রবিউল আউয়াল ১৪৪৪   ||   অক্টোবর ২০২২

নবীপ্রেমে উদ্দীপ্ত সাহাবা জীবনের পাঠ থেকে...

মুহাম্মাদ আশিক বিল্লাহ তানভীর

এই পৃথিবী ও পৃথিবীবাসীর উপর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে অপার ইহসান ও অনুগ্রহ রয়েছে তা গভীর থেকে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তাঁর হাতেগড়া শিষ্যকুল সাহাবায়ে কেরাম। তাদের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত ছিল এবং মুখে সদা উচ্চারিত ছিল-  আল্লাহু ওয়া রাসূলুহূ আমান্নু-আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের প্রতি সর্বাধিক অনুগ্রহকারী। এই উপলব্ধি জাগরূক ছিল বিধায় প্রিয়নবীর পুণ্যময় আদর্শ আঁকড়ে রাখতে যারপরনাই কুরবানী ও ত্যাগের নযরানা পেশ করতে পেরেছেন তাঁরা।

বস্তুত ঈমান আকীদা, বোধ বিশ্বাস, চিন্তা দর্শন, রুচি প্রকৃতি, নীতি নৈতিকতা, সভ্যতা সংস্কৃতি, আচার আচরণ, স্বভাব চরিত্রসহ যাপিত জীবনের সকল অঙ্গনে প্রিয়নবীকে একমাত্র উসওয়া ও আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে নেওয়া এবং নববী আদর্শের বিপরীতে যা কিছু প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় তা উপেক্ষা করে হৃদয়ের মণিকোঠায় শ্রদ্ধা ও ভালবাসার শ্রেষ্ঠ আসনে প্রিয় নবীকে সমাসীন করার নামই হচ্ছে নবীর প্রতি ভালবাসা। মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে এই ভালবাসার রূপ ও স্বরূপ অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। একটি আয়াত শুনুন-

قُلْ اِنْ کَانَ اٰبَآؤُكُمْ وَاَبْنَآؤُكُمْ وَ اِخْوَانُكُمْ وَاَزْوَاجُكُمْ وَعَشِیْرَتُكُمْ وَ اَمْوَالُ اقْتَرَفْتُمُوْهَا وَتِجَارَۃٌ تَخْشَوْنَ کَسَادَهَا وَمَسٰکِنُ تَرْضَوْنَهَاۤ  اَحَبَّ  اِلَیْكُمْ مِّنَ اللهِ وَرَسُوْلِهٖ  وَجِهَادٍ فِیْ سَبِیْلِهٖ فَتَرَبَّصُوْا حَتّٰی یَاْتِیَ اللهُ بِاَمْرِهٖ وَاللهُ  لَا یَهْدِی الْقَوْمَ الْفٰسِقِیْنَ .

বল, তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ্, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয়, তোমাদের বাপ-দাদা, তোমাদের সন্তান-সন্ততি, তোমাদের ভাই-বেরাদার, তোমাদের স্ত্রী-পরিজন, তোমাদের জ্ঞাতি-গোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, যা মন্দা পড়ার আশঙ্কা তোমরা করে থাক এবং তোমাদের ঘর-বাড়ি, যা তোমরা পছন্দ করে থাক, তবে অপেক্ষা কর, আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ্ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না। -সূরা তাওবা (৯) : ২৪

হাঁ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথে চলতে গিয়ে জীবনে বহু ঘাত প্রতিঘাত আসবে। মোকাবেলা করতে হবে নানা প্রতিকূলতার। সইতে হবে অনেক কষ্ট নির্যাতন। দেখা যাবে, এক মেরুতে অবস্থান করছে বাপ দাদা ও তাদের ঐতিহ্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ কিংবা বিরাজ করছে স্ত্রী পুত্র ও পরিজনের ভালবাসা অথবা সামনে চলে এসেছে সামাজিক ও জাতিগত বিভিন্ন উপলক্ষ। অপরদিকে প্রিয়নবীর নির্মল আদর্শ। জীবন চলার পথে নববী সুন্নাহ ও উসওয়ার আলো একদিকে, অপরদিক থেকে তা ম্লান করে দিতে চাচ্ছে ধন সম্পদ ও ব্যবসা বাণিজ্যের অন্যায় মোহ। প্রকৃত মুমিন সে, যে এ মুহূর্তে সুন্নাহ্র আলোয় পথ চলতে পারল, প্রাধান্য দিতে পারল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালবাসাকে এবং আল্লাহর পথে জিহাদে অবতীর্ণ হতে। মূলত এমন নির্মোহ নাযরানা তিনিই পেশ করতে পারবেন, যিনি লাভ করতে পারবেন ঈমানের স্বাদ এবং অনুভব করতে পারবেন ভালবাসার মিষ্টতা। নবীজী বলেন-

ثَلاَثٌ مَنْ كُنّ فِيهِ وَجَدَ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ: أَنْ يَكُونَ الله وَرَسُولُهُ أَحَبّ إِلَيْهِ مِمّا سِوَاهُمَا، وَأَنْ يُحِبّ المَرْءَ لاَ يُحِبّهُ إِلّا لِلهِ، وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ فِي الكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِي النّارِ.

তিনটি বৈশিষ্ট্য যার মাঝে বিরাজ করবে সে ঈমানের মিষ্টতা অনুভব করতে পারবে-

এক. আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যার কাছে অন্য সবকিছুর চাইতে অধিক প্রিয় হবে।

দুই. কাউকে ভালবাসলে শুধু আল্লাহর জন্যই ভালবাসবে।

তিন. কুফুরি থেকে আল্লাহ তাকে পরিত্রাণ দেওয়ার পর তাতে আবার ফিরে যেতে সে এতটাই অপছন্দ করে, যেমন অপছন্দ করে আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৩

আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল যাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন তাঁরা হলেন নবীজীর প্রিয় সাহাবীগণ। আল্লাহর রাসূল তাঁদের কাছে প্রিয় ছিলেন নিজ পিতা, সন্তান এবং সকল মানুষের চেয়ে; বরং নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি। জীবনের পরতে পরতে তাঁরা নবীপ্রেমের অপূর্ব দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন আমাদের জন্য। নবীজীর ভালবাসার সামনে সবকিছু বিসর্জন দিয়েছিলেন তাঁরা। নবীপ্রেমে উদ্দীপ্ত সে জীবন থেকে কিছু পাঠ গ্রহণের প্রয়াস আজকের এ নিবন্ধ।

নবীপ্রেমের সামনে সবকিছু তুচ্ছ; এমনকি নবীজীর ভালবাসার সামনে নিজ পিতার ভালবাসাও তুচ্ছ। এমন এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ রা.। এই আবদুল্লাহ ছিলেন মুনাফেক সরদার আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের পুত্র। পিতা-পুত্র উভয়ের নামই আবদুল্লাহ। পিতা নেফাক ও কপটতার নর্দমায় নিমজ্জিত থাকলেও পুত্রের অন্তর ছিল ঈমানী নূরে উদ্ভাসিত। সে যখন শুনতে পেল তার মুনাফেক বাবা বলেছে, মদীনায় গিয়ে আমাদের সম্মানিত ব্যক্তিরা নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের বের করে দেবে। অর্থাৎ নিজেদের সম্মানিত ঠাহর করে তারা মুমিনদের ব্যাপারে তাচ্ছিল্য সুরে মন্তব্য করে বলে মদীনায় গিয়ে আমরা তাদেরকে (মুমিনদেরকে) এলাকা থেকে বের করে দেব।

এ শুনে পুত্র আবদুল্লাহ যে বিস্ময়কর পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন তা উম্মতকে অনেক বড় সবক শিখিয়ে দেয়। হযরত আবদুল্লাহ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরজ করলেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর কসম সে ঠিকই বলেছে। নিশ্চয় সম্মানিতগণ মদীনার পুণ্যভূমি থেকে নিকৃষ্টদের বের করে দেবে। নিঃসন্দেহে আপনিই সম্মানিত ও শ্রেষ্ঠ আর সে নিকৃষ্ট।

ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই যে আমি মদীনায় অবস্থান করছি। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যদি চান তাহলে আমি তার (মুনাফেক বাবার) মস্তক আপনার কদমে রাখতে প্রস্তুত রয়েছি। কিন্তু নবীজী সে অনুমতি দিলেন না।

পরবর্তীতে যখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মদীনায় ফিরল পুত্র হযরত আবদুল্লাহ তরবারী হাতে বাবার পথ রোধ করে দাঁড়ালেন। আপনি বুঝি এ কথা বলেছেন- মদীনায় গিয়ে আমাদের সম্মানিত ব্যক্তিরা নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের বের করে দেবে? আল্লাহর কসম আজই আপনার জানা হয়ে যাবে, প্রকৃত সম্মানের অধিকারী কে? আপনি, না আল্লাহর রাসূল? আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুমতি ব্যতীত মদীনার আলো বাতাস ভোগ করার কোনো অধিকার আপনার নেই।

এমন পরিস্থিতিতে ভড়কে গিয়ে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই স্বজাতির সাহায্য কামনা করতে থাকে। যে কিনা মুমিনদের ঘরছাড়া করতে ফন্দি আঁটছিল আজ সে-ই নিজের ঘরে পা রাখতে এদিক ওদিক সাহায্য চাইছে! গোত্রের সকলে সমবেত হলে পুত্র আবদুল্লাহ সেই ঈমানদীপ্ত ফয়সালা শুনিয়ে দেন- তোমরা যে যাই বল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুমতি ব্যতীত একে মদীনায় প্রবেশ করতে দিতে পারি না। সবাই নবীজীর কাছে বিষয়টি উত্থাপন করলে নবীজী সংবাদ পাঠিয়ে বললেন- আচ্ছা, তাকে তার ঘরে থাকতে দাও। এ শুনে আবদুল্লাহ তার পথ ছেড়ে দিয়ে বললেন- যেহেতু নবীজী অনুমতি দিয়েছেন তাই রক্ষা পেলেন। (দ্রষ্টব্য : তাফসীরে তবারী ২৩/৪০৬; সীরাতে ইবনে হিশাম ৪/২৯২)

এ মুহূর্তে স্মরণ করতে পারি ওই আত্মত্যাগী কাফেলার কথা যেখানে উপস্থিত ছিলেন হযরত যায়েদ ও খুবায়বের মতো জানবায সাহাবী। যাদেরকে অত্যন্ত নির্মমভাবে শহীদ করা হয়। যেই নির্মমতাকে তারা প্রতিহত করেছেন নবীপ্রেমের ঢাল দিয়ে। অবশেষে শাহাদাতের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে হাসিমুখে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন!

হযরত যায়েদ ইবনে দাসিনাহ রা.-কে যখন মক্কার বাইরে তানঈম নামক স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় হত্যা করার জন্যে তখন কুরাইশের একটি দল সাথে যায় সে পাশবিকতায় শরীক হতে। সেখানে উপস্থিত ছিল মক্কার চতুর সরদার আবু সুফিয়ানও। (আবু সুফিয়ান রা. তখনও মুসলমান হননি।) হযরত যায়েদকে হত্যা করা হবে এমন মুহূর্তে আবু সুফিয়ান এগিয়ে আসে। বলে- আচ্ছা যায়েদ, আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, আমাকে বল তো, আজ যদি এ মুহূর্তে তোমার স্থানে তোমার মনিব মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদের হাতে থাকত আর তুমি তোমার পরিবারের মাঝে অবস্থান করতে তবে কেমন হত?

এমন প্রশ্নে নবীপ্রেমে উদ্বেলিত হযরত যায়েদ রা. ঈমানদীপ্ত যে জবাব দেন ইতিহাসের পাতায় তা স্বর্ণাক্ষরে সংরক্ষিত হয়েছে। তাঁর প্রতিটি শব্দ থেকে যেন নির্গত হচ্ছিল ঈমানের বারুদ ও নবীপ্রেমের স্ফুলিঙ্গ। হযরত যায়েদ বলেন-

وَاللهِ مَا أُحِبّ أَنّ مُحَمّدًا الْآنَ فِي مَكَانِهِ الّذِي هُوَ فِيهِ تُصِيبُهُ شَوْكَة تؤذيه، وأنّى جَالِسٌ فِي أَهْلِي.

(আবু সুফিয়ান! তুমি তো অনেক বেশিই বলে ফেলেছ!) আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে আছেন সেখানে তাঁর শরীরে একটি কাঁটা ফুটবে আর আমি ঘরে বসে থাকব- এতটুকুও তো আমি বরদাশত করব না!

এ শুনে আবু সুফিয়ান চুপ থাকতে পারেনি। স্বজাতির সামনে চিরসত্যটি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। বলে-

مَا رَأَيْتُ مِنْ النّاسِ أَحَدًا يُحِبّ أَحَدًا كَحُبِّ أَصْحَابِ مُحَمّدٍ مُحَمّدًا.

মুহাম্মাদের সাথীরা তাকে যে পরিমাণ ভালবাসে এমন নিঃস্বার্থ ও গভীর ভালবাসার নজির আমি কোথাও পাইনি। (দ্রষ্টব্য : সীরাতে ইবনে হিশাম ২/১৭২; সহীহ বুখারী, হাদীস ৪০৮৬)

প্রিয় পাঠক, হযরত যায়েদের এ উক্তি তাৎক্ষণিক পরিস্থিতির কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। ছিল না আবেগে চলে এসে বলে ফেলা কোনো জোশীলা বক্তব্য। এ তো ছিল নবীর প্রতি উৎসর্গিত একজন সাহাবীর খুব স্বাভাবিক অনুভূতি। হৃদয়ের গভীরে এতদিন যা লালন করতেন আজ তাই দুই ঠোঁটে প্রকাশ করেছেন। শব্দগুলো যদিও হযরত যায়েদের। কিন্তু এর মর্ম ও ব্যঞ্জনা ধারণ করত প্রতিটি সাহাবীর হৃদয়। শুধু মুখে মুখে নয়, জীবনের প্রতিটি পর্বে তারা তা বাস্তবে করে দেখিয়ে দিয়েছেন।

উহুদের প্রান্তরে যখন মুমিনগণ অত্যন্ত নাজেহাল সময় পার করছিলেন। ঝরে যাচ্ছিল সাহাবীদের তাজা তাজা প্রাণগুলো। যেই রাসূলের মুখ দেখে সকল দুর্দশা প্রশমিত হত আজ সেই নূরে ঝলমল চেহারাখানাও ক্ষত বিক্ষত! প্রিয়নবীর দিকে ধেয়ে আসছে উপর্যুপরি তীর বর্শার আঘাত। সাহাবায়ে কেরাম তো নবীর দেহে কাঁটা ফুটতেও দেবেন না। কিন্তু আজ এই তীরের বৃষ্টি...? ব্যস পেতে দিলেন নিজেকে ঢাল হিসেবে। ঘিরে রাখলেন প্রিয় নবীজীকে। আঘাতে আঘাতে তাদের বুক পিঠগুলো ঝাঁঝরা হতে থাকল। আবু বকর রা., আলী ইবনে আবী তালেব রা., সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা., আবু উবাইদা রা., আবু তালহা রা., আবু দুজানা রা., মুসআব ইবনে উমাইর রা., আনাস ইবনে নযর রা., মালিক ইবনে সিনান রা., সাহল ইবনে হুনাইফ রা. প্রমুখ সাহাবীর নবীপ্রেমে নিবেদিত আত্মত্যাগের দাস্তান হাদীস ও সীরাতের কিতাবগুলোতে আজও জ¦লজ¦ল করছে।

নবীপ্রেমে দিওয়ানা ওই নারীর কথা কী বলবেন! যিনি নবীর ডাকে জিহাদে শরীক হতে পাঠিয়ে দিয়েছেন নিজের বাবা ভাই এবং স্বামীকে। যুদ্ধ শেষে বনু দীনারের আনসারী সেই সাহাবিয়াকে যখন একে একে পিতা ভ্রাতা ও স্বামীর শাহাদাতের সংবাদ দেওয়া হল তিনি সব মেনে নিলেন। বিচলিত হলেন না। অস্থির হলেন না। অস্থিরতা শুধু একটাই- আমার প্রিয়নবীর কী অবস্থা? তিনি কেমন আছেন?

একজন সম্ভ্রান্ত মুসলিম নারী। জগতে তার পিতা নেই। নেই স্বামী। এমনকি চলে গেছেন ভাইও। একইসাথে তিন তিনজন তাকে নিঃসঙ্গ করে বিদায় নিয়েছেন। মাথার উপর আশ্রয়ের ছায়া বলতে আর কী বাকি থাকে!? কিন্তু তাতে পরওয়া নেই। কারণ আমার নবীর ছায়া আমার উপর থাকবে তো! এ পেরেশানীতে তিনি অস্থির। সাহাবায়ে কেরাম তাকে আশ্বস্ত করলেন- ওগো মা, তুমি যেমনটি কামনা করছ, প্রিয়নবী তেমনই আছেন। আমরা নবীজীকে এখনো হারাইনি।

সাহাবিয়া তাতেও স্থির হতে পারলেন না। মিনতি করলেন, একনজর নবীকে দেখিয়ে দাও না! যখন এই দিওয়ানাকে দেখিয়ে দেওয়া হল, ওই যে আমাদের প্রিয়নবী! তিনি নবীজীকে দেখে বলে উঠলেন-

كُلّ مُصِيبَةٍ بَعْدَكَ جَلَلٌ!

আপনি বেঁচে আছেন! তাহলে তো আর কোনো মসিবত মসিবতই না! সব তুচ্ছ! (দ্রষ্টব্য : সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৯৯)

সুবহানাল্লাহ! এর নাম ছিল সাহাবায়ে কেরাম! এমনই ছিল সাহাবীওয়ালা ঈমান! বনু দীনারের এই নারী সাহাবী নবীপ্রেমে সিক্ত ঈমানদীপ্ত এ উক্তির মাধ্যমে উম্মতের জন্য জন্য রেখে গেলেন নবীপ্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

সাহাবায়ে কেরাম প্রিয় নবীকে কেমন ভালবাসতেন তার বিবরণ দিয়ে গিয়েছেন আরবের বিচক্ষণ মুশরিক নেতৃবৃন্দ। নবীজীর শত্রু হয়েও ইতিহাসের এই অমোঘ সত্যকে তারা এড়িয়ে যেতে পারেনি। আমরা মাত্রই যেমনটি দেখে আসলাম হযরত যায়েদ ইবনে দাসিনা রা.-এর শাহাদাত প্রাক্কালে আবু সুফিয়ান কীভাবে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে-

مَا رَأَيْتُ مِن النّاسِ أَحَدًا يُحِبّ أَحَدًا كَحُبِّ أَصْحَابِ مُحَمّدٍ مُحَمّدًا.

মুহাম্মাদের সাহাবীরা তাকে যে পরিমাণ ভালবাসে এমন নিঃস্বার্থ ও গভীর ভালবাসার নজির আমি কোথাও পাইনি।

এছাড়াও রয়েছে আরো বহু দৃষ্টান্ত। ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল হুদায়বিয়ার সন্ধি। আল্লাহ তাআলা যাকে ফাতহুম মুবীন বা প্রকাশ্য বিজয় বলে আখ্যা দিয়েছেন। এ হুদায়বিয়ার ঘটনার পরতে পরতে রয়েছে শিক্ষা ও আদর্শ গ্রহণের বহু অনুষঙ্গ। রয়েছে প্রিয়নবীর শানে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা নিবেদনের বিস্তৃত গাঁথা।

হুদায়বিয়া-সন্ধির প্রাক্কালে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট মক্কার কুরাইশদের পক্ষ থেকে যে কজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এসেছিলেন তাদের একজন ছিলেন উরওয়া ইবনে মাসঊদ সাকাফী। (যিনি তখনও মুসলমান হননি) তিনি নবীজীর কাছ থেকে ফিরে গিয়ে কুরাইশ মুশরিকদের যে বার্তা পৌঁছান তা আজও আমাদের জন্য সোনালী পাঠ হয়ে ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে। তিনি বলেন-

أَيْ قَوْمِ، وَاللهِ لَقَدْ وَفَدْتُ عَلَى المُلُوكِ، وَوَفَدْتُ عَلَى قَيْصَرَ، وَكِسْرَى، وَالنّجَاشِيِّ، وَاللهِ إِنْ رَأَيْتُ مَلِكًا قَطّ يُعَظِّمُهُ أَصْحَابُهُ مَا يُعَظِّمُ أَصْحَابُ مُحَمّدٍ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ مُحَمّدًا، وَاللهِ إِنْ تَنَخّمَ نُخَامَةً إِلّا وَقَعَتْ فِي كَفِّ رَجُلٍ مِنْهُمْ، فَدَلَكَ بِهَا وَجْهَهُ وَجِلْدَهُ، وَإِذَا أَمَرَهُمْ ابْتَدَرُوا أَمْرَهُ، وَإِذَا تَوَضّأَ كَادُوا يَقْتَتِلُونَ عَلَى وَضُوئِهِ، وَإِذَا تَكَلّمَ خَفَضُوا أَصْوَاتَهُمْ عِنْدَهُ، وَمَا يُحِدّونَ إِلَيْهِ النّظَرَ تَعْظِيمًا لَهُ، وَإِنّهُ قَدْ عَرَضَ عَلَيْكُمْ خُطّةَ رُشْدٍ فَاقْبَلُوهَا.

হে আমার সম্প্রদায়! আমি জীবনে বহু রাজ দরবারে প্রতিনিধি হয়ে গিয়েছি। কায়সার কিসরা নাজাশীর মতো রাজা মহারাজাদের সভাসদে উপস্থিত হয়েছি। আল্লাহর কসম করে বলছি, মুহাম্মাদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার সাথীরা যেরকম শ্রদ্ধা করে তেমনটি কারো ক্ষেত্রে আমি পাইনি। আল্লাহর কসম করে বলছি, মুহাম্মাদ থুথু নিক্ষেপ করে তো তা মাটিতে পড়ে না। কোনো হাত তা পেতে গ্রহণ করে নেয়। চেহারা ও শরীরে মেখে নেয়। সে কোনো আদেশ করলে তার সঙ্গীরা সঙ্গে সঙ্গে তা পালনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে ওযু করলে তার ওযুর পানি নেওয়ার জন্যে তারা কাড়াকাড়ি শুরু করে। সে কথা আরম্ভ করলে তারা চুপ হয়ে যায়। শ্রদ্ধার আতিশয্যে তারা মুহাম্মাদের প্রতি চোখ তুলে তাকায় না। সে তোমাদের সামনে একটি ন্যায়সঙ্গত প্রস্তাব রেখেছে; তোমরা তা মেনে নাও। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৭৩১

জি হাঁ, এমনই ছিল সাহাবা জীবন! যেখানে ঘটেছিল শ্রদ্ধা ও ভালবাসার অপূর্ব সম্মিলন! প্রিয়নবীর প্রতি সাহাবায়ে কেরামের অগাধ অকৃত্রিম ও অবর্ণনীয় শ্রদ্ধা ও ভালবাসার বিষয়টি এ থেকেও খুব সহজে বুঝে আসে, কথায় কথায় তারা নবীজীকে উদ্দেশ্য করে বলতেন- আমার বাবা মা উৎসর্গিত হোক আপনার প্রতি...! ফিদাকা আবী ওয়া উম্মী, বিআবী আনতা ওয়া উম্মী ইয়া রাসূলাল্লাহ... ইত্যাদি মধুময় শব্দমালা নিসৃত হতে থাকত তাদের যবান থেকে! আর ভালবাসার এই দাবির বাস্তবতা ছিল তাদের গোটা জীবন। সেজন্যই মহান রাব্বুল আলামীন (আমিনূ কামা আমানান্নাস বলে) জগদ্বাসীর জন্যে ঈমান ও আমলের মাপকাঠি নির্ধারণ করেছেন হযরত সাহাবায়ে কেরামকে।

সূরা মুজাদালায় আল্লাহ তাআলা সাহাবায়ে কেরামের পরিচয় উল্লেখ করেছেন এভাবে-

لَا تَجِدُ قَوْمًا یُّؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ یُوَآدُّوْنَ مَنْ حَآدَّ اللّٰهَ وَ رَسُوْلَهٗ وَ لَوْ كَانُوْۤا اٰبَآءَهُمْ اَوْ اَبْنَآءَهُمْ اَوْ اِخْوَانَهُمْ اَوْ عَشِیْرَتَهُمْ ؕ اُولٰٓىِٕكَ كَتَبَ فِیْ قُلُوْبِهِمُ الْاِیْمَانَ وَ اَیَّدَهُمْ بِرُوْحٍ مِّنْهُ ؕ وَ یُدْخِلُهُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهٰرُ خٰلِدِیْنَ فِیْهَا ؕ رَضِیَ اللّٰهُ عَنْهُمْ وَ رَضُوْا عَنْهُ ؕ اُولٰٓىِٕكَ حِزْبُ اللّٰهِ ؕ اَلَاۤ اِنَّ حِزْبَ اللّٰهِ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ

যেসব লোক আল্লাহ ও আখেরাত দিবসে ঈমান রাখে (অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম), তাদেরকে তুমি এমন পাবে না যে, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখছে। হোক না তারা তাদের পিতা বা তাদের পুত্র কিংবা তাদের ভাই অথবা তাদের স্বগোত্রীয় কেউ। তারাই এমন, আল্লাহ যাদের অন্তরে ঈমান খোদাই করে দিয়েছেন এবং নিজ রূহ দ্বারা তাদের সাহায্য করেছেন। তিনি তাদেরকে প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতে, যার তলদেশে নহর প্রবাহিত থাকবে। তাতে তারা সর্বদা থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে গেছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে গেছে। তারা আল্লাহর দল। স্মরণ রেখ, আল্লাহর দলই কৃতকার্য হয়। -সূরা মুজাদালাহ (৫৮) : ২২

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাদের রেখে যাওয়া সেই আদর্শের পথে চলার তাওফীক নসীব করুন। আমীন। হ

 

 

advertisement