রবিউল আখির ১৪৪৪   ||   নভেম্বর ২০২২

জলসাতুল ইস্তিরাহা
প্রথম ও তৃতীয় রাকাতে সিজদা থেকে দাঁড়ানোর মাসনূন পদ্ধতি

মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহমান

নামাযে দ্বিতীয় ও শেষ রাকাতে দুই সিজদা সম্পন্ন করার পর বৈঠক করা জরুরি। কিন্তু প্রথম ও তৃতীয় রাকাতে দুই সিজদা সম্পন্ন করার পর সুন্নত হল সোজা দাঁড়িয়ে যাওয়া; এই স্থানে কোনো ধরনের বৈঠক নেই। তবে অসুস্থতা বা অন্য কোনো ওজরের কারণে সরাসরি দাঁড়াতে কষ্ট হলে সামান্য বসে দাঁড়ানো যাবে।১

এই পদ্ধতি (প্রথম ও তৃতীয় রাকাতে দুই সিজদা সম্পন্ন করার পর সোজা দাঁড়িয়ে যাওয়া) নির্ভরযোগ্য হাদীস এবং সাহাবা-তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীন যুগের আমলে মুতাওয়ারাস তথা যুগ পরম্পরায় চলে আসা ব্যাপক ও অনুসৃত কর্মধারার মাধ্যমে প্রমাণিত। এখানে আমরা এ সম্পর্কে আলোকপাত করব।

 

হাদীস

প্রথমে আমরা হাদীস উল্লেখ করব। তারপর সাহাবা-তাবেয়ীগণের আমল উল্লেখ করব।

আবদুর রহমান ইবনে গান্ম থেকে বর্ণিত, একদিন আবু মালিক আশআরী রা. বললেন, হে আশআরী সম্প্রদায়, তোমরা সমবেত হও এবং তোমাদের স্ত্রী-সন্তানদের সমবেত কর; আমি তোমাদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায শিক্ষা দেব, যেভাবে তিনি আমাদের নিয়ে মদীনায় নামায পড়েছেন। তারা সমবেত হল।... তিনি পুরুষদেরকে কাছের কাতারে দাঁড় করালেন। শিশুদেরকে তার পরের কাতারে এবং নারীদেরকে তার পরের কাতারে দাঁড় করালেন। এরপর তিনি সামনে গিয়ে দুই হাত ওঠালেন এবং তাকবীর বললেন। তারপর সূরা ফাতেহা ও আরেকটি সূরা আস্তে পড়লেন। তারপর তাকবীর বলে রুকু করলেন। সেখানে তিনবার سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ বললেন। তারপর سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ বলে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর তাকবীর বলে সিজদায় গেলেন। তারপর তাকবীর বলে মাথা উঁচু করলেন। তারপর তাকবীর বলে সিজদা করলেন। তারপর তাকবীর বলে সোজা দাঁড়িয়ে গেলেন। এভাবে প্রথম রাকাতে তাঁর তাকবীর হল ছয়টি। যখন দ্বিতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়ালেন তখনো তাকবীর বললেন।  নামায শেষ করে গোত্রের লোকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা আমার তাকবীর স্মরণ রাখো, আমার রুকু-সিজদা শেখো। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিনের এই সময়ে আমাদের নিয়ে যেভাবে নামায পড়েছিলেন- এটা সেই নামায। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৯০৬

সনদসহ বর্ণনাটির আরবী পাঠ এই-

حَدّثَنَا أَبُو النّضْرِ، حَدّثَنَا عَبْدُ الْحَمِيدِ بْنُ بَهْرَامَ الْفَزَارِيّ، عَنْ شَهْرِ بْنِ حَوْشَبٍ، حَدّثَنَا عَبْدُ الرّحْمنِ بْنُ غَنْمٍ، أَنّ أَبَا مَالِكٍ الْأَشْعَرِيّ جَمَعَ قَوْمَهُ فَقَالَ: يَا مَعْشَرَ الْأَشْعَرِيِّينَ! اجْتَمِعُوا وَاجْمَعُوا نِسَاءَكُمْ وَأَبْنَاءَكُمْ أُعَلِّمْكُمْ صَلَاةَ النّبِي صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ الّتِي صلى لَنَا بِالْمَدِينَةِ. فَاجْتَمَعُوا وَجَمَعُوا نِسَاءَهُمْ وَأَبْنَاءَهُمْ ... فَصَفّ الرِّجَالَ فِي أَدْنَى الصفِّ، وَصَفّ الْوِلْدَانَ خَلْفَهُمْ، وَصَفّ النِّسَاءَ خَلْفَ الْوِلْدَانِ، ثُمّ أَقَامَ الصلَاةَ، فَتَقَدّمَ فَرَفَعَ يَدَيْهِ وَكَبّرَ، فَقَرَأَ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ وَسُورَةٍ يُسِرّهُمَا، ثُمّ كَبّرَ فَرَكَعَ فَقَالَ: سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ ثَلَاثَ مِرَارٍ، ثُمّ قَالَ: سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ، وَاسْتَوَى قَائِمًا، ثُمّ كَبّرَ وَخَرّ سَاجِدًا، ثُمّ كَبّرَ فَرَفَعَ رَأْسَهُ، ثُمّ كَبّرَ فَسَجَدَ، ثُمّ كَبّرَ فَانْتَهَضَ قَائِمًا، فَكَانَ تَكْبِيرُهُ فِي أَوّلِ رَكْعَةٍ سِتّ تَكْبِيرَاتٍ، وَكَبّرَ حِينَ قَامَ إِلَى الرّكْعَةِ الثّانِيَةِ، فَلَمّا قَضَى صَلَاتَهُ أَقْبَلَ إِلَى قَوْمِهِ بِوَجْهِهِ، فَقَالَ: احْفَظُوا تَكْبِيرِي، وَتَعَلّمُوا رُكُوعِي وَسُجُودِي، فَإِنَّهَا صَلَاةُ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ الّتِي كَانَ يُصَلِّي لَنَا كَذَى السّاعَةِ مِنَ النّهَارِ.

শায়েখ মুহাম্মাদ ইবনে আলী নিমাভী রাহ. (১৩২২ হি.) বলেন-

إِسْنَادُهُ حَسَنٌ.

এ বর্ণনার সনদ হাসান। -আসারুস সুনান ১৫২

এই হাদীসে আমরা দেখলাম, আবু মালিক আশআরী রা. তাঁর সম্প্রদায়কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায নিজে পড়ে দেখিয়েছেন এবং তাতে তিনি প্রথম রাকাতে দুই সিজদা সম্পন্ন করে তাকবীর বলে সোজা দাঁড়িয়ে গেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয়, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম রাকাতে দুই সিজদা সম্পন্ন করার পর বসতেন না; বরং সোজা দাঁড়িয়ে যেতেন।

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে পায়ের অগ্রভাগের উপর দাঁড়িয়ে যেতেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৮৮

সনদসহ বর্ণনাটির আরবী পাঠ নিম্নরূপ-

حَدّثَنَا يَحْيَى بْنُ مُوسَى، قَالَ: حَدّثَنَا أَبُو مُعَاوِيَةَ، قَالَ: حَدّثَنَا خَالِدٌ، عَنْ صَالِحٍ مَوْلَى التّوْأَمَةِ، عَنْ أَبي هُرَيْرَةَ، قَالَ: كَانَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَنْهَضُ فِي الصّلاَةِ عَلَى صُدُورِ قَدَمَيْهِ.

খালেদ (ইবনে ইলিয়াস) ছাড়া এ বর্ণনার অন্য রাবীগণ নির্ভরযোগ্য। খালেদের ব্যাপারে ইমামদের বিভিন্ন মন্তব্য এবং তার কিছু বর্ণনা পর্যালোচনা করে ইমাম ইবনে আদী রাহ. (৩৬৫ হি.) আলোচনা শেষ করেছেন এভাবে-

وَمَعَ ضَعْفِهِ يُكْتَبُ حَدِيْثُهُ.

তিনি যঈফ হলেও তার বর্ণনা সংরক্ষণ করা যাবে। -আলকামিল ফী যুআফাইর রিজাল ৩/৭

আর সালেহ মাওলা তাওয়ামা মাঝারি পর্যায়ের নির্ভরযোগ্য রাবী। তবে কতক ইমাম শেষ জীবনে তার স্মৃতিতে কিছু পরিবর্তন এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন। দ্রষ্টব্য : তাহযীবুল কামাল ১৩/৯৯-১০৩

এ হচ্ছে উপরিউক্ত বর্ণনাটির সূত্রগত অবস্থা। এ ধরনের বর্ণনা শাহিদ হিসেবে গ্রহণ করা যায়। বিশেষত যখন সাহাবা-তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীন যুগের ব্যাপক আমল এমনই ছিল। এটা নির্দেশ করে- এ বর্ণনায় উল্লেখিত মূল বিষয়টির মজবুত ভিত আছে।

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রাহ. (৮৫৫ হি.) বলেন-

ومع ضعفه يكتب حديثه، ويقويه ما روي عن الصحابة في ذلك.

অর্থাৎ খালেদ ইবনে ইলিয়াস যঈফ হলেও তার বর্ণনা (শাহিদ হিসেবে) উল্লেখ করা যাবে। সাহাবীদের আমল একে সমর্থন করে। -আলবিনায়া ২/২৫১

ইমাম তিরমিযী (২৭৯ হি.) রাহ.-ও এদিকে ইঙ্গিত করেছেন। তিনি আবু হুরায়রা রা.-এর বর্ণনা সম্পর্কে বলেছেন-

حَدِيثُ أَبِي هُرَيْرَةَ عَلَيْهِ العَمَلُ عِنْدَ أَهْلِ العِلْمِ: يَخْتَارُونَ أَنْ يَنْهَضَ الرّجُلُ فِي الصّلاَةِ عَلَى صُدُورِ قَدَمَيْهِ.

আবু হুরায়রার হাদীস অনুযায়ীই আহলে ইলম আমল করেন। তাঁরা পছন্দ করেন, ব্যক্তি যেন নামাযে পায়ের অগ্রভাগের উপর দাঁড়িয়ে যায়। (জামে তিরমিযী, ২৮৮ নং হাদীসের অধীন)

ইমাম ইবনুল হুমাম রাহ. (৮৬১ হি.) তিরমিযী রাহ.-এর এ বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন-

يَقْتَضِي قُوةَ أَصْلِهِ، وَإِنْ ضَعُفَ خُصُوصُ هَذَا الطّرِيقِ، وَهُوَ كَذَلِكَ.

এ বক্তব্যের দাবি হল এই বর্ণনায় উল্লেখিত মূল বিষয়টির মজবুত ভিত আছে, যদিও নির্দিষ্ট এই সূত্রটি যঈফ। ব্যাপারটি আসলে এমনই। -ফাতহুল কাদীর ১/৩১৪

যাইহোক, এই বর্ণনায় পাঠক লক্ষ করেছেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে পায়ের অগ্রভাগের উপর দাঁড়িয়ে যেতেন। পায়ের অগ্রভাগের উপর দাঁড়ানোর মর্ম হল, যে অবস্থায় সিজদা থেকে মাথা উঁচু করতেন ওই অবস্থায়ই দাঁড়িয়ে যেতেন। এর মানে সিজদা থেকে মাথা উঁচু করে বসতেন না। 

আবদুর রহমান মুবারকপুরী এই বর্ণনার ব্যাখ্যায় বলেন-

أي بدون الجلوس.

অর্থাৎ না বসে দাঁড়িয়ে যেতেন। -তুহফাতুল আহওয়াযী ২/১৪৬

একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণীয় বিষয়

আলোচ্য বিষয়ের প্রথম দলীল মারফূ হাদীস প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণীয় বিষয় এই যে, আমরা সবাই জানি, নামাযের তালীম খোদ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েছেন। তিনি আপন কর্ম ও বাণীর মাধ্যমে নামায শিখিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম তাঁর সঙ্গে নামায পড়েছেন, তাঁর নামায দেখেছেন, তাঁর বাণী শুনেছেন। অতঃপর পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সেগুলো বর্ণনা করেছেন। শুধু তাই নয়; শিষ্যদেরকে নবীজীর নামায প্রায়োগিকভাবে দেখিয়েছেন।

হাদীস-ভাণ্ডার অনুসন্ধান করলে আমরা দেখতে পাই, মালিক ইবনে হুওয়াইরিস রা. ছাড়া নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত সূত্রে অন্য কোনো সাহাবীর বর্ণনায় প্রথম ও তৃতীয় রাকাতে দুই সিজদা সম্পন্ন করার পর বসার কথা নেই। এ থেকে প্রমাণিত হয়, এই স্থানে সুন্নত হল, না বসে সোজা দাঁড়িয়ে যাওয়া। যদি এখানে বসা সুন্নত হত তাহলে অনেক সাহাবী তা বর্ণনা করতেন। বিশেষত ওই সাহাবীগণ অবশ্যই তা বর্ণনা করতেন, যাঁরা প্রবাসে-নিবাসে নবীজীর সঙ্গে থাকতেন, তাঁর পেছনে প্রথম কাতারে নামায পড়তেন। কিন্তু আলোচ্য বিষয়ে তা উপস্থিত নয়। যে সাহাবীগণ প্রবাসে-নিবাসে নবীজীর সঙ্গে থাকতেন, তাঁর পেছনে প্রথম কাতারে নামায পড়তেন তাঁদের বর্ণনায় প্রথম ও তৃতীয় রাকাতে দুই সিজদা সম্পন্ন করার পর বসার কথা নেই।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহ. (২৪১ হি.) বলেন-

أَكْثَرُ الْأَحَادِيْثِ عَلَى هَذَا.

অধিকাংশ বর্ণনায় এই বসার কথা নেই। -আততামহীদ, ইমাম ইবনে আবদুল বার ১৯/২৫৪

আরো দ্রষ্টব্য : আলমুগনী, ইমাম ইবনে কুদামা ১/৬০৩; ফাতহুল বারী, ইমাম ইবনে রজব ৫/১৪২-৪৩

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে নামায পড়তে বলেছেন এবং তিনি নিজে কীভাবে নামায পড়তেন- সাহাবীগণ তা বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমাদ রাহ.-এর উদ্দেশ্য হল এধরনের অধিকাংশ হাদীসে জলসায়ে ইস্তিরাহাতের কথা নেই।

যেমন নবীজীর নামাযের শিক্ষা সম্বলিত একটি হাদীস হল রিফাআ ইবনে রাফি রা.-এর হাদীস। রিফাআ রা. বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে মসজিদে ছিলাম। এমন সময় এক লোক প্রবেশ করে মসজিদের এক কোণায় নামায পড়ল। নামায শেষ করে লোকটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে সালাম দিল। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, তুমি পুনরায় নামায পড়, কেননা তুমি নামায পড়নি। সে পুনরায় নামায পড়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এল এবং সালাম দিল। তিনি সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তুমি পুনরায় নামায পড়, কেননা তুমি নামায পড়নি। সে তৃতীয় বা চতুর্থবার আরয করল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাকে নামায শিক্ষা দিন। তিনি বললেন-

إِذَا أَرَدْتَ أَنْ تُصَلِّيَ فَتَوَضّأْ فَأَحْسِنْ وُضُوءَكَ، ثُمّ اسْتَقْبِلِ الْقِبْلَةَ، ثُمّ كَبِّرْ، ثُمّ اقْرَأْ، ثُمّ ارْكَعْ حَتّى تَطْمَئِنّ رَاكِعًا، ثُمّ ارْفَعْ حَتَّى تَطْمَئِنّ قَائِمًا، ثُمّ اسْجُدْ حَتَّى تَطْمَئِنّ سَاجِدًا، ثُمّ ارْفَعْ حَتَّى تَطْمَئِنّ جَالِسًا، ثُمّ اسْجُدْ حَتّى تَطْمَئِنَّ سَاجِدًا، ثُمّ قُمْ...

তুমি যখন নামাযের ইচ্ছা করবে তখন সুন্দরভাবে ওযু করবে। তারপর কিবলামুখী হবে। তারপর কুরআন থেকে পড়বে। তারপর স্থির হয়ে রুকু করবে। তারপর রুকু থেকে মাথা উঁচু করে স্থির হয়ে দাঁড়াবে। তারপর স্থির হয়ে সিজদা করবে। তারপর সিজদা থেকে মাথা উঁচু করে স্থির হয়ে বসবে। তারপর স্থির হয়ে সিজদা করবে। তারপর দাঁড়িয়ে যাবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৯৯৭

এই হাদীসে শেষ সিজদা করার পর যে পদ্ধতিতে দাঁড়িয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে তা থেকে বোঝা যায় এই স্থানে কোনো বৈঠক নেই; বরং সোজা দাঁড়িয়ে যাবে।

ইমাম আহমাদ রাহ.-এর পুত্র আবদুল্লাহ বলেন, আমার পিতা মালিক ইবনে হুওয়াইরিস ও রিফাআ ইবনে রাফির হাদীস উদ্ধৃত করে বলেছেন-

وأذهب أنا إلى حَدِيث رِفَاعَة بن رَافع ... قَالَ أبي: بَلغنِي أن حَمّاد بن زيد كَانَ يذهب إلى حَدِيث رِفَاعَة إلى مَا روي عَن عبد الله بن مَسْعُود وَغَيره من أصحاب النّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم أنهم كَانُوا ينهضون على صُدُور أقدامهم. أذْهَب إلى هَذَا.

আমার মত রিফাআ ইবনে রাফির হাদীস অনুযায়ী। আমার পিতা আরো বলেন, আমার কাছে এ কথা পৌঁছেছে যে, হাম্মাদ ইবনে যায়েদের মতও রিফাআর হাদীস এবং আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবী সম্পর্কে যে বর্ণিত আছে যে, তাঁরা পায়ের অগ্রভাগের উপর দাঁড়িয়ে যেতেন- সে অনুযায়ীই ছিল। আমার মতও এ অনুযায়ীই। -মাসাইলুল ইমাম আহমাদ ৮১-৮২

ইমাম আহমাদ রাহ. মালিক ইবনে হুওয়াইরিস রা.-এর হাদীস সম্পর্কে বলেন-

لَيْسَ لِهَذَا الْحَدِيْثِ ثَانٍ.

এই হাদীসের সমর্থনে দ্বিতীয় কোনো হাদীস নেই।২ -ফাতহুল বারী, ইমাম ইবনে রজব ৫/১৩৯

সাহাবা-তাবেয়ীনের তাআমুল

হাদীস-সম্ভার অনুসন্ধান করলে আমরা দেখতে পাই, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণের তাআমুল ছিল, তাঁরা প্রথম ও তৃতীয় রাকাতে দুই সিজদা সম্পন্ন করার পর পায়ের অগ্রভাগের উপর দাঁড়িয়ে যেতেন, বসতেন না।

আবদুর রহমান ইবনে ইয়াযীদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ কীভাবে নামায পড়েন- আমি তা লক্ষ করেছি। তিনি প্রথম ও তৃতীয় রাকাতে পায়ের অগ্রভাগের উপর দাঁড়িয়ে গেছেন, বসেননি। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, বর্ণনা ২৯৬৬

সনদসহ বর্ণনাটির আরবী পাঠ এই-

عَنِ ابْنِ عُيَيْنَةَ، عَنِ ابْنِ أَبِي لَيْلَى، قَالَ: سَمِعْتُ عَبْدَ الرّحْمَنِ بْنَ يَزِيدَ يَقُولُ: رَمَقْتُ عَبْدَ اللهِ بْنَ مَسْعُودٍ فِي الصّلَاةِ، فَرَأَيْتُهُ يَنْهَضُ وَلَا يَجْلِسُ. قَالَ: يَنْهَضُ عَلَى صُدُورِ قَدَمَيْهِ فِي الرّكْعَةِ الْأُولَى وَالثّالِثَةِ.

আরো দ্রষ্টব্য : মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৪০০৮; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী ৯/২৬৬-২৬৭

হাফেয ইবনে হাজার রাহ. (৮৫২ হি.) একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করে বলেন-

عَن ابن مَسْعُودٍ مِثْلُهُ بِإِسْنَادٍ صَحِيحٍ.

ইবনে মাসউদ থেকে অনুরূপ কথা সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। -ফাতহুল বারী ২/৪২০

নূরুদ্দীন হায়সামী রাহ. (৮০৭ হি.) বলেন-

رَوَاهُ الطّبَرَانِيّ فِي الْكَبِيرِ وَرِجَالُهُ رِجَالُ الصّحِيحِ.

তবারানী এটা আলমুজামুল কাবীরে বর্ণনা করেছেন। এর রাবীগণ সহীহের রাবী। -মাজমাউয যাওয়ায়েদ ২/৩২৬

সুলায়মান ইবনে মেহরান আমাশ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি উমারাকে কিন্দার দরজার কাছে নামায পড়তে দেখেছি। তিনি রুকু করেছেন তারপর সিজদা করেছেন। যখন দ্বিতীয় সিজদা সম্পন্ন করলেন তখন ঐ অবস্থায়ই দাঁড়িয়ে গেলেন। নামায শেষে আমি তাঁকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, আবদুর রহমান ইবনে ইয়াযীদ আমাকে বলেছেন, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদকে তা করতে দেখেছেন।

তিনি বলেন, আমি এটা মুহাম্মাদ ইবনে উবায়দুল্লাহ সাকাফীর কাছে বর্ণনা করি। তিনি বলেন, আমি আবদুর রহমান ইবনে আবী লায়লাকে পায়ের অগ্রভাগের উপর দাঁড়িয়ে যেতে দেখেছি।

তিনি বলেন, আমি এটা আতিয়ার কাছে বর্ণনা করি। তিনি বলেন, আমি ইবনে উমর রা., ইবনে আব্বাস রা., ইবনে যুবাইর রা. ও আবু সায়ীদ খুদরী রা.-কে পায়ের অগ্রভাগের উপর দাঁড়িয়ে যেতে দেখেছি। -আলআওসাত, ইমাম ইবনুল মুনযির ৩/৩৬৩-৬৪

সনদসহ বর্ণনাটির আরবী পাঠ নিম্নরূপ-

حَدّثنا مُحَمدُ بْنُ إِسْمَاعِيلَ، قَالَ: ثنا عَفّانُ، قَالَ: ثنا عَبْدُ الْوَاحِدِ بْنُ زِيَادٍ، قَالَ: ثنا سُلَيْمَانُ الْأَعْمَشُ، قَالَ: رَأَيْتُ عُمَارَةَ يُصَلِّي مِنْ قِبَلِ أَبْوَابِ كِنْدَةَ، فَرَأَيْتُهُ رَكَعَ ثُمّ سَجَدَ، فَلَمّا قَامَ مِنَ السّجْدَةِ الْأَخِيرَةِ قَامَ كَمَا هُوَ، فَلَمّا انْصَرَفَ ذَكَرْتُ ذَلِكَ لَهُ، فَقَالَ: حَدّثَنِي عَبْدُ الرّحْمَنِ بْنُ يَزِيْدَ أَنّهُ رَأَى عَبْدَ اللهِ بْنَ مَسْعُودٍ يَفْعَلُ ذَلِكَ. قَالَ: فَحَدّثْتُ بِهِ مُحَمّدَ بْنَ عُبَيْدِ اللهِ الثّقَفِيّ، فَقَالَ: رَأَيْتُ عَبْدَ الرّحْمَنِ بْنَ أَبِي لَيْلَى يَقُومُ عَلَى صُدُورِ قَدَمَيْهِ. فَحَدّثْتُ بِهِ عَطِيّةَ الْعَوْفِيّ، فَقَالَ: رَأَيْتُ ابْنَ عُمَرَ، وَابْنَ عَبّاسٍ، وَابْنَ الزّبَيْرِ، وَأَبَا سَعِيدٍ الْخُدْرِيّ يَقُومُونَ عَلَى صُدُورِ أَقْدَامِهِمْ.

আরো দ্রষ্টব্য : সুনানে বায়হাকী ২/১২৫

খায়সামা ইবনে আবদুর রহমান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি দেখেছি, ইবনে উমর নামাযে পায়ের অগ্রভাগের উপর দাঁড়িয়ে গেছেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৪০০২

সনদসহ বর্ণনাটির আরবী পাঠ এই-

حَدّثَنَا أَبُو مُعَاوِيَةَ، عَنِ الأَعْمَشِ، عَنْ خَيْثَمَةَ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ: رَأَيْتُهُ يَنْهَضُ فِي الصّلاَةِ عَلَى صُدُورِ قَدَمَيْهِ.

আরো দ্রষ্টব্য : মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৪০০৭; আলআওসাত, ইমাম ইবনুল মুনযির ৩/৩৬৩

আতা ইবনে আবী রাবাহ থেকে বর্ণিত, তিনি দেখেছেন, মুআবিয়া রা. তৃতীয় রাকাতে সিজদা থেকে মাথা উঁচু করে দেরি করেননি। তাকবীর বলেই দাঁড়িয়ে গেছেন। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, বর্ণনা ২৯৬০

সনদসহ বর্ণনাটির আরবী পাঠ নিম্নরূপ-

عَنِ ابْنِ جُرَيْجٍ قَالَ: أَخْبَرَنِي عَطَاءٌ، أَنّهُ رَأَى مُعَاوِيَةَ فِي الرّكْعَةِ الثّالِثَةِ - كَذَا قَرَأَ الدّبَرِيّ - وَالثّالِثَةِ مِنَ الرّكُوعِ إِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنَ السّجُودِ لَمْ يَتَلَبّثْ، قَالَ: يَنْهَضُ وَهُوَ يُكَبِّرُ فِي نَهْضَتِهِ لِلْقِيَامِ.

ওয়াহব ইবনে কায়সান থেকে বর্ণিত, আমি ইবনে যুবাইরকে দেখেছি, তিনি যখন দ্বিতীয় সিজদা করেছেন তখন ঐ অবস্থায়ই পায়ের অগ্রভাগের উপর দাঁড়িয়ে গেছেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৪০০৫

সনদসহ বর্ণনাটির আরবী পাঠ এই-

حَدّثَنَا حُمَيْدُ بْنُ عَبْدِ الرّحْمَنِ، عَنْ هِشَامِ بْنِ عُرْوَةَ، عَنْ وَهْبِ بْنِ كَيْسَانَ، قَالَ: رَأَيْتُ ابْنَ الزّبَيْرِ إذَا سَجَدَ السّجْدَةَ الثّانِيَةَ قَامَ كَمَا هُوَ عَلَى صُدُورِ قَدَمَيْهِ.

নিমাভী রাহ. বলেন-

إِسْنَادُهُ صَحِيْحٌ.

এ বর্ণনার সনদ সহীহ। -আসারুস সুনান ১৫৩

নোমান ইবনে আবী আইয়াশ থেকে বর্ণিত, আমি একাধিক সাহাবীকে পেয়েছি, তাঁরা যখন প্রথম ও তৃতীয় রাকাতে সিজদা থেকে মাথা উঁচু করতেন তখন ঐ অবস্থায়ই দাঁড়িয়ে যেতেন, বসতেন না। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৪০১১

সনদসহ বর্ণনাটির আরবী পাঠ নিম্নরূপ-

حَدّثَنَا أَبُو خَالِدٍ الأَحْمَر، عَنْ مُحَمّدِ بْنِ عَجْلاَنَ، عَنِ النعْمَانِ بْنِ أَبِي عَيّاشٍ، قَالَ: أَدْرَكْت غَيْرَ وَاحِدٍ مِنْ أَصْحَابِ النّبِي صَلّى الله عَلَيْهِ وَسَلّمَ، فَكَانَ إذَا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنَ السّجْدَةِ فِي أَوّلِ رَكْعَةٍ وَالثّالِثَةِ، قَامَ كَمَا هُوَ، وَلَمْ يَجْلِسْ.

নিমাভী রাহ. বলেন-

إِسْنَادُهُ حَسَنٌ.

এ বর্ণনার সনদ হাসান। -আসারুস সুনান ১৫২

উল্লেখ্য, নোমান ইবনে আবী আইয়াশ রাহ. একজন মর্যাদাশীল তাবেয়ী। তাঁর পিতা আনসারী সাহাবী ছিলেন। এ ছাড়া তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা., জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. ও আবু সায়ীদ খুদরী রা. প্রমুখকে দেখেছেন।

যুবাইর ইবনে আদী রাহ. থেকে বর্ণিত, ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. প্রথম রাকাতে দুই সিজদা সম্পন্ন করে দ্রুত দাঁড়িয়ে যেতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৪০১০

সনদসহ বর্ণনাটির আরবী পাঠ এই-

حَدّثَنَا عَبْدُ الرّحْمَنِ بْنُ مَهْدِي، عَنْ سُفْيَانَ، عَنِ الزّبَيْرِ بْنِ عَدِي، عَنْ إبْرَاهِيمَ: أَنّهُ كَانَ يُسْرِعُ الْقِيَام فِي الرّكْعَةِ الأُولَى مِنْ آخِرِ سَجْدَةٍ.

মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত, (আবদুর রহমান) ইবনে আবী লায়লা নামাযে পায়ের অগ্রভাগের উপর দাঁড়িয়ে যেতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৪০০৩

সনদসহ বর্ণনাটির আরবী পাঠ নিম্নরূপ-

حَدثَنَا حَفْصٌ، عَنِ الأَعْمَشِ، عَنْ مُحَمّدِ بْنِ عَبْدِ اللهِ، قَالَ: كَانَ ابْنُ أَبِي لَيْلَى يَنْهَضُ فِي الصّلاَةِ عَلَى صُدُورِ قَدَمَيْهِ.

ইবনে শিহাব যুহরী থেকে বর্ণিত, আমাদের শায়েখগণ দেরি করতেন না। অর্থাৎ যখন প্রথম ও তৃতীয় রাকাতে দ্বিতীয় সিজদা থেকে মাথা উঁচু করতেন তখন ঐ অবস্থায়ই দাঁড়িয়ে যেতেন, বসতেন না। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৪০০৯

সনদসহ বর্ণনাটির আরবী পাঠ নিম্নরূপ-

حَدّثَنَا يَزِيدُ بْنُ هَارُونَ، قَالَ : أَخْبَرَنَا مُحَمّدُ بْنُ عَمْرٍو، عَنِ الزّهْرِي، قَالَ: كَانَ أَشْيَاخُنَا لا يُمَايلُونَ، يَعْنِي: إذَا رَفَعَ أَحَدُهُمْ رَأْسَهُ مِنَ السجْدَةِ الثّانِيَةِ فِي الرّكْعَةِ الأُولَى وَالثّالِثَةِ يَنْهَضُ كَمَا هُوَ، وَلَمْ يَجْلِسْ.

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল, ইবনে শিহাব যুহরী রাহ. (১২৪ হি.) একজন বিদগ্ধ তাবেয়ী। তাঁর শায়েখদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সাহাবী এবং অনেক বড় বড় তাবেয়ী রয়েছেন।

আইয়ুব সাখতিয়ানী রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমর ইবনে সালিমা রাহ. নামাযে এমন কাজ করতেন, যা আমি তাঁদেরকে করতে দেখিনি, তিনি তৃতীয় রাকাতে অথবা চতুর্থ রাকাতে৩ বসতেন। -সহীহ বুখারী, বর্ণনা ৮১৮

সনদসহ বর্ণনাটির আরবী পাঠ এই-

حَدّثَنَا أَبُو النّعْمَانِ، قَالَ: حَدّثَنَا حَمّادُ، عَنْ أَيّوبَ، عَنْ أَبِي قِلاَبَةَ، أَنّ مَالِكَ بْنَ الحُوَيْرِثِ قَالَ لِأَصْحَابِهِ: أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ صَلاَةَ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ؟ قَالَ: وَذَاكَ فِي غَيْرِ حِينِ صَلاَةٍ، فَقَامَ، ثُمّ رَكَعَ فَكَبّرَ، ثُمّ رَفَعَ رَأْسَهُ، فَقَامَ هُنَيّةً، ثُمّ سَجَدَ، ثُمّ رَفَعَ رَأْسَهُ هُنَيّةً، فَصَلّى صَلاَةَ عَمْرِو بْنِ سَلِمَةَ شَيْخِنَا هَذَا، قَالَ أَيّوبُ: كَانَ يَفْعَلُ شَيْئًا لَمْ أَرَهُمْ يَفْعَلُونَهُ، كَانَ يَقْعُدُ فِي الثّالِثَةِ أَوالرّابِعَةِ.

উল্লেখ্য, আইয়ুব সাখতিয়ানী রাহ. (১৩১ হি.) নিজেও একজন বিদ্বান তাবেয়ী এবং অনেক বড় বড় তাবেয়ীদের দেখেছেন। তো তাঁদের বলে তিনি কাদের বুঝিয়েছেন। নিশ্চয় তাঁর উস্তায বা সমকালীনগণ হবেন, যাঁদের বেশিরভাগই তাবেয়ী ছিলেন।

এখানে আমরা দেখলাম, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা., আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা., আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., আবু সায়ীদ খুদরী রা., আবু মালিক আশআরী রা., আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা.-এর মত সাহাবীগণ প্রথম ও তৃতীয় রাকাতে সোজা দাঁড়িয়ে যেতেন, বসতেন না। এ থেকে বোঝা যায়, এই স্থানে সুন্নত হল সোজা দাঁড়িয়ে যাওয়া। বসা নিয়মিত ও সাধারণ সুন্নত নয়। যদি এখানে বসা নিয়মিত সুন্নত হত তাহলে তাঁরা অবশ্যই তা করতেন। কেননা মালিক ইবনে হুওয়াইরিস রা. অপেক্ষা এই সাহাবীগণ নবীজীর অধিক সান্নিধ্য লাভ করেছেন।৪ তাঁরা বেশি দেখেছেন নবীজী কোন্ কাজ বেশি করেছেন আর কোন্টা কম করেছেন এবং তাঁরা অধিক বুঝতেন, নবীজী কোন্ কাজ সাধারণ নিয়ম হিসেবে করেছেন আর কোন্টা ওজরের কারণে করেছেন।৫

উপরিউক্ত বর্ণনাসমূহ থেকে আরো বোঝা যায়, প্রথম ও তৃতীয় রাকাতে দুই সিজদা সম্পন্ন করে সোজা দাঁড়িয়ে যাওয়া সাহাবা-তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীন যুগের আমলে মুতাওয়ারাস-এর অন্তর্ভুক্ত। এটা প্রত্যেক উত্তরসূরি পূর্বসূরি থেকে যুগ পরম্পরায় চলে আসা ব্যাপক ও অনুসৃত কর্মধারার মাধ্যমে লাভ করেছেন।

এ পর্যায়ে আমরা কয়েকজন হাদীস ব্যাখ্যাকারের বক্তব্য পেশ করব, যাঁরা আলোচ্য বিষয়ে বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করেছেন।

১. ইমাম তহাবী রাহ. (৩২১ হি.)। তিনি একাধারে হাদীস ও ফিকহের ইমাম। হাদীসের ব্যাখ্যার উপর তাঁর একাধিক মূল্যবান রচনা রয়েছে। তিনি তাঁর শরহু মাআনিল আসার গ্রন্থে জলসায়ে ইস্তিরাহাত করা বিষয়ক একটি হাদীস এবং না করা বিষয়ক একটি হাদীস বর্ণনা করে লেখেন-

فَلَمّا جَاءَ هَذَا الْحَدِيثُ عَلَى مَا ذَكَرْنَا، وَخَالَفَ الْحَدِيثَ الْأَوّلَ، احْتَمَلَ أَنْ يَكُونَ مَا فَعَلَهُ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فِي الْحَدِيثِ الْأَوّلِ لِعِلّةٍ كَانَتْ بِهِ، فَقَعَدَ مِنْ أَجْلِهَا، لَا لِأَنّ ذَلِكَ مِنْ سُنّةِ الصّلَاةِ، كَمَا قَدْ كَانَ ابْنُ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا يَتَرَبّعُ بِالصّلَاةِ، فَلَمّا سُئِلَ عَنْ ذَلِكَ قَالَ: إِنْ رِجْلِي لَا تَحْمِلَانِي. فَكَذَلِكَ يُحْتَمَلُ أَنْ يَكُونَ مَا فَعَلَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ مِنْ ذَلِكَ الْقُعُودِ كَانَ لِعِلّةٍ أَصَابَتْهُ، حَتّى لَا يُضَادّ ذَلِكَ مَا رُوِيَ عَنْهُ فِي الْحَدِيثِ الْآخَرِ، وَلَا يُخَالِفُهُ. وَهَذَا أَوْلَى بِنَا مِنْ حَمْلِ مَا رُوِيَ عَنْهُ عَلَى التّضَادِّ وَالتّنَافِي.

অর্থাৎ যখন দুই হাদীসের মধ্যে বিরোধ দেখা যাচ্ছে তাই এ সম্ভাবনা আছে যে, প্রথম হাদীসে যে কাজটি বর্ণিত হয়েছে (জলসায়ে ইস্তিরাহাত) তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো ওজরের কারণে করেছেন; এজন্য নয় যে, এটা নামাযের সুন্নত। যেমন ইবনে উমর রা. নামাযে চারজানু হয়ে বসতেন। জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আমার শরীর ভারী হয়ে গেছে। এখানেও এ সম্ভাবনা আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো ওজরের কারণে বসেছেন। এতে দুই হাদীসের মধ্যে সমন্বয় হয়ে যায়। দুই হাদীসের মাঝে বিরোধ দেখা দেয়- এমন ব্যাখ্যার চেয়ে এই ব্যাখ্যা উত্তম। -শরহু মাআনিল আসার ৪/৫৮৩

২. ইমাম ইবনুল কায়্যিম রাহ. (৭৫১ হি.) তাঁর যাদুল মাআদ ফী হাদয়ি খাইরিল ইবাদ গ্রন্থে বলেন-

سَائِرُ مَنْ وَصَفَ صَلَاتَهُ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ لَمْ يَذْكُرْ هَذِهِ الْجِلْسَةَ، وَإِنّمَا ذُكِرَتْ فِي حَدِيثِ أبي حميد، ومالك بن الحويرث. وَلَوْ كَانَ هَدْيُهُ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فِعْلَهَا دَائِمًا لَذَكَرَهَا كُلّ مَنْ وَصَفَ صَلَاتَهُ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، وَمُجَرّدُ فِعْلِهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ لَهَا لَا يَدُلّ عَلَى أَنّهَا مِنْ سُنَنِ الصّلَاةِ، إِلّا إِذَا عُلِمَ أَنّهُ فَعَلَهَا عَلَى أَنّهَا سُنّةٌ يُقْتَدَى بِهِ فِيهَا، وَأَمّا إِذَا قُدِّرَ أَنّهُ فَعَلَهَا لِلْحَاجَةِ، لَمْ يَدُلّ عَلَى كَوْنِهَا سُنّةً مِنْ سُنَنِ الصّلَاةِ.

অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামাযের বিবরণদাতা সবাই জলসায়ে ইস্তিরাহাতের কথা উল্লেখ করেননি; তা রয়েছে কেবল আবু হুমায়দ৬ ও মালিক ইবনে হুওয়াইরিস রা.-এর বর্ণনায়। যদি এই বৈঠক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামাযের সাধারণ আমল হত তাহলে তাঁর নামাযের বিবরণদাতা সবাই তা উল্লেখ করতেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসেছেন- শুধু এতটুকুর দ্বারা এটা নামাযের সুন্নত বলে প্রমাণিত হয়ে যাবে না; তবে যদি জানা যায়, তিনি তা অনুসরণীয় সুন্নত হিসেবে করেছেন। পক্ষান্তরে যদি বোঝা যায়, তিনি ওজরের কারণে করেছেন তাহলে এটা নামাযের সুন্নত বলে প্রমাণিত হবে না। -যাদুল মাআদ ফী হাদয়ি খাইরিল ইবাদ ১/২৩৩-৩৪

৩. ইমাম ইবনে রজব রাহ. (৭৯৫ হি.)। তিনিও একাধারে হাদীস ও ফিকহের ইমাম। তিনি তাঁর সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে উল্লেখ করেছেন-

وحملوا حديث مالك بن الحويرث على مثل ذلك، وأن النبي صلى الله عليه وسلم كان يقعد أحيانا لمّا كبر وثقل بدنه؛ فإن وفود العرب إنما وفدت على النّبيّ صلى الله عليه وسلم في آخر عمره. ويشهد لذلك أن أكابر الصحابة المختصين بالنبي صلى الله عليه وسلم لم يكونوا يفعلون ذلك في صلاتهم، فدل على أنهم علموا أن ذلك ليس من سنن الصلاة مطلقاً.

অর্থাৎ যারা জলসায়ে ইস্তিরাহাতকে সুন্নত মনে করেন না তারা মালিক ইবনে হুওয়াইরিস (রা.)-এর হাদীসের এই ব্যাখ্যা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কখনো জলসায়ে ইস্তিরাহাত করেছেন- যখন তাঁর শরীর ভারী হয়ে গিয়েছিল। কেননা আরবের প্রতিনিধিরা (যাদের একজন মালিক ইবনে হুওয়াইরিস রা.) তাঁর কাছে জীবনের শেষ দিকেই এসেছিলেন। বড় বড় এবং বিশিষ্ট সাহাবীদের জলসায়ে ইস্তিরাহাত না করা এ ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে। এই সাহাবীদের জলসায়ে ইস্তিরাহাত না করা থেকে বোঝা যায়, তাঁরা জেনেছেন, এটা নামাযের সাধারণ সুন্নত না। -ফাতহুল বারী, ইবনে রজব ৫/১৪৪

গাইরে মুকাল্লিদ বন্ধুদের আস্থাভাজন একাধিক সালাফী আলেমও একই কথা বলেছেন যে, প্রথম ও তৃতীয় রাকাতে দুই সিজদা সম্পন্ন করার পর সুন্নত হল, না বসে সোজা দাঁড়িয়ে যাওয়া। তবে অসুস্থতা বা অন্য কোনো ওজর থাকলে জলসায়ে ইস্তিরাহাত করা যাবে।

শায়েখ মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ আলউসায়মীন (১৪২১ হি.) জলসায়ে ইস্তিরাহাতের হুকুম সম্পর্কিত একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন-

للعلماء في جلسة الاستراحة ثلاثة أقوال:

القول الأول: الاستحباب مطلقاً.

القول الثاني: عدم الاستحباب مطلقاً.

القول الثالث: التفصيل بين من يشق عليه القيام مباشرة فيجلس، ومن لا يشق عليه فلا يجلس...

وهذا القول هو الذي أميل إليه أخيراً، وذلك لأن مالك بن الحويرث قدم على النبي صلى الله عليه وسلم وهو يتجهز في غزوة تبوك، والنبي صلى الله عليه وسلم في ذلك الوقت قد كبر وبدأ به الضعف، وفي صحيح مسلم ص ৫০৬، تحقيق محمد فؤاد عبد الباقي عن عائشة - رضي الله عنها - قالت: >لما بدن رسول الله صلى الله عليه وسلم وثقل كان أكثر صلاته جالساً<. وسألها عبد الله بن شقيق هل كان النبي صلى الله عليه وسلم يصلي وهو قاعد؟ قالت: >نعم، بعدما حطمه الناس<. وقالت حفصة - رضي الله عنها -: >ما رأيت النبي صلى الله عليه وسلم يصلي في سبحته قاعداً حتى كان قبل وفاته بعام، فكان يصلي في سبحته قاعداً<. وفي رواية: >بعام واحد أو اثنين<. وكل هذه الروايات في صحيح مسلم. ويؤيد ذلك أن في حديث مالك بن الحويرث ذكر الاعتماد على الأرض، والاعتماد على الشيء إنما يكون عند الحاجة إليه...

জলসায়ে ইস্তিরাহাতের ব্যাপারে আলেমদের তিনটি মত রয়েছে। প্রথম মত হল, তা করা মুস্তাহাব। দ্বিতীয় মত হল, তা মুস্তাহাব নয়। তৃতীয় মত হল, যার জন্য সরাসরি দাঁড়ানো কষ্টকর সে বসবে আর যার জন্য সরাসরি দাঁড়ানো কষ্টকর নয় সে বসবে না।

সর্বশেষ এ মতটিই আমার কাছে অগ্রগণ্য মনে হয়। এর কারণ হল, মালিক ইবনে হুওয়াইরিস রা. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ঐ সময় এসেছেন, যখন তিনি তাবুকের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।৭ এই সময়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শারীরিক দুর্বলতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। সহীহ মুসলিমে আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীর ভারী হয়ে গিয়েছিল তখন তিনি অধিকাংশ নামায বসে পড়তেন।

আবদুল্লাহ ইবনে শাকীক তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বসে নামায পড়তেন?

বললেন, হাঁ, যখন মানুষ তাঁকে বৃদ্ধ করে দিল।

হাফসা রা. বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কখনো বসে নফল নামায পড়তে দেখিনি। মৃত্যুর এক বছর আগে তিনি বসে নফল পড়তেন। অন্য বর্ণনায় আছে, মৃত্যুর এক বছর বা দুই বছর আগে। এসকল বর্ণনা সহীহ মুসলিমে রয়েছে।

এ ব্যাখ্যার সমর্থন এখান থেকেও পাওয়া যায় যে, মালিক ইবনে হুওয়াইরিসের বর্ণনায় জমিনে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর কথা আছে। আর ভর তো প্রয়োজনের সময়ই দেওয়া হয়। -ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম ৩৩০-৩৩২ (প্রশ্ন নং ২৫৩)

শায়েখ সালেহ ইবনে ফাওযান আলফাওযান তার তাসহীলুল ইলমাম বি-ফিকহিল আহাদীস মিন বুলূগিল মারাম গ্রন্থে লিখেছেন-

وإنما فعلها النبي صلى الله عليه وسلم للحاجة في آخر حياته لما ثقل، ولم يفعلها على أنها تشريع وأنها من سنن الصلاة، لأنه إنما كان هذا في آخر حياته صلى الله عليه وسلم لما ثقل، حيث لم يأمر بها، ولم يُعَلِّمْهَا للناس... وهي إنما تباح لمن احتاج إليها من مريض أو ثقيل الجسم أو كبير السن، وهي ليست سنة من سنن الصلاة.

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জলসায়ে ইস্তিরাহাত জীবনের শেষ দিকে প্রয়োজনের কারণে করেছেন- যখন তাঁর শরীর ভারী হয়ে গিয়েছিল। এজন্য করেননি যে, এটা নামাযের সুন্নত। কেননা এটা তিনি জীবনের শেষ দিকে শরীর ভারী হয়ে যাওয়ার পর করেছেন এবং অন্য কাউকে এর আদেশ করেননি, শিক্ষা দেননি। তাই এই বৈঠক কেবল ওই ব্যক্তির জন্য মুবাহ, যার প্রয়োজন হয়, যেমন অসুস্থ, ভারী, বৃদ্ধ। এটা নামাযের সুন্নত নয়। -তাসহীলুল ইলমাম বি-ফিকহিল আহাদীস মিন বুলূগিল মারাম ২/২৬১ হ

 

টীকা :

১. এই বৈঠককে কিতাবের পরিভাষায় জলসায়ে ইস্তিরাহাত (বিশ্রাম নেওয়ার বৈঠক) বলা হয়। বৈঠকটির নাম থেকেই বোঝা যায়, এটা নামাযের সাধারণ নিয়ম নয়; বরং প্রয়োজনের সময়কার বিধান।

২. ইমাম আহমাদ রাহ.-এর এ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, জলসায়ে ইস্তিরাহাত করা সম্পর্কে শুধু মালিক ইবনে হুওয়াইরিস রা.-এর হাদীসই সহীহ। এ বিষয়ে এ ছাড়া অন্য কোনো বর্ণনা সঠিক নয়। এ থেকে বোঝা যায়, আবু হুমায়দ রা.-এর হাদীসের একটি বর্ণনায় যে জলসায়ে ইস্তিরাহাত করার কথা উল্লেখিত হয়েছে সে বর্ণনাটি সঠিক নয়।

তার কারণ হল, এই হাদীসে জলসায়ে ইস্তিরাহাত করার কথা আছে কি না- এ ব্যাপারে রাবীদের ইখতিলাফ হয়েছে। আবু হুমায়দ রা.-এর একজন শাগরেদ হল মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে আতা। তার থেকে হাদীসটি তাঁর একাধিক শাগরেদ বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে শুধু আবদুল হামীদ ইবনে জাফরের বর্ণনায় জলসায়ে ইস্তিরাহাত করার কথা রয়েছে। কিন্তু তার অপর শাগরেদ ঈসা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মালিকের বর্ণনায় জলসায়ে ইস্তিরাহাত না করার কথা রয়েছে। তার বর্ণনার আরবী পাঠ হল-

ثُمّ قَالَ: اللهُ أَكْبَرُ فَسَجَدَ فَانْتَصَبَ عَلَى كَفّيْهِ وَرُكْبَتَيْهِ وَصُدُورِ قَدَمَيْهِ وَهُوَ سَاجِدٌ، ثُمّ كَبّرَ فَجَلَسَ فَتَوَرّكَ وَنَصَبَ قَدَمَهُ الْأُخْرَى، ثُمّ كَبّرَ فَسَجَدَ، ثُمّ كَبّرَ فَقَامَ وَلَمْ يَتَوَرّكْ.

এরপর তিনি তাকবীর বলে সিজদা করেন। সিজদায় হাতের তালু, হাঁটু ও পায়ের অগ্রভাগের উপর ভর করেন। এরপর তাকবীর বলে নিতম্বের উপর ভর করে বসেন এবং অপর পা দাঁড় করিয়ে রাখেন। তারপর তাকবীর বলে সিজদা করেন। তারপর তাকবীর বলে দাঁড়িয়ে যান, বসেননি।

এ বর্ণনাটি ইমাম আবু দাউদ রাহ. (২৭৫ হি.) তাঁর সুনান গ্রন্থে বর্ণনা করে মৌনতা অবলম্বন করেছেন এবং ইমাম ইবনে হিব্বান রাহ. (৩৫৪ হি.) তাঁর সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। দ্রষ্টব্য : সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৭৩৩সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৮৬৬

ইমাম ইবনে রজব রাহ. এ বর্ণনা উদ্ধৃত করে বলেন-

وهذه الرواية صريحة في أنه لم يجلس بعد السجدة الثانية. ويدل عليه: أن طائفة من الحفاظ ذكروا أن حديث أبي حميد ليس فيه ذكر هذه الجلسة.

মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে আতার আরেক শাগরেদ মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে হালহালার বর্ণনায় জলসায়ে ইস্তিরাহাত করা-না করা কোনোটাই নেই। (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ৮২৮)

এমনিভাবে আবু হুমায়দ রা.-এর অপর শাগরেদ আব্বাস ইবনে সাহলের বর্ণনায়ও জলসায়ে ইস্তিরাহাত করা-না করা কোনোটাই নেই। (দ্র. সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৮৭১)

তো আবদুল হামীদ ইবনে জাফরের বর্ণনাটি অন্যান্য রাবীর বর্ণনা থেকে ভিন্ন। আর তিনি উচ্চস্তরের সিকা রাবী নন। এ কারণে ইলাল শাস্ত্রের নীতি অনুযায়ী তার বর্ণনাটি সন্দেহপূর্ণ। ইমাম আহমাদের উপরিউক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যায় ইবনে রজব রাহ. লিখেছেন-

هذا يدل على أن ما روي فيه هذه الجلسة من الحديث غير حديث مالك بن الحويرث، فإنه غير محفوظ، فإنها قد رويت في حديث أبي حميد وأصحابه في صفة صلاة النبي صلى الله عليه وسلم.

এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, মালিক ইবনে হুওয়াইরিস রা.-এর হাদীস ছাড়া জলসায়ে ইস্তিরাহাত করা সম্পর্কে অন্য যে বর্ণনা রয়েছে তা সঠিক নয়। যেমন আবু হুমায়দ রা.-এর বর্ণনা। -ফাতহুল বারী ৫/১৩৯

এই বর্ণনা থেকে পরিষ্কার যে, দ্বিতীয় সিজদার পর বসেননি। এটা এখান থেকেও বোঝা যায় যে, একদল হাফিযুল হাদীস উল্লেখ করেছেন, আবু হুমায়দ রা.-এর হাদীসে এই বৈঠকের কথা নেই। -ফাতহুল বারী ৫/১৪০

৩. অথবা চতুর্থ রাকাতে এটা কোনো রাবীর সন্দেহ। অন্য বর্ণনায় স্পষ্ট আছে, প্রথম ও তৃতীয় রাকাতে বসতেন। দ্র. শরহু মাআনিল আসার ৪/৫৮২

৪. মালিক ইবনে হুওয়াইরিস রা. নবীজীর কাছে এসে বিশ দিনের মত থাকেন। তারপর বসরা চলে যান।  সেখানেই ৯৪ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারীবর্ণনা ৬৮৫; উসদুল গাবা ফী মারিফাতিস সাহাবা ৪/২৪৫

৫. ইমাম ইবনুল হুমাম রাহ. এই সাহাবীদের আমলের কথা উল্লেখ করে বলেন-

فَقَدْ اتّفَقَ أَكَابِرُ الصّحَابَةِ الّذِينَ كَانُوا أَقْرَبَ إلَى رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، وَأَشَدّ اقْتِفَاءً لِأَثَرِهِ، وَأَلْزَمَ لِصُحْبَتِهِ مِنْ مَالِكِ بْنِ الْحُوَيْرِثِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ، عَلَى خِلَافِ مَا قَالَ، فَوَجَبَ تَقْدِيمُهُ. وَلِذَا كَانَ الْعَمَلُ عَلَيْهِ عِنْدَ أَهْلِ الْعِلْمِ كَمَا سَمِعْته مِنْ قَوْلِ التِّرْمِذِيِّ.

অর্থাৎ বড় বড় সাহাবীগণ, যারা মালিক ইবনে হুওয়াইরিস রা. অপেক্ষা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেশি কাছের ছিলেন, তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণে অধিক আগ্রহী ছিলেন এবং তাঁর সাহচর্য বেশি লাভ করেছেন, তাঁরা ব্যাপকভাবে মালিক ইবনে হুওয়াইরিস রা.-এর বর্ণনার বিপরীত আমল করেছেন। সুতরাং (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আসল সুন্নত কী ছিল তা বোঝার ক্ষেত্রে) তাঁদের (এই ব্যাপক ও অনুসৃত) কর্মকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এজন্যই আহলে ইলম এই অনুযায়ী আমল করতেন যেমনটি তিরমিযীর যবানে শুনেছেন। -ফাতহুল কাদীর ১/৩১৫

শায়েখ আবদুল্লাহ ইবনে সালেহ আলফাওযান এই সাহাবীদের আমলের কথা উদ্ধৃত করে লেখেন-

وهؤلاء من أحرص الناس على مشاهدة أفعال النبي صلّى الله عليه وسلّم وهيئاته في الصلاة، وقد ساق ابن المنذر، ومن قبله ابن أبي شيبة ما ورد عن هؤلاء الصحابة رضي الله عنهم بأسانيد صحيحة.

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামাযের পদ্ধতি প্রত্যক্ষ করার জন্য এই সাহাবীগণ অধিক আগ্রহী ছিলেন। ইবনুল মুনযির ও ইবনে আবী শাইবা তাঁদের জলসায়ে ইস্তিরাহাত না করার কথা সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। -মিনহাতুল আল্লাম ফী শরহি বুলূগিল মারাম ৩/১২১-২২

৬. আবু হুমায়দ রা.-এর এই বর্ণনা সম্পর্কে পেছনে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।

৭. তাবুকের যুদ্ধ ৯ হিজরীতে সংঘটিত হয়।

 

 

advertisement