অন্ধকারে। উম্মত আজ দিশেহারা রসম রেওয়াজের আবর্তে

দুর্ভাগ্যক্রমে আজ মুসলিম উম্মাহ দুটি বড় দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদল বলে, মীলাদুন্নবী হারাম ও বিদআত। আর অন্যদল মীলাদের নামে  বিভিন্ন হারাম কাজে লিপ্ত। বিদআত ও রসম রেওয়াজকে মীলাদের অঙ্গীভূত করে  এর পবিত্রতাকে তারা বিনষ্ট করে ফেলেছে।

আমরা মীলাদ ও সীরাতের নামে মুসলমানদেরকে দুই দলে বিভক্ত করে দিয়েছি। একদল শুধু মীলাদের আহবায়ক, অন্যদল সীরাত-প্রচারক।

মীলাদভক্ত সীরাত থেকে কেটে পড়ে, আর সীরাতপ্রেমী মীলাদকে নাজায়েয আখ্যা দেয়। তাই সময়ের দাবি হল, সকল প্রান্তিকতা পরিহার করে  সঠিক পথে ফিরে আসা।

আল্লাহর ওয়াস্তে বুদ্ধি বিবেক ব্যবহার করুন যদি মীলাদ না হত, তাহলে সীরাত কোত্থেকে আসে; আর যদি  সীরাতের আলোচনাই না থাকে তবে মীলাদের উদ্দেশ্যই বা কীভাবে পূরণ হয়? মীলাদের  বয়ান ও সীরাতের আলোচনা দুটোই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর স্মরণ। উভয়টিই এক প্রদীপের আলো। মীলাদকে বিদআত ও হারাম মনে করা যেমন উচিত নয়, তেমনি মীলাদের নামে গর্হিত কার্যকলাপের অনুপ্রবেশ ঘটানোও  ঠিক নয়।

মীলাদ রাসূলের আবির্ভাবের আনন্দের নাম। এ মজলিসে শ্রদ্ধা ও মহব্বতের সঙ্গে অযু অবস্থায় শামিল হলে খোদার কসম, এটি সর্বোত্তম ইবাদত। মীলাদের জলসাজুলুস ও মাহফিলগুলোতে সীরাতের আলোচনা করা এবং শ্রোতাদেরকে আকায়ে নামদার মাহবুবে কিবরিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর সুরত ও সীরাতের সৌন্দর্য, মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য শোনানো এবং তাঁর ইশক ও মহব্বতের গীত গাওয়া প্রত্যেক মুসলিমের বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। কেননা, এর মধ্যেই গোটা মুসিলম উম্মাহর সফলতার রহস্য লুকায়িত এবং এটাই এখন সবচেয়ে বড় ধর্মীয় প্রয়োজন। মিল্লাতে ইসলামের ওয়ায়েজ ও মুবাল্লিগরাই যদি মীলাদ ও সীরাতের মতো দুটি মৌলিক বিষয়কে ভিন্ন করে দেন তবে সাধারণ মুসলিম জনগণের নিকট হক কথা পৌঁছবে কীভাবে?

ওয়ায়েজ ও মুবাল্লিগণ যদি তাদের দ্বীনের পয়গাম ও রাসূলের সম্মান বহাল রাখতে চান, তাহলে তাদের দায়িত্ব হল, যথাসাধ্য যাবতীয় শরীয়ত বিরোধী ও বিদআতী কর্মকাণ্ডের মোকাবেলায় সর্বাত্মক জিহাদ শুরু করা।

প্রশাসনের দায়িত্ব হল, মীলাদ মাহফিলগুলোর পবিত্রতা রক্ষায় এগিয়ে আসা এবং ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর নামে নাচগান ও অন্যান্য ভিত্তিহীন কার্যকলাপের হোতাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা, যাতে জলসাজুলুসের পরিবেশ সবধরনের গর্হিত কায়কলাপ থেকে মুক্ত ও পবিত্র থাকে।

{লেখক ঈদে মীলাদুন্নবীকে শরীয়তসম্মত বলে যে দাবি করেছেন সেটার সাথে আমরা একমত নই। তবে সমস্ত বিদআত ও রসমরেওয়াজ থেকে দূরে থাকার যে আহ্বান তিনি জানিয়েছেন তার সাথে আমরা একমত এবং এ জন্যই লেখাটা আমরা পত্রস্থ করেছি। রেজভী ভাইগণ যদি তাদের নিজেদের মানুষের লিখিত এ কথাগুলো মনোযোগের সঙ্গে ভেবে দেখেন তাহলে সম্ভবত অবস্থার কিছুটা উন্নতি হবে।

(লেখকের মীলাদুন্নবী নামক রচনা থেকে গৃহিত ও অনূদিত)}

 

 

advertisement