মুহাররম ১৪৪৪   ||   আগস্ট ২০২২

সুবহে সাদিক কখন শুরু?
প্রসঙ্গ : আহসানুল ফাতাওয়ার উদ্ধৃতিগুলোর পর্যালোচনা-৬

মাওলানা মুহাম্মাদ ফয়যুল্লাহ

আলহামদু লিল্লাহ, গত সংখ্যাতে আহসানুল ফাতাওয়ার تحقیقات جدیدہ শিরোনামের প্রথম উদ্ধৃতির হাল-হাকীকত স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। সেটি যে অসংখ্য ভুলে ভরপুর সম্পূর্ণ আগ্রহণযোগ্য এক সময়সূচি তা প্রমাণ করে দেখানো হয়েছে। এখন সামনে  এই শিরোনামের বাকি উদ্ধৃতিগুলোর পর্যালোচনা তুলে ধরা হল।

শুধু কয়েকটি ইংরেজি বইয়ের নাম

আহসানুল ফাতাওয়াতে تحقیقات جدیدہ শিরোনামের অধীনে ২ থেকে ৫ নম্বরে কোনো বক্তব্য উদ্ধৃত করা ছাড়া কেবল চারটি ইংরেজি বইয়ের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলোর নাম উর্দু ভাষায়  এভাবে লেখা হয়েছে-

-ایڈمرلٹی مینول آف نیویگیشن ص ১৩৭، ج۔

-بیسک ایر نیویگیشن ڈرلز۔

-ایسٹرونومیکل افیمیرز۔

-ناٹیکل المینک۔

অর্থাৎ-

২. এডমিরালটি ম্যানুয়াল অফ ন্যাভিগেশন (Admiralty Manual of Navigation)  খ. ২, পৃ. ১৩৭

৩. বেসিক এয়ার ন্যাভিগেশন ڈرلز

৪. অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এফিমেরিস (Astronomical Ephemeris)

৫. নটিক্যাল আলম্যানাক (Nautical Almanac)। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৬৭)

আহসানুল ফাতাওয়াতে এ চারটি বইয়ের শুধু নামই উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো থেকে কোনো বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়নি। এমনকি প্রথমটি (এডমিরালটি ম্যানুয়াল অফ ন্যাভিগেশন) ছাড়া বাকিগুলোর খণ্ড পৃষ্ঠাও উল্লেখ করা হয়নি। এভাবে শুধু বইয়ের নাম লিখে দিলেই যে উদ্ধৃতি হয়ে যায় না তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

লক্ষণীয় যে, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষার অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট, যা ১৮°-এ প্রকাশিত হয়, আহসানুল ফাতাওয়ার দাবি হল, তা সুবহে কাযিব। আর সুবহে কাযিবের পরিচয় হল, ভোরের আগে আকাশের উপর দিকে লম্বালম্বিভাবে প্রকাশিত আলো। অতএব আহসানুল ফাতাওয়ার দাবি অনুযায়ী অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে কাযিব হলে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে এটি প্রমাণ করে দেখাতে হবে যে, অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে কাযিবের মতো আকাশের উপর দিকে লম্বালম্বিভাবে প্রকাশিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের কোনো বইয়ের উদ্ধৃতি দিলে সেগুলো থেকে এটিই প্রমাণ করে দেখাতে হবে। নতুবা আহসানুল ফাতাওয়ার পক্ষে এসব বইয়ের উদ্ধৃতি টানা সম্পূর্ণ অনর্থক। তাই এখন এই বিষয়টিই দেখার। আহসানুল ফাতাওয়ায় তো এরকম কোনো বক্তব্য উদ্ধৃত করা ছাড়া শুধু বইগুলোর নামই উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবেও কি এমন কোনো কথা আছে এই বইগুলোতে?

বাস্তবতা হল, আহসানুল ফাতাওয়াতে যদিও শিরোনাম দেওয়া হয়েছে- تحقیقات جدیدہ অর্থাৎ নতুন গবেষণা; কিন্তু আহসানুল ফাতাওয়ার এই নতুন গবেষণায় অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে কাযিব হওয়ার একটি প্রমাণও নেই।

এডমিরালটি ম্যানুয়াল অফ ন্যাভিগেশন

আহসানুল ফাতাওয়াতে এখানে b Admiralty Manual of Navigation (এডমিরালটি ম্যানুয়াল অফ ন্যাভিগেশন)-এর খণ্ড ২ পৃষ্ঠা ১৩৭ উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে বইটির খণ্ড পৃষ্ঠা লেখার দ্বারা বোঝা যায়, বইটির এই খণ্ডের এই পৃষ্ঠাতে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট কিংবা ১৮°-এর সময় সুবহে কাযিব হওয়ার পক্ষে কোনো কথা আছে। তাই সেই বই থেকে আহসানুল ফাতাওয়াতে এর উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এমন কিছুই নয়; বরং এর হাকীকত হল, আহসানুল ফাতাওয়ার পরবর্তী পৃষ্ঠায় পাকিস্তান হাইড্রোগ্রাফি নেভাল হেডকোয়ার্টারের ডাইরেক্টর কর্তৃত প্রেরিত একটি পত্র উল্লেখ করা হয়েছে। সেই পত্রে উক্ত প্রতিষ্ঠানের ডাইরেক্টর সাহেব এডমিরালটি ম্যানুয়াল অফ ন্যাভিগেশন’ -এর দ্বিতীয় খণ্ডের ১৩৭ পৃষ্ঠা থেকে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের পরিচয় তুলে ধরেছেন। আহসানুল ফাতাওয়াতে এই বইয়ের উক্ত খণ্ড-পৃষ্ঠাই লিখে দেওয়া হয়েছে। এই হচ্ছে এই উদ্ধৃতিটির হাকীকত!

 

এখন দেখার বিষয়, এই বইটিতে আলোচ্য বিষয়ে কী তথ্য আছে। অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে কাযিব হওয়ার পক্ষে কোনো প্রমাণ রয়েছে, নাকি সুবহে সাদিক হওয়ার সপক্ষের প্রমাণ আছে? আহসানুল ফাতাওয়ার পরবর্তী পৃষ্ঠার পত্রটিতে বইটি থেকে এই কথাটি উদ্ধৃত করা হয়েছে-

Astronomical twilight. This is said to end or begin when the Sun's centre is 18° below the horizon, at which moment absolute darkness is assumed to begin or end so far as the Sun is concerned.

অর্থাৎ সূর্য যখন দিগন্ত থেকে ১৮° নিচে থাকে তখন অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট (ভোরে) শুরু হয় বা (সন্ধ্যার পর) শেষ হয়। সূর্যের অবস্থা প্রেক্ষিতে যেই মুহূর্ত থেকে পূর্ণ আঁধারের (সন্ধ্যার পর) শুরু বা (ভোরে) সমাপ্তি ধরে নেওয়া হয়।

লক্ষ্য করার বিষয়, এই বক্তব্যটিতে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের ধরন ও আকার সম্পর্কে কোনো কথা নেই। সেটির ধরন সুবহে সাদিকের মতো প্রশস্ত আকারের, নাকি সুবহে কাযিবের মতো পড়হব (শঙ্কু) তথা দিগন্তের উপরের দিকে লম্বালম্বি আকারের- কোনো কথাই তাতে বিদ্যমান নেই। তাই শুধু এটুকু কথা দ্বারা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটসুবহে কাযিব হওয়া বা সুবহে সাদিক হওয়া কোনোটিই প্রমাণিত হয় না।

মোটকথা, এই বইটি থেকে আহসানুল ফাতাওয়ার উক্ত পত্রে উদ্ধৃত বক্তব্যটুকু দ্বারা কোনো দিকই প্রমাণিত হয় না। তবে বইটির ১৯৩৮ ঈ. সনের সংস্করণটি থেকে সংশ্লিষ্ট আলোচনা আমরা পড়ে দেখেছি। তাতে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সম্পর্কিত উক্ত কথাটুকু লেখার আগে টোয়াইলাইটের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে-

Twilight is that period of the day when, although the Sun is below the horizon, the observer is still receiving light reflected and scattered by the upper atmosphere.

অর্থাৎ টোয়াইলাইট দিনের অংশ। এই সময় সূর্য যদিও দিগন্তের নিচে থাকে তবুও পর্যবেক্ষক তখন বায়ুম-লের উপরের স্তরগুলি দ্বারা প্রতিবিম্বিত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সূর্যের আলো দেখতে পায়।

দেখুন-

Admiralty Manual of Navigation, Vol. 1, pp.221-222, Her Majesty's Stationery Office London, 1938.

এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, এই আলো দিগন্তের উভয় দিকে ছড়ানোভাবে থাকে; দিগন্তের উপর দিকে খাড়াভাবে নয়। বক্তব্যটির reflected and scattered by the upper atmosphere বাক্যটি যার সুস্পষ্ট প্রমাণ। বায়ুম-ল দ্বারা প্রতিবিম্বিত হয়ে ছড়িয়ে পড়া আলো যে দিগন্তে প্রশস্ত আকারে দেখা যাবে; দিগন্তের উপর দিকে লম্বালম্বিভাবে নয়- তা সুস্পষ্ট বিষয়।

অতএব আহসানুল ফাতাওয়াতে এডমিরালটি ম্যানুয়াল অফ ন্যাভিগেশন’ -এর নাম নেওয়া হলেও তাতে ১৮°-এ সুবহে কাযিব হওয়া সম্পর্কে কোনো প্রমাণ তো নেই-ই; তাতে আছে বরং এর উল্টো প্রমাণ। এই বইয়ের বক্তব্য দ্বারা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে সাদিক হওয়াই প্রমাণিত হয়।

বেসিক এয়ার ন্যাভিগেশন ڈرلز

আহসানুল ফাতাওয়াতে এখানে তারপর উর্দু অক্ষরে ইংরেজি একটি বইয়ের নাম লেখা হয়েছে এভাবে-

بیسک ایر نیویگیشن ڈرلز

কিন্ত পুরো নামটি ইংরেজিতে আমরা উদ্ধার করতে পারিনি। بیسک ایر نیویگیشن পর্যন্ত তো বোঝা যায়। অর্থাৎ basic air navigation (বেসিক এয়ার ন্যাভিগেশন)। কিন্তু সর্ব শেষ শব্দটি (ڈرلز) এখানে ইংরেজিতে কী হবে তা মিলানো যাচ্ছে না। তাছাড়া বিভিন্নভাবে অনুসন্ধানের পর basic air navigation (বেসিক এয়ার ন্যাভিগেশন) নামে শুধু একটি বই-ই পাওয়া গেছে, যা Elbert F. Blackburn কর্তৃক রচিত। কিন্তু অনেক অনুসন্ধান করেও এই নামের সাথে ইংরেজিতে ڈرلز শব্দ যোগ করে কোনো বইয়ের নাম পাওয়া যায়নি। আহসানুল ফাতাওয়াতেও অন্য কোথাও এই বইয়ের নাম আর আসেনি। এক্ষেত্রে বড় কথা হল, এই বই থেকে কোনো বক্তব্য উদ্ধৃত করা তো দূরের কথা, এর খণ্ড-পৃষ্ঠার নম্বরও লেখা হয়নি। বইটির নাম কী- তা বোঝা যাচ্ছে না; কে এর লেখক, প্রকাশক- তাও লেখা হয়নি; খণ্ড-পৃষ্ঠার নম্বরও নেই; সর্বোপরি কোনো কথাও এর থেকে উদ্ধৃত করা হয়নি, তাহলে এর দ্বারা প্রমাণিত হবে কোন্ জিনিসটি?! তাছাড়া এতে বাস্তবেই আহসানুল ফাতাওয়ার দাবির পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ থকলে সেটি উল্লেখ করা হবে না- তাও হতে পারে না!

অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এফিমেরিস ও নটিক্যাল আলম্যানাক

আহসানুল ফাতাওয়াতে তারপর অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এফিমেরিসনটিক্যাল আলম্যানাক’-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ দুটি মূলত বর্ষপঞ্জি। ইউএস নটিক্যাল আলম্যানাক অফিস ও ব্রিটিশ নটিক্যাল আলম্যানাক অফিস যৌথ উদ্যোগে এই দুটি বর্ষপঞ্জি প্রকাশ করে থাকে। ১৭৬৭ সাল থেকে প্রতি বছরই সেই বছরের জন্য নতুন করে এর সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তাই বর্ষ উল্লেখ করা ছাড়া কেউ এর উদ্ধৃতি দেয় না। কিন্তু আহসানুল ফাতাওয়াতে শুধু এ দুটির নামই লেখা হয়েছে। বর্ষও লেখা হয়নি; পৃষ্ঠা নম্বরও নয়। অতএব আহসানুল ফাতাওয়াতে এর বর্ষ নির্ধারণ করা ছাড়া এবং পৃষ্ঠা নম্বর না লিখে শুধু বইদুটির নাম লিখে দেওয়াটাই প্রথমত অনর্থক। উপরন্তু বইদুটি থেকে কোনো বক্তব্যও উদ্ধৃত হয়নি। তাহলে এই বইদুটির শুধু শুধু নাম লিখে দেওয়ার কোনোই অর্থ থাকছে না।

এখন আসা যাক মূল বিষয়ে। এক্ষেত্রে আসল কথা হল, এই বইগুলোর কোনোটি থেকে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে কাযিবের মতো আকাশের উপর দিকে লম্বালম্বিভাবে প্রকাশিত হওয়ার কোনো প্রমাণ দেখানো তো সম্ভব নয়ই; বরং এগুলোতে উল্টো অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে সাদিক হওয়ারই প্রমাণ রয়েছে। এখানে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এফিমেরিসনটিক্যাল আলম্যানাকএ দুটির শুধু নাম লেখা হয়েছে। অথচ আমরা এ দুটি থেকেই অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে সাদিক হওয়ার প্রমাণ পেছনে তুলে ধরেছি। অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এফিমেরিসনটিক্যাল আলম্যানাকএই দুটির একটি এক্সপ্ল্যানেটরি সাপ্লিমেন্ট তথা বিশেষ সংখ্যার উদ্ধৃতি আমরা যিলকদ ১৪৪১; জুলাই ২০২০ -এর সংখ্যায় উল্লেখ করে এসেছি। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত উক্ত বইটিতে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে যে, অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট দিগন্তরেখার সমান্তরালে (প্রশস্ত আকারে) প্রকাশিত হয়। বইটিতে আছে-

At a zenith distance of 108°, astronomical twilight, the indirect illumination from the Sun on a horizontal surface, is about 6×10-5 ft. candles.

অর্থাৎ সূর্যের সুবিন্দু দূরত্ব যখন ১০৮°(অর্থাৎ সূর্য যখন দিগন্তের ১৮° নিচে থাকে) তখন দিগন্তরেখার সমান্তরালে প্রকাশিত অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের ঔজ্জ্বল্যের পরিমাণ হয় ৬দ্ধ১০-৫ ফুট ক্যান্ডেল (আলোর ঔজ্জ্বল্যের একক)।

দেখুন-

Explanatory supplement to the astronomical ephemeris and the American ephemeris and nautical almanac, p.399. Issued by  H.M. Nautical Almanac Office. 1961.

নটিক্যাল আলম্যানাক অফিস থেকে ১৯৯২ সালে প্রকাশিত আরেকটি এক্সপ্ল্যানেটরি সাপ্লিমেন্টেও প্রায় একই কথা বলা হয়েছে। তাতে আছে-

At an altitude of -18°, astronomical twilight, the indirect illumination from the Sun on a horizontal surface is about 6×10-4 lux.

অর্থাৎ ১৮°-এ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট যখন শুরু হয় বা শেষ হয় তখন দিগন্তের সমান্তরালে প্রকাশিত অপ্রত্যক্ষ সূর্যের এই আলোকের পরিমাণ থাকে ৬দ্ধ১০-৪ লাক্স (আলোর ঔজ্জ্বল্যের একক)।

দেখুন-

Explanatory Supplement to the Astronomical Almanac p.33. ©1992 By University Science Books.

অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের আলো যে দিগন্তের ডানে-বামে উভয় দিকে বিস্তৃতভাবে প্রকাশিত হয় তা এই দুই বক্তব্য থেকে পুরোপুরি স্পষ্ট। অথচ এটি সুবহে কাযিব হলে এর পরিচয়ে তারা এটি না বলে এ কথা বলতেন যে, অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট পড়হব (শঙ্কু) বা পিরামিড আকারে দিগন্তের উপর দিকে লম্বালম্বিভাবে দৃশ্যমান। কিন্তু আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের কোনো বইয়ে এমন কথা পাওয়া যায় না।

আর এই বইটি ছাড়াও এডমিরালটি ম্যানুয়াল অফ ন্যাভিগেশন’, ‘অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এফিমেরিসনটিক্যাল আলম্যানাকএই বইগুলো যে যে প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত, সেসব প্রতিষ্ঠানসহ অন্য আরো অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের বহু বই থেকে জোডিয়াকাল লাইট সুবহে কাযিব হওয়ার এবং অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে সাদিক হওয়ার প্রমাণ আমরা পূর্বে পেশ করে এসেছি। অতএব এই বইগুলোতেই আবার এর বিপরীত তথ্য যে থাকতে পারে না- তা তো পরিষ্কার।

মোটকথা, আহসানুল ফাতাওয়াতে এই শিরোনামের অধীনে এই কয়টি বইয়ের নাম লিখে দিলেও এগুলোতে নিজ দাবির পক্ষের কোনো প্রমাণ নেই। বরং এগুলোতে ১৮°-এ সুবহে সাদিক হওয়ারই সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে।

হাইড্রোগ্রাফি নেভাল হেডকোয়ার্টারের পত্র

আহসানুল ফাতাওয়াতে এই শিরোনামের অধীনে তারপর পাকিস্তান হাইড্রোগ্রাফি নেভাল হেডকোয়ার্টার’-এর ডাইরেক্টরের পক্ষ থেকে ইংরেজি ভাষায় প্রদত্ত হযরত মুফতী রশীদ আহমাদ রাহ.-এর প্রশ্নের জবাবী একটি পত্র তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু মুফতী রশীদ আহমাদ রাহ.-এর প্রশ্নপত্রটি তাতে উল্লেখ করা হয়নি। আর আহসানুল ফাতাওয়াতে পত্রটির একটি খোলাসাও প্রদান করা হয়েছে।

এই পত্রে মোট পাঁচটি পয়েন্ট রয়েছে। প্রথম পয়েন্টে শুরুতে নটিক্যাল আলম্যানাক’-এর পরিচয় তুলে ধরে বলা হয়েছে-

From the nautical almanac of 1970 the times of sunrise and twilight have been calculated to compare your computations, The results are as under-

 ‘নটিক্যাল আলম্যানাক১৯৭০-এর সংখ্যা থেকে সূর্যোদয় ও টোয়াইলাইটের সময় বের করা হয়েছে আপনার (অর্থাৎ হযরত মুফতী রশীদ আহমাদ রাহ.) সময়ের হিসাবগুলো মিলানোর জন্য। যার ফলাফল নিম্নরূপ।

এই কথা বলে পত্রটিতে দুটি স্থানের ১৫°-এর সময় উল্লেখ করা হয়েছে। একটি হল, ২৫:৪৬ʹ (২৫.৭৬৬°) উত্তর ও ৬৮:৪০ʹ (৬৮.৬৬৬°) পূর্ব স্থানের ১১-০৬-৭০ তারিখে ১৫°-এর সময়। অপরটি, করাচির ২৪:৫২ʹ(২৪.৮৬৬°) উত্তর ও ৬৭:২৫ʹ (৬৭.৪১৬°) পূর্ব এলাকার ২০-০৬-৭০, ২০-০৯-৭০ ও ২০-১২-৭০ মোট এই তিন তারিখের ১৫°-এর সময়। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৬৮)

আহসানুল ফাতাওয়াতে যেখানে এই পত্রের খোলাসা লেখা হয়েছে সেখানেও করাচির এই স্থানের এই তিন তারিখের ১৫°-এর সময় উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এটি কেন তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, এর দ্বারা কী প্রমাণিত হয়- আহসানুল ফাতাওয়ার কোথাও এর কোনো বিবরণ পাওয়া যায়নি।

কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ হল ২৫:৪৬ উত্তর ও ৬৮:৪০ পূর্ব স্থানের ১১-০৬-৭০ ঈ. তারিখে ১৫°-এর সময়টি। এই স্থানটি হল, টন্ডুআদমের মুশাহাদার জায়গা। যেখানে মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.-সহ আলেমগণের এক জামাত মুশাহাদার জন্য গমন করেছিলেন। ১১-০৬-৭০ ঈ. ও ১২-১১-৭০ ঈ. এই দুই দিন সেখানে তাঁরা সুবহে কাযিব ও সুবহে সাদিক মুশাহাদার চেষ্টা করেন। যার বিবরণ আহসানুল ফাতাওয়াতে রয়েছে এবং একে নিজ দাবির পক্ষে মজবুতভাবে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে।

তো এই পত্রটিতে উক্ত স্থানে ১১.-০৬-৭০ ঈ. তারিখে ১৫°-এর সময় উল্লেখ করা হয়েছে ৪:২০ মিনিট। অথচ আহসানুল ফাতাওয়াতে আছে, ঐ দিন সেখানে তারা সর্বসম্মতভাবে পরিপূর্ণ স্পষ্ট আকারে ৪:১৯ মিনিটে সুবহে সাদিক দেখেছেন। এমনকি তাদের কারো কারো মতে এই আলোটি মূলত ৪:১৯ মিনিটের আরো আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৭৬)

অতএব আহসানুল ফাতাওয়াতে বিদ্যমান মুশাহাদার বিবরণ এবং আহসানুল ফাতাওয়াতেই উল্লেখিত এই পত্রটি দ্বারা পরিষ্কারভাবেই সুবহে সাদিক ১৫°-এর আগে শুরু হওয়া প্রমাণিত হয়ে যায়। যার আরো বিস্তারিত বিবরণ আমরা পেছনে পেশ করে এসেছি।

তারপর দেখুন, আহসানুল ফাতাওয়াতে এই পত্রের খোলাসা দেওয়া হয়েছে। এই খোলাসায় উক্ত পত্র থেকে করাচির ঐ জায়গার তিন দিনের ১৫°-এর সময়টি উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ এর দ্বারা আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে হাঁ-না কোনোটিরই প্রমাণ নেই। অপরদিকে এই পত্রে টন্ডুআদম-এর ১৫°-এর যে সময় উল্লেখ করা হয়েছে, আহসানুল ফাতাওয়ার প্রদত্ত খোলাসায় তা উল্লেখই করা হয়নি। অথচ সে তথ্যের সাথে মাসআলার তাহকীক জড়িত। কারণ, এ পত্রে প্রদত্ত ১৫°-এর সময়ের আগেই সেখানে তারা সুবহে সাদিক মুশাহাদা করেছিলেন।

আরো লক্ষ্য করুন, এই পত্রটিতে উক্ত স্থানের শুধু ১১-০৬-৭০ ঈ. তারিখের ১৫°-এর সময় উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে, তাদের কাছে শুধু এই দিনের ১৫°-এর সময়ই জানতে চাওয়া হয়েছে। অথচ সেখানে তাঁরা পরের দিন ১২-০৬-৭০ ঈ. তারিখেও মুশাহাদা করেছেন। আহসানুল ফাতাওয়াতে আছে, সেই দিন তাঁরা সর্বসম্মতভাবে সুস্পষ্ট আকারেই ৪:১৭ মিনিটে সুবহে সাদিক মুশাহাদা করেছেন। আর সুবহে কাযিব মুশাহাদা করেছেন ঠিক চারটায়। আমাদের প্রশ্ন, এই তারিখে সেখানে ১৮° ও ১৫°-এর সময় কখন হয় তা কেন জানতে চাওয়া হয়নি তাদের কাছে? ঠিক চারটার সময় তাঁরা যে সেখানে সুবহে কাযিব দেখেছেন, তা ১৮°-এর সময় ছিল, নাকি ১৮°-এর আগের সময়- সেটি কেন তাদের কাছে প্রশ্ন করা হল না? ইচ্ছা করেই কি তা জানতে চাওয়া হয়নি- আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।

বাস্তবতা হল, সেদিন তাঁরা সুবহে কাযিব দেখেছেন ১৮°-এর আগে এবং সুবহে সাদিকও দেখেছেন ১৫°-এর আগে। যার বিস্তারিত বিবরণ পেছনে পেশ করা হয়েছে।

এ গেল পত্রটির প্রথম পয়েন্টের উপর আলোচনা। এর দ্বিতীয় পয়েন্টে প্রথমে নটিক্যাল আলম্যানাক ১৯৭০’ -এর সংখ্যা থেকে একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে। এতে Basis of the tabulations বলে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত ও নটিক্যাল টোয়াইলাইট ও সিভিল টোয়াইলাইট এগুলোর সময়ের যে চার্ট নটিক্যাল আলম্যানাক’-এ দেওয়া হয়েছে তা কীসের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে- এর বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু  অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট কিংবা ১৮°-এর সময় সম্পর্কে তাতে কোনো কথা নেই। অতএব পত্রটির এই পয়েন্টে আমাদের আলোচ্য বিষয়ের পক্ষের বা বিপক্ষের কোনো কিছুই নেই।

তারপর পত্রটিতে এডমিরালটি ম্যানুয়াল অফ ন্যাভিগেশন দ্বিতীয় খন্ড ১৩৭ পৃষ্ঠা থেকে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে, যা পর্যালোচনাসহ একটু আগেই উল্লেখ করা হল।

এর উপর বিভিন্ন দিক থেকে দালীলিক বিস্তারিত আলোচনা আমরা পূর্বে তুলে ধরেছি। যা মাসিক আলকাউসার যিলহজ¦ ১৪৪১ হি./আগস্ট ২০২০ ঈ. সংখ্যায় ছেপেছিল। প্রয়োজনে সেটি আবার দেখে নেওয়া যেতে পারে।

এই পত্রটির পরবর্তী পয়েন্টে (৩ নম্বরে) বলা হয়েছে-

3. The times of صبح صادق or    صبح كاذب   and other requirements can be obtained from the above stated arguments according to the definitions of the terms.

অর্থাৎ সুবহে সাদিক বা সুবহে কাযিব ও প্রয়োজনীয় অন্য যে কোনোটির সময় প্রত্যেকটির সংজ্ঞা অনুসারে উপরের উদ্ধৃত বক্তব্যের মূলনীতির ভিত্তিতে বের করা সম্ভব।

স্পষ্টত, এখানে সুবহে সাদিকের সময় কখন শুরু হয়, কিংবা সুবহে কাযিব কখন আরম্ভ হয়- কোনো কিছুই বলা হয়নি। এখানে শুধু বলা হয়েছে, সুবহে সাদিক বা সুবহে কাযিব বা অন্য যে কোনো বিষয় আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের যে পরিভাষার সাথে মিলবে সে অনুযায়ী এর সময় বের করা যাবে। ব্যস্, এতটুকুই তাদের বক্তব্য। এখন সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিবের কোন্টি আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের কোন্ পরিভাষার সাথে মেলে এবং কোন্টি কত ডিগ্রিতে শুরু হয় এ ব্যাপারে তাতে কিছুই বলা হয়নি। অতএব পত্রটির এই পয়েন্ট দ্বারাও আলোচ্য বিষয়ের কোনো কিছু প্রমাণিত হচ্ছে না।

পত্রটির ৪ নং পয়েন্টে আছে-

4. A comparison of the times given by you for 22nd September and 22nd December, 1970 indicates that they relate to Astronomical twilight (morning) when the sun is 18° below the horizon. For 22nd June 1970 the time given is a little earlier.

এখানে বলা হয়েছে, আপনি ২২ সেপ্টেম্বর ও ২২ ডিসেম্বর ১৯৭০ ঈ.-এর যে সময় সম্পর্কে প্রশ্ন করেছেন সেটি অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের সময়। সূর্য যখন দিগন্তের ১৮° নিচে থাকে। আর ২২ জুনের সময়টি এর অল্প আগের।

লক্ষ্য করুন, এই কথায়ও আমাদের আলোচ্য বিষয়ে আহসানুল ফাতাওয়ার প্রমাণ হতে পারে- এমন কিছু নেই। ২২ সেপ্টেম্বর, ২২ ডিসেম্বর ও ২২ জুন ১৯৭০ ঈ.-এর ১৮°-এর সময় দ্বারা ১৫°-এ সুবহে সাদিকের দাবির কী প্রমাণিত হয়, কিংবা ১৮°-এ সুবহে সাদিকের বক্তব্যের উপর কোন্ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়- এ সম্পর্কে কোনো কথা নেই আহসানুল ফাতাওয়াতে। সুতরাং এই প্রশ্নের উত্তর তাদের কাছে কেন জানতে চাওয়া হয়েছে আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।

বাকি থাকল পত্রটির সর্বশেষ পয়েন্ট। তাতে বলা হয়েছে-

5. The chart of time supplied by you has also been compared and the times given for صبح صادق as well as sunrise generally tally with other times calculated from the Nautical Almanac for Astronomical twilight and sunrise respectively.

এখানে বলা হয়েছে, আপনার সরবরাহকৃত সময়ের চার্ট এবং আপনার প্রদত্ত সুবহে সাদিকের সময় ও সূর্যোদয়ের সময়- এগুলোকে  নটিক্যাল আলম্যানাকথেকে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের সময় ও সূর্যোদয়ের সময়ের সাথে মিলিয়ে দেখা হয়েছে।

পত্রটির এই অংশ দ্বারাও যে আহসানুল ফাতাওয়ার কোনো দাবি প্রমাণিত হয় না- তাও বলার অপেক্ষা রাখে না। কোন্ প্রশ্নের জবাবে এই কথা বলা হয়েছে সেটিই তো এখানে স্পষ্ট নয়।

এই হল পাকিস্তান হাইড্রোগ্রাফি নেভাল হেডকোয়ার্টারের ডাইরেক্টরের পত্রটির পুরো বক্তব্য। যাতে আমরা দেখলাম, আহসানুল ফাতাওয়ার দাবি প্রমাণিত হওয়ার মতো কোনো তথ্য তো নেই-ই; বরং এতে এমন তথ্য আছে, যার দ্বারা আহসানুল ফাতাওয়ার দাবিই উল্টো ভুল সাব্যস্ত হয়। সেটি হল, ২৫:৪৬ উত্তর ও ৬৮:৪০ পূর্ব অবস্থান স্থল (টন্ডুআদম)-এর ১৫°-এর সময়। যার বিবরণ এখানেই একটু আগে এবং পেছনে আহসানুল ফাতাওয়ার মুশাহাদার পর্যালোচনায় বিস্তারিত আলোচনাসহ পেশ করা হয়েছে।

পাকিস্তান আবহাওয়া অধিদপ্তরের ডাইরেক্টরের পত্র

আহসানুল ফাতাওয়াতে উক্ত শিরোনামে এরপর পাকিস্তান আবহাওয়া অধিদপ্তরের ডাইরেক্টর কর্তৃক প্রেরিত একটি পত্র তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এরও প্রশ্নপত্র তাতে উল্লেখ করা হয়নি। শেষে পত্রটির একটি খোলাসা ও সারসংক্ষেপও উল্লেখ করা হয়েছে।

এই পত্রটিতে মোট চারটি পয়েন্টে উত্তর প্রদান করা হয়েছে। প্রথম পয়েন্টে বলা হয়েছে-

1. We have no comments to offer.

অর্থাৎ আমাদের কাছে এর কোনো উত্তর নেই।

পত্রটির প্রথম পয়েন্টে শুধু এটুকু কথাই আছে। কিন্তু প্রশ্নপত্রটি উল্লেখ না করার কারণে কীসের ব্যাপারে এই উত্তর প্রদান করা হয়েছে তা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আহসানুল ফাতাওয়াতে এই উত্তরটির কোনো ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়নি। যেখানে উর্দু ভাষায় পত্রটির খোলাসা ও সারসংক্ষেপ লেখা হয়েছে সেখানেও এই সংশ্লিষ্ট কোনো কথা নেই।

তারপর পত্রটির দ্বিতীয় পয়েন্টে প্রথমে বলা হয়েছে-

2. The time for the beginning of morning astronomical twilight for 12th June is 4h 11m. The begining of morning astronomical twilight is taken to be the time when the Sun is 18° below horizon.

অর্থাৎ ১২ জুন  অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের সময় হয় ৪:১১ মিনিটে আর সূর্য যখন দিগন্তের ১৮° নিচে থাকে, সেই সময়টিকে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের শুরু ধরে নেওয়া হয়ে থাকে।

এই বিষয়ে সামনে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

এরপর বলা হয়েছে-

We have no comments to offer on the timings in the different charts given, the timings of Sub-he-Sadiq for Karachi.

অর্থাৎ করাচির সুবহে সাদিকের সময় সম্পর্কিত আপনাদের দেওয়া বিভিন্ন চার্ট সম্পর্কে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই।

পত্রটির তৃতীয় পয়েন্টে আছে-

3. When the Sun is 18° below horizon, all light from the sun is cut off.

অর্থাৎ (সন্ধ্যায়) সূর্য যখন দিগন্ত থেকে ১৮° নিচে চলে যায় তখন সূর্য থেকে আসা সমস্ত আলো বন্ধ হয়ে যায়।

এ কথাটিকে আহসানুল ফাতাওয়াতে দলীল হিসেবে উল্লেখ করা হলেও তা যে কোনোভাবেই আলোচ্য বিষয়ে দলীল হতে পারে না- এর উপর বিস্তারিত আলোচনা আমরা পূর্বে তুলে ধরেছি। এখানে তৃতীয় পত্রটির বক্তব্য উল্লেখ করার পর এ সংক্রান্ত আরো কিছু আলোচনা পেশ করা হবে ইনশাআল্লাহ।

এই পত্রের চতুর্থ ও সর্বশেষ পয়েন্ট হচ্ছে-

4. This Department has not undertaken any work on the determination of the timings of Sub-he-Sadiq according to the definition given in the 'note' at the end of page 4 of the Report enclosed with your letter. These timings can, however, be calculated for any location if the phenomena Sub-he-Sadiq is precisely defined with respect to the position of the Sun below horizon. Without this the calculation of the timings will not be possible and as you have yourself noticed, will be subject to the personal error of the observer.

এখানে বলা হয়েছে, আপনার চিঠিতে প্রদত্ত সুবহে সাদিকের সংজ্ঞা অনুযায়ী এর সময় নির্ধারণের বিষয়ে আমাদের এই বিভাগ কোনো কাজ করে না। যে কোনো জায়গার সুবহে সাদিকের সময় বের করা সম্ভব যদি দিগন্তের নিচে সূর্যের অবস্থান দ্বারা এটিকে নির্ধারণ করা যায় (অর্থাৎ সুবহে সাদিকের সময় সূর্য দিগন্তের কত ডিগ্রি নিচে থাকে তা যদি নির্ণয় করা যায় তখন)। এটি ছাড়া এর সময় বের করা সম্ভব হবে না।

পত্রটির এই পয়েন্ট এবং দ্বিতীয় পয়েন্টের শেষ কথাটি থেকে স্পষ্ট যে, সুবহে সাদিক কত ডিগ্রিতে শুরু হয়- এ বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। তারা বরং বলেছেন, সুবহে সাদিক কত ডিগ্রিতে শুরু হয় তা নির্ধারণ করে দিলে এর সময় তারা বের করে দিতে পারবেন। অতএব পত্রটিতে যখন তারা স্পষ্টভাবে এ কথা বলেই দিয়েছেন, এরপর আলোচ্য বিষয়ে এই পত্র দ্বারা কোনো কিছু প্রমাণিত হওয়ার সুযোগই থাকছে না।

পাকিস্তান আবহাওয়া অধিদপ্তরের  ডেপুটি ডাইরেক্টরের পত্র

আহসানুল ফাতাওয়াতে এ বিষয়ে তৃতীয় আরেকটি পত্র উল্লেখ করা হয়েছে পাকিস্তান আবহাওয়া অধিদপ্তরের  ডেপুটি ডাইরেক্টরের। অবশ্য এখানে উত্তরপত্রটির সাথে প্রশ্নও উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশ্নগুলো এই-

امور ذیل سے متعلق اپنے محکمہ کی تحقیق تحریر فرمائیں:

-کراچی کے عام نقشوں میں صبح صادق کے اوقات یہ ہیں: ২২ جونبجکر ১১ منٹ، ২২ ستمبربجکرمنٹ، ২২ دسمبربجکر ৪৯منٹ۔ اس وقت آفتاب افق سے کتنے درجہ نیچے ہوتا ہے؟

-جب آفتاب افق سے ১৮درجہ نیچے ہوتا ہے اس وقت افق پر کسی قسم کی روشنی ہوتی ہے یا نہیں؟

-کراچی کے لئے صبح صادق (১৫درجہ زیر افق) کے اوقات تحریر کریں۔

এর অর্থ হল-

নিম্নোল্লিখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে আপনার বিভাগের মতামত লিখুন :

১. করাচির নামাযের সময়সূচিগুলোতে ব্যাপকভাবে সুবহে সাদিকের সময় এভাবে আছে : ২২ জুন, ৪:১১ মিনিট; ২২ সেপ্টেম্বর, ৫:৩ মিনিট; ২২ ডিসেম্বর, ৫:৪৯ মিনিট। এই সময় সূর্য দিগন্তের কত ডিগ্রি নিচে থাকে?

২. সূর্য যখন দিগন্ত থেকে ১৮° নিচে থাকে তখন দিগন্তে কোনো আলো থাকে কি না?

৩. করাচির জন্য সুবহে সাদিক (১৫°)-এর সময় লিখুন। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৭১)

এই তিনটি প্রশ্নের জবাবে পত্রটিতে বলা হয়েছে-

(1) The sun is approximately 18 degrees below the horizon at the times given on the dates specified.

(2) When the sun is 18° degrees below the horizon all light from the sun is cut off.

(3) The times, correct to the nearest helf min., calculated for meteorological observatory at Karachi Airport (coordinates 24°54' N & 67°08' E) when the sun is 15°below the horizon on the dates specified are as follows.

এই পত্রটিতে মৌলিক দুটি বিষয় রয়েছে :

এক. করাচির জন্য কয়েকটি তারিখের ১৮° ও ১৫°-এর সময়ের হিসাব।

দুই. ১৮°-এর সময় আকাশে কোনো আলো থাকে কি না- এই প্রসঙ্গ। দ্বিতীয় পত্রটিতেও এই দুইটি বিষয় ছিল। সামনে আমরা এই দুই বিষয় নিয়ে পৃথকভাবে আলোচনা তুলে ধরছি ইনশাআল্লাহ।

করাচির ১৮° ও ১৫°-এর সময় প্রসঙ্গ

আহসানুল ফাতাওয়াতে উল্লেখকৃত এই পত্র তিনটিতেই করাচির জন্য বিভিন্ন তারিখের সময়ের হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। প্রথম পত্রের প্রথম পয়েন্টে ২০ জুন ১৯৭০, ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭০ ও ২০ ডিসেম্বর ১৯৭০ এই তিনটি তারিখের ১৫°-এর সময় দেওয়া হয়েছে। এই পত্রের চতুর্থ পয়েন্টে উল্লেখ করা হয়েছে ২২ জুন, ২২ সেপ্টেম্বর ও ২২ ডিসেম্বর ১৯৭০-এর তিনটি সময় সম্পর্কে প্রশ্নের জবাব। দ্বিতীয় পত্রে ১২ জুনের ১৮°-এর সময় লেখা হয়েছে। তৃতীয় পত্রের প্রথম প্রশ্নে ২২ জুন, ২২ সেপ্টেম্বর ও ২২ ডিসেম্বর- এই তিন তারিখের তিনটি সময় সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে, সূর্য তখন দিগন্তের কত ডিগ্রি নিচে থাকে। যার উত্তর পত্রটিতে দেওয়া হয়েছে। এই পত্রে তিন নম্বর পয়েন্টে উক্ত তিন তারিখের ১৫°-এর সময়ও দেওয়া হয়েছে।

খোলাসা কথা হল, এই তিনটি পত্রে তিনরকম তারিখের সময় প্রদান করা হয়েছে। প্রথম পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০ জুন ১৯৭০, ২০ সেপ্টেম্ব ১৯৭০ ও ২০ ডিসেম্বর এবং ২২ জুন, ২২ সেপ্টেম্বর ও ২২ ডিসেম্বর-এর সময়। দ্বিতীয় প্রত্রে ১২ জুনের সময় এবং তৃতীয় পত্রে ২২ জুন, ২২ সেপ্টেম্বর ও ২২ ডিসেম্বর-এর সময়। এখন দেখার বিষয় এই তারিখগুলোর ১৮° কিংবা ১৫°-এর সময় উল্লেখ করার দ্বারা কী উদ্দেশ্য, কী এর প্রসঙ্গ? এবং এর দ্বারা কী প্রমাণিত হয়?

প্রথম পত্রের ২০ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর এবং প্রথম ও তৃতীয় পত্রের ২২ জুন ও ২২ সেপ্টেম্বর- এই চার তারিখের কোনো প্রসঙ্গই আমরা আহসানুল ফাতাওয়াতে খুঁজে পাইনি। এই দুই পত্রের বাইরে আহসানুল ফাতাওয়ার কোথাও এই চার তারিখ সম্পর্কে কোনো কথা নেই। আহসানুল ফাতাওয়ায় উর্দুতে পত্রগুলোর খোলাসাও উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানেও পত্রগুলোতে বিদ্যমান এসব তারিখের ১৮° কিংবা ১৫°-এর সময় লেখা হয়েছে। কিন্তু এই তারিখগুলোর প্রসঙ্গ কী? এর দ্বারা কী প্রমাণিত হয়- সেখানেও এর কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।

আর প্রথম পত্রের ২০ ডিসেম্বর এবং প্রথম ও দ্বিতীয় পত্রের ২২ ডিসেম্বর- এই দুই তারিখের একটি প্রসঙ্গ আহসানুল ফাতাওয়াতে পাওয়া যায়। কিন্তু তা দ্বারা আহসানুল ফাতাওয়ার কোনো দাবি প্রমাণিত হওয়ার যে সুযোগ নেই- তা আহসানুল ফাতাওয়া দ্বারাই পরিষ্কার। আহসানুল ফাতাওয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে-

دسمبر ১৯৭১ میں پاک وہند کی جنگ کے دوران بلیک آوٹ کی وجہ سے شہر کے اندر رہتے ہوئے مشاہدات کا بہترموقع مل گیا۔۔۔ اس پورے مشاہدہ میں میرے ساتھ ایک صاحب اور بھی تھے۔۔ ২০ تا ২২ دسمبر ابر کی وجہ سے صبح کا مشاہدہ نہ ہوسکا۔

এখানে বলা হয়েছে, ১৯৭১-এ যুদ্ধের সময় ব্ল্যাকআউটের কারণে শহরের ভেতরে থেকেই মুশাহাদার ভালো সুযোগ পাওয়া যায়। এই পুরো মুশাহাদায় সাথে আরেকজনও ছিলেন। ... ২০ থেকে ২২ ডিসেম্বর মেঘের কারণে সুবহের মুশাহাদা সম্ভব হয়নি। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮২)

এই হচ্ছে আহসানুল ফাতাওয়ার ২০ ও ২২ ডিসেম্বরের প্রসঙ্গ। এই দুই দিন শহরের ভেতর থেকে মুশাহাদার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আহসানুল ফাতাওয়ার বক্তব্য অনুযায়ীই মেঘের কারণে ঐ দিনগুলোতে মুশাহাদা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এই প্রসঙ্গটি ছাড়া আহসানুল ফাতাওয়ার অন্য কোথাও এই দুই তারিখ কেন্দ্রিক কোনো কথা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

আহসানুল ফাতাওয়ার প্রথম ও তৃতীয় পত্রের সবগুলো তারিখের পর্যালোচনা উল্লেখ করা হল। বাকি থাকল দ্বিতীয় পত্রের তারিখের প্রসঙ্গ। এই পত্রটিতে ১২ জুন ১৮°-এর সময় লেখা হয়েছে ৪:১১ মিনিট। আর এর মূল প্রসঙ্গ হচ্ছে ১২ জুন টান্ডুআদমের মুশাহাদা। এই তারিখে সেখানে তারা ঠিক চারটার সময় সুবহে কাযিব দেখেছেন। অ্যাস্ট্রোনমির হিসাব অনুযায়ী সেটি ছিল ১৮°-এর ৩ মিনিট ১৭ সেকেন্ড আগের সময়। কারণ, অ্যাস্ট্রোনমির হিসাব অনুযায়ী সেখানে উক্ত তারিখে ১৮°-এর সময় হয় ৪:০৩ মিনিট ১৭ সেকেন্ডে। এক্ষেত্রে এটিই হচ্ছে সঠিক ও শাস্ত্রীয় হিসাব। কিন্তু আহসানুল ফাতাওয়াতে এক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় পদ্ধতির হিসাব এড়িয়ে গিয়ে ভিন্ন পদ্ধতির হিসাবের আশ্রয় নিয়ে জুনের ১২ তারিখ টান্ডুআদমে চারটার সময়কে ১৮°-এর সময় বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই হিসাবের একটি ভুল ছিল ১২ জুন করাচিতে ১৮°-এর সময় ৪:১১ মিনিটে হওয়ার দাবি। যার খ-ন আহসানুল ফাতাওয়ার মুশাহাদার পর্যালোচনায় আমরা পেশ করে এসেছি। কিন্তু এখানে  এসে আবার প্রশ্ন আসে। কারণ, ১২ জুন ১৮°-এর সময় ৪:১১ মিনিটে হওয়ার কথা শুধু আহসানুল ফাতাওয়াতেই তো দাবি করা হয়নি। এই পত্রটিতেও তো একই কথা বলা হয়ছে। তাহলে এর কী উত্তর?

জেনে রাখা দরকার, করাচি সিটি অনেক বড়। এর আয়তন ৩৫২৭ বর্গ কিলোমিটার এবং এর অক্ষাংশ সর্বনিম্ন ২৪.৮৩° এবং সর্বোচ্চ ২৫.৬৩°। তবে করাচির সদর শহরের স্থানাঙ্ক ২৪:৫২ (২৪.৮৬°) অক্ষাংশ ও ৬৭:২ (৬৭.০৩°) দ্রাঘিমাংশ। যা আহসানুল ফাতাওয়ার প্রথম পত্রেও রয়েছে। শহরের এই মূল অংশে জুনের ১২ তারিখ ৪:১১ মিনিটে ১৮°-এর সময় হওয়ার দাবি ভুল। বরং এই তারিখে ৪:১১ মিনিটে ১৮°-এর সময় হয় মূল শহরের বাইরে পূর্ব-উত্তর ও পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত করাচিরই অন্য দুইটি শহরে। পূর্ব-উত্তরের এই শহরের নাম গাডাপ টাউন (Gadap Town)| এর স্থানাঙ্ক-

25.12N; 67.31E (UC-3 Gadap, Karachi City)

আর পূর্ব-দক্ষিণের শহরটির নাম বিন কাসিম টাউন। যার স্থানাঙ্ক- ২৪.৮৬০৭৩৪৩ ঘ; ৬৭.৫২৫৫ ঊ

(VG6G+75 Bin Qasim Town, Karachi)

করাচি শহরের বাইরে এই দুই শহরে ১২ জুন ৪:১১ মিনিটে ১৮°-এর সময় হয়।

এখন আহসানুল ফাতাওয়ার দ্বিতীয় পত্রটির বক্তব্য লক্ষ্য করে দেখুন। এতে জুনের ১২ তারিখ ১৮°-এর সময় লেখা হয়েছে ৪:১১ মিনিট। কিন্তু এই হিসাব করাচির কোন্ স্থানের- তাতে এ সম্পর্কে কোনো কথাই নেই। পত্রে এই বক্তব্যটি পুনরায় ভালোভাবে খেয়াল করে পড়ে দেখুন-

The time for the beginning of morning astronomical twilight for 12th June is 4h 11m. The begining of morning astronomical twilight is taken to be the time when the Sun is 18° below horizon.

তাতে তারিখ ও সময় তো বলা হয়েছে। কিন্তু জায়গার নাম নেই। কোন্ এলাকার সময়, কিংবা কোন্ অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের এই হিসাব- তা কিছুই বলা হয়নি। এমনকি এটি করাচির সময়- এ কথাটুকুও নেই। আর এর প্রশ্নপত্রটিও নেই, যার দ্বারা বোঝা যাবে- এটি কোন্ এলাকার সময়ের হিসাব। সুতরাং কোন্ জায়গার সময় সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে পত্রটিতে এই সময় লেখা হয়েছে তা বোঝারই সুযোগ থাকেনি। তাই এ পত্রের এই অংশটুকু দ্বারা প্রশ্ন উত্থাপনেরও সুযোগ নেই।

বাকি এটি যে করাচির মূল শহরের সময়ের হিসাব নয় তা চূড়ান্ত বিষয়। করাচির জন্য এই সময়ের এই হিসাব প্রদান যে ভুল- অ্যাস্ট্রোনমির হিসাব দ্বারা তা প্রমাণিত। সাথে সাথে আহসানুল ফাতাওয়া থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়।

লক্ষণীয় যে, এই পত্রটিতে বলা হয়েছে, ১২ জুন ১৮°-এর সময় হয় ৪:১১ মিনিটে। আহসানুল ফাতাওয়াতে এর খোলাসায় আরো লেখা হয়েছে-

১২ جون کو  اسٹرونومیکل ٹوایلائٹبجکر ১১ منٹ پر شروع ہوتی ہے، (جیسے مروجہ نقشوں میں ہے) اسوقت آفتاب افق سے ১৮ درجہ نیچے ہوتاہے۔

অর্থাৎ প্রচলিত সময়সূচিগুলোতে ১২ জুন ফজরের ওয়াক্ত লেখা আছে ৪:১১ মিনিট; যা ১৮°-এর সময়। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৭৩)

আহসানুল ফাতাওয়াতে মুশাহাদার বিবরণেও বলা হয়েছে, করাচির পুরোনো সময়সূচিগুলোতে ১২ জুন সুবহে সাদিকের সময় দেওয়া আছে ৪:১১ মিনিট। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৭৭)

তাহলে আহসানুল ফাতাওয়ার বক্তব্য দ্বারা এই বিষয়টি পরিষ্কার যে, প্রচলিত সময়সূচিগুলোতে করাচিতে ১২ জুন সুবহে সাদিক তথা ফজরের ওয়াক্ত ৪:১১ মিনিট লেখা আছে। এখন আহসানুল ফাতাওয়ার আরেকটি বক্তব্য লক্ষ্য করুন। তৃতীয় পত্রের প্রথম প্রশ্নে আহসানুল ফাতাওয়ায় বলা হয়েছে-

کراچی کے عام نقشوں میں صبح صادق کے اوقات یہ ہیں: ২২ جونبجکر ১১ منٹ۔

এখানে বলা হয়েছে, করাচির সময়সূচিগুলোতে ব্যাপকভাবে ২২ জুন সুবহে সাদিকের সময় (ফজরের ওয়াক্ত) লেখা আছে ৪:১১ মিনিট। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৭১)

এখন ভেবে দেখুন, বিষয়টি কী দাঁড়াচ্ছে! আহসানুল ফতাওয়ার বক্তব্য অনুযায়ী করাচির সময়সূচিগুলোতে ১২ জুনও সুবহে সাদিকের (১৮°-এর) সময় লেখা আছে ৪:১১ মিনিট, ২২ জুনও সুবহে সাদিকের (১৮°-এর) সময় লেখা আছে ৪:১১ মিনিট! তার মানে ১২ জুন থেকে ২২ জুন পর্যন্ত ১৮°-এর সময় একই। অথচ আহসানুল ফাতাওয়ায় প্রদত্ত (১৫° অনুযায়ী) করাচির সময়সূচিই দেখুন, তাতে ১৫° অনুযায়ী ১২ জুন ফজরের ওয়াক্ত লেখা হয়েছে ৪:২৯ মিনিট। তারপর ১৬ জুন থেকে ২১ জুনের সময় ৪:৩০ মিনিট এবং ২২ জুনের সময় ৪:৩১ মিনিট। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/২৬৮)

তাহলে আহসানুল ফাতাওয়ায় প্রদত্ত সময়সূচি দ্বারাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, ১২ জুন থেকে ২২ জুন পর্যন্ত ২ মিনিট সময়ের ব্যবধান। অর্থাৎ ১২ জুন যখন ১৫°-এর সময় হয়, ২২ জুন ১৫°-এর সময় হয় এর দুই মিনিট পর। ১৫°-এর সময়ের ক্ষেত্রে এই হচ্ছে আহসানুল ফাতাওয়ার হিসাব। কিন্তু ১৮°-এর ক্ষেত্রে এসে এই হিসাব পরিবর্তন হয়ে গেছে! এক্ষেত্রে তাতে বলা হচ্ছে, ১২ জুনও ১৮°-এর সময় হয় ৪:১১ মিনিট, ২২ জুনও ১৮°-এর সময় হয় ৪:১১ মিনিট। অর্থাৎ উভয় তারিখের ১৮°-এর সময় এক।

আরো লক্ষণীয় যে, এখানে ১২ জুন থেকে ২২ জুন- এই দুই তারিখের ১৮°-এর সময়ে ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও উভয় তারিখের জন্য একই সময় প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু ১১ ও ১২ জুন- এই দুই তারিখের ১৮°-এর সময় একই হওয়া সত্ত্বেও উভয় দিনের সময়ে এক মিনিটের ব্যবধান দেখানো হয়েছে। অথচ এই দুই তারিখেরে সময়ে যে কোনো ব্যবধান নেই তাও আহসানুল ফাতাওয়া দ্বারাই প্রমাণিত। আহসানুল ফাতাওয়াতেই (২/২৬৮) ৮ জুন থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত মোট আট দিনের ১৫°-এর সময় লেখা হয়েছে ৪:২৯ মিনিট। কিন্তু আহসানুল ফাতাওয়ার মুশাহাদার বিবরণে (২/১৭৭) নিজ দাবি প্রমাণের জন্য এই দুই তারিখে ১৮°-এর সময়ে এক মিনিট ব্যবধান করে দেখানো হয়েছে। ১১ জুন ৪:১২ মিনিট এবং ১২ জুন ৪:১১ মিনিট। এই হচ্ছে হিসাব-নিকাশের অবস্থা! যে দুই তারিখের সময়ে দুই মিনিটের ব্যবধান, সেখানে এক করে দেওয়া হয়েছে, আর যে দুই তারিখের সময় অভিন্ন, সেখানে ভিন্ন ভিন্ন সময় প্রদান করা হয়েছে!

এখন আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, ১৮°-এর এই সময়গুলো যদি নির্ধারিত একটি স্থানেরই হয় তাহলে সেখানে জুনের ১১ ও ১২ তারিখে ১৮°-এর সময় বিভিন্ন হয় কীভাবে? এবং ১২ জুন থেকে ২২ জুনের সময় এক হয় কী করে? এক্ষেত্রে হয়ত বলতে হবে, উভয় হিসাবই ভুল। নতুবা বলতে হবে, সবগুলো সময় নির্ধারিত একটি এলাকার নয়; বরং ভিন্ন ভিন্ন এলাকার। অর্থাৎ জুনের ১১ তারিখ ৪:১২ মিনিটে ১৮°-এর সময় এক এলাকার এবং জুনের ১২ তারিখ ৪:১১ মিনিটে ১৮°-এর সময় অন্য এলাকার। তেমনিভাবে জুনের ১২ তারিখ ও ২২ তারিখ ১৮°-এর সময় ৪:১১ মিনিটে হওয়ার হিসাব একই এলাকার নয়। আর আহসানুল ফাতাওয়াতে করাচির পুরোনো সময়সূচি থেকে এই সময়গুলো উল্লেখ করার বিষয়টি যদি সঠিক হয় তাহলে সেগুলো করাচির বিভিন্ন এলাকার সময়সূচি থেকে নেওয়া হয়ে থাকবে। যেগুলের কোনোটিই করাচির মূল শহরের সময়সূচি নয়; বরং এর বাইরের করাচি সিটিরই অন্যান্য শহরের সময়সূচি।

সন্ধ্যায় ১৮°-এর পর সূর্য কেন্দ্রিক কোনো আলোই কি প্রকাশিত হয় না?

আহসানুল ফাতাওয়ার ভুল দাবি, অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে কাযিব। তা প্রমাণ করার জন্য আহসানুল ফাতাওয়ার আবিষ্কৃত আরেক ভিত্তিহীন দাবি হল, ভোরে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সূর্যের প্রথম আলো। তাই এটি সুবহে কাযিব। কারণ, সুবহে কাযিবই তো প্রথম। সুবহে সাদিক এরপর দৃশ্যমান হয়। (দেখুন : আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৬২, ১৮৪)

এ সম্পর্কে আমাদের প্রথম কথা হল, কুরআন-হাদীস, ফিকহ-ফতোয়ার কোথায় সুবহে কাযিব সূর্যের প্রথম আলো হওয়ার কথা আছে? এবং সুবহে কাযিব নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তা সূর্যের প্রথম আলো হওয়া-না হওয়ার মানদ- কে প্রদান করেছেন? সুবহে কাযিবের এই পরিচয় এবং তা নির্ণয়ের এই মানদ- তো কোথাও নেই। অতএব সুবহে কাযিবের মূল পরিচয় ও মানদ- উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক এই দাবিটির আশ্রয় নেওয়ার কোনোই অর্থ হয় না। বরং অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে সাদিক না সুবহে কাযিব- এর নির্ণয় হবে এ দুটির শরীয়তকর্তৃক নির্ধারিত পরিচয় ও মানদ- অনুযায়ী। আর এই ভিত্তিতেই আমরা পেছনে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সম্পর্কে বিস্তারিত দলীল-প্রমাণসহ আলোচনা করে এসেছি।

এখন আসা যাক আহসানুল ফাতাওয়ার এই দাবিটির প্রসঙ্গে। অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট ভোর বেলা সূর্যের প্রথম আলো- এই দাবিটি কি সঠিক? এক্ষেত্রে ভালোভাবে মনে রাখা দরকার, ভোরে ১৮°-এর আগে সূর্যের কোনো আলো দৃশ্যমান না হওয়ার দাবি এবং অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটকে ভোর বেলা সূর্যের প্রথম আলো মনে করা সম্পূর্ণ ভুল। এর কোনো বাস্তবতা নেই। অ্যাস্ট্রোনমির কোনো বই থেকে এর প্রমাণ দেখানো সম্ভব নয়। ভোর বেলা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সূর্যের প্রথম আলো- এ কথা অ্যাস্ট্রোনমির কোনো বই থেকে প্রমাণ করা যাবে না। পক্ষান্তরে সন্ধ্যায় ১৮°-এর পর সূর্যের আর কোনো আলো দেখা যায় না- এ কথাও অ্যাস্ট্রোনমির কোনো বই থেকে দেখানো সম্ভব নয়। অ্যস্ট্রোনমির বইয়ে এ কথা আছে যে, ১৮° থেকে আঁধারের শুরু (সন্ধ্যায়) বা সমাপ্তি (ভোরে) ঘটে। আহসানুল ফাতাওয়াতে উল্লেখিত প্রথম পত্রটিতে এডমিরালটি ম্যানুয়াল অফ ন্যাভিগেশনথেকে একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে। সেখানেই বলা হয়েছে-

at which moment absolute darkness is assumed to begin or end so far as the Sun is concerned.

অর্থাৎ ১৮° থেকে পূর্ণ আঁধারের শুরু (সন্ধ্যায়) বা সমাপ্তি (ভোরে) ঘটে বলে ধরে নেওয়া হয়। যার সম্পর্ক সূর্যের সাথে।

সামনে এ সম্পর্কে আরো কয়েকটি বক্তব্য লক্ষ করুন।

Aircraft Navigation Manual

ইউনাইটেড স্টেট্স নেভি ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক প্রস্তুতকৃত, ইউনাইটেড স্টেটস গভর্মেন্ট প্রিন্টিং অফিস থেকে ১৯৪১ সালে প্রকাশিত এই বইটিতেও একই ভাষায় বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে যে-

Astronomical twilight begins and ends when the sun's center is 18° below the horizon at which moment absolute darkness is assumed to begin and end so far as the sun is concerned.

দেখুন-

Aircraft Navigation Manual

p.156. By United States Navy department. Hydrographic Office. ©United States Government Printing Office 1941.

Astronomy: a Handbook

১৩ জন বিজ্ঞানীর সহযোগিতায় প্রস্তুতকৃত, G.D. Roth কর্তৃক সম্পাদিত এবং আন্তর্জাতিক প্রকাশনা কোম্পানি স্প্রিঙ্গার থেকে প্রকাশিত এই বইটিতে আছে-

The astronomical twilight ends when the solar altitude is -18° and indicates the moment at which no trace of scattered sunlight can be seen any longer.

অর্থাৎ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট শেষ হয়  (সন্ধ্যায়) ১৮°-এ এবং এটি এই মুহূর্ত নির্দেশ করে, যার পর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সূর্যের আলোর আর কোনো চিহ্ন দেখা যায় না।

দেখুন-

Astronomy: a Handbook p.159. edited by G.D. Roth. © 1975 Springer Verlag New York inc.

এই বইটির বক্তব্য আরো পরিষ্কার। এতে বলা হয়েছে, এরপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সূর্যের আলোর আর কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। কিন্তু এরপর রাতে সূর্যের আর কোনো আলোই দেখা যায় না- কথাটি এভাবে কোথাও নেই।

মোটকথা, ১৮° তথা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট (ভোরে) সম্পর্কে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের বক্তব্য হচ্ছে, এর আগে আকাশ পূর্ণ অন্ধকার থাকে। আহসানুল ফাতাওয়াতে উল্লেখিত পত্রদুটিতে all light from the sun is cut off বাক্য দ্বারা এ কথা বলাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকবে। পত্রটির পুরো বক্ত্যটি আবার লক্ষণীয়। তাতে বলা হয়েছে-

When the Sun is 18° below horizon, all light from the sun is cut off.

অর্থাৎ (সন্ধ্যায়) সূর্য যখন দিগন্তের ১৮° নিচে চলে যায় তখন সূর্যের সমস্ত আলো বন্ধ হয়ে যায়।

লক্ষ্য করার বিষয়, এই বক্তব্যটিতে শুধু এ কথা আছে যে, সন্ধ্যায় ১৮°-এর সময় সূর্যের সকল আলো বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সন্ধ্যার ১৮°-এর পর থেকে ভোরের ১৮°-এর আগ পর্যন্ত পুরো রাত সূর্যের আর কোনো আলো দেখা যায় না- এ কথা তাতে বলা হয়নি। এবং এমন কথা বক্তব্যটি থেকে বোঝারও উপায় নেই। কারণ, ১৮°-এর সময় সূর্যের সকল আলো বন্ধ হয়ে যায়- এ কথা ঠিক আছে। কিন্তু পরবর্তীতে সূর্যের কোনো ধরনের আলো পুনরায় দৃশ্যমান হয় না- এ কথা এখানে কোথায় বলা হয়েছে? অতএব পত্রটির এই বক্তব্য থেকে এ দাবি কিছুতেই প্রমাণিত হয় না। যদিও অ্যাস্ট্রোনমির বইগুলোতে বিষয়টিকে এই ভাষায় উপস্থাপন করা হয় না- যেভাবে এখানে বলা হয়েছে।  আমরা যে কটি বক্তব্য এখানে উদ্ধৃত করেছি-  বিষয়টিকে এই ভাষাতেই উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ ১৮° থেকে পূর্ণ আঁধারের শুরু বা সমাপ্তি ঘটে- এই ভাষায়। তখন সূর্যের সকল আলো বন্ধ হয়ে যায়- এই ভাষায় নয়।

আরো লক্ষণীয় যে, সন্ধ্যায় ১৮°-এর পর সূর্য থেকে আসা সকল প্রকার আলো শেষ হয়ে যাওয়ার দাবি যে নিতান্তই ভুল; এরপর রাতে সূর্যের কোনো আলো দৃশ্যমান না হওয়ার কথা আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিকে সম্বন্ধ করা যে সম্পূর্ণ বাস্তবতা বিরোধী- এর জ¦লন্ত প্রমাণ, জোডিয়াকাল লাইট ও গেগেন্স। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের বক্তব্য অনুযায়ী ভোর বেলা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের আগে এবং সন্ধ্যার পর অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের পরে দৃশ্যমান জোডিয়াকাল লাইট সূর্যেরই আলো। এতে তাদের কোনো মতভিন্নতা নেই। পেছনে অ্যাস্ট্রোনমির বহু বই থেকে জোডিয়াকাল লাইটের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। জোডিয়াকাল লাইট যে সূর্যের আলো- এ বিষয়য়ে সামনে আমরা পুনরায় কয়েকটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি :

Exploring Ancient Skies

(An Encyclopedic Survey of Archaeoastronomy)

কানাডার ক্যালগারি ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর উধারফ ঐ. কবষষবু এবং ফিজিক্স ও অ্যাস্ট্রোনমি বিভাগের প্রফেসর Eugene F. Milone কর্তৃক রচিত, আন্তর্জাতিক প্রকাশনা কোম্পানি স্প্রিঙ্গার থেকে প্রকাশিত এই বইটিতে আছে-

Sunlight reflected from this dust is visible just after sunset or before sunrise along a tapered cone pointing upward from the horizon, along the ecliptic. It is called zodiacal light.

এতে বলা হয়েছে, জোডিয়াকাল লাইট সূর্যোদয়ের আগে এবং সূর্যাস্তের পর ধূলিকণায় প্রতিফলিত সূর্যালোক।

দেখুন-

Exploring Ancient Skies (An Encyclopedic Survey of Archaeoastronomy) p.138. by David H. Kelley; Eugene F. Milone. © Springer Science+Business Media, Inc. 2005.

Dictionary of Geophysics, Astrophysics, and Astronomy

জিওফিজিক্স, অ্যাস্ট্রোফিজিক্স ও অ্যাস্ট্রোনমি বিষয়ে ৫০ জন বিশেষজ্ঞের অংশগ্রহণে রচিত Richard A. Matzner কর্তৃক সম্পাদিত এই ডিকশনারিটিতে আছে-

Zodiacal light: A band of diffuse light seen along the ecliptic near the sun immediately after sunset or before sunrise. It is created by sunlight reflecting off the interplanetary dust particles, which are concentrated along the ecliptic plane.

এখানে আরো পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে, জোডিয়াকাল লাইট সৃষ্টি হয় আন্তগ্রহ ধূলিকণায় সূর্যের আলো প্রতিবিম্বিত হওয়ার দ্বারা। তা দৃশ্যমান হয় সূর্যাস্তের পর এবং সূর্যোদয়ের আগে।

দেখুন-

Dictionary of Geophysics, Astrophysics, and Astronomy p.514 by Richard A. Matzner (Editor).

Oxford Dictionary of Astronomy

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত   অ্যাস্ট্রোনমির এই ডিকশনারিটিতেও একই কথা বলা হয়েছে-

Zodiacal light: A faint diffuse glow, comparable in intensity to the fainter parts of the Milky Way, produced by the reflection of sunlight from zodiacal dust particles in the ecliptic plane.

দেখুন-

Oxford Dictionary of Astronomy. p.522. ©Oxford University Press 1997.

Encyclopedia of the Solar System

তিনজন বিজ্ঞানীর সম্পাদিত এই বইটিতেও পরিষ্কার ভাষায় এ কথাই বলে হয়েছে যে, এটি সূর্যেরই আলো। যা দেখা যায় ভোরের আগে।

Zodiacal light Diffuse glow seen on the Earth in the west after twilight and in the east before dawn, that appears wedge-shaped and lies along the ecliptic. It is widest near the horizon and is caused by the reflection of sunlight from the myriads of interplanetary dust particles concentrated in the ecliptic plane.

দেখুন-

Encyclopedia of the Solar System, p.937, edited by Lucy-Ann McFadden, Torrence Johnson, Paul Weissman. Second edition, ©2007 Elsevier Inc.

অ্যাস্ট্রোনমি পিকচার অব দি ডে (APOD)

এটি যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসা এবং মিশিগান টেকনোলজিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত একটি ওয়েবসাইট। এই ওয়েবসাইটটিতে বলা হয়েছে-

This early glow does not originate directly from the Sun, but rather from sunlight reflected by interplanetary dust. Called zodiacal light.

দেখুন-

https://apod.nasa.gov/apod/ap120116.html

মাত্র এই কটি উদ্ধৃতি আমরা এখানে তুলে ধরলাম। চাইলে এর আরো বহু উদ্ধৃতি দেওয়া সম্ভব। কিন্তু এর বিপরীত কোনো উদ্ধৃতি খুঁজে পাওয়া যাবে না। জোডিয়াকাল লাইট সূর্যের আলো না হওয়ার উদ্ধৃতি আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়।

ভালোভাবে বুঝে নেওয়া দরকার, জোডিয়াকাল লাইটও সূর্যের আলো, অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটও সূর্যের আলো। এবং উভয়টিই সূর্যের অপ্রত্যক্ষ আলো; সরাসরি আলো নয়। অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এফিমেরিসএবং নটিক্যাল আলম্যানাক’-এর দুইটি এক্সপ্ল্যানেটরি সাপ্লিমেন্টের উদ্ধৃতি একটু আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। সে দুইটি বইয়ে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটকে indirect illumination from the Sun (অপ্রত্যক্ষ সূর্যালোক) বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সামনে আরেকটি বক্তব্য লক্ষ্য করুন। তাতে বলা হয়েছে-

Twilight. After the sun has set, indirect sunlight, reflected and scattered by the upper atmosphere.

এখানে আরো পরিষ্কারভাবে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটকে indirect sunlight (সূর্যের অপ্রত্যক্ষ আলো) বলে পরিচয় দেওয়া হয়েছে।

দেখুন-

Textbook on Spherical Astronomy, p.51. by W. M. Smart © Cambridge University Press; 6 edition, July 29, 1977.

অতএব আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুযায়ী জোডিয়াকাল লাইট এবং অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট উভয়টিই রহফরৎবপঃ ংঁহষরমযঃ অপ্রত্যক্ষ সূর্যালোক এবং উভয়টি হালকা ও ক্ষীণভাবে প্রকাশিত হয়। এদিক থেকে উভয়টির মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। তবে উভয়টির মাঝে অন্য দিক থেকে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। তা হল, জোডিয়াকাল লাইট সৃষ্টি হয় আন্তঃগ্রহ ধূলিকণায় সূর্যের আলো প্রতিবিম্বিত হয়ে এবং এর প্রকাশ হয় টোয়াইলাইট শুরু হওয়ার আগে দিগন্তের উপর দিকে লম্বালম্বি আকারে। আর অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট অস্তিত্বে আসে, সূর্য দিগন্তের আরো কাছাকাছি আসার পর পৃথিবীর বায়ুম-ল দ্বারা সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে। সুতরাং জোডিয়াকাল লাইট সূর্যের আলো হওয়ার দিক থেকে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের সাথে পার্থক্য নেই। পার্থক্য উভয়টির প্রকাশের মাধ্যম, সময় ও আকারের দিক দিয়ে।

এখানে আরো লক্ষণীয় যে, ভোরে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের আগে শুধু জোডিয়াকাল লাইটই সূর্যের আলো নয়; বরং জোডিয়াকাল লাইটেরও আগে আরেকটি সূর্যালোকও দৃশ্যমান হয়ে থাকে। অ্যাস্ট্রোনমির পরিভাষায় যার নাম gegenschein (গেগেন্সেন)। এ সম্পর্কে সামনে দুয়েকটি উদ্ধৃতি লক্ষণীয়। তা হল-

Interplanetary Dust. Two faint light phenomena, namely zodiacal light and gegenschein (counterglow) make it possible to observe interplanetary dust, small dust particles reflecting the light of the Sun.

This weak glow can be seen above the rising or setting Sun (zodiacal light) or exactly opposite the Sun (gegenschein).

এখানে বলা হয়েছে, আন্তঃগ্রহীয় ধূলিকণায় প্রতিফলিত দুই ধরনের ক্ষীণ আলো  আছে, জোডিয়াকাল লাইট ও গেগেন্সেন নামে। উভয়টিই সূর্যের আলো আন্তঃগ্রহীয় ছোট ছোট ধূলিকণায় প্রতিবিম্বিত হয়ে দৃশ্যমান হয়।

এই দুর্বল আভা সূর্যোদয়ের আগে বা সূর্যাস্তের পর দৃশ্যমান হয়, যার নাম জোডিয়াকাল লাইট। এবং সূর্যের ঠিক বিপরীতে দেখা যায়, যার নাম গেগেন্সেন।

দেখুন-

Fundamental Astronomy, edited by Hannu Karttunen, Pekka Kröger, Heikki Oja, Markku Poutanen, Karl Johan Donner, pp.196-197, © Springer-Verlag Berlin Heidelberg 1987.

বাংলা একাডেমি ঢাকা থেকে প্রকাশিত জ্যোতির্বিজ্ঞান শব্দকোষের বক্তব্যও লক্ষণীয়। তাতে বলা হয়েছে-

Ògegenschein (সূর্যের) প্রতিদীপ্তি : পরিষ্কার, চাঁদহীন রাতে কখনো ভূকক্ষের (ecliptic)  কাছে সূর্যের বিপরীত বিন্দুতে (antisolar point) মৃদু আলো দেখা যায়। এর আকৃতি অনেকটা ডিম্বাকার (oval)  দেখায়। এটি কখনো কখনো রাশিচক্রের আলোর  (zodiacal light) সাথে যুক্ত হয়ে যায়। আন্তঃগ্রহস্থানে ছড়িয়ে থাকা ধূলিকণা কর্তৃক সূর্যের আলো প্রতিফলনের দরুন প্রতিদীপ্তির সৃষ্টি হয়।

দেখুন-

জ্যোতির্বিজ্ঞান শব্দকোষ, ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, পৃ. ৭৮; বাংলা একাডেমি ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮

গেগেন্সেন সম্পর্কে উদ্ধৃতি আমরা দীর্ঘায়িত করতে চাচ্ছি না। অ্যাস্ট্রোনমির বইয়ে এর অসংখ্য উদ্ধৃতি রয়েছে।

খোলাসাকথা হল, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুযায়ী অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট ভোরে সূর্যের প্রথম দৃশ্যমান আলো নয়। এর আগে সূর্যের কোনো আলো প্রকাশিত না হওয়ার দাবি আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুযায়ী নিতান্তই ভুল ও বাস্তবতা বিরোধী।

এক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত কথা হল, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিদ্যমান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের বিবরণ এবং সুবহে সাদিকের পরিচয়ে কুরআন-হাদীস ও ফিকহ-ফতোয়ার বক্তব্য- উভয়টির মাঝে কোনো দিক থেকে সংঘর্ষ ও কোনো রকম অসামঞ্জস্য নেই।

১. কুরআন-সুন্নাহর ইরশাদ অনুযায়ী সুবহে সাদিক সাদা রেখার মতো হালকা ও ক্ষীণ আকারে প্রকাশিত হয়। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুযায়ী অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটও ক্ষীণ ধরনের আলো। যার ঔজ্জ্বল্য তারার আলোর চেয়েও কম।

২. হাদীস-সুন্নাহর বক্তব্য অনুযায়ী সুবহে সাদিকের মূল পরিচয় হচ্ছে, এটি দিগন্তের উভয় দিকে প্রশস্ত আকারে দৃশ্যমান আলো; দিগন্তের উপরের দিকে লম্বালম্বি আকারে প্রকাশিত আলো সুবহে সাদিক নয়। পক্ষান্তরে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটও দিগন্তের সমান্তরালে প্রশস্ত আকারে প্রকাশিত আলো। এটি দিগন্তের উপর দিকে লম্বালম্বি আকারে দৃশ্যমান হওয়ার কোনো প্রমাণ আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে নেই।

৩. হাদীস-সুন্নাহ অনুযায়ী সুবহে সাদিকের আগে দিগন্তের উপরের দিকে লম্বালম্বি আকারে একটি আলো দৃশ্যমান হয়। হাদীস শরীফে যেটিকে بَيَاضُ الْأُفُقِ الْمُسْتَطِيلُ (দিগন্তের দৈর্ঘে প্রকাশিত লম্বা আলো) এবং কোনো কোনো বর্ণনায় ذَنَبُ السِّرحانِ (নেকড়ের লেজ) দ্বারা পরিচয় দেওয়া হয়েছে। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানেও অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের আগে পড়হব (শঙ্কু) আকারে দিগন্তের উপর লম্বালম্বিভাবে একটি আলো দৃশ্যমান হয়। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে যার নাম জোডিয়াকাল লাইট।

৪. ফিকহ-ফতোয়ার বক্তব্য অনুযায়ী সুবহে সাদিকের আগে আকাশ অন্ধকার থাকে। অর্থাৎ সুবহে কাযিব দৃশ্যমান হওয়ার পর তা বিলীন হয়ে আকাশ আবার অন্ধকার হয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর সুবহে সাদিক প্রকাশিত হয়। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানেও বলা হয়েছে, ১৮° তথা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট-এর আগে আকাশ সম্পূর্ণ অন্ধকার থাকে।

অতএব সর্বদিক থেকেই আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিবরণ অনুযায়ী অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে সাদিক হওয়াই প্রমাণিত হয়। সুবহে সাদিকের সাথে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট-এর কোনো দিক থেকে অসামঞ্জস্য থাকার কথা আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে নেই।

সারকথা

আহসানুল ফাতাওয়ার تحقیقات جدیدہ বা নতুন তাহকীকশিরোনামের পুরো আলোচনা আমরা এখানে তুলে ধরলাম। এই পুরো আলোচনায় ১৫°-এ সুবহে সাদিক শুরু হওয়ার কোনো প্রমাণই আমরা পেলাম না। ১৮°-এ সুবহে কাযিব হওয়ার কোনো প্রমাণও নেই এগুলোর কোনোটিতে। এই শিরোনামের প্রথম নম্বরে মিয়ারুল আওকাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ১৫° অনুযায়ী সুবহে সাদিকের সময় দেওয়া হলেও শাস্ত্রীয় দিক থেকে তাতে অনেক বড় বড় অসঙ্গতি ও স্থূল ধরনের বহু ভুল রয়েছে। যার কোনো কোনোটি আহসানুল ফাতাওয়ার বক্তব্য অনুযায়ীই সুস্পষ্ট ভুল। পেছনে এর বিস্তারিত বিবরণ পেশ করা হয়েছে। অতএব মিয়ারুল আওকাত ভুলে ভরপুর সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য বই।

এছাড়া আহসানুল ফাতাওয়াতে এই শিরোনামের ২ নম্বর থেকে ৮ নম্বর পর্যন্ত কয়েকটি ইংরেজি বইয়ের নাম এবং পাকিস্তান নেভি ও আবহাওয়া দপ্তরের তিনটি ইংরেজি পত্র তুলে ধরা হয়েছে। এগুলোতে কী বলা হয়েছে তা বোঝার সুবিধার্থে আহসানুল ফাতাওয়া থেকে আমরা পত্রগুলোর পুরো বক্তব্যই এখানে তুলে ধরেছি। কিন্তু আমরা দেখলাম, এগুলোর কোনোটিতে মূল আলোচ্য বিষয়ে আহসানুল ফাতাওয়ার পক্ষের কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। ১৫°-এ সুবহে সাদিক কিংবা ১৮°-এ সুবহে কাযিব (যা আহসানুল ফাতাওয়ার মূল দাবি) হওয়ার পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই এগুলোর কোনোটিতে। মূল প্রসঙ্গের কিছু থাকলেও তা আহসানুল ফাতাওয়ার দাবির সপক্ষের নয়। যেমন, প্রথম পত্রটিতে প্রদত্ত ২৫:৪৬ উত্তর ও ৬৮:৪০ পূর্ব অবস্থান স্থল (টন্ডুআদম) এর ১৫°-এর সময়। যার দ্বারা ১৫°-এর আগে সুবহে সাদিক শুরু না হওয়ার দাবিই উল্টো ভুল সাব্যস্ত হয়।

এ হল আহসানুল ফাতাওয়ার تحقیقات جدیدہ বা নতুন তাহকীকশিরোনামের উদ্ধৃতিগুলোর হাল-হাকীকত! কিন্তু এর বিপরীতে আহসানুল ফাতাওয়ার দাবির অবস্থা দেখুন। এই পত্রগুলো উল্লেখ করার পূর্বে টীকাতে বলা হয়েছে-

جدید تعلیم یافتہ طبقہ کے خاطر ان محکموں سے تصدیق کروائی گئی، ورنہ مجھے اس کی حاجت نہ تھی۔

আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণীর উদ্দেশ্যে এই এই বিভাগগুলো থেকে সত্যায়ন করানো হয়েছে। নতুবা আমার এগুলোর দরকার ছিল না। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৬৮)

আচ্ছা, এখানে তো আমরা তিনটি পত্রের পুরো বক্তব্যই তুলে ধরলাম। কিন্তু এই বিভাগগুলো থেকে এমন কোন্ বিষয়টির সত্যায়ন করানো হয়েছে, যার দ্বারা আহসানুল ফাতাওয়ার দাবি প্রমাণিত হয়?!

আমাদের প্রশ্ন

আহসানুল ফাতাওয়ার এই পত্রগুলো সম্পর্কে একটি বিষয় খুবই গুরুত্বের সাথে লক্ষণীয়। আহসানুল ফাতাওয়ার মূল দাবি হচ্ছে, ১৮°-এ সুবহে কাযিব শুরু হয়; সুবহে সাদিক নয়। সুবহে সাদিক শুরু হয় ১৫°-এ। ১৮° থেকে ১৫°-এর আগ পর্যন্ত পুরোটি সুবহে কাযিবের সময়। আহসানুল ফাতাওয়াতে আরো দাবি করা হয়েছে, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষার অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট, যা ১৮°-এ প্রকাশিত হয় তা সুবহে কাযিব; সুবহে সাদিক নয়। এগুলো আহসানুল ফাতাওয়ার আসল দাবি। অপরদিকে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিবের পরিচয় ও তা নির্ণয়ের মানদ- হাদীস ও ফিকহ-ফতোয়া দ্বারা সুনির্ধারিত এবং সবার নিকট স্বীকৃত। তা হল, ভোরের আগে দিগন্তের উপরে লম্বালম্বি আকারে প্রকাশিত আলো সুবহে কাযিব। আর ভোরের সময় দিগন্তের উভয় দিকে প্রশস্ত আকারে প্রকাশিত আলো সুবহে সাদিক। আহসানুল ফাতাওয়াতেও (২/১৬১) উভয়টির এই পরিচয় ও মানদ-ই উল্লেখ করা হয়েছে।

অতএব ১৮° থেকে ১৫° পর্যন্ত প্রকাশিত আলোর ব্যাপারে যদি দাবি করা হয়, এটি সুবহে কাযিব, তাহলে এটি দিগন্তের উপরে লম্বালম্বি আকারে থাকার বিষয়টি প্রমাণ করে দেখাতে হবে। পক্ষান্তরে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটকে সুবহে কাযিব দাবি করলে এটি যে দিগন্তের উপরে লম্বালম্বি আকারে প্রকাশিত হয়- আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে এর প্রমাণ তুলে ধরতে হবে।

এখন ভেবে দেখুন, আহসানুল ফাতাওয়াতে যে তিনটি পত্র উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের কাছে কি এই প্রশ্নগুলো করা হয়েছে? ১৮° থেকে ১৫° পর্যন্ত প্রকাশিত আলোর ধরনটা কী থাকে, প্রশস্ত আকারে, না লম্বালম্বি আকারে- এই উত্তরপত্রগুলোতে কি এ সম্পর্কিত কোনো কথা আছে? তাহলে এ প্রশ্ন কেন করা হয়নি তাদের কাছে? আর অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট তো তাদেরই পরিভাষার বিষয়। এর পরিচয় সম্পর্কে তারাই ভালো অবগত থাকবেন। তাহলে তাদের কাছে এই প্রশ্ন কেন করা হল না যে, অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট দিগন্তের উপরে লম্বালম্বি আকারে দেখা যায়, নাকি দিগন্তের উভয় দিকে প্রশস্ত আকারে? মূল প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বারবার তাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক কিছু জানতে চাওয়া হল কেন- তা আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।

এখানে আরেকটি বড় প্রশ্নের বিষয় হল, তাদের কাছে বিভিন্ন তারিখের ১৮° ও ১৫°-এর সময় জানতে চাওয়া হয়েছে। যার জবাব সবকটি পত্রেই দেওয়া হয়েছে। অথচ এর মধ্যে একটি তারিখ (১১ জুন টান্ডুআদমের ১৮°-এর সময়) ছাড়া বাকিগুলোর সময়ের  হিসাব জানতে চাওয়া সম্পূর্ণ অনর্থক ছিল। আর জুনের ১২ তারিখ তারা টান্ডুআদমে সুবহে কাযিব ও সুবহে সাদিক উভয়টি মুশাহাদা করেছেন। কিন্তু আফসোস্! এই তারিখ সম্পর্কে কোনোই প্রশ্ন করা হয়নি। সেখানে ঐ দিন ১৫°-এর সময় কয়টায় হয় এবং বিশেষ করে ১৮°-এর সময় কয়টায় হয়- এই প্রশ্ন তাদের কারো কাছে করা হয়নি। অথচ অন্যান্যগুলোর চেয়ে টান্ডুআদমে এই তারিখের ১৮° ও ১৫°-এর সময় জানার সাথে পুরো বিষয়টির তাহকীকেরই সম্পর্ক ছিল।

মোটকথা, পাকিস্তান আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং হাইড্রোগ্রাফি নেভাল হেডকোয়ার্টারের পত্রগুলোতে আসল বিষয়েরই কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। কারণ, তাদের কাছে যেসব প্রশ্ন করার দরকার ছিল সেগুলো করাই হয়নি। ফলে জ্যোতির্বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সুবহে সাদিকের সময় কখন হয়- এর কোনো সমাধান সেগুলোতে নেই। অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে সাদিক, না সুবহে কাযিব; ১৮°-এর সময় প্রকাশিত আলো প্রশস্ত আকারে থাকে, না লম্বালম্বি আকারে; ১৫°-এর আগ মুহূর্তের আলোর আকার কী ধরনের থাকে- কোনো কিছুরই জবাব এই পত্রগুলোতে নেই।

অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট সুবহে সাদিক হওয়ার সমর্থনে কয়েকটি পত্র

আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষার অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট যে সুবহে সাদিক; একে সুবহে কাযিব আখ্যা দেওয়া যে নিতান্তই ভুল- এর অনেক প্রমাণ আমরা আলহামদু লিল্লাহ পূর্বে পেশ করেছি। এর সপক্ষে এমনসব প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য ও বইয়ের উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়েছে, যা এই বিষয়ে সর্বোচ্চ রেফারেন্স। এর সপক্ষে তার পর আর কোনো প্রমাণ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবুও আহসানুল ফাতাওয়াতে যেহেতু সমকালীন দুটি প্রতিষ্ঠানের তিনটি পত্র তুলে ধরা হয়েছে তাই এই প্রসঙ্গ ধরে আমরাও সমকালীন তিনটি পত্র তুলে ধরছি। তবে আহসানুল ফাতাওয়াতে উল্লেখিত তিনটি পত্র এবং আমাদের এই তিনটি পত্রের মাঝে পার্থক্য হল, আহসানুল ফাতাওয়ার তিনটি পত্রে ১৮°-এ প্রকাশিত আলো সুবহে কাযিব হওয়া কিংবা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট আর সুবহে কাযিব এক হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। আছে কেবল কিছু সময়ের হিসাব ও মূল বিষয়ের বাইরের কিছু কথা। এর বিপরীতে এখানে সামনের তিনটি পত্র পড়ন। যাতে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে যেঅ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট দিগন্তের উভয় দিকে প্রশস্ত ও বিস্তৃত আকারে প্রকাশ হয়; দিগন্তের উপর দিকে লম্বালম্বিভাবে নয়।

পাকিস্তান মহাকাশ ও উচ্চ বায়ুমণ্ডল গবেষণা কমিটি Pakistan Space and Upper Atmosphere Research Committee (SUPARCO)-এর ডাইরেক্টর কর্তৃক প্রেরিত পত্রে বলা হয়েছে-

In the morning when the sun is below the horizon direct sunlight cannot reach above horizon. But sunlight as reflected and diffracted by earth's atmospheric layers illuminates places above the local horizon. The instant, when the solar depression angle (S.D.A.) is 18° has been chosen by the astronomers as the beginning of astronomical twilight. The instant of 18° S.D.A. is universally regarded as a point of separation between the completely dark background and discernible background illumination. ...

At the beginning of morning twilight (S.D.A. 18°) the entire horizon is illuminated with faint reddian light. It is distributed all along the horizon in a circular form of distribution rather than a conical or rectangular form, The light intensity increases without any apparent change in the form of distribution.

Zodiacal light is also sunlight but it is reflected by the interplanetary gas and dust (and not by earth's atmosphere). It is somewhat whitish in colour and confined within the zodiacal belt around the ecliptic and thus lies streaming upwards. In favourable conditions it is visible as a cone of light extending above the eastern horizon when the S.D.A. is more than 18°. It sometimes gives the imprese on of 'false dawn'.

এখানে খুবই পরিষ্কার ভাষায় বলে দেওয়া হয়েছে-

ভোরে সূর্য দিগন্তের নিচে থাকা সত্ত্বেও সূর্যরশ্মি পৃথিবীর বায়ুম-ল দ্বারা প্রতিফলিত, প্রতিসৃত হয়ে দিগন্তকে আলোকিত করে। সূর্য যখন দিগন্তের ১৮° নিচে থাকে তখন অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট শুরু হয়...।

১৮°-এ ভোরের টোয়াইলাইট যখন শুরু হয় তখন পুরো দিগন্ত ম্লান ও হাল্কা লালচে আলো দ্বারা আলোকিত হয়। এর আলো প্রকাশিত হয় পুরো দিগন্ত জুড়ে বৃত্তাকারে; শঙ্কু (cone)  কিংবা চৌকা আকারে নয়। আলোটি এর পর ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে।

জোডিয়াকাল লাইটও সূর্যের আলো। তবে এটি আন্তঃগ্রহ স্যাস ও ধুলিকণার দ্বারা প্রতিফলিত হয়ে প্রকাশ হয়; বায়ুম-ল দ্বারা নয়। এর আলো অনেকটা সাদা বর্ণের হয়ে থাকে। এটি আকাশের উপর দিকে cone (শঙ্কু) আকারে দৃশ্যমান হয় এবং সূর্য যখন দিগন্ত থেকে ১৮°-এর বেশি নিচে থাকে তখনই তা দেখা যাওয়া সম্ভব।

দেখুন-

صبح صادق وصبح کاذب، پروفیسر عبد اللطیف، ص ১৯৫-১৯৪۔

এই বক্তব্যটিতে আমরা দেখলাম, পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে যে, ১৮°-এর সময় দৃশ্যমান আলো বৃত্তাকারে দিগন্ত জুড়ে প্রকাশিত হয়। cone (শঙ্কু) বা চৌকা আকারে দিগন্তের উপর দিকে লম্বালম্বিভাবে দেখা যায় না। বরং cone (শঙ্কু) আকারে দিগন্তের উপর দিকে লম্বালম্বিভাবে দৃশ্যমান আলো ১৮°-এর আগে দেখা সম্ভব; এর পর নয়।

দ্বিতীয় আরেকটি পত্র হল, করাচি ইউনিভার্সিটির অ্যাস্ট্রোনমি বিভাগের প্রফেসর ড. জাবেদ ক্বমর সাহেবের। প্রফেসর সাহেবের দীর্ঘ পত্রটির নির্বাচিত কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হল-

صبح صادق کا ظہور اس لمحہ ہوتا ہے جب آفتاب افق سے (تقریباً) 18° نیچے ہوتاہے،  نہ کہ اس لمحہ جب یہ افق سے (تقریباً) 15° نیچے ہوتاہے۔

--- چنانچہ صبح صادق کی ابتداء اور فلکی فلق کی ابتداء اس معنی میں ایک شے کے دو نام ہیں، کہ دونوں آفتاب کی براہ راست روشنی سے وجود میں آتی ہیں، اور اسی ایک لمحہ پر وجود میں آتی ہیںکہ جب آفتاب افق سے (تقریباً) 18°نیچے ہوتاہے، --- جہاں تک صبح کاذب کا تعلق ہے یہ بالکل دوسری شے ہے ۔۔۔

آفتاب جب (تقریباً) 18°زیر افق ہو تو افق پر کسی مخروطی یا اہرام کے شکل کی روشنی کا سوال ہی پیدا نہیں ہوتا، اس وقت موجود روشنی آفتاب کی روشنی کا براہ راست نتیجہ ہوتی ہے، اور سارے افق پر پھیلی ہوئی ہوتی ہے۔

এখানেও তিনি অনেক পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, সুবহে সাদিক হয় ১৮°-এ; ১৫°-এ নয়। আর সুবহে সাদিক ও فلکی فلق (অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট) একই জিনিসের নাম। فلکی فلق (অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট)-এর সাথে সুবহে কাযিবের কোনো সম্পর্ক নেই। সূর্য যখন দিগন্ত থেকে ১৮° নিচে থাকে তখন cone (শঙ্কু) বা পিরামিড আকারের কোনো আলো দেখা যাওয়ার প্রশ্নই আসে না; বরং ১৮°-এ যে আলো প্রকাশিত হয় তা পুরো দিগন্ত জুড়ে বিস্তৃত ও প্রশস্ত আকারে থাকে।

দেখুন-

صبح صادق وصبح کاذب، پروفیسر عبد اللطیف، ص 192-191۔

এই দুটি পত্রে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট ও ১৮°-এ প্রকাশিত আলোর যে পরিচয়, ধরন ও আকার-আকৃতির বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রামাণিক গ্রন্থ ও পশ্চিমা অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারসমূহের বক্তব্যে বিষয়টি এমনই বিদ্যমান রয়েছে। যার কিছু উদ্ধৃতি ইতিপূর্বে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট ও জোডিয়াকাল লাইটের পরিচয় সম্পর্কিত আলোচনায় তুলে ধরা হয়েছে।

এখানে তৃতীয়টি হল, বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত  জ্যোতির্বিজ্ঞান শব্দকোষ’-এর বক্তব্য। এতে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের পরিচয় এভাবে তুলে ধরা হয়েছে-

ÒAstronomical twilight মহাজাগতিক প্রদোষ, মহাজাগতিক গোধূলি :

বিকেলে সূর্যাস্ত এবং অন্ধকার নেমে আসার মধ্যবর্তী সময় (গোধূলিবেলা); এবং প্রত্যুষে অন্ধকার এবং সূর্যোদয়ের মধ্যবর্তী সময়ের (ভোর বেলা) সাধারণ নাম। এ সময়ে সূর্যরশ্মি বায়ুম-লের উপরের অংশের ধূলি ও পানিকণা দ্বারা প্রতিফলিত, প্রতিসৃত ও বিচ্ছুরিত হয়ে একরকমের মৃদু (ব্যাপ্ত,diffused) আলোর সৃষ্টি করে। এ সময়ে সূর্য দিগন্ত রেখার নিচে থাকে। সূর্যের কেন্দ্র দিগন্তরেখা থেকে ৬°, ১২°, ১৮°  নিচে চলে গেলে যথাক্রমে সাধারণ গোধূলি (civil twilight) নটিক্যাল গোধূলি (nautical twilight) এবং মহাজাগতিক গোধূলি শেষ হয়। ভোরের প্রারম্ভে (সুবহে সাদিকের সময়) সুবিন্দুতে (zenith) ষষ্ঠ উজ্জ্বলতার তারাসমূহ (খালি চোখে দেখা ক্ষীণতম তারা) অদৃশ্য হতে শুরু করে এবং তখন থেকেই মহাজাগতিক প্রদোষকাল শুরু হয়। বাংলাদেশে এটা শুরু হয় সূর্যোদয়ের ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট পূর্বে এবং রমজান মাসে এটাই সেহরির শেষ সময়। এই সময় দর্শকের অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ, উচ্চতা (elevation)  এবং বছরের নির্দিষ্ট সময়ের উপর নির্ভর করে।

দেখুন-

জ্যোতির্বিজ্ঞান শব্দকোষ, ফারসীম মান্নান মোহম্মদী, বাংলা একাডেমি ঢাকা, পৃ. ২২

এই তিনটি বক্তব্যে দেখুন, কত স্পষ্ট ও পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে যে, অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট আর সুবহে সাদিক একই। ১৮°-এ দৃশ্যমান এই আলো পূর্ব দিগন্ত জুড়ে বিস্তৃত ও প্রশস্ত আকারে দেখা যায়; শঙ্কু (cone)  বা পিরামিড আকারে নয়।

কিন্তু আহসানুল ফাতাওয়াতে যে তিনটি পত্র উল্লেখ করা হয়েছে, এমনকি আহসানুল ফাতাওয়ার পুরো আলোচনাতেই এমন একটি উদ্ধৃতিও নেই, যাতে এ কথা পাওয়া যায় যেঅ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট বা ১৮°-এর সময় দৃশ্যমান আলো শঙ্কু (cone)  বা পিরামিড আকারে দেখা যায়, কিংবা সুবহে কাযিবের মতো দিগন্তের উপর দিকে লম্বালম্বিভাবে প্রকাশিত হয়। অথচ এটি প্রমাণ করা ছাড়া ১৮° ও অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটকে সুবহে কাযিব দাবি করা কেবল মৌখিক দাবি বৈ কিছু নয়। বাস্তবতা ও দলীল-প্রমাণ যার সম্পূর্ণ বিপরীত।

***

আলহামদু লিল্লাহ, আল্লাহ তাআলার অশেষ মেহেরবানী, এ পর্যন্ত আহসানুল ফাতাওয়ার حوالجات (উদ্ধৃতিসমূহ) শিরোনামের تحقیقات قدیمہ (প্রাচীন তাহকীক) এবং   تحقیقات جدیدہ  (নতুন তাহকীক) উভয় প্রকারের সকল উদ্ধৃতির বিস্তারিত পর্যালোচনা শেষ হল। এ পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে, আল্লাহ তাআলার ফযল ও করমেই হয়েছে। আমাদের আশা, রাব্বে কারীম নিজ ফযল ও করমে একে কবুলও করে নেবেন।

رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ، وَتُبْ عَلَيْنَآ إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ.

 

খোলাসা

মুহতারাম পাঠক! পুরো লেখাটি প্রথম কিস্তি থেকে শেষ কিস্তি পর্যন্ত যদি পড়ে থাকেন তবে আমরা আশা করি, নিম্নোক্ত বাস্তবতাগুলো স্পষ্ট হয়ে গেছে যে-

১. ভোরে দিগন্তের উভয় দিকে প্রশস্ত আকারে প্রকাশিত আলোর নাম সুবহে সাদিক। কুরআনুল কারীমের ইরশাদ অনুযায়ী যার শুরু হয়ে থাকে الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ তথা সাদা রেখার মতো হাল্কা ও ক্ষীণ আকারে। শরীয়তে সুবহে সাদিকের একক পরিচয় এবং তা নির্ণয়ের একমাত্র মানদ- এটিই। অর্থাৎ তা প্রকাশিত হয় দিগন্তের উভয় দিকে প্রশস্ত আকারে এবং শুরু হয় খুবই হাল্কা ও ক্ষীণভাবে। পরে এর আলো ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।

২. সুবহে সাদিকের এই এক পরিচয় ও মানদ- অনুযায়ী মুসলিম উম্মাহ শুরু থেকেই যুগ যুগ ধরে আমল করে চলেছেন। যার মূল ভিত্তি সুবহে সাদিকের চাক্ষুষ মুশাহাদা ছাড়া আর কিছু নয়। আর মুশাহাদা নির্ভর সুবহে সাদিকের এই শুরু সময়টিকেই মুসলিম ফালাকীগণ দিগন্ত থেকে সূর্যের কৌণিক দূরত্বের পরিমাণ দ্বারা নির্ণয় করে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তাদের কারো থেকে ১৮°-এর কমের কথা নেই। বরং তাদের সবার ঐকমত্য অনুযায়ী ১৮°-এর ভেতরই সুবহে সাদিক শুরু হয়ে যায়। এর থেকে বিলম্ব হয় না। এটি যুগ পরম্পরায় চলে আসা মুসলিম উম্মাহ্র তাআমুল, ফুকাহায়ে কেরাম ও আকাবির উলামায়ে হিন্দের বক্তব্য, সব যুগের শাস্ত্রজ্ঞ মুসলিম ফালাকীগণের বক্তব্য, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং সমকালীন বিভিন্ন দেশের চাক্ষুষ মুশাহাদা- সবকিছু দ্বারাই প্রমাণিত।

৩. শাস্ত্রজ্ঞ কোনো ফালাকী থেকে ১৫°-এ সুবহে সাদিক শুরু হওয়ার কথা নেই। এ কথা বলেছেন সর্বপ্রথম দশম হিজরী শতাব্দীর বিরজান্দী রাহ.। এর আগের কারো বক্তব্যে ১৫°-এর কথা নেই। আর বিরজান্দী রাহ. বাস্তবিক অর্থে ইলমুল ফালাকের কোনো মুক্তাদা আলেম  ছিলেন না। তাছাড়া এক্ষেত্রে বড় কথা হল, তিনি নিজেই ১৫°-এর কথা তার এক কিতাবে قد قيل অর্থাৎ বলা হয়েছেবলে উল্লেখ করেছেন। এবং তার অন্য কিতাবে আরো স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘সুবহে সাদিক কত ডিগ্রিতে উদিত হয়, তাহকীকের সাথে তা জানা যায় না। ...। অতএব ১৫°-এ সুবহে সাদিক শুরু হওয়ার কথা তাঁর কিতাবে থাকলেও এটি যে কিছুতেই তাহকীক নির্ভর নয়- এটি তাঁর বক্তব্য দ্বারাই প্রমাণিত।

৪. ভোরে সুবহে সাদিকের আগে আরেকটি আলো প্রকাশিত হয়, যার আকার সুবহে সাদিক থেকে ভিন্ন। এর নাম আলফাজরুল কাযিব’ (সুবহে কাযিব)। তা প্রকাশিত হয় দিগন্তের উপরে লম্বালম্বিভাবে। আর সুবহে সাদিক দৃশ্যমান হয় দিগন্তজুড়ে উভয় দিকে প্রশস্ত আকারে। হাদীস শরীফে লম্বালম্বিভাবে প্রকাশিত এই আলোটির প্রসঙ্গ এসেছেই মূলত সুবহে সাদিকের পরিচয় প্রদানের লক্ষ্যে। উভয়টি যেহেতু কাছাকাছি সময়ে প্রকাশিত হয়ে থাকে তাই কেউ যেন সুবহে সাদিক নির্ধারণে সুবহে কাযিব দ্বারা ধোঁকা না খায়- কেবলই এ জন্যে সুবহে কাযিবের পরিচয় বলা হয়েছে। শরীয়তে সুবহে কাযিবের এছাড়া কোনো প্রয়োজন নেই। শরীয়তের কোনো বিধান এর উপর নির্ভরশীল নয়।

৫. ১৮° থেকে ১৫°-এর ভেতর সুবহে কাযিব মুশাহাদারও কোনো প্রমাণ নেই। এমনকি আহসানুল ফাতাওয়াতেও এর প্রমাণ নেই; বরং ১৫°-এর আগে সুবহে সাদিক শুরু হওয়ার বিষয় স্বয়ং আহসানুল ফাতাওয়াতে উল্লেখিত মুশাহাদা দ্বারাই প্রমাণিত।

৬. সেহরির সমাপ্তি এবং ফজরের নামাযের ওয়াক্ত শুরু- উভয়টিরই সম্পর্ক সুবহে সাদিকের সাথে। সুবহে সাদিকের সময় সেহরির ওয়াক্ত সমাপ্ত হয় এবং ফজরের নামাযের ওয়াক্ত শুরু হয়। সুবহে কাযিবের সাথে কোনোটিরই সম্পর্ক নেই। এটিই কুরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট বিধান। কুরআনুল কারীমে সুবহে সাদিক পর্যন্ত পানাহার করতে বলা হয়েছে। এবং হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, ‘সুবহে কাযিব যেন তোমাদেরকে সেহরি থেকে বাধা প্রদান না করে।অতএব যেটি সেহরির শেষ সময় সেটিই সালাতুল ফাজরের সময়ের শুরু। মাঝখানে এমন কোনো মুহূর্ত নেই, যাতে না সেহরি খাওয়া যায়, না ফজরের নামায পড়া যায়।

৭. শাস্ত্রজ্ঞ ফালাকীগণ শুধু সুবহএবং ফজরশব্দ বলে সুবহে সাদিক উদ্দেশ্য নিয়ে থাকেন; সুবহে কাযিব উদ্দেশ্য নেওয়ার কোনো প্রমাণ নেই।

৮. শাস্ত্রজ্ঞ উলামায়ে দ্বীনের সময়সূচিতে সুবহে সাদিকের সময় না লিখে সুবহে কাযিবের সময় প্রদানের দাবি সম্পূর্ণ ভুল। এর কোনো প্রমাণ ও বাস্তবতা নেই।

৯. সুবহে কাযিব সুবহে সাদিকের সাথে মিলিতভাবে প্রকাশিত হওয়া আবশ্যক- এটি ভুল ও বাস্তবতা বিরোধী দাবি। এর ভিত্তিতে সুবহে সাদিক নির্ণয় করা শরীয়তের মানদ- পরিবর্তনের শামিল।

১০. সুবহে কাযিব ও সুবহে সাদিকের মাঝে তিন ডিগ্রি ব্যবধানের কথা ভুল। তা বাস্তবসম্মত নয়।

১১. শাফাকে আবইয়াযের সময় ১৮° পর্যন্ত বাকি থাকে। এর আগে শেষ হওয়ার দাবি সম্পূর্ণ ভুল।

১২. ১৬°-এর আগে শাফাকে আহমারের ওয়াক্ত শেষ হয় না।

১৩. ১৮°-এ প্রকাশিত আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষার অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট আর সুবহে সাদিক একই। এটি সুবহে কাযিব হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই।

১৪. অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইট ভোর বেলা প্রকাশিত সূর্যের প্রথম আলো হওয়ার দাবি ঠিক নয়। এরও কোনো প্রমাণ নেই।

১৫. পূর্ব যুগের বিশেষজ্ঞ মুসলিম ফালাকীগণের বক্তব্যে যেমন ১৫°-এর কোনো কথা নেই, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানেও ১৫°-এ ভিন্ন ধরনের কোনো আলো দৃশ্যমান হওয়ার বক্তব্য নেই। টোয়াইলাইটকে তারা ১৮°, ১২° ও ৬°- এই তিন প্রকারে বিভক্ত করলেও তাদের নিকট এক্ষেত্রে ১৫°-এর কোনো ভাগ নেই।

১৬. ১৮°-এর আগে প্রকাশিত আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষার জোডিয়ালাকাল লাইট আর সুবহে কাযিব একই।

১৭. জোডিয়ালাকাল লাইট বছরে শুধু দুইবার প্রকাশিত হওয়ার দাবিও ঠিক নয়।

আমাদের প্রবন্ধটিতে এইসব বিষয় অত্যন্ত মজবুত দলীল ও উদ্ধৃতসহ পেশ করা হয়েছে। এর বিপরীত সমস্ত দাবি ও আপত্তির দলীলভিত্তিক সুস্পষ্ট জবাব তুলে ধরা হয়েছে। তার পরও কোনো পাঠকের কাছে দলীলনির্ভর কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে আমাদেরকে অবশ্যই অবগত করবেন। আমরা স্বাগত জানাব ইনশাআল্লাহ।

উল্লেখ্য, ১৮°-এর ভেতর সুবহে সাদিক শুরু হওয়ার বিষয়টি ইজমা ও ঐকমত্যপূর্ণ মাসআলা। এটি কিছুতেই মুখতালাফ ফীহিও মতভেদপূর্ণ নয়। কোনো যুগের কোনো ফালাকীর এতে মতভিন্নতা নেই। আর আহসানুল ফাতাওয়াতেও বিষয়টিকে মুখতালাফ ফীহি ও মতভেদপূর্ণ মাসআলা হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। বরং বাস্তবতার সম্পূর্ণ উল্টো, ১৮°-এ সুবহে কাযিব হওয়ার شاذ ও বিচ্ছিন্ন দাবিটিকে এর অনেক জায়গায় ইজমা ও মুত্তাফাক আলাইহি তথা সবার ঐকমত্যপূর্ণ মাসআলা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং এ বিষয়ে সঠিক ও বাস্তবসম্মত ইজমা এবং ঐকমত্যপূর্ণ মতের অবলম্বনকারী আকাবির উলামায়ে কেরামের অবস্থানকে তাতে (২/১৯১) خلاف بلا دلیلদলীলবিহীন বিরোধীতাআখ্যা দেওয়া হয়েছে। যা খুবই দুঃখজনক।

যদি মাসআলাটি বাস্তবেই মুখতালাফ ফীহি হত, তাহলে আমরা এই বিষয়ে লেখারই চিন্তা করতাম না। দুআ করি, পাঠকবর্গের কাছেও দুআ চাই, আল্লাহ তাআলা এই মেহনত কবুল করেন। এবং এই অধমের জন্য আখেরাতের যখীরা বানান।

آمين يا رب العالمين. هذا، وصلى الله تعالى وسلم على سيدنا ومولانا محمد خاتم النبيين، وعلى آله وصحبه أجمعين، وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.

 

মুহাম্মাদ ফয়যুল্লাহ

০৮-১১-১৪৪৩ হি.

০৯-০৬-২০২২ ঈ.

 

বি. দ্র. চলমান কিস্তিসহ প্রবন্ধটির মোট ১৩ কিস্তি ছাপা হয়েছে। আলকাউসারের বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধটির সকল কিস্তির শিরোনাম ও সংখ্যা নিম্নে উল্লেখ করা হল-

১. সুবহে সাদিক ও ফজরের সময় কখন শুরু? একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর

এপ্রিল-মে ২০১৯

২. সুবহে সাদিক কখন শুরু? প্রসঙ্গ : আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান

ফেব্রুয়ারি ২০২০

৩. সুবহে সাদিক কখন শুরু? প্রসঙ্গ : আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান-২

অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টোয়াইলাইটের পরিচয়

জুলাই ২০২০

৪. সুবহে সাদিক কখন শুরু? প্রসঙ্গ : আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান-৩

কিছু আপত্তি ও তার জবাব

আগস্ট ২০২০

৫. সুবহে সাদিক কখন শুরু? প্রসঙ্গ : সমকালীন কিছু মুশাহাদার বিবরণ-১

অক্টোবর ২০২১

৬. সুবহে সাদিক কখন শুরু? প্রসঙ্গ : সমকালীন কিছু মুশাহাদার বিবরণ-২

নভেম্বর ২০২১

৭. সুবহে সাদিক কখন শুরু? প্রসঙ্গ : আহসানুল ফাতাওয়ার উল্লেখকৃত মুশাহাদা ও তার পর্যালোচনা

ডিসেম্বর ২০২১

৮. সুবহে সাদিক কখন শুরু? প্রসঙ্গ : আহসানুল ফাতাওয়ার উদ্ধৃতিগুলোর পর্যালোচনা-১

জানুয়ারি ২০২২

৯. সুবহে সাদিক কখন শুরু? প্রসঙ্গ : আহসানুল ফাতাওয়ার উদ্ধৃতিগুলোর পর্যালোচনা-২

ফেব্রুয়ারি ২০২২

১০. সুবহে সাদিক কখন শুরু? প্রসঙ্গ : আহসানুল ফাতাওয়ার উদ্ধৃতিগুলোর পর্যালোচনা-৩

মার্চ-এপ্রিল ২০২২

১১. সুবহে সাদিক কখন শুরু? প্রসঙ্গ : আহসানুল ফাতাওয়ার উদ্ধৃতিগুলোর পর্যালোচনা-৪

মে ২০২২

১২. সুবহে সাদিক কখন শুরু? প্রসঙ্গ : আহসানুল ফাতাওয়ার উদ্ধৃতিগুলোর পর্যালোচনা-৫ = জুন ২০২২

 

সুবহে সাদিক প্রবন্ধের পরিশিষ্ট

মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক

বান্দার আরজ এই যে, আহসানুল ফতাওয়াতে বিদ্যমান সুবহে সাদিকরিসালাটি বহুল আলোচিত একটি রিসালা। এতে ফজরের নামায ও এশার নামাযের সময়ের ব্যাপারে যা কিছু লেখা হয়েছে তা উম্মতের সাধারণ পরম্পরা ও সর্বসম্মত তাআমুল ও কর্মপন্থার বিরোধী। হযরত রাহ. ব্যতীত সে সময়ের এবং এ সময়ের সকল আকাবিরের তাহকীক ও আমল এর বিপরীত। কিতাবটিতে যদিও প্রচুর পরিমাণে উদ্ধৃতি রয়েছে, কিন্তু মূল  মহল্লে নেযা’-এর  বিষয়ে কিতাবটির ভিত্তি হল তাসামুহ ও তাসাহুল। কেবলই দলীলবিহীন নয়, বরং দলীলের বিপরীত উদ্ধৃতি কিংবা উদ্ধৃতির ভুল প্রয়োগের উপরই পুরো রিসালাটির ভিত্তি।

মুসলিম উম্মাহর ব্যাপক আমল ও তাআমুল যদিও এর বিপরীত, তবুও আহলে ইলমের পক্ষ থেকে এ রিসালাটির দলীলসমৃদ্ধ বিস্তারিত পর্যালোচনার অনেক ঘাটতি ছিল। আমার যদ্দুর জানা, মাসিক আলকাউসারে প্রকাশিত বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধটির পূর্বে আহলে ইলমের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে দুটি রচনা সামনে এসেছে :

ক. পাকিস্তানের ইদারাতুল গোফরান, রাওয়ালপিন্ডি থেকে মাওলানা মুহাম্মাদ রেযওয়ান সাহেব কর্তৃক রচিত দুটি কিতাব।

খ. দারুল ইফতা, দারুল উলূম করাচি থেকে মাওলানা হুসাইন আহমাদ সাহেবের প্রস্তুতকৃত ৩৯ পৃষ্ঠার ফতোয়া। যা ১০ রমযান ১৪৩৮ হিজরীতে প্রকাশিত হয়েছিল।

মাওলানা মুহাম্মাদ রেযওয়ান সাহেবের রচনাদুটি মাশাআল্লাহ বেশ দীর্ঘ, যা সুবহে সাদিক ওয়া কাযিব আওর ওয়াকতে ইশা কি তাহকীকএবং কাশফুল গিতা আন ওয়াকতিল ফাজরি ওয়াল ইশানামে কিতাব আকারেও প্রকাশিত হয়েছে। উভয় রচনাকার সকল আহলে ইলমের পক্ষ থেকে শুকরিয়া পাওয়ার হকদার। কারণ, তারা একটি ইলমী দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন। তবে সত্য কথা হচ্ছে, এগুলোতে আহসানুল ফাতাওয়ায় উল্লেখিত সকল উদ্ধৃতির যাচাই ও পর্যালোচনা করা হয়নি এবং এর সব সংশয়ের উত্তরও দেওয়া হয়নি। সবচে বড় কথা হচ্ছে, বিষয়টির গোড়া থেকে সমাধান করা হয়নি এবং পরিপূর্ণ শাস্ত্রীয় আঙ্গিকে রিসালাটির পর্যালোচনা করা হয়নি।

এই ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে অধমের  শাগরিদে রশীদ বেরাদারে আযীয মাওলানা মুহাম্মাদ ফয়যুল্লাহ বিন মুঈনুদ্দীন প্রবন্ধটি প্রস্তুত করেছেন। সত্য কথা হচ্ছে, তিনি তাহকীকের হক আদায় করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা লেখকের কলব ও কালিব এবং যবান ও কলমে নূর ও বরকত দান করুন। ইসলাম ও উলূমে ইসলামিয়ার খিদমত করার ভরপুর তাওফীক নসীব করতে থাকুন। ইস্তেকামাত, আফিয়াত, সুস্থতা, সক্ষমতা ও নিরাপত্তার সাথে দীর্ঘ নেক হায়াত দান করুন- আমীন।

প্রবন্ধটির যতটুকু মাসিক আলকাউসারে প্রকাশ করার ছিল তা প্রকাশিত হয়ে গেছে। তবে প্রবন্ধটি এখানেই সমাপ্ত হয়ে যায়নি। এর আরো কয়েকটি কিস্তি রয়ে গেছে। যেখানে অন্য কিছু জরুরী আলোচনার সাথে সমকালীন কোনো কোনো লেখকের বই নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। যারা মূলত সুবহে সাদিক রিসালাটির তাসামুহগুলোরই পুনরাবৃত্তি করেছেন। তবে ভাবটা এমন, যেন তারা কোনো নতুন কিছু পেশ করতে যাচ্ছেন। অথচ নতুন কিছু তো নেই-ই, উপরন্তু তারা পুরোনো স্খলনগুলোর সাথে নতুন কিছু ভুলের সমাবেশ ঘটিয়েছেন!

এই প্রবন্ধটি যখন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে তখন অপ্রকাশিত সেই কিস্তিুগুলো তাতে শামিল থাকবে ইনশাআল্লাহ। অধম এই লেখাটির প্রথম কিস্তির (এপ্রিল-মে ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত)   ভূমিকায় পাঠকবৃন্দের সমীপে এ মর্মে নিবেদন করেছিলাম- আমাদের পেশকৃত আলোচনার বিপরীতে যার কাছেই কোনো দালীলিক পর্যালোচনা থেকে থাকে, আমাদেরকে সে ব্যাপারে অবশ্যই অবগত করবেন। প্রবন্ধের শেষে এসে বান্দা সেই নিবেদনই পুনরায় করছি। আমাদের কিতাব প্রকাশ করার পূর্বে কমপক্ষে এক বছর আমরা আহলে ইলমের পর্যালোচনা ও মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকব ইনশাআল্লাহ।

সুবহে সাদিক এবং শাফাক-এর ব্যাপারটি যেহেতু নামায রোযার মতো মহিমান্বিত ফরয ইবাদতের শুদ্ধাশুদ্ধির সাথে সম্পৃক্ত, এজন্য একে হালকা ভাবা সহীহ নয়। বিশেষ করে যখন আহসানুল ফাতাওয়ার সুবহে সাদিকরিসালাটিতে মুসলিম উম্মাহর যুগপরম্পরায় চলে আসা আমল এবং মুহাক্কিক ফকীহ ও জ্যোতির্বিদবর্গের সর্বসম্মত মতামতকে ভুল সাব্যস্ত করা হয়েছে, পক্ষান্তরে তাসামুহ ও তাসাহুলের উপর প্রতিষ্ঠিত মতামতকে একমাত্র সঠিক সিদ্ধান্ত এবং ঐকমত্যপূর্ণ মাসআলা হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর বিগত কয়েক বছর থেকে এ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এর অনুসরণও শুরু হয়ে গেছে এবং মুতাওয়ারাছ তরীকার অনুসারীদের বিরুদ্ধে অন্যায়-সমালোচনাও বেড়ে চলেছে। এজন্য এ বিষয়ে দালীলিক
বিস্তারিত পর্যালোচনা তুলে ধরা ইলমী আমানতেরই দাবি ছিল। এ বিবেচনায়ই মাসিক আলকাউসারে এত দীর্ঘ লেখা
প্রকাশ করা হল।

প্রবন্ধকার আমাদের শুকর ও সিপাস’-এর হকদার। কেননা তিনি সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয়ভাবে মাসআলাটি গোড়া থেকে সমাধান করেছেন। ধরে ধরে সকল উদ্ধৃতির পর্যালোচনা করেছেন এবং সকল সংশয়ের অবসান করেছেন।

প্রবন্ধটিতে আলোচনা ও পর্যালোচনা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও মজবুতির সাথে পেশ করা হয়েছে। এতে আপত্তির কিছু নেই। খালেস ইলমী এবং মুত্তাফাকাহ শরয়ী হুকুমের উপস্থাপন এমনই হওয়া উচিত। আপত্তি তখনই হত যখন পর্যালোচনা করতে গিয়ে ইলমের আদব এবং ইখতেলাফের আদব লঙ্ঘিত হত। আমার যতটুকু মনে হয়েছে, প্রবন্ধকার তা পরিহার করে চলেছেন। যথাসম্ভব আদব রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। তবে অসম্ভব কিছু নয় যে, বেখেয়ালীতে কোথাও কলম থেকে এমন কোনো শব্দ-বাক্য নির্গত হয়ে গেছে, যাতে কারো দৃষ্টিতে আদবের কমতি অনুভব হতে পারে। এজন্য সর্বপ্রথম আমরা আল্লাহ তাআলার মহান দরবারে ক্ষমার মিনতি করছি। অতঃপর হযরত রাহ.-এর ভক্ত-অনুরাগীদের সমীপে (যাদের সারিতে আলহামদু লিল্লাহ আমরাও পিছিয়ে নেই) ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে বিবেচনা করার অনুরোধ করছি। প্রবন্ধটির নযরে ছানী করার সময় এমন কিছু সামনে এলে আমরা অবশ্যই সংশোধন করে দেব ইনশাআল্লাহ।

إن أريد إلا الإصلاح ما استطعت، وما توفيقي إلا بالله، عليه توكلت وإليه أنيب.

 

-বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক

১০ যিলকদ ১৪৪৩ হিজরী

শনিবার

 

 

advertisement