রবিউল আখির ১৪৪৪   ||   নভেম্বর ২০২২

নারায়ে তাকবীরেই বিএনপির অস্বস্তি
এর পরও কি এই দলের প্রয়োজন থাকে?

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

একসময় আলকাউসারের পাতায় রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে মনের কিছু কথা বললেও পরে তা প্রায় ছেড়েই দেওয়া হয়েছে। একবার এক বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব হারাম শরীফে বলেছিলেন, এগুলো নিয়ে আপনার না বললেও হয়। হয়তো তিনি নিরাপত্তার কোনো বিষয়ও ভেবেছিলেন। আমি বলেছি, হযরত আমার তো এসব বিষয়ে আগ্রহ নেই। শুধু দেশ ও জনস্বার্থে এসব কথা বলা হয় অথবা অন্যরা অনুরোধ করলে লিখি। আসলে প্রচলিত রাজনীতি সাধারণ বা ধর্মীয় কোনোটির প্রতিই ছাত্রকাল থেকেই আগ্রহ ছিল না। কিন্তু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি তো চোখের সামনে ছিলই। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ইসলামী রাজনীতির শুরুটাও আমাদের চোখের সামনে দিয়ে হয়েছে। তাই পর্যবেক্ষণে তো সবকিছুই থাকে। আজকে যে বিষয়ে দুয়েকটি কথা আরজ করতে চাই, তা মূলত রাজনৈতিক নয়। যদিও রাজনৈতিক দলকে কেন্দ্র করেই।

আমরা সকলেই জানি, বাংলাদেশে দুটো বড় রাজনৈতিক দল- আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা তো পাকিস্তান আমলে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির প্রতিষ্ঠা জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। এ দুটি দলকে কেন্দ্র করে শুধু তাদের নেতা-কর্মীই নয়; বরং তাদের অনুসারী সমর্থকদের মধ্যেও একটা সুস্পষ্ট বিভক্তি যুগ যুগ ধরে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ছাত্র, শিক্ষক, পেশাজীবী, প্রচার-মাধ্যমকর্মী, বুদ্ধিজীবী সব শ্রেণিতেই চিন্তাগত দুটো ধারা দেশে বিদ্যমান ছিল। এই বিভক্তি কিছু ক্ষেত্রে ছিল আদর্শিক ও মৌলিক, কিছু ক্ষেত্রে ছিল নেহায়াত ক্ষমতা কেন্দ্রিক। যা হানাহানি, মারামারি ও তিক্ততা পর্যন্ত গড়িয়ে দেশ ও জাতির ক্ষতি করেছে অনেক। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ এবং তার পরম প্রভাবশালী নেতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের পরেও একটি নতুন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে কীভাবে জনপ্রিয়তা গড়ে তুলল এবং একাধিক বার ক্ষমতায় আসীন হল- এ আলোচনায় একটু পরে আসছি। মূল যে বিষয়টিকে নিয়ে আজকের আলোচনার সূত্রপাত সেটির দিকে আগে নজর দেওয়া যাক।

সম্প্রতি রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের খবরাখবর ও কথাবার্তাও খুব কম পড়া হয়। একধরনের অনীহা ও হতাশাও কাজ করে। সংবাদটি আসলে কেউ আমাকে পাঠিয়েছেন। চট্টগ্রামে  বিএনপির কোনো এক জনসভায় এক নেতা নারায়ে তাকবীর ধ্বনী তুলেছিলেন। উপস্থিত জনতা ব্যাপক উৎসাহে তাঁর সঙ্গে আল্লাহু আকবার বলেছিল। এর পরই বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠী এবং একশ্রেণির চিহ্নিত গণমাধ্যমে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। বিএনপির কিছু বড় নেতাও এ নিয়ে চরম হীনম্মন্যতার পরিচয় দেন। এ স্লোগান তাদের নয়, এর সাথে তাদের দলের কোনো সম্পর্ক নেই- এমন বিবৃতি দিতে থাকেন।

কিছুদিন এ নিয়ে ব্যাপক হইচই হল। শাহবাগে গুটি কয়েক লোক প্রতিবাদ সমাবেশও করে ফেলল।

যে বিষয়টি নিয়ে এত বিতর্ক প্রথমে দেখা যাক সেটি আসলে কী ছিল? বিএনপির যে নেতা এ স্লোগান দিয়েছেন তার নাম হুম্মাম কাদের চৌধুরী। তিনি সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরীর ছেলে। যাঁর পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন তাৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার। সে সুবাদে কখনো রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন। সে সময়কার বিরোধীদল আওয়ামী লীগের প্রবীণ সংসদ সদস্যদের -যারা এখন মরহুম হয়ে গেছেন- বিভিন্ন লেখায় ফজলুল কাদের চৌধুরী সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় পড়া হয়েছিল। সেসব কথা থাকুক। মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি।

হুম্মাম কাদের তাঁর বক্তব্যের শেষে নারায়ে তাকবীর ধ্বনি তোলেন, যা নিয়ে এত কথা। নারায়ে তাকবীর শব্দটি কি বাংলাদেশে নতুন? এদেশের গণ মানুষের কাছে অজানা অচেনা? এটা কি কোনো দেশদ্রোহী বা সাম্প্রদায়িক শব্দ? এর অর্থই বা কী? আমার মনে হয়, সাধারণ লোকও এটা জানে এবং এ স্লোগানের সাথে পরিচিত যে, নারায়ে তাকবীর মানে তাকবীর ধ্বনি তোলো। তাকবীর মানে হচ্ছে, আল্লাহ সবচেয়ে বড়, সর্বশ্রেষ্ঠ- এ কথা বলা।

আল্লাহু আকবার এমন একটি বাক্য, যা শুনে মুসলমানদের ঘুম ভাঙে। রাত দিন ২৪ ঘণ্টার প্রতিটি মুহূর্তেই পৃথিবীর কোনো না কোনো এলাকায় আল্লাহু আকবার উচ্চারিত হতে থাকে।   সময়ের ব্যবধানের কারণে পৃথিবীর কোনো না কোনো অঞ্চলে আযান হতে থাকে। কোনো না কোনা অঞ্চলের মানুষজন নামাযরত থাকেন। আর নামাযে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা বাক্য হচ্ছে আল্লাহু আকবার। আল্লাহু আকবারের ফরজ তাকবীর বলেই নামায শুরু করতে হয়। একসময় আল্লাহু আকবারই হয়ে ওঠে সত্য ও ন্যায়ের পথে লড়াইকারীদের প্রেরণা ও সাহসের প্রথম উৎস। বড় থেকে বড় বাতিলপন্থী ও জালিমের বিরুদ্ধে যুগে যুগে যারা সোচ্চার হয়ে উঠেছেন তাঁরা আল্লাহু আকবার ধ্বনিতেই প্রেরণা পেয়েছেন এবং কর্মী ও অনুসারীদের অনুপ্রাণিত করেছেন। কেন? এজন্য যে, জালিমশাহী, আগ্রাসী, স্বৈরাচার বা দুশমন বাহ্যিক দৃষ্টিতে যত শক্তিশালীই হোক আল্লাহর মহত্ব ও শক্তির কাছে একেবারেই তুচ্ছ। সম্ভবত এসব বিবেচনাতেই আল্লাহু আকবারের স্লোগান মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয়।

সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক বিভিন্ন প্রসঙ্গে আল্লাহু আকবার ধ্বনিত করার কথা হাদীসের কিতাবগুলোতেও পাওয়া যায়। সে আল্লাহু আকবার ধ্বনি তোলার জন্যই বলা হয়ে থাকে- নারায়ে তাকবীর। যেমনিভাবে কোনো কোনো দল বলে থাকে, জয় বাংলা। কেউ বলে থাকে, নেতা আছে? অন্যরা বলে, অমুক ভাই।

নারায়ে তাকবীর স্লোগান নিয়ে সাম্প্রতিক এ বিতর্ক দেখে অবাক হলেও আমি হতবাক হইনি। কারণ, বিগত কিছু বছর থেকে একশ্রেণির গণমাধ্যম ও তথাকথিত লেখক বুদ্ধিজীবী সম্ভবত পেইড এজেন্ট হিসেবেই এ কাজে নিয়োজিত আছেন। তাদের প্রধান কাজই হল, ইসলাম, মুসলমান এবং এ দেশ ও জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও স্বার্থের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া। তারা এদেশের আলো বাতাস ও যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও বরাবরই অন্যের গান গেয়ে থাকেন। এবং মিথ্যা দশ বার বললে সত্য হয়ে যায় সে কুখ্যাত উক্তিকে আরও সম্প্রসারিত করে একটি মিথ্যাকে শত শত বার বলতে থাকেন। যা দ্বারা এ নতুন প্রজন্মের মধ্যে মিথ্যা ইতিহাস ও ভুল সংস্কৃতি বিস্তারে তাঁরা কিছুটা সফলও হয়েছেন। তাঁদেরকে নিয়েও আজকে আমার আলোচনা নয়। আমার আলোচনার বিষয়বস্তু বিএনপির প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের হাল আমলের নেতারাও নয়।  কারণ, তাদের চিন্তা-চেতনা ও ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন বিষয়ে তাদের অবস্থান কারও কাছে অজানা নয়।

যে বিষয়ের দিকে আমি পাঠক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই তা হচ্ছে, এই বিএনপি আসলে কোন্ বিএনপি? যে বিএনপির নেতারা নারায়ে তাকবীর স্লোগানকে অস্বীকার করে; এর সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই, এটি নিতান্তই একজনের ব্যক্তিগত স্লোগান- এসব কথা বলেন। কেন? কার ভয়ে ভীত হয়ে বা কোন্ দেশী-বিদেশী প্রভুর প্রলোভনে আশান্বিত হয়ে তারা এমনটি বলছেন! শুধু আল্লাহু আকবারই নয়, বরং সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি মহাসচিব (যিনি মূলত দলীয় প্রধানের ভূমিকাও পালন করে থাকেন) মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কিছু কথাও দেশের সাধারণ মানুষ খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছে। যেমন তিনি বলেছেন, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। আবার বলেছেন, কুরআনের সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই।

একথা সত্য যে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি কোনো ইসলামী রাজনৈতিক দল নয়। তাদের দলের মেনিফেস্টোতে ইসলামী সরকার গঠনের কথাও নেই। কিন্তু বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এবং এ দল প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ও প্রাসঙ্গিক বিষয়টি দেখলে আর বিগত দশকগুলোতে বিএনপির রাজনীতির বাহ্যিক দিকগুলো প্রত্যক্ষ করলে যে কেউই এ পরিবর্তন এবং এ ধরনের কথাবার্তায় বিস্মিত হবেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর একটি সংবিধান তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সংবিধানের খসড়া তৈরির জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত হয় একটি উপকমিটি। মুক্তিযোদ্ধা এবং এ দেশের জনগণ দেশ স্বাধীন করলেও সংবিধান প্রণয়নের জন্য তিনি চলে যান ভারতে। সেখান থেকে যা নিয়ে আসা হয় সেটি পরে এখানে ঘষামাজা করে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান হিসেবে ঘোষিত হয়। সে সংবিধানের প্রস্তাবনায় যে চারটি মূলনীতির কথা বলা হয়েছে। অনেকের মতেই তাতে এ দেশের গণমানুষের এমনকি জান বাজি রেখে লড়াই করা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধাগণের আশার প্রতিফলন ঘটেনি। কারণ, সংবিধানের প্রস্তাবনায় যে চারটি মূলনীতি দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে দুটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলায় হয়, আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।

নতুন প্রণীত এ সংবিধান দেখে শুধু ধর্মপ্রাণ গণমানুষই হতাশ হননি, হতাশ হয়েছেন অনেক মুক্তিযোদ্ধাও। কারণ, দীর্ঘদিনের আগ্রাসী ব্রিটিশ শাসনের পতনকালে যখন উপমহাদেশের স্বাধীনতার শুভক্ষণ ঘনিয়ে আসে তখন এ অঞ্চলের বড় বড় নেতাসহ (যাদের মধ্যে ছাত্রনেতা হিসেবে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন) বড় বড় মুসলিম নেতারা দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য যে পৃথক আবাসভূমি চেয়েছিলেন- তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭ সালে গঠিত হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি আলাদা দেশ। সে পাকিস্তানেরই জনসংখ্যার দিক থেকে বৃহৎ অংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান, যা আজকের বাংলাদেশ। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা এ অঞ্চল শাসন করে এসেছে। দেশের বৃহৎ অঞ্চলের উন্নয়নে পশ্চিমাঞ্চলের মতো নজর দেওয়া হয়নি। বহু ক্ষেত্রেই বৈষম্য কাজ করেছে। এছাড়া বারবারের সামরিক শাসন এবং এ অঞ্চলের লোকদের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় জায়গা দিতে না চাওয়া- এসব বিষয়ের প্রতিবাদের দীর্ঘ গণআন্দোলন হয়েছে। সর্বশেষ ১৯৭০ -এর জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার করায় প্রথমে ব্যাপক গণআন্দোনল, যা দমিয়ে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের দমন পীড়ন এবং সর্বশেষ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।

স্বাধীনতা পূর্ববর্তী দীর্ঘ সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় কখনো ধর্মনিরপেক্ষতা বা সমাজতন্ত্র মূল বিষয় হিসেবে উপস্থাপিত হয়নি। ইসলাম বা ইসলামী আদর্শকে প্রতিপক্ষ করা হয়নি; বরং মূল বিষয়টাই ছিল পাকিস্তানী শাসকদের জুলুম, বৈষম্য এবং এ অঞ্চলের লোকদের শাসন মেনে নিতে অনীহার প্রসঙ্গটি। সঙ্গত কারণেই সে সময়ের নবগঠিত দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রটির জনগণ হতাশ হয়েছে। এরপর বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের মাধ্যমে পার হয়ে যায় ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল। এর মধ্যে চার বার সংবিধানের অপারেশন হয়েছে। আনা হয়েছে সংবিধানের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ সংশোধনী। কিন্তু কোনোটিতেই ধর্মনিরপেক্ষতা বা সমাজতন্ত্রকে বাদ দেওয়া হয়নি। যদিও কার্ল মার্ক্স, লেনিন বা মাওসেতুংয়ের সমাজতন্ত্র, যেটিকে লক্ষ করে ঐ সময়কার আওয়ামী লীগের একটি অংশ সংবিধানে তা বসিয়েছিল, সে সমাজতন্ত্র বাংলাদেশে কখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবুও সংবিধানে সেটি রেখে দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারের প্রধান দুশমনও ছিল এ সমাজতন্ত্রীরাই। কালের বিবর্তনে যাদের উত্তরসূরিরা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিত্ব ও এমপিত্বের হালুয়া-রুটিও ভোগ করেছেন।

যাইহোক, মূল কথায় আসি। ২০১১ সনে যখন সংবিধানে সংশোধনী আনা হল তখন একবার বলেছিলাম, যে নতুন সংশোধনী এনে সংবিধানকে আবার ৭২ সনে ফিরিয়ে নেওয়া হল, সমাজতন্ত্রও ফিরিয়ে আনা হল, সমাজতান্ত্রিক মেনন-ইনুরা মন্ত্রী হলেন, এ ধারার অনেকে এমপিও হলেন- তাঁরা সংসদে বা কেবিনেটে দেশে সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য আওয়াজ ওঠান না কেন? যাক সে কথা।

সংবিধানে চারটি সংশোধনী হলেও ধর্মনিরপেক্ষতা সেখান থেকে বাদ যায়নি। এরপর ঘটে যায় ৭৫ -এর ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনা। কয়েক মাসের ঘাত-প্রতিঘাত ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির পর ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। প্রথমে সামরিক শাসনের মাধ্যমে শাসন শুরু করে পরবর্তীতে রাজনৈতিক দল গঠন করে জাতীয় নির্বাচন দেন। এর পরেই আনা হয় সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী। সে সংশোধনীতে অন্যান্য বিষয়াদির সাথে মৌলিক যে বিষয়টি ছিল তা হচ্ছে, সংবিধানের মূলনীতির পরিবর্তন। ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস এবং সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যা প্রদান করে অর্থাৎ সামাজিক সাম্য ন্যায় বিচার বাক্য সংযোজন ছিল এই সংশোধনীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এছাড়া সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীমও যুক্ত করা হয়। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসার পর ১৯৭৪ সালের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা শুধু একদলীয় বাকশালী রাজনীতি বাতিল করে বহুদলীয় গণতন্ত্রই প্রতিষ্ঠা করেননি; বরং ধর্মীয় রাজনীতি, যা এর আগে নিষিদ্ধ ছিল তারও অনুমোদন দেন। অনেকেই মনে করেন, এটিই ছিল বাংলদেশে রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট।

আওয়ামী লীগের রাজনীতির ইতিহাস তো পুরোনো। সোহরাওয়ার্দী ভাসানী থেকে আরম্ভ করে বহু বড় বড় নেতা এ দলে ছিলেন। তাদের কর্মী-সমর্থকের অভাব ছিল না কোনো কালেই। কিন্তু একজন সেনাপ্রধান, যার কোনো রাজনীতি করার সুযোগ ছিল না, তিনি কীভাবে এমন একটি রাজনৈতিক দলের গোড়াপত্তন করলেন, যা কিছুদিনের মধ্যে হয়ে উঠল দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল! কী করণে দেশের ছাত্র ও সাধারণ জনতা তাতে ভিড় জমাল। যদিও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনাকালে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার কারণে (মতান্তরে ঘোষণাপত্র পাঠ করে) এবং মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার হিসাবে জিয়াউর রহমানের একটি খ্যাতি ছিল। কিন্তু সেনানিবাস থেকে এসে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে নবগঠিত দলকে জনপ্রিয়তা এনে দেওয়া এবং দীর্ঘদিনের পুরোনো ও স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামীলীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনের শক্তিটা কী ছিল? সুস্পষ্টতই তা হচ্ছে, এ দেশের জনগণের বিশাল শ্রেণির ধর্মীয় আবেগ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি নমনীয় মনোভাব। সেই তখন থেকেই ইসলাম ও মুসলিম সংস্কৃতি বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দল হিসেবে অলিখিত একটা বিভাজন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। যদিও বিএনপিতেও কিছু বামপন্থী ও সেক্যুলার মনোভাবের লোক ছিল। অন্য দিকে দলীয় আদর্শে অবিচল থেকেও আওয়ামী লীগের কিছু কিছু নেতাও ধর্মীয় বিষয়ে সহনশীল ও সহযোগিতা ভাবাপন্ন ছিলেন। কিন্তু উভয় দলেই এ ধরনের লোকেরা আদর্শিক প্রশ্নে কোণঠাসা ছিলেন।

যাইহোক, কথা লম্বা হয়ে যাচ্ছে। বলছিলাম, একজন সামরিক শাসক কর্তৃক একটি নবগঠিত দলের ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়ার পেছনের কাহিনী। জিয়াউর রহমানও বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। ১৯৮১ সালেই তাকে হত্যা করা হয়। এর পরও তার দল এগিয়ে গেছে এবং জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের সময়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে ছিল এই বিএনপি। এরপর দু দু বার ক্ষমতায়ও এসেছে তারা। জানি না, বিএনপির এখনকার সাংগঠনিক শক্তি বা জনসমর্থন কতটুকু আছে। তবে সরকারের লোকজন এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রতিদিনের বক্তব্যগুলোর শিরোনাম সংবাদপত্রে দেখলে তো মনে হয় বিএনপি এখনো অনেক শক্তিশালী। কারণ, সে ২০১৪ সাল থেকেই কাগজে কলমে সংসদে প্রধান বিরোধী দল হচ্ছে জাতীয় পার্টি। কিন্তু সরকার বা সরকারি দল সেই বিরোধী দলের বিরোধিতা কখনো করেন না; বরং বিএনপি এবং বিএনপির নেতারাই তাদের প্রধান টার্গেট থাকে। মনে হয়, আওয়ামী লীগের দৃষ্টিতেও বিএনপি এখনো শক্তিশালী দল।

যাইহোক, এসব বিচার তো রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহল ও সাধারণ জনগণই করবেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির হাল আমলের রাজনীতি নিয়ে। সাম্প্রতিক কিছু নড়াচড়া ও হইচইয়ে মনে হয় বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু সেটার জন্য তারা কী কৌশল নিয়েছে? তাদের কিছু কিছু নেতার আচার-আচরণে তো মনে হয়, তারা ভাবছে তাদেরকেও পাশর্^বর্তী একটি রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। আর বিদেশীদের কাছে ধরনা-নালিশ দিয়ে আগে কিছু অর্জন না করতে পারলেও এখন হয়তো তা কাজে লেগে যাবে। সে কারণেই কি না বিএনপির শীর্ষ নেতারাও এখন তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠাকালীন মূল প্রেরণা থেকে দূরে সরে গিয়ে প্রতিপক্ষের বুলিই আওড়াচ্ছেন। নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ বা ইসলামমুক্ত প্রকাশ করার বিভিন্ন কসরত করে যাচ্ছেন। নারায়ে তাকবীর স্লোগানের বিরোধিতা, মির্জা ফখরুলের সাম্প্রতিক বক্তব্য- কুরআনের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নেই, দুর্গার আবির্ভাব পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, ধর্ম যার যার উৎসব সবার- একই সূত্রে গাঁথা। সম্ভবত এসব দেখেই অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, তাহলে বিএনপির আর রাজনীতির কাজ কী? দেশে দুটি বড় রাজনৈতিক দল থাকার দরকারই বা কী? এমন তো না যে, গণমানুষের অধিকার আদায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্মীয় ও বিভিন্ন প্রতিবাদী সাধারণ লোকজনের উপর জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনো ভূমিকা তারা রাখতে পেরেছে! বরং দেশে গণতন্ত্র আছে- এই ভাব বিদেশীদের বোঝানোর জন্যই হয়তো বিরোধী পক্ষের গণমাধ্যমই বিএনপির রাজনীতিকে জিইয়ে রেখেছে। এখন যদি ঘোষিতভাবেই তারা দলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠাকালীন চেতনাও বিসর্জন দিয়ে দেয় তাহলে তাদের আর থাকল কী?

আসলে পৃথিবীর ক্ষণজন্মা যে কজন নেতা জনপ্রিয়তার উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন তারা সেটি পেরেছিলেন গণমানুষের মনের ভাষা বুঝতে পেরেই। এছাড়া নেতা ও দল ক্ষমতায় তো বহুভাবেই অধিষ্ঠিত হয়। জোর-জবরদস্তি, দালালী, গোলামী বহু পথে অনেকেই ক্ষমতায় আসেন ও থাকেন। কিন্তু মানুষের হাত ধরে তাদের সমর্থন নিয়ে যদি ক্ষমতায় যেতে বা থাকতে হয় তাহলে অবশ্যই গণমানুষের মনের ভাষা বুঝতে হবে। দাঁড়াতে হবে তাদের স্বার্থে ও পক্ষে। হাল আমলে বিএনপি সে পথে হাঁটছে বলে মনে হয় না। তুমুল জনপ্রিয় একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের বর্তমান করুণ দশার পেছনে হয়তো অনেক কারণই রয়েছে। এটি কি একটি নয়?

 

 

advertisement