রবিউল আউয়াল ১৪৪৪   ||   অক্টোবর ২০২২

হাশরের ময়দানে মুমিন ও কাফেরের অবস্থা : একটি চিত্র

মাওলানা সায়ীদুল হক

পবিত্র কুরআনে কারীমের সূরা কিয়ামাহ-এর ২০-২১ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে তার একটি ভুল কর্মনীতির বিষয়ে সতর্ক করেছেন। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার জীবনের পিছনে পড়ে  আখেরাতকে ভুলে যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে আল্লাহ তাআলা বলেন-

كَلَّا بَلْ تُحِبُّوْنَ الْعَاجِلَةَۙ۝۲۰ وَ تَذَرُوْنَ الْاٰخِرَةَ

সাবধান! প্রকৃতপক্ষে তোমরা নগদ জীবন (পার্থিব জীবন)কেই ভালবাসো আর আখেরাতকে উপেক্ষা করো। -সূরা কিয়ামাহ (৮৫) : ২০-২১

এর পরের চার আয়াতে আল্লাহ তাআলা হাশরের ময়দানে বিশ্বাসী মুমিন বান্দার অবস্থা কেমন হবে আর অবিশ্বাসী কাফেরের অবস্থা কেমন হবে তা তুলে ধরেছেন-

وُجُوْهٌ یَّوْمَىِٕذٍ نَّاضِرَةٌۙ۝۲۲ اِلٰى رَبِّهَا نَاظِرَةٌۚ۝۲۳ وَ وُجُوْهٌ یَّوْمَىِٕذٍۭ بَاسِرَةٌۙ۝۲۴ تَظُنُّ اَنْ یُّفْعَلَ بِهَا فَاقِرَةٌ

সেদিন অনেক চেহারা উজ্জ¦ল হবে। আপন রবের দীদার (দর্শন) লাভ করবে। সেদিন অনেক  চেহারা (ভয়ে আতঙ্কে) বিবর্ণ হয়ে যাবে। তারা বুঝবে যে, তাদের সাথে এমন আচরণ করা হবে, যা তাদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেবে। -সূরা কিয়ামাহ (৭৫) : ২২-২৫

আখেরাতের ফিকির মুমিন বান্দাহর জীবনের সবচে বড় অনুষঙ্গ। সে তার পার্থিব জীবন আখেরাতের জীবন নিরাপদ ও সুন্দর করার কাজে ব্যয় করে। দুনিয়ায় বসে সে আখেরাতের পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ঈমান ও নেক আমলের মাধ্যমে যথাযথ চেষ্টা মেহনত অব্যাহত রাখে। যেসকল কথা ও কাজে আল্লাহ তাআলা নারাজ হন সেগুলো থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। ভুল হয়ে গেলে তওবা-ইস্তেগফারের মাধ্যমে নিজেকে শুধরে  নেয়ার চেষ্টা করে।

আল্লাহ তাআলার কাছে বান্দার এ আখেরাতমুখিতা অনেক পছন্দনীয়।  আখেরাতের জন্য যে চেষ্টা মেহনত করে আল্লাহ তাআলা তার মেহনতের উত্তম পুরস্কার দান করেন।

আখেরাতমুখী মেহনতের পুরস্কার স্বরূপ আল্লাহ তাআলা তাকে দুনিয়ায় দান করেন হায়াতুন তাইয়িবাহ-উত্তম জীবন। পরকালের প্রত্যেক পর্বে তাকে ঢেকে রাখেন বিশেষ রহমতের চাদরে। সবশেষে রহমত ও সন্তুষ্টির পরম আধার জান্নাতে স্থান দান করেন।

পক্ষান্তরে যে ব্যক্তির চিন্তা ফিকির কেবলমাত্র পার্থিব জীবনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়, আল্লাহ তাআলার বিধি বিধানের তোয়াক্কা না করে নিজ খেয়াল খুশিমত চলতে থাকে, আখেরাত ভুলে শুধু দুনিয়ার ফিকিরে মগ্ন থাকে, তার জন্য রয়েছে দুনিয়া-আখেরাতে কঠিন শাস্তি। দুনিয়ার হাজারো আসবাব-উপকরণ থাকার পরও তার জীবন হয় সংকীর্ণ। আর পরকালের প্রত্যেক পর্বে তার জন্য থাকবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।

কুরআন কারীমের অনেক জায়গায় আল্লাহ তাআলা বারবার আমাদেরকে এ বিষয়গুলো স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বিভিন্নভাবে আমাদের সামনে বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন; যেন আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি।

সূরা আলে ইমরানে ইরশাদ হয়েছে-

یَّوْمَ تَبْیَضُّ وُجُوْهٌ وَّ تَسْوَدُّ وُجُوْهٌ

সেদিন অনেক মুখ (ঈমান ও নেকআমলের আলোয়) উজ্জ্বল হবে আর কতক মুখ (কুফর ও পাপের কালিমায়) কালো হয়ে যাবে। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১০৬

সূরা আবাসায় ইরশাদ হয়েছে-

وُجُوْهٌ یَّوْمَىِٕذٍ مُّسْفِرَةٌۙ۝۳۸ ضَاحِكَةٌ مُّسْتَبْشِرَةٌۚ۝۳۹ وَ وُجُوْهٌ یَّوْمَىِٕذٍ عَلَیْهَا غَبَرَةٌۙ۝۴۰ تَرْهَقُهَا قَتَرَةٌؕ۝۴۱ اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْكَفَرَةُ الْفَجَرَةُ

সেদিন অনেক চেহারা হবে উজ্জ্বল। সহাস্য, প্রফুল্ল। এবং সেদিন অনেক চেহারা হবে ধুলোমলিন। সেগুলোকে আচ্ছন্ন করে রাখবে (পাপাচারের) কালিমা। এরাই তারা, যারা ছিল অস্বীকারকারী পাপিষ্ঠ। -সূরা আবাসা (৮২) : ৩৮-৪২

হাশরের মাঠে কঠিন মুসিবতের মধ্যেও মুমিন বান্দার চেহারা থাকবে হাস্যোজ্জ্বল। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অনুগ্রহের বিশেষ ছায়া সেদিন তাদেরকে ঢেকে রাখবে।

সহীহ বুখারীতে আবু হুরায়রা রা. ও আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, একবার কিছু সাহাবী নবীজীর কাছে জানতে চাইলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কি কিয়ামত দিবসে আমাদের প্রভু আল্লাহ তাআলার দীদার পাবনবীজী বললেন, মেঘমুক্ত আকাশে সূর্য বা পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে কি তোমাদের কোনো বেগ পেতে হয়তারা বললেনজী না। নবীজী বললেন, তোমরা সেদিন এভাবে তোমাদের প্রভুর দীদার লাভ করবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৮০৬, ৪৫৮১

কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার দীদার লাভের জন্য নবীজী  একটি আমলও বাতলে দিয়েছেন। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে জারীর রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবীজী এক পূর্ণিমার রাতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে উপস্থিত সাহাবীগণকে জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা  এ পূর্ণিমার চাঁদটি যেভাবে দেখছো তোমরা তোমাদের প্রভুকেও এমনিভাবে দেখতে পাবে। এ নিআমত লাভের সহায়ক হিসেবে তোমরা একটি কাজ করতে পারো, সূর্য উদয়ের আগের নামায (ফজর) আর সূর্যাস্তের আগের নামায (আসর) যেন না ছুটে যায়। -সহীহ বুখারী, হাদীস  ৫৫৪

জান্নাতে দাখিল হওয়ার আগেই মুমিন বান্দাহগণ আল্লাহ তাআলার দীদার লাভ করবে। যার ফলে কিয়ামতের কঠিন ভয়াবহ পরিস্থিতির মাঝেও তারা থাকবে শান্ত সমাহিত। চেহারা থাকবে উজ¦ল।

পক্ষান্তরে অবিশ্বাসী পাপাচারীরা সেদিন থাকবে শঙ্কিত লাঞ্ছিত, ভীত সন্ত্রস্ত। হাশরের মাঠের ভয়াবহতা দেখেই তারা বুঝে ফেলবে সামনে তাদের জন্য কত মারাত্মক শাস্তি অপেক্ষা করছে।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দুনিয়া আখেরাতের লাঞ্ছনা থেকে হেফাযত করুন এবং তাঁর রহমতের জান্নাতে স্থান দান করুন- আমীন। হ

 

 

advertisement