রবিউল আউয়াল ১৪৪৪   ||   অক্টোবর ২০২২

কুরআন কারীমের মহান শিক্ষা
অন্যায়ের বিপরীতে অন্যায় নয় ইনসাফ অবলম্বন করো

মাওলানা হুজ্জাতুল্লাহ

ষষ্ঠ হিজরী চলছে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম মদীনায়। জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে হিজরত করে  আসা হয়েছে বহু দিন। কুরাইশ কাফেরদের শত্রুতার জেরে শত আকাঙক্ষা সত্ত্বেও জন্মভূমিতে পা রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যক্তিগত প্রয়োজন দূরে থাক হজ্ব কিংবা উমরার উদ্দেশ্যেও মক্কায় গমন নিরাপদ নয়। এমনকি পবিত্র চার মাসেও (যিলকদ, যিলহজ্ব, মুহাররম, রজব) মক্কায় যাওয়ার সাহস করা যায়নি। অথচ আরব-ঐতিহ্য অনুসারে পবিত্র চার মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রক্তপাত নিষেধ। এ সময়ে শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবাই সর্বত্র অবাধে ও নিঃশঙ্কচিত্তে গমনাগমনের অধিকার রাখে। আরব-ঐতিহ্য অনুসারে হজ্ব ও উমরার উদ্দেশ্যে আগমনকারীদের যথাযোগ্য সম্মান রক্ষা করাও আবশ্যক। এমনকি কুরবানীর উদ্দেশ্যে হজ্ব ও উমরাকারীগণ সঙ্গে করে যে পশু নিয়ে আসেন সেগুলোর সম্মান করাও অনিবার্য।

জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রশ্নে আরবরা ছিল নিষ্ঠাবান ও আপোষহীন। আরবরীতি ও ঐতিহ্যবিরোধী কোনো কাজ তারা না নিজেরা করতআর না অন্য কাউকে করতে দিত। কিন্তু মুসলিমদের প্রসঙ্গে আরবরা নিজেদের জাতীয় স্বকীয়তা হারাল। মুসলিম-বিদ্বেষে পরাভূত হয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লালন করে আসা জাতীয় ঐতিহ্য বিসর্জন দিয়ে দিল।

এদিকে মদীনায় সাহাবায়ে কেরাম চরম মানসিক কষ্টের মাঝে দিন পার করছিলেন। জন্মভূমির প্রতি স্বাভাবিক মানবীয় যে টান, তা তো সাহাবায়ে কেরাম দ্বীনের খাতিরে কুরবান করে দিয়েছিলেন। ঈমান ও ইসলামের প্রতি তাদের এমনই নিবেদন ছিল যে, শুধু জন্মভূমির মায়া কেন, নিজেদের জান পর্যন্ত কুরবান করতে তারা সদাপ্রস্তুত ছিলেন। এর বাস্তব প্রমাণও দিয়েছিলেন তাঁরা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আকাক্সক্ষা ছিল, যারা হিজরত করে মদীনায় চলে এসেছে তারা যেন আর মক্কায় ফেরত না যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও আর মক্কায় ফিরে যাননি। তাঁর ইচ্ছা ও নির্দেশনার প্রতি সম্মান জানিয়ে মুহাজির সাহাবায়ে কেরাম স্থায়ীভাবে মদীনায়ই থেকে যান। তাদের কেউ জন্মভূমি মক্কায় ফিরে যাননি।

কিন্তু আল্লাহর ঘরের প্রতি একজন মুমিনের যে প্রাণের টান তা আর কতদিন দমিয়ে রাখা যায়? একে একে পাঁচটি বছর পেরিয়ে গেছে- আল্লাহর ঘর দেখা হয়নি, তাওয়াফ করা হয়নি, মাকামে ইবরাহীমে দাঁড়িয়ে নামায পড়া হয়নি, হজরে আসওয়াদ চুম্বন করা হয়নি, যমযমের পানি পান করা হয়নি, বাইতুল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে হৃদয়-মন উজাড় করে কান্নাকাটি করা হয়নি...। হায় বাইতুল্লাহ! আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তোমার দেখা পাবার জন্য?

এমনি সময়ে একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নে দেখেন, তিনি সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে নিরাপদে মসজিদে হারামে প্রবেশ করছেন। এ স্বপ্নের কথা শুনে সাহাবায়ে কেরামের ভগ্ন হৃদয়ে প্রত্যাশার সঞ্চার হয়- এবার বোধ হয় প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হবে! আবার হয়তো বাইতুল্লাহ যিয়ারতের সৌভাগ্য হবে!

ষষ্ঠ হিজরীর যিলকদ মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায় দেড় হাজার সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে ওমরার উদ্দেশ্যে মক্কাভিমুখে রওয়ানা করে হুদাইবিয়াহ নামক স্থানে এসে পৌঁছান। কিন্তু সংবাদ পেয়ে কাফেরবাহিনী পথ রোধ করে দাঁড়ায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জানান যে, আমরা যুদ্ধের জন্য আসিনি। কেবল বাইতুল্লাহ যিয়ারতের নিয়তে এসেছি। ওমরা করে আমরা আবার মদীনায় ফিরে যাব। কিন্তু কাফেররা মক্কায় প্রবেশের অনুমতি দিতে নারাজ। কয়েকদফা বৈঠক ও আলোচনার পর কিছু অন্যায় শর্তারোপের ভিত্তিতে দশ বছরের জন্য একটি সন্ধিচুক্তি করতে সম্মত হয় তারা। চুক্তির একটি অন্যায় শর্ত ছিল, মুসলিমদের এ বছর ওমরা না করেই মদীনায় ফিরে যেতে হবে, আগামী বছর ওমরা করার অনুমতি থাকবে। তবে আসার সময় নিজস্ব তরবারি ছাড়া আর কোনো যুদ্ধাস্ত্র তারা সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারবে না এবং তিন দিনের বেশি মক্কায় অবস্থান করতে পারবে না।

আরব-ঐতিহ্য, প্রজন্ম পরম্পরায় প্রাপ্ত জাতীয় রীতি, আল্লাহর ঘরের সম্মান, পবিত্র চার মাসের সম্মান, উমরার উদ্দেশ্যে আগমনকারী আল্লাহর ঘরের মেহমানদের সম্মান, স্বাভাবিক মানবিক বোধ- কোনো কিছুরই পরোয়া করেনি তারা। মদীনা থেকে দীর্ঘ পথ সফর করে মক্কার কাছাকাছি চলে এসেছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। তাই মুসলিমদের পক্ষ থেকে কাফেরদের বোঝানোর অনেক চেষ্টা করা হয়, যেহেতু এতদূর চলেই এসেছে, তাই এ বছর উমরা করে যাওয়ার সুযোগ প্রদান করা হোক। কিন্তু তারা তাদের অন্যায় সিদ্ধান্তে ছিল অনড়।

অবশেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের এ অন্যায় দাবিও মেনে নেন এবং এ বছর উমরা না করেই ফিরে যাওয়ার মনস্থ করেন। কিন্তু কাফেরদের এ অন্যায় হঠকারিতায় সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত মর্মাহত হন। যিলকদ মাস চলছিল তখন। যিলকদ মাস সম্মানিত চার মাসের অন্তর্ভুক্ত। এ সময়ে বহিরাগত কোনো লোককেও মক্কায় প্রবেশে বাধা দেওয়ার অধিকার নেই, সেখানে মক্কায় জন্মগ্রহণকারী এ কাফেলাকে আপন জন্মভূমিতে প্রবেশে বাধাদান, উপরন্তু তারা এসেছিলেন উমরার নিয়তে, পরিহিত ছিলেন ইহরামের লেবাস, সঙ্গে কুরবানীর উদ্দেশ্যে নিয়ে আসা পশুর বহর- ইহরামের লেবাসে থাকা আল্লাহর ঘরের মেহমানদের এরূপ অসম্মান কীভাবে বরদাশত করা যায়?

শেষ পর্যন্ত তাঁরা এই অনাচার মেনে নিতে বাধ্য হন এবং মদীনায় ফিরে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যান। কিন্তু আশাভঙ্গের বেদনা তাদের পীড়া দিয়ে যাচ্ছিল। সম্ভাবনা ছিল, মনের দুঃখে তাঁদের কেউ হয়তো কাফেরদের সাথে এমন কোনো আচরণ করে বসবেন, যা শরীয়ত সমর্থন করে না। কিন্তু তাঁরা তো ছিলেন সেই মহান কাফেলা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্যধন্য হওয়ার জন্য যাঁদেরকে নির্বাচন করা হয়েছিল। আসমান থেকে তাঁদের তারবিয়াতের ব্যবস্থা করা হল। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুমিনদের সম্বোধন করে ইরশাদ করলেন-

وَ لَا یَجْرِمَنَّكُمْ شَنَاٰنُ قَوْمٍ اَنْ صَدُّوْكُمْ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ اَنْ تَعْتَدُوْا

তোমাদেরকে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করতে বাধা দিয়েছিল, এই কারণে কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি অসন্তোষ ও ক্ষোভ৫ যেন তোমাদেরকে তাদের প্রতি সীমালঙ্ঘন করতে প্ররোচিত না করে। -সূরা মায়েদা (৫) : ২

এ ছিল ইসলামের এক মহান শিক্ষা। অন্যায়ের বিপরীতে অন্যায় নয়, ইনসাফই অবলম্বনীয়। মসজিদুল হারামে যেতে বাধা দান করে মুসলিমদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছিল, তাই কাফেরদের প্রতি জন্মানো ক্ষোভ ছিল খুবই স্বাভাবিক এবং স্বীকৃতও বটে। কিন্তু স্বীকৃত ক্ষোভের প্রকাশও স্বীকৃত পন্থায় হওয়া চাই। ইসলামে সবকিছুরই সীমারেখা স্থিরীকৃত আছে। শত্রুর সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রেও, এমনকি যখন সে কার্যত জুলুম করে যাচ্ছে, তখনও শরয়ী সীমারেখা লঙ্ঘন করা জায়েজ নয়। কী মহান ইসলামের শিক্ষা!

ইসলামের এ অমূল্য শিক্ষার আলোকে আমরা নিজেদেরকে যাচাই করে দেখি। দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানা কারণে একে-অপরের প্রতি অসন্তুষ্ট হই। অসন্তুষ্টির মাত্রা বেড়ে কখনো ক্ষোভ, আক্রোশ ও বিদ্বেষের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এই অসন্তোষ, ক্ষোভ বা বিদ্বেষ যদি সঙ্গত কারণে হয়ে থাকে; যেমন বাস্তবেই যদি আমার প্রতি অন্যায় ও অবিচার হয়ে থাকে তাহলে অসন্তুষ্ট হওয়ার অধিকার আমার আছে, কিন্তু কুরআন কারীম আমাদের শিক্ষা দেয় যে, সেই অসন্তোষ প্রকাশের ক্ষেত্রেও শরয়ী সীমারেখার প্রতি লক্ষ্য রাখা জরুরি। কোনো অবস্থাতেই শরয়ী সীমারেখা লঙ্ঘন করা জায়েয নয়।

আর যে অসন্তোষ ও ক্ষোভের  পেছনে শরীয়ত অনুমোদিত কোনো কারণ নেই, যার নেপথ্য কারণ কেবলই ব্যক্তিস্বার্থ, অকারণ হিংসা-বিদ্বেষ, ধনলিপ্সা, পদলিপ্সা, আত্মম্ভরিতা বা এজাতীয় কিছু তা স্পষ্ট হারাম। এর সাথে বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘনের মতো বিষয় যোগ হলে তা আরও জঘন্য গুনাহ।

সুতরাং কারো প্রতি মনে অসন্তোষ বা ক্ষোভ থাকলে তার নেপথ্য কারণ যাচাই করা জরুরি, কেন তার প্রতি আমি বিরাগ? এই অসন্তোষ কি শরীয়ত অনুমোদন করে, নাকি আমি প্রবৃত্তিপূজার শিকার? মনে রাখতে হবে, স্বীকৃত কারণ ছাড়া কারো প্রতি ক্ষোভ থাকলে তা মিটিয়ে ফেলা ফরয। আর যেমনটি পূর্বে বলা হয়েছে, স্বীকৃত কারণে ক্ষোভ জন্মে থাকলে তার প্রকাশও নিয়ন্ত্রিত হওয়া জরুরি। কুরআন আমাদেরকে সর্বাবস্থায় ন্যায় ও ইনসাফ অবলম্বনের শিক্ষা দেয়। অপর এক আয়াতে কুরআন কারীম আমাদের বলছে-

وَ لَا یَجْرِمَنَّكُمْ شَنَاٰنُ قَوْمٍ عَلٰۤی اَلَّا تَعْدِلُوْا ؕ اِعْدِلُوْا ۫ هُوَ اَقْرَبُ لِلتَّقْوٰی ؗ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ خَبِیْرٌۢ بِمَا تَعْمَلُوْنَ

কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি অসন্তোষ ও ক্ষোভ যেন তোমাদেরকে ইনসাফ পরিত্যাগে প্ররোচিত না করে। ইনসাফ অবলম্বন করো। এ-ই তাকওয়ার বেশি নিকটবর্তী। -সূরা মায়েদা (৫) : ৮

প্রথমোক্ত আয়াতের শিক্ষা, সর্বাবস্থায় সীমালঙ্ঘন থেকে বেঁচে থাকা। এই আয়াতের শিক্ষা, সর্বাবস্থায় ইনসাফ অবলম্বন করা। উভয় আয়াতের সম্মিলিত বার্তা হল, সর্বাবস্থায় সীমালঙ্ঘন পরিত্যাগ ও ইনসাফ অবলম্বন। এটা কুরআন কারীমের এমন মহিমাময় শিক্ষা, যার ধারক-বাহক হওয়ার জন্য মুসলিম জাতি গর্ব বোধ করার অধিকার রাখে।

কিন্তু এখন আমরা কুরআন কারীমের এই মহান শিক্ষা থেকে বহু দূরে। আমাদের ব্যক্তিজীবন ও সমাজ জীবনে ন্যায় ও ইনসাফের চর্চা নেই। ভারসাম্য রক্ষার যথাযোগ্য প্রয়াস নেই। সমাজজুড়ে কেবলই অন্যায়, অনাচার আর সীমালঙ্ঘন। অথচ কুরআন কারীমের এই মহিমাময় শিক্ষার সঠিক সমাদর ও যথাযথ চর্চা ব্যতিরেকে কিছুতেই একটি মুসলিম সমাজ পূর্ণতা লাভ করতে পারে না।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবধরনের বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন থেকে মুক্ত রেখে ন্যায়, ইনসাফ ও ভারসাম্যের গুণ দান করুন। কুরআনের শিক্ষার আলোয় প্রদীপ্ত একটি সুন্দর মুসলিম সমাজ আমাদের দান করুন- আমীন। হ

 

১. দ্রষ্টব্য : তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা তাওবা (৯) : ৩৬; আলমুফাসসাল ফি তারীখিল আরব ৮/৪৭১-৪৭৬

২. দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ১২৯৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৫২

৩. সূরা ফাতহের (৪৮) ২৭ নং আয়াতে এই স্বপ্নের কথাই বলা হয়েছে। তাফসীরে তবারী ও তাফসীরে ইবনে কাসীরে উক্ত আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য।

৪. সহীহ বুখারী, হাদীস ২৭৩১-২৭৩২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৯১০ (حسن); সীরাতে ইবনে হিশাম ৩/২৫৫-২৬৯; আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া ৪/৩৭৫-৩৮৬

৫. মাকায়িসু লুগাতে আছে-

(شَنَأَ) الشِّينُ وَالنّونُ وَالْهَمْزَةُ أَصْلٌ يَدُلُّ عَلَى الْبِغْضَةِ وَالتَّجَنُّبِ لِلشّيْءِ.

 

 

advertisement