সফর ১৪২৮   ||   মার্চ ২০০৭

দশদিক

পঁচা ডিমের রমরমা বাণিজ্য

দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষিত হওয়ার পর ভেজাল বিরোধী অভিযান আবার নতুন মাত্রা পেয়েছে। ইতিপূর্বে আরও একাধিকবার এই অভিযানকে দেশের মানুষ স্বাগত জানিয়েছিল। মাঝে কিছুদিন বিরতি দিয়ে পুনরায় এ অভিযান শুরু হয়েছে এবং যথারীতি পিলে চমকানো খবরাখবর পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হচ্ছে। চাল, গম, দুধ, তৈল ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীতে ভেজাল মেশানোর একাধিক কারখানার সন্ধান বেরিয়েছে যৌথ বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে। গত ১৩ ফেব্রয়ারি দৈনিক প্রথম আলো-তে প্রকাশিত হল পঁচা ডিমের রমরমা বানিজ্যের সংবাদ। রিপোর্টটির সারাংশ ছিল, একটি সংঘবদ্ধ চক্র বিভিন্ন হ্যাচারি থেকে  প্রতি সপ্তাহে প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ পঁচা ডিম কমদামে কিনে সরবরাহ করছে ঢাকা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন বেকারিতে। বর্তমানে পুলিশি হেফাজাতে থাকা একটি হ্যাচারির মহা ব্যবস্থাপক স্বীকার করেছেন যে, পঁচা ডিম পুঁতে ফেলাই নিয়ম। কিন্তু তিনি প্রতি সপ্তাহে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার করে পঁচা ডিম বিক্রি করে এসেছেন। আরেক আটককৃত পঁচা ডিম ব্যবসায়ী জানিয়েছে, গাজীপুরের বিভিন্ন হ্যাচারি থেকে ৭৫ টাকা শ দরে পঁচা ডিম কিনে সাভার, ঢাকা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে থাকে। তারা আবার ১৫০ টাকা বা ২০০ টাকা শ দরে বিভিন্ন বেকারিতে তা সরবরাহ করে। মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. বিকাশ চন্দ্র তরফদার বলেছেন, ডিম বা খাদ্য পঁচে আফলা টকসিন নামে এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থে পরিণত হয়। এ পদার্থ মানবদেহে ঢুকলে জন্ডিসসহ কিডনি ও লিভার আক্রান্ত হতে পারে, যা এক পর্যায়ে ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. কবিরুল আলম বলেছেন, বিষাক্ত খাবারের মাধ্যমে শিশুদেহে স্যালমোনেলা জীবাণু প্রবেশ করে। এর আক্রমণে শিশুদের ডায়রিয়া ও টাইফয়েড হতে পারে। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, হ্যাচারি ও বেকারির কর্মকর্তারা যারা এই চরম অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত তারা পেটের দায়ে এই কাজ করে না। তাদের ক্ষুধা নিবৃত্তির অন্ন এবং লজ্জা নিবারণের বস্ত্র যথেষ্ট চেয়েও অনেক বেশিই পরিমাণেই রয়েছে, কিন্তু তারপরও কীসের দৈন্য তাদেরকে এই ঘৃণ্য কর্মের সঙ্গে সংযুক্ত করে তা খুব ভালোভাবে ভেবে দেখা দরকার। পাশাপাশি এসব ধরা খাওয়া ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়াও প্রয়োজন। যাতে এই হ্যাচারি-বেকারির যোগসূত্র আগামীতে বহাল থাকতে না পারে। বর্তমানে দেশের একটি শ্রেণীর নৈতিকতার যে মাত্রা তাতে এ ধরনের অভিযান বন্ধ রাখার কোনো অবকাশ নেই। দেশের আমজনতার স্বার্থেই এই অভিযান অব্যাহত থাকা অপরিহার্য।

বিজ্ঞানীর অজ্ঞানতা

মানুষের রয়েছে পরশ পাথরসম প্রতিভা, যার স্পর্শে মানুষের চার পাশের জগতে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এ পৃথিবীর যত স্বল্পমূল্য বা মূল্যহীন উপকরণাদি সব যেন নবজীবন লাভ করছে মানুষের হাতের ছেঁায়ায়। তবে বিজ্ঞানের এই আবিষ্কারগুলো কি শুধু মানুষের বন্দনাই করছে নাকি তার অতি স্থূল একটি অসম্পূর্ণতার প্রতিও অঙ্গুলি তাক করছে? দৃষ্টান্ত চোখ দিয়ে দেওয়া যেতে পারে। চোখ যেমন জগতের সকল রূপ সৌন্দর্য অবলোকন করলেও আত্মদর্শনে অক্ষম তদ্রূপ সৃষ্টির চোখ এই মানুষও কি নিজের ব্যাপারে অন্ধই হয়ে থাকবে?

গত ৪ঠা ফেব্রয়ারি দৈনিক যায়যায়দিন-এ এই অন্ধত্বেরই একটি দৃষ্টান্ত প্রকাশিত হল। সংবাদটির শিরোনাম ছিল, আমেরিকান বিজ্ঞানীর ১৪ বছর জেল আমেরিকান বিজ্ঞানী বলে শিরোনামটিতে যাকে বোঝানো হয়েছে তিনি যে সে লোক নন। জিন থেরাপির জনক হিসাবে সারা বিশ্বে সুপরিচিত একজন শীর্ষ বিজ্ঞানীকেই ওই শিরোনামে বোঝানো হয়েছে। টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে কয়েক বছর আগে তিনি ম্যান অফ দা ইয়ার নির্বাচিত হয়েছিলেন। এহেন উঁচু পর্যায়ের একজন

মানুষকে কেন জেলে যেতে হলঅত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তাকে জেলে যেতে হয়েছে অতি নিচু পর্যায়ের একটি অপরাধের কারণে। নয় বছরের এক শিশুকে যৌন নির্যাতনের অপরাধে তাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে লস এঞ্জেলেসের আদালত। মেয়েটি আদালতে বলেছে, ওই ঘটনা আমার স্বাভাবিক শৈশব কে শেষ করে দিয়েছে।

এ ধরনের ঘটনা পাশ্চাত্যে খুব বিরল কিছু নয়। তাই তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রভাবিত হওয়ার সময় চরিত্রের এই অন্ধকার দিকটি সম্পর্কেও বোধহয় সচেতন থাকা প্রয়োজন এবং এত আলোর আয়োজনে এহেন অন্ধকার কীভাবে তাদের স্বত্তার একেবারে অভ্যন্তরে হাটু গেড়ে বসে  আছে তা-ও বোধহয় এক ফাঁকে ভেবে দেখা দরকার।

সভ্যতার বর্বরতা

ইতিহাসের পাতায় একটি সভ্যতার এক পৈশাচিক বিনোদনরীতি উল্লেখিত আছে। প্রাচীন রোমক সম্রাজ্যে নাকি বন্দীদের শাস্তি দেওয়ার রীতি এই ছিল যে, দর্শকভর্তি ষ্টেডিয়ামে তাকে সিংহের মুখে ছেড়ে দেওয়া  হত। ক্ষুধার্ত সিংহ ও দুর্ভাগা মানুষটির মধ্যে চলত এক অসম লড়াই। হিংস্র সিংহের থাবায় সে হতভাগা যতই ক্ষতবিক্ষত হত ততই নাকি দর্শকদের উল্লাস বেড়ে যেত এবং মানুষটির জীবন সায়াহ্নের করুণ গোঙানী নাকি সেই দর্শকগুলোর গোটা অস্তিত্ত্বে মাদকতার তরঙ্গ তুলত।

এই বিবরণ ইতিহাসের পাতা থেকে যে একেবারে বাস্তবের আঙ্গিনায় এসে দাঁড়াতে পারে তার একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে ১৩ ই ফেব্রয়ারি ০৭ দৈনিক যায়যায়দিন-এ। রিপোর্টটির সারসংক্ষেপ হল, আমেরিকার ক্রীড়া জগতে কেইজ ফিউরি ফাইটিং নামক একটি খেলা খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। খেলাটির সারকথা হল, অষ্টভুজ আকৃতির একটি খাঁচার ভেতরে দুজন মানুষ জীবনপণ যুদ্ধে লিপ্ত হবে। যতক্ষণ এক পক্ষ হার না মানবে ততক্ষণ পর্যন্ত চলবে এ লড়াই। জুডো, কারাতে, বক্সিং, রেসলিং ইত্যাদি সকল পন্থাই এ খেলায় অনুমোদিত। এখেলায় একজন খেলোয়াড় মার খেতে খেতে শুয়ে পড়লেও প্রতিপক্ষ তাকে পেটাতে পারবে।

আমেরিকান মার্শাল আর্ট ফাইটার জাস্টিন হ্যাজেলেটের  ফাইট দেখার জন্য জড়ো হয়েছিল ১০,৭৮৭ জন দর্শক। লড়াই শুরু করার আগে জাস্টিন দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলল, আমি রক্ত দেখতে চাই। তার এ চাওয়া যে আমেরিকান অনেকেরই চাওয়া তা এ খেলার ক্রমবর্ধমান দর্শক সংখ্যা থেকেই আন্দাজ করা যায়। ২০০৫ সালে এ খেলার একটি ইভেণ্টে দর্শক হয়েছিল ২,৮০,০০০। ২০০৬ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭,৭৫,০০০ এবং হু হু করে-এর দর্শক সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

আলটিমেট ফাইটিং চ্যাম্পিয়নশিপের চিফ  এক্সিকিউটিভ ডানা হোয়াইট বলেছেন, খুব শিগগিরই আমেরিকার গণ্ডি পেরিয়ে কেইজ ফাইটিংকে তারা বিশ্বব্যাপী ছাড়িয়ে দিতে চান।

বিনোদনের  এ রক্তক্ষয়ী আয়োজন বিশ্বের অন্যান্য জাতি কীভাবে গ্রহণ করবে তা এখনই জানা না গেলেও অন্তত  সভ্য আমেরিকান জাতি যে এতে যথেষ্টই তৃপ্তি পাচ্ছে তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। পাশাপাশি তারা যে নানা নামে ও শ্লোগানে বিশ্বময় পাশববৃত্তির ফেরি করতেই বেশি আগ্রহী তা-ও বোধহয় এ রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে।

ইতিবাচক তবে...

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির আয়োজনে ইসলামের আলোকে নারীদের অধিকার নিশ্চিতকরণ শীর্ষক একটি কর্মশালার আয়োজন ছিল রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে। গত ৪ ফেব্রয়ারি দৈনিক প্রথম আলো প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বক্তাদের বক্তব্যের সারসংক্ষেপ উদ্ধৃত হয়েছে। উদ্বোধনী পর্বে প্রধান অতিথির  বক্তব্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরী তার দাদা ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কথা উল্লেখ করে বলেছেন, দাদু বলতেন, কোরান তোতা পাখির মতো পড়ে গেলে হবে না, কোরানকে বুঝতে হবে।

ধারণা করতে পারি, তিনি তার দাদুর কথার সঙ্গে একমত বলেই তাঁর উক্তিটি উদ্ধৃত করেছেন। অন্তত কুরআনকে বোঝার ব্যাপারে এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু আমাদের দেশের বিদ্বান সমাজ যদি কুরআনকে যথাযথভাবে বোঝার ব্যাপারে কিছুটা সময় ব্যয় করতেন তাহলে তাঁদেরও কল্যাণ হত এবং দেশবাসীও এর সুফল ভোগ করতে পারত। আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার যে দৈন্য তাতে তো কুরআন বোঝা দূরের কথা তোতা পাখির মতো পড়ে যাওয়া শেখারও কোনো ব্যবস্থা নেই। কুরআনী শিক্ষা ও নির্দেশনা যদি আমরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সিলেবাসভুক্ত করতে পারতাম তাহলে এর সুদূর প্রসারী একটি ফলরূপে হয়তো এদেশের দুর্নীতি, সন্ত্রাস ইত্যাদিতে একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসত। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ বিষয়টি আমাদের স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটি পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় চরমভাবে অবহেলিত। এহেন পরিস্থিতিতে কুরআন বোঝার ব্যাপারে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা কোনো ইতিবাচক মন্তব্য করেন তখন আমরা ক্ষণিকের জন্য হলেও আনন্দিত হই। তবে খোদ কুরআনের দৃষ্টিতেই কুরআন তেলাওয়াতের যে গুরুত্ব সে সম্পর্কে সম্যক অবগতি না থাকা আমাদের বর্তমান পরিবেশে খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

প্রথম আলো উপস্থাপিত বক্তৃতার সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, পবিত্র কুরআনে নারীদের অধিকারের বিষয়গুলো উল্লেখ করা আছে। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং ইসলামের অপব্যবহারের কারণে নারীরা অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

এখানে নারীদের অধিকার বঞ্চিত হওয়ার যে দুটো কারণ উল্লেখ করা হয়েছে অর্থাৎ ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং ইসলামের অপব্যবহার, এর প্রথম কারণটি অবশ্যই বাস্তবসম্মত। যারা এই রিপোর্ট তৈরি করেছেন তারা একথার কী অর্থ গ্রহণ করেছেন তারাই ভালো জানেন। তবে বাস্তবিকভাবেই একথাটি সঠিক যে, বর্তমান সময়ে বৈশ্বিক পরিসরে সভ্যতার নামে নারীদের বঞ্চিত করা ও বঞ্চিত হওয়ার যে মর্মন্তুদ ধারা চলছে তার একটি কারণ ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা, যদি ইসলামী শিক্ষার চর্চা ব্যাপকভাবে থাকত তাহলে নানা মনোহর শ্লোগানের মাধ্যমে নারীদের প্রতারিত করা এবং তাদেরকে পণ্যে পরিণত করা কখনো সম্ভব হত না। অতএব ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা অবশ্যই নারীদের অধিকারবঞ্চিত হওয়ার একটি বাস্তবসম্মত কারণ।

আর দ্বিতীয় কারণ ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষা, আইন ও কানূন ইত্যাদির অনুপস্থিতি। শুধু নারী সমাজই নন, পৃথিবীতে যতভাবে যত অত্যাচার চলছে এবং পৃথিবীতে যত শ্রেণী যতভাবে বঞ্চিত হচ্ছে তার মূল কারণ এ দুটিই। এই সত্য অন্তত মুসলিম জনগণের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তারা যত তাড়াতাড়ি এটা বুঝতে সক্ষম হবেন তত তাড়াতাড়িই তারা বঞ্চনার নিগড় থেকে মুক্তি লাভ করবেন। আল্লাহ তাআলাই তাওফীক দাতা।

 

 

advertisement