রজব ১৪৪৪   ||   ফেব্রুয়ারি ২০২৩

আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে নারীবিদ্বেষের অভিযোগ
পুরোনো কাসুন্দি

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

আফগানিস্তানে ইমারাতে ইসলামিয়ার সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এক বছর পার হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক ইসলাম বিদ্বেষী মিডিয়াগুলো শুরুর দিকে তাদের নিয়ে মাতামাতি করলেও পরে অনেকটা চুপসে গেছে। আমাকে বিভিন্ন সময় শুভাকাঙ্ক্ষী বা দ্বীনদার ব্যক্তিরা প্রশ্ন করত, তালেবান সরকারের খবর কী? তারা কেমন আছে? কেমন চালাচ্ছে?

আমার জবাব একটাই ছিল, ভাই আমিও আপনার মতো। কোনো কিছুই জানি না। যতটুকু দেশ-বিদেশের পত্রিকা থেকে আপনারা জানেন ততটুকুই আমি জানি। সাথে এটিও বলতাম, তবে একটি কথা খুবই স্পষ্ট, তাঁরা আল্লাহর ফজলে ভালো চালাচ্ছে বলেই মনে হয়। ইসলামের মুখোশধারী আইএসের চোরাগোপ্তা হামলা ছাড়া অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাজনিত কোনো অসুবিধা শোনা যাচ্ছে না।

তারা ভালো আছে এবং ভালো চালাচ্ছে, এর জন্য আমি যে বিষয়টিকে দলীল হিসেবে পেশ করতাম তা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি প্রচারমাধ্যমে খবর না আসা। এ প্রচারমাধ্যমগুলো তো মুখিয়ে থাকে- কখন তাদের কোনো ভুল-ভ্রান্তি হয় কি না, তাদের কোনো দোষ-ত্রুটি বিশে^র সামনে তুলে ধরা যায় কি না। তো যেহেতু তাদের সম্পর্কে লেখালেখি-বলাবলি কম- এটি এ কথার ইঙ্গিত বহন করে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ না করেও এবং আমেরিকাসহ পরাশক্তিগুলো কর্তৃক তাদের অর্থকড়ি আটকে রাখা সত্ত্বেও তারা দেশ ভালোই চালিয়ে যাচ্ছে।

এরই মধ্যে গত মাসে একটি বিষয়ে খুব শোরগোল শুরু হয়ে গেল, আফগান সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নারীশিক্ষা আপাতত মুলতবি করেছে। পরবর্তী ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত তা বন্ধ থাকবে। এ খবর প্রচার হওয়ার পরপরই অনুমিতভাবেই সরগরম হয়ে ওঠে বিশ্ব মিডিয়া। সাথে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা তারস্বরে বলতে থাকে, তালেবান আসলে বদলি হয়নি, পুরোনো চেহারায় ফিরে এসেছে তারা, নারীবিদ্বেষ থেকে বের হতে পারেনি ইত্যাদি আরও বহু কথা।

এগুলো তো আসলে পুরোনো কাসুন্দি। তাই শিরোনাম দেখেই বোঝা যায়, তারা কী আওড়াবে। এসব ক্ষেত্রে তারা কী বলে থাকে, নারীর প্রতি কেমন দরদ দেখিয়ে থাকে, তা তো ওয়াকিফহাল মহলে অজানা নয়। এটি ভিন্ন কথা যে, ওসব দেশ ও সমাজ, তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলো নারীর প্রতি কতটুকু শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখায় আর কতটুকু নারীকে নিজ মতলবে পণ্যের মতো ব্যবহার করে। কিন্তু এবার অবাক করার মতো বিষয় ঘটেছে অন্যটা। তা হল, প্রথার বাইরে গিয়ে সৌদি সরকার কর্তৃক এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন। সৌদি সরকার গণমাধ্যমে প্রকাশিত একাধিক বিবৃতির মাধ্যমে আফগান সরকারের বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীশিক্ষা বন্ধের তীব্র সমালোচনা করেছে এবং প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা শুধু এখানেই শেষ করেনি; বরং ওআইসি ফিকহ একাডেমি, হাইআতু কিবারিল উলামা (সৌদির সরকারি গ্র্যান্ড উলামা কাউন্সিল)-এর পক্ষ থেকেও কিছু দলীল-প্রমাণ দিয়ে আফগান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রকাশ করিয়েছে। আজকের এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে আমরা শুধু নিচের দু-তিনটি প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু কথা বলার প্রয়াস পাব।

তার আগে দেখা যাক, আফগানিস্তানে আসলে ঘটেছিল কী? জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, আফগান কর্তৃপক্ষ তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছেলেদের সাথে নারীদের শর্তসাপেক্ষে যে সহশিক্ষা চালু রেখেছিল তা মুলতবি করে দিয়েছে। কারণ হিসেবে তারা বলেছে, যেহেতু মেয়েদের জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়ের এখনো ব্যবস্থা হয়নি তাই পর্দার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা এবং কোনো মাহরাম কর্তৃক ক্যাম্পাসে পৌঁছে দেওয়াসহ আরও কিছু শর্তে তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছেলেদের সাথে সহশিক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এ ব্যবস্থায়ও কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাই আপাতত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহশিক্ষা ব্যবস্থা মুলতবি থাকবে।

উল্লেখ্য, আফগানিস্তানে এখনো মেয়েদের প্রাইমারি শিক্ষা বহাল আছে। মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে তারা সহশিক্ষা উঠিয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পড়া শর্তসাপেক্ষে চালু রেখেছিল, যা এখন স্থগিত করে দিয়েছে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইসলামে শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য নেই। শিক্ষার অধিকার ও প্রয়োজনীয়তা যেমন পুরুষের রয়েছে তেমনি নারীরও রয়েছে। অবশ্য এটিও সত্য যে, সকল পুরুষ যেমন সব পড়াশোনা করে না, সব স্তর পর্যন্ত পড়ে না, নারীর ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।

এ বিষয়ে আরও কিছু কথায় আমরা পরে আসছি। প্রথমে দেখা যাক, সৌদি আরব, ওআইসি ফিকহ একাডেমি এবং সৌদির হাইআতু কিবারিল উলামা আফগান সরকারের নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষা মুলতবি করার প্রতিক্রিয়ায় কী বলেছে। গত মাসের (ডিসেম্বর ২০২২) শেষ দশকে ওই বিবৃতিগুলো প্রকাশিত হয়েছে সৌদি আরবের সরকার সমর্থিত পত্রিকা দৈনিক আররিয়াদসহ অন্যান্য প্রচারমাধ্যমে। প্রথমে সৌদির পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় আফগান সরকারের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয়। এরপর তারা তাদের দুটি প্রভাবশালী শরীয়া সংস্থাকে দিয়েও বিবৃতি প্রদান করায়। একটি হচ্ছে, মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী বা ওআইসি ফিকহ একাডেমি। বর্তমান বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সংস্থা ওআইসি রাজনৈতিকভাবে মুসলমানদের জন্য তেমন কিছু করতে না পারলেও তাদের অধীনে পরিচালিত এ ফিকহ একাডেমি কিন্তু বেশ কিছু ভালো কাজ করেছে। অনেক নতুন বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আলেমদেরকে একত্রিত করে গবেষণা ও পর্যালোচনা করিয়েছে। জার্নাল বের করেছে। কিন্তু সে ফিকহ একাডেমিও এখন এমবিএসদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে বলে মনে হয়। আর হাইআতু কিবারিল উলামা তো হচ্ছে সৌদির মুফতীদের সর্বোচ্চ ফোরাম। এর প্রধান হয়ে থাকেন দেশটির গ্র্যান্ড মুফতী-মুফতিল মামলাকা। রাষ্ট্রীয় সংস্থা হওয়াই বিভিন্ন সময় রাজা-বাদশাহ বা তাদের সিদ্ধান্তের সপক্ষে কিছু কিছু বিষয়ে মতামত দিয়ে বিতর্কের জন্ম দিলেও মৌলিকভাবে এ সংস্থাও ফিকহ ও শরীয়তের ভালো ভালো কাজ করেছে। শায়েখ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম রাহ., শায়েখ বিন বায রাহ., শায়েখ ইবনে উসাইমীন রাহ. প্রমুখ ব্যক্তিত্বগণ এ সংস্থার প্রধান ছিলেন। বর্তমানে এ সংস্থারও কাহিল অবস্থা। দেশটির সরকারের বিগত কয়েক বছর থেকে অব্যাহতভাবে ইসলামবিরোধী তৎপরতাগুলোর কোনো বিষয়েই কি তাঁরা মুখ খুলতে পেরেছেন? এর থেকেই সংস্থাগুলোর দৈন্যদশা অনুমান করা যায়। আর রাবিতাতুল আলামিল ইসলামীকে তো এক প্রকার ধ্বংসই করে ফেলা হয়েছে। এর প্রধান চেয়ারে ডক্টর ঈসা নামে একজন চরম বিতর্কিত, ইসলামের মনগড়া ব্যাখ্যাদানকারী লোককে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, যিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে তার বানানো ইসলাম প্রচার করছেন। কুরআন-সুন্নাহর ব্যাখ্যা দিচ্ছেন তার সরকারের অনুকূলে।

একটা সময় ছিল যখন ক্ষমতাবানেরা ধর্মীয় ব্যক্তি ও সংস্থাগুলোকে সরাসরি এড়িয়ে চলত এবং দাবিয়ে রাখত। যেন কোনো ধর্মীয় জায়গা থেকে তাদের জুলুম-নির্যাতন ও ইসলামবিরোধী তৎপরতার জোরালো আওয়াজ উঠতে না পারে। এখন দেশে দেশে ক্ষমতাবানেরা তাদের কৌশল পাল্টেছে। এখন তারা নিজেদেরকে ধর্মবান্ধব বলে প্রচার করা পছন্দ করে। আর ধর্মীয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের আয়ত্তে নেওয়ার চেষ্টা করে; যাদের কেউ কেউ তাদের পক্ষে ওকালতী করবে। এছাড়া যেন তাদের কুকর্মগুলোর ব্যাপারে এসকল ফোরাম থেকে জোরালো প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ গড়ে উঠতে না পারে।

কী ছিল সেই বিবৃতিগুলোতে?

ওআইসি ফিকহ একাডেমি তাদের বিবৃতি শুরু করেছে এ বলে-

أكد مجمع الفقه الإسلامي الدولي، أن تعليم الذكور والإناث يعد في الشريعة واجباً شرعيّاً، وقد دلَّت على ذلك آياتٌ مباركاتٌ من القرآن الكريم، وأحاديث صِحَاحٌ من السنَّة النبويَّة الشريفة.

অর্থাৎ আন্তর্জাতিক ফিকহ একাডেমি গুরুত্বের সাথে ঘোষণা করছে যে, শরীয়তে নারী-পুরুষের শিক্ষা ওয়াজিব। এ ব্যাপারে কুরআনের অনেক আয়াত ও সহীহ হাদীস রয়েছে।

এরপর তারা আফগানিস্তানে নারীশিক্ষাকে শর্তযুক্ত করার বিরেধিতা করে বলেছে, এটি শরীয়া পরিপন্থী। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে নারীগণ আসতেন। অনেক মহিলা সাহাবী বড় বড় আলেমাও ছিলেন, যাঁদের কাছ থেকে পুরুষ সাহাবীগণও হাদীস-ফিকহ শিখেছেন। এছাড়া শিক্ষার দ্বারা মানুষ নিজের জান-মাল-ইজ্জতের হেফাজত করতে শেখে, অধিকার আদায় করতে  শেখে। সুতরাং নারীশিক্ষা বন্ধ করা বা শর্তযুক্ত করা ইসলামপরিপন্থী। ওআইসি ফিকহ একাডেমির বিবৃতিটি লম্বা। তবে ঘুরে ফিরে কথা এগুলোই। আর হাইআতু কিবারিল উলামার বিবৃতিতেও প্রায় একই কথা রয়েছে। তবে সেটি সংক্ষিপ্ত ছিল।

যেকোনো নিরপেক্ষ সুবিবেচক ব্যক্তি ওই বিবৃতিদুটি পড়লে বুঝতে পারবেন এগুলো অন্তসারশূন্য। মূল বিষয়ের সাথে যেগুলোর মিল নেই। আসল প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে শুধুই কিছু নীতিবাক্য বলা হয়েছে। যেমন তারা বলেছেন, ইসলামে নারী ও পুরুষ সকলের জন্য শিক্ষা ওয়াজিব। এ কথা কে না জানে? আমাদের দেশের কথাই ধরুন, শিক্ষার একেবারে শুরুতেই যাদের মকতবে যাওয়ার তাওফীক হয়েছে তারা অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তো-

طلبُ العلمِ فريضةٌ على كلِّ مسلمٍ.

(ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২২৪) হাদীসটি তরজমাসহ মুখস্থ করে ফেলে। সুতরাং শিক্ষা যেমন পুরুষের জন্য আবশ্যক তেমন নারীর জন্যও আবশ্যক। একথা মুসলমান মাত্রই জানে। আসল প্রশ্ন কি সেটি? আফগান সরকার কি বলেছে যে, নারীশিক্ষা নাজায়েয? তারা কি নারীদের প্রাথমিক শিক্ষাও বন্ধ করে দিয়েছে? এসবের উত্তর হল, না। আফগানিস্তানে তো নারীদের প্রাথমিক শিক্ষা চালু আছেই। সাথে তারা যা বলেছে, ইসলামের অন্যান্য বিধি-বিধান পালনের স্বার্থে বালেগা মেয়েদের পৃথক শিক্ষাব্যবস্থা দরকার। প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের সহশিক্ষা ইসলামে অনুমোদিত নয়। ওআইসি ফিকহ একাডেমি ও হাইআতু কিবারিল উলামা তাদের বিবৃতির কোনো জায়গায় একথা তো খোলাসা করেনি- ইসলামে সহশিক্ষা জায়েয আছে কি না? বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছেলেমেয়েদের একত্রে পড়ানো শরীয়ত অনুমোদন করে কি না? খোদ সৌদি আরবেই কি এ ব্যবস্থার ব্যাপকতা আছে? কাউস্ট তথা কিং আবদুল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজির আগে কি সৌদি আরবে সহশিক্ষার কোনো অস্তিত্ব ছিল? সৌদির যে কায়েকটি জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের শিক্ষা দেওয়া হত সেগুলো তো সীমিত পর্যায়েই হত। তাহলে বিবৃতিদাতা প্রতিষ্ঠানদুটি মূল প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল কেন? যদি মূল প্রসঙ্গেই না ঢুকবেন তবে লাভ কী হল। যে ওযরে বা যে সমস্যার কথা বলে আফগান সরকার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নারীশিক্ষা স্থগিত রেখেছে সে বিষয়ে শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি এ বিবৃতিদাতারা জানালেন না কেন? এর থেকেই এ বিবৃতিগুলোর মর্ম স্পষ্ট হয়। এগুলো যে নিছক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দেওয়ানো হয়েছে- তা আর বেশি ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন হয় না।

আসলে সৌদি সরকার একদিকে নিজেরা খাদেমুল হারামাইনিশ শারীফাইন খেতাব ধারণ করে আছে, মুসলমানদের দুই পবিত্র স্থানের নিয়ন্ত্রণ এবং হজ্জ-ওমরার ব্যবস্থাপনা নিজেরা আঁকড়ে রাখছে, অন্যদিকে বিগত কয়েক বছর থেকে তাদের যুবরাজের নেতৃত্বে বদলে ফেলছে জাযিরাতুল আরবের হাজার বছরের তাহযীব-তামাদ্দুন, ইতিহাস-ঐতিহ্য। যে জমিনকে শিরক-কুফর ও অপসংস্কৃতি-মুক্ত করতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ শরীরের রক্ত ঝরিয়েছেন, দানদান মুবারক শহীদ করেছেন, জান দিয়েছেন সাহাবায়ে কেরাম। যে নাজদ ও রিয়াদ এলাকায় শহীদ হয়েছেনে সবচেয়ে বেশি সাহাবী, সেসব পবিত্র জমিনকে বানিয়ে ফেলা হয়েছে হলিউড-বলিউডের নর্তক-নর্তকীদের আখড়া। এমনকি পবিত্র নগরী মক্কা মুকাররামার পাশে অবস্থিত জেদ্দাও বাদ যাচ্ছে না এসব থেকে। ঈমান-ইসলাম ধ্বংসকারী পেশাগুলোর লোকদের বিভিন্ন দেশ থেকে উঠিয়ে নিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন পদক। পশ্চিমা দেশগুলো থেকে একেকজন খেলোয়াড়কে উঠিয়ে নিয়ে দৈনিক তাদের একেক জনের পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে ছয়/সাত কোটি করে টাকা। এসব অর্থকড়ির উৎস যে আল্লাহর দেওয়া তেল ও গ্যাস- তা তো কারও অজানা নয়। আল্লাহর দেওয়া সরাসরি নিআমতকে অকাতরে ব্যয় করা হচ্ছে আল্লাহর নাফরমানির কাজে। বেপর্দা, বেহায়াপনায় প্রতিযোগিতামূলক অগ্রসর হওয়ার মহড়া চলছে। সৌদি বিমানবন্দরগুলোতে চলছে একপ্রকারের নারী প্রদর্শনী। ইমিগ্রেশন থেকে শুরু  করে পদে পদে নারী আর নারী। এমনকি পবিত্র মসজিদুল হারামের পাশের হোটেল মুখেই নারী আর নারী। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তারা লিফলেট বিতরণ করছে। আরেক দল এমবিএসের নামে নতুন চালু হওয়া এনজিওর বিজ্ঞাপন বিলি করছে। এদের বড় অংশরই আধা পর্দা। এসব কীসের আলমত? এটা কি নারীর ক্ষমতায়ন, না নারী প্রদর্শনের মহড়া? সৌদি থেকে কি হঠাৎ করে শিক্ষিত পুরুষ গায়েব হয়ে গেল? তাহলে জাযিরাতুল আরবে নিজেদের এসব অপকর্ম ঢাকার জন্যই কি আফগানিস্তান বিষয়ে তাদের শরীয়া সংস্থাগুলো দিয়ে বিবৃতি দেওয়ালো সৌদি আরব? তারা কি প্রকারান্তরে এটা বোঝাতে চেয়েছে যে, নারীদের বিষয়ে বর্তমান কয়েক বছরে আমরা যা করছি সেটিই শরীয়াসিদ্ধ। এজন্য টার্গেট করা হল আফগানিস্তানের ইমারতে ইসলামী সরকারকে। না হয় যদি তারা শরীয়া বিষয়েই মত প্রকাশ করবেন তাহলে মূল প্রসঙ্গের ব্যাখ্যা দিলেন না কেন?

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কিছু সাহাবিয়া হাদীস ও ফিকহের বড় আলেমাও ছিলেন। তাদের কাছ থেকে বড় বড় পুরুষ সাহাবীও হাদীস-ফিকহ হাসিল করেছেন। কিন্তু একথা কেন বলা হয়নি, সেটি তারা করেছিলেন পর্দার সাথে। পুরুষ সাহাবীগণ আলেমা সাহাবীদের থেকে পর্দা রক্ষা করেই হাদীসের ইলম অর্জন করতেন। বিবৃতিদাতাগণ একথা কেন বললেন না? তারা যদি ভিন্ন কোনো হাদীস পেয়ে থাকেন যে, বেপর্দা হয়েই সাহাবী নারী-পুরুষগণ এমনটি করেছিলেন- সেটি কেন পেশ করলেন না। আসলে সৌদি কর্তৃপক্ষ ... ... সিনাজুরি করার মতো কাজ করে যাচ্ছে। সাথে ইসলামকে বিকৃত করার পাঁয়তারাতেও লেগেছে। যদি সৌদিসহ ধনাঢ্য মুসলিম দেশগুলো আন্তরিক হত, যদি জাতিসংঘসহ বিশ্বের বড় বড় সংস্থা ও দেশগুলো নারীশিক্ষার বিষয়ে সত্যিই ইতিবাচক হত তাহলে তো তারা আফগান সরকারকে এ বিষয়ে সর্বাত্মক আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা দিয়ে নারীদের পৃথক ক্যাম্পাস করার  এবং যথাযোগ্য ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার সুযোগ করে দিতে পারত।  তা না করে শুধু নীতিবাক্য আওড়ে গেলে এবং হুমকি-ধমকি দিয়ে গেলে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না কেন? দাল মে কুছ কালা হায় বোঝার জন্য আর ব্যাখ্যার দরকার আছে বলে মনে হয় না। খোদ মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলো হাল আমলে খেলাধুলা ও তথাকথিত অন্যান্য বিনোদনের নামে অকাতরে যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অর্থ খরচ করছে তা কিছুটা কমিয়ে আফগান মেয়েদের শিক্ষাখাতে খরচের জন্য অর্থকড়ি দিলেও এতদিনে হয়তো ইমারাতে ইসলামীর সরকার বেশ কিছু পৃথক নারী ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে পারত। এসবের কিছুই যারা করতে পারছে না, তাদের নীতিবাক্য ও বড় বড় কথা বলা কতটুকু মানায়? সুতরাং সজাগ থাকতে হবে বিশ্বের মুসলিম নর-নারীদের।

যে বিষয় নিয়ে বিতর্ক সে বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হল, আফগান সরকার প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের ইসলামসম্মত পৃথক শিক্ষাব্যবস্থার দ্রুত আয়োজন করুক। মুসলিম মেয়েদের উচ্চশিক্ষা দীর্ঘদিন মুলতবি হয়ে পড়ে না থাকুক। বরং যত দ্রুত সম্ভব পৃথক ক্যাম্পাসে শরীয়া নীতিমালা অনুযায়ী নরীদের উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পড়াশোনা চালু করে বিশ্বের সামনে একটি নমুনা তুলে ধরুক। প্রথম দিকে দুয়েকটি মডেল প্রকল্প নিয়েও কাজ শুরু করা যেতে পারে।

ইমারাতে ইসলামী সরকারকে অনুধাবন করতে হবে, দেড় শ কোটির বেশি মুসলমানের বিশ্বে তারাই একমাত্র ঘোষিত ইসলামী রাষ্ট্র। দীর্ঘ ত্যাগ-তিতিক্ষা ও বহু জান কুরবানীর বিনিময়ে তারা বিদেশি ও তাদের স্বদেশীয় দাস-দাসীদের উৎখাত করতে সক্ষম হয়েছে। এখন পুরো বিশ্বের নজর তাদের দিকে। একদিকে যেমন ইসলাম বিদ্বেষী মুসলিম-অমুসলিম রাষ্ট্রের অনেক সরকার তাদের দোষ-ত্রুটি বের করে অঙ্কুরেই দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত। অন্যদিকে বিশ্বের তাবত দ্বীনদরদী মুসলিমগণও ইমারাতে ইসলামীর সরকারের সাফল্য প্রত্যাশী। এ সরকার কুরআন-সুন্নাহর আদর্শ নিয়ে টিকে থাকুক, মাথা উঁচু করে থাকুক এবং আফগানিস্তান ও আফগানিস্তানের বাইরের দক্ষ, যোগ্য উলামায়ে কেরামের সহায়তা নিয়ে দ্বীনী বিষয়গুলোতে ফায়সালা করুক। তাদের কোনো সিদ্ধান্ত যেন আপন ও হিতাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যেই বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করে সেটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তাদের সফলতা ও টিকে থাকা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য খুবই জরুরি।

কবির ভাষায়-

افغان باقی، کُہسار باقی + الحکم للہ! الملک للہ!

আফগান অক্ষয়, পাহাড়শ্রেণি অক্ষয়/ হুকুম আল্লাহর, রাজত্ব আল্লাহর

 

 

advertisement