জুমাদাল উলা ১৪৪৪   ||   ডিসেম্বর ২০২২

প্রসঙ্গ পাকিস্তান
বর্তমান পরিস্থিতি : দুঃখজনক কয়েকটি দিক

মাওলানা হানীফ জালান্ধারী

[বর্তমান বিশ্বে মুসলিম দেশগুলো এমনিতেই হরেক রকম সমস্যায় জর্জরিত। অযোগ্য নেতৃত্ব, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতির মতো অভ্যন্তরীণ সমস্যার সাথে সাথে বিদেশী ও বিজাতীয় দুশমনদের অব্যাহত ষড়যন্ত্রও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। কিন্তু কিছুতেই আমাদের ঘুম ভাঙছে না। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের পরিস্থিতিও বেসামাল যাচ্ছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক কোন্দল ছাড়াও বিভিন্ন কারণে দেশটির দিকে বিশ্বমোড়লদের শ্যেন দৃষ্টি সবসময় লেগে আছে। একে তো এটি খেলাফত পরবর্তী সময়ে বিশ্বের একমাত্র রাষ্ট্র, যা ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশও বটে। এছাড়া ভৌগলিক অবস্থান এবং বিশেষত সামরিক শক্তি ও পারমাণবিক ক্ষমতাধর হওয়ায় সবসময় বিশ্বশক্তির আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দেশটি। সঙ্গত কারণেই অন্যান্য মুসলিম দেশের মতো পাকিস্তানের পরিস্থিতিও বিশ্বের মুসলমানদের ভালোভাবেই নাড়া দেয়।

আলকাউসারের অনেক পাঠক পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বিষয়াদি নিয়ে কিছু লেখার অনুরোধ জানিয়ে  আসছেন। সেটি এখনও হয়ে ওঠেনি। এদিকে কয়েক মাস আগে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অনাস্থা প্রস্তাবে হেরে গিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান ক্ষমতায় বসে রিয়াসাতে মদীনার ধোঁয়া তুলেছিলেন। বিভিন্ন ভাষণেও ইসলাম ও মুসলমানের কথা বলেছিলেন। যদিও তাঁর দলের নেতাদের অধিকাংশই কট্টর ইসলামবিদ্বেষী সাবেক সামরিক শাসক মোশাররফের লোক ও সেক্যুলার মানসিকতার। তাঁর নিজের জীবনাচরণ, বিবাহ-শাদী-  এগুলোর সাথেও ইসলামের দূরত্ব অনেক। আর আমলীভাবেও তিনি চার বছরের ক্ষমতাকালে ইসলামের জন্য তেমন কিছু করেননি। তবুও তাঁর গরম ও মজার ভাষণে অনেকেই মজে যান। তাই ইমরান খানের ব্যাপারেও অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে।

বক্ষমাণ লেখাটি ইমরান খানের সাম্প্রতিক লংমার্চে কথিত গুলিবর্ষণ এবং এ নিয়ে তাঁর বক্তব্য কেন্দ্র করে। এটি ছেপেছে পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ পত্রিকা দৈনিক জংয়ের (৭ নভেম্বর ২০২২ ঈ.) সম্পাদকীয় পাতায়। লেখক পাকিস্তানে দেওবন্দী ধারার মাদরাসাগুলোর একমাত্র বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার সুযোগ্য সেক্রেটারি জেনারেল, প্রতিথযশা আলেমেদ্বীন মাওলানা হানীফ জালান্ধারী। আলকাউসারের পাঠকদের জন্য তা অনুবাদ করেছেন, মাওলানা ওয়ালিউল্লাহ আব্দুল জলীল।

আল্লাহ তাআলা বিশ্বের মুসলিম জনগণ ও মুসলিম দেশগুলোকে হেফাজত করুন। নেতা-নেত্রীদের সুমতি দান করুন। নিজেদের মধ্যে সততা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার এবং অন্যের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সচেতন থাকার তাওফীক দান করুন- আমীন। -সম্পাদক]

 

গত কয়েকদিনে দেশে কিছু দুঃখজনক ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। যেগুলোকে শুধুই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে। গভীরভাবে ভাবলে দেখা যায়, এসব ঘটনা শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং সামাজিক, ধর্মীয়, বিশেষ করে দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখা উচিত। এসব ঘটনার মূলে আছে ওয়াজিরাবাদে পাকিস্তান তাহরীকে ইনসাফের র‌্যালিতে বোমা বর্ষণের ঘটনা। এসব ঘটনার রাজনৈতিক একটি দিক তো আছেই, যে বিষয়ে আমার মতামত দেওয়ার না প্রয়োজন আছে আর না এটা আমার বিষয়।

যেহেতু অনেকদিন থেকেই রাজনীতির অঙ্গনে এমন ভেল্কিবাজি, গলদ বিবৃতি এবং এমন এমন কাজ চলে আসছে, যার ফলে কোনো ঘটনাই না পুরোপুরি বিশ্বাস করা সম্ভব আর না এর ওপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। এজন্য ইমরান খানের লংমার্চে গুলিবর্ষণের বিষয়েও মানুষের মাঝে স্পষ্ট বিভক্তি আছে। কেউ কেউ এসব ঘটনাকে সত্য মনে করছে আবার কেউ কেউ এসব দাবি বিশ্বাস করতে প্রস্তুত নয়। বাস্তবতা যাই হোক এসব ঘটনা সংশ্লিষ্ট কিছু দিক অনেক বিপদজনক, দুঃখজনক ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। সর্বপ্রথম দুঃখজনক বিষয় হল, রাজনৈতিক চরমপন্থা। এই রাজনৈতিক চরমপন্থা রাতারাতি এ পর্যায়ে আসেনি। এর আছে দীর্ঘ প্রেক্ষাপট। কিন্তু ব্যাপারটা এতই ভয়ংকর, যার কারণে দেশের পরিস্থিতি এ পর্যায়ে গড়িয়েছে যে, এই রাজনৈতিক চরমপন্থা, অসহিষ্ণুতা এবং গালি ও গুলির কালচার এদেশের প্রতিটি শ্রেণি, প্রতিটি অলি-গলিকে প্রভাবিত করতে পারে। এই আগুন প্রতিটি আঁচল স্পর্শ করতে পারে। এখন প্রয়োজন হল, এই কালচারকে থামানোর জন্য পূর্ণ বুদ্ধিমত্তা ও গুরুত্বের সঙ্গে পদক্ষেপ নেওয়া।

দ্বিতীয় বিশৃঙ্খলাপূর্ণ দিক হল, এই রাজনৈতিক চরমপন্থাকেও ধর্মের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। রাজনৈতিক চরমপন্থাকে নিরাপদ রাখতে ধর্মীয় চরমপন্থার জিগির তোলা হয়েছে। এটা আজকের কথা নয়। কয়েক দশক ধরে রাজনৈতিক ভৌগলিক ও আন্তর্জাতিক- সব অঙ্গনের আবর্জনা ধার্মিকদের ওপর ফেলার জন্য ধর্মীয় চরমপন্থা নামক শব্দ দাঁড় করানো হয়। এই পরিস্থিতিতে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও জনসাধারণের করণীয় হল, ধর্মীয় চরমপন্থার বাদ্যবাদকদের মানোবল ভেঙ্গে দেওয়া; রাজনৈতিক চরমপন্থা রোধে ভূমিকা নেওয়া।

এ ঘটনার তৃতীয় দুঃখজনক দিক হল, দুর্ঘটনা ঘটেছে ওয়াজিরাবাদে। বাস্তবে কী ঘটেছে তা-ও সামনে আসেনি, ঘটনার সবদিক জনসম্মুখে এসে সারেনি- এর মধ্যেই কিছু ক্ষুব্ধ মানুষ পেশাওয়ারের কোর কমান্ডার হাউসে হামলা করে বসে। কিছু মানুষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন আর কিছু মানুষ গভর্নর হাউস ঘেরাও করে ফেলে। সারা দেশে ভাংচুর শুরু হয়ে যায়। এ কেমন বিপদজনক ও দুঃখজনক ক্রোধ। আমরা কি নিজ দেশে ও নিজ ঘরে এভাবে আগুন দেব? আল্লাহ না করুন, কাল এজাতীয় অন্য কোনো ঘটনা ঘটলে কি আমরা দেশকে এমন ধ্বংস ও বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেব! মনে রাখতে হবে, এ কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। খেয়াল করলে দেখতে পাব, যেমনিভাবে আরব বসন্তের নামে কয়েকটি আরব দেশকে আগুন ও রক্তের মাঝে ঠেলে দেওয়া হয়েছে -খোদা না করুন- মনে হয় পাকিস্তানকেও এমন কোনো চোরাগলিতে ঠেলে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়ে আছে। আরব বসন্তের শুরুর দিনগুলো এবং এর ভয়ানক পরিণতি সামনে রাখলে কিছু ইঙ্গিত এমন রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে আমাদের চোখ খুলে যাওয়া উচিত। আরব বসন্তের পর কিছু আরব দেশের মতো পরিণতি থেকে প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য চিন্তাশীল হতে হবে।

ওয়াজিরাবাদের ঘটনার পর যে দুঃখজনক ও বিপদজনক ঘটনা সামনে এসেছে তা হল, প্রথম দফায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন বর্তমান সিনিয়র অফিসারের নাম নিয়ে তাঁকে দায়ী করা হয়েছে। এ কোনো সাধারণ বিষয় নয়। এটা শুধু একজন অফিসারের নাম নেওয়া নয়, বরং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পুরো সিস্টেমের ওপর আস্থাহীনতা এবং সন্দেহ ও সংশয়ের প্রকাশ করা।

ইতিপূর্বে রাজনীতিবিদেরা একে-অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও গলাবাজি করত। কিন্তু এবারই প্রথম এমনভাবে সেনাবাহিনীকে লক্ষ্যবস্তু  করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, পাক সেনাবাহিনী আমাদের শেষ দুর্গ। দুশমনের চেষ্টা হল, এ দুর্গ ভেঙে দেওয়া এবং সিপাহী-জনতার মাঝে অবিশ্বাস ও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করা। অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম শেষ হওয়ার আগে ওয়াজিরাবাদের ঘটনার আড়ালে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সুযোগ খোঁজা দুশমনের উদ্দেশ্য পূরণেরই নামান্তর। এই কয়েক দিন আগে এক জন সংবাদিক (আরশাদ শরীফ) হত্যার সব দায়ও সেনাবাহিনীর ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আর সাম্প্রতিক ঘটনায় তো দলীয় পলিসির মতো সেনাবাহিনীকে টার্গেট করা হচ্ছে, যা নিঃসন্দেহ বিপদসংকেত। এই ধারা এখানেই বন্ধ করতে হবে। নতুবা দেশের নিরাপত্তা ও সংহতির জন্য এ পরিস্থিতি অনেক উদ্বেগজনক। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দল, প্রভাবশালী গোষ্ঠী, মিডিয়া ও জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের এক্ষুণি পরামর্শ সভায় বসা জরুরি। যেখানে এমন প্রতিশ্রুতি ও নীতিমালা গৃহীত হবে, যা দেশ ও জাতিকে এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এবং এই সুরতে হালের বিপদজনক পরিণতি থেকে রক্ষা করবে। আল্লাহ রাব্বুল ইযযত প্রিয় দেশকে হেফাজত করুন- আমীন। হ

 

 

advertisement