যিলহজ্ব ১৪৪৩   ||   জুলাই ২০২২

হজ্বের মাস : হৃদয়ে স্বপ্নের প্রবাহ

মাওলানা মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব

কালো গিলাফে ঢাকা বাইতুল্লাহ আর সবুজ গম্বুজের মসজিদে নববী। মুমিনের হৃদয়ে লালিত দুটি স্বপ্ন। লাখো কোটি চোখের অসীম তৃষ্ণা এই দুটি স্বপ্নকে ঘিরে। অনবরত সেই স্বপ্ন মুমিন-হৃদয়কে আলোড়িত করে। কল্পনার অথৈ সাগরে জোয়ার আনে। ভাবে অনুভবে আনে পবিত্র পরশ।

হজ্বের মৌসুম এলে তাই মুমিনের ব্যাকুলতা বেড়ে যায়। ঢেউ ওঠে আবেদনে। প্রার্থনায়। প্রায়ই চোখের কোণে জমে বিন্দু বিন্দু জল। বারবার সে চলে যায় সুদূরে। মরু মক্কায়। মসজিদে হারামে। স্বপ্নের শহরে। মদীনায়।

হাজ্বীদের বিদায় দিতে গিয়ে সে যেন কেমন হয়ে যায়। কেমন এক দোলায় যেন দুলে ওঠে। অন্যরকম আবেগে ভারী হয়ে যায়। কল্পনা তাকে আনমনা করে দেয়। চোখের সামনে তখন ভাসতে থাকে একের পর এক দূর-দৃশ্য। মনে হয় যেন না থেকেও সে আছে ওখানে। তার সামনেই ঘটছে সব। সে দেখতে পাচ্ছে- গুঞ্জরিত মাতাফ। চারদিকে তালবিয়ার সুর। অসংখ্য মানুষ। ধবধবে সাদা ইহরাম পরে আছে সবাই। তওয়াফ চলছে। এখানে হাজারে আসওয়াদ। ওখানে মাকামে ইবরাহীম। সামনে মুলতাযাম। কোনো কোলাহল নেই। কলরব নেই। নেই নীরবতাও। শুধু মিনতি আর আকুতি। সম্বোধন আর আকুলতা। শান্ত আহাজারি আর উষ্ণ শ্বাস।

এরই মধ্যে সে খুঁজে পায় নিজেকে। আর খুঁজে পায় তার বুকের ভেতরে লুকানো অশ্রুকে।

***

কল্পনায় ভেসে ওঠে সারি সারি তাঁবু। ঐ তো মিনা। নানা দেশের, নানা জাতের, নানান শ্রেণির মানুষ। কোনো ভেদাভেদ নেই। একই লেবাসে, একই পোশাকে, একই আমলে সবাই। যিকিরে। নামাযে। তিলাওয়াতে। সবার কণ্ঠে একই ধ্বনি। একই তালবিয়া। ৮ যিলহজ্ব যোহর থেকে ৯ যিলহজ্ব ফজর। পাঁচ ওয়াক্ত নামায এখানেই পড়বে তাঁরা।

সে শুনতে পায় লাখো কণ্ঠের উচ্চারণ- লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক। লা শারীকা লাক।

এই যে আরাফা!  ঐযে মসজিদে নামিরা! ওখানেই আজ একসঙ্গে পড়া হবে যোহর ও আসর।

যুগ যুগ ধরে অগণন হাজীদের জামাত এসেছে এখানে। অসংখ্য মানুষ এখানে দুআ করেছে। রোনাযারি করেছে। ইবাদত বন্দেগীতে মগ্ন থেকেছে। ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। ভেসে ওঠে বিদায় হজ্বের ভাষণ-আলা হাল বাল্লাগতু?’ ভেসে ওঠে লক্ষ সাহাবীর একত্র স্বীকারোক্তি-নাআম। এরপর নবীজীর দৃপ্ত উচ্চারণ-আল্লাহুম্মাশহাদ। চৌদ্দশ বছর আগের কথা। কল্পনার কাছে তো অতীত আর বর্তমানে ফারাক নেই। সে বর্তমানকে যেভাবে অনুভব করে। তেমনি অনুভব করে দূর-অতীতকে। প্রেমময় দূর-অতীত। স্বপ্ন ও ভাবনার উজ্জ্বল স্মৃতি।

এখানেই আছে জাবালে রহমত। এর পাদদেশেই নবীজী উকূফ করেছিলেন। সালাওয়াতুল্লাহি ওয়া সালামুহূ আলাইহি।

হাজ্বী সাহেবান আরাফায় উকূফ করবেন দুপুরে সূর্য হেলে যাওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। সূর্যাস্তের পর সবাই রওয়ানা হবেন মুযদালিফায়।

***

৯ যিলহজ্ব দিবাগত রাত। অসংখ্য হাজ্বী অবস্থান করছেন মুযদালিফায়। কল্পনায় ভেসে উঠছে তারাভরা আকাশ। যমিনও আলোকিত হয়ে উঠেছে সফেদ লেবাসের মানব তারায়। ইশার ওয়াক্তে মাগরিব ও এশা একসাথে পড়ছে সবাই। এক আযানে। এক ইকামাতে। আনুগত্যের কী অপূর্ব প্রকাশ এখানে! সারাজীবন মাগরিব পড়েছে মাগরিবের সময়। আজ পড়ছে এশার সময়। দুটোই আল্লাহ তাআলার নির্দেশে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল অনুসরণ করে। এখানে নিজের ইচ্ছা-অভ্যাসের কোনো বিষয় নেই। বিষয় শুধু আনুগত্যের।

ঐ তো দেখা যাচ্ছে একটি মসজিদ। মসজিদে মাশআরে হারাম। আশপাশে বিশ্রাম করছেন হাজ্বী সাহেবান। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ রাতে বিশ্রাম করেছেন। এই মুযদালিফায়।

এই রাত পার হয়ে পরদিন সকাল। ১০ যিলহজ্ব। এ দিনের ব্যস্ততা অনেক। সুবহে সাদিক থেকে চারদিক ফর্সা হওয়া পর্যন্ত মুযদালিফার উকূফ। সেখানে সবাই দুআ-মুনাজাতে মগ্ন। আগেভাগে ফজর পড়ে হাত তুলে দুআ করছেন অনেকে। জারজার হয়ে কাঁদছেন। দরূদ পড়ছেন। নিবিষ্ট মনে তালবিয়া পড়ছেন।

দুআ মুনাজাতের পর ছোট ছোট কংকর কুড়িয়ে নিচ্ছেন সবাই। খেজুরের বিচির মতো কংকর। বুট কিংবা ছোলার দানার মতো কংকর। ছোট ছোট। অনেকে রাতের বেলায়ই কুড়িয়ে নিয়েছেন পর্যাপ্ত।

সূর্যোদয়ের একটু আগেই রওয়ানা হয়েছে কাফেলা। একের পর এক অনেক কাফেলা। সাদা পোশাকের নূরানী জামাত। ধীর গতিতে, ভাব গাম্ভীর্যের সাথে চলছে সবাই। কণ্ঠে মধুর তালবিয়া ধ্বনি।

জামরা আকাবায় গিয়ে শয়তানকে লক্ষ করে কংকর মারছে। তাঁরা এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যে, ডানদিকে কাবা। বামদিকে মিনা। এভাবে দাঁড়িয়েই নিক্ষেপ করছে; একে একে সাতটি কংকর। কংকর নিক্ষেপের মাঝে যেমন প্রকাশ পাচ্ছে আনুগত্য, তেমনি শয়তানকে পরাভূত করার ইচ্ছা। এই ওসিলায় হয়তো সামনের জীবনে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে। আল্লাহ তাআলা যেন তা-ই করেন, সবারই হৃদয়-মনে সেই আকুলতা।

যোহরের আগেই কংকর নিক্ষেপ করেছে বহু মানুষ। তারা উত্তম আমল করেছে। অনেকে নিক্ষেপ করেছে যোহরের পর। সূর্যাস্তের আগে। আর অনেকে নিক্ষেপ করেছে সূর্যাস্তের পরে। সুবহে সাদিকের আগে। ওজরের কারণে।

***

ঐ তো মীনা। ইবরাহীম-ইসমাঈলের মীনা। কুরবানীর মীনা। মহান ত্যাগের শিক্ষা ওখানে। আরাফা মুযদালিফায় তপ্ত অশ্রু বিসর্জনের পরই যেন বিসর্জন রক্তের। বাবা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের স্বপ্ন। বালক ইসমাঈল আলাইহিস সালামের সমর্পণ। আর আসমান থেকে নেমে আসা দুম্বার স্মৃতি ওখানে। ওখানেই আনুগত্যের উপমাহীন দৃষ্টান্ত।

জামরা আকাবায় কংকর নিক্ষেপের পর কুরবানী করছেন হাজ্বী সাহেবান।

মিনাতেই কুরবানী করছেন অনেকে। অনেকে করছেন মিনার বাইরে। তবে হারামের সীমানার মধ্যে। এরপর মাথা মুণ্ডিয়ে  ইহরাম ত্যাগ করেছেন।

ইহরাম ত্যাগ করতেই যেন তাঁদের বুক চিন্ চিন্ করে উঠেছে। সেলাইবিহীন এই সাদা পোশাক যেন তাদের কত আপন। এ পোশকই যেন তাদের পরিচয়। এ পোশাক চোখ খুলে দিয়েছিল তাদের। সজাগ করে তুলেছিল মৃত্যুর অনুভূতি। জীবনব্যাপী শুভ্রতা, শুদ্ধি ও পবিত্রতার অনুভূতি এনে দিয়েছে এ পোশাক।

কিন্তু আবেগ অনুভূতি আর ইচ্ছা আনন্দকে প্রাধান্য দেবে না মুমিন। সে প্রাধান্য দেবে দ্বীনকে। শরীয়তের নির্দেশকে। তাই এ পোশাক পরিবর্তন করে নিয়েছে আজ।

আবার সুযোগ এসেছে তাওয়াফের। মসজিদে হারামে। কাবাকে ঘিরে। আবেগময় আঙিনায়। কালো গিলাফে ঢাকা কাবা। মুমিন হৃদয়ে লালিত পরম স্বপ্নের পুষ্পিত কানন।

এই তাওয়াফকে বলে তাওয়াফে যিয়ারাত।

***

ঐযে সাফা-মারওয়া। মহান স্মৃতি বিজড়িত দুটি পাহাড়। কল্পনায় ভেসে ওঠে শিশু ইসমাঈলের পিপাসাকাতর কান্না আর মা হাজেরা আলাইহাস সালামের ব্যাকুল ছোটাছুটি। একবার এই পাহাড়ে। আবার ঐ পাহাড়ে। অস্থির মনের আকুল প্রার্থনা- এক পেয়ালা পানি! পিপাসিত বুকের মানিক। তার শুষ্ক-শুকনো ঠোঁট।

আল্লাহর দয়া ও রহমতের সাগরে ঢেউ উঠল; উৎসারিত হল আবে যমযম। পবিত্র পানি। বরকতময় সুধা। মহিমান্বিত কূপ। যুগ যুগ ধরে লাখো কোটি মানুষ তৃষ্ণা মিটিয়েছে এই কূপ থেকে। প্রাণভরে গ্রহণ করেছে এর বরকত! কতইনা ভাগ্যবান তারা, এ পানির যথাযোগ্য কদর করতে পারে যারা।

হাজ্বী সাহেবান সাফা-মারওয়ার সাঈ শুরু করেছেন। প্রথমে সাফা থেকে শুরু, মারওয়ায় গিয়ে শেষ। একবার সাঈ। এরপর মারওয়া থেকে শুরু। সাফায় এসে শেষ। দুইবার। এভাবে সাতবার সাঈ করছেন সবাই। প্রতিবার সাঈ শুরু করার আগে কাবার দিকে ফিরে মুনাজাত করছেন। সাঈ চলাকালেও করছেন যিকির ও দুআ।

১০ যিলহজ্ব দিন পেরিয়ে রাত। মিনায় পৌঁছে গেছেন সবাই। আজ রাতের অবস্থান মিনাতেই হবে।

তাঁবুতে তাঁবুতে শোনা যাচ্ছে যিকির, দরূদ, দুআ ও তিলাওয়াত। শোনা যাচ্ছে ইসতিগফার ও শোকরের বিভিন্ন বাক্য। কোথাও কোথাও দ্বীনী আলোচনা। ওয়ায ও নসীহত। কেউ কেউ দীর্ঘ ব্যস্ততার পর বিশ্রামে আছেন। সবাই খেয়াল রাখছেন, যেন তাদের বিশ্রামে ব্যাঘাত না হয়।

***

১১ যিলহজ্ব। যোহরের ওয়াক্ত থেকে কংকর নিক্ষেপের আমল। এবার প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয়-তিনটি জামরাতেই কংকর নিক্ষেপ করতে হবে। সূর্যাস্তের আগেই অনেক হাজ্বী সাহেব কংকর নিক্ষেপ করেছেন। অনেকে নিক্ষেপ করেছেন সূর্যাস্তের পর। রময়ুল জিমার। শয়তানকে বিতাড়ন ও শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে পানাহ চাওয়ার আমল। এক পুণ্যময় স্মৃতির অনুসরণ।

১২ যিলহজ্ব। এদিনও যোহরের ওয়াক্ত থেকে রময়ুল জিমার। কংকর নিক্ষেপের আমল। আগের দিনের মতোই।

এইদিন সূর্যাস্তের আগেই মিনা থেকে রওয়ানা হয়ে গেছেন অনেকে। অনেকে রাতে থেকেছেন মিনাতেই।

১৩ যিলহজ্ব। সুবহে সাদিক থেকেই কংকর নিক্ষেপের সময় শুরু হয়ে গেছে। রাতে যারা মিনায় ছিলেন শুধু তারাই কংকর নিক্ষেপ করছেন আজ।

হজ্বের কাজ শেষ হয়ে যাচ্ছে। মীকাতের বাইরে থেকে যারা হজ্বে এসেছেন তারা মক্কা ত্যাগ করার আগে আবার তাওয়াফ করবেন। সেই স্বপ্নের কাবাঘর। তার চারপাশে মুগ্ধময় ঘূর্ণন। এই তাওয়াফের নাম তাওয়াফে বিদা। বিদায়ের তাওয়াফ। বিদায় মক্কা। বিদায় প্রেমময় পুণ্যভূমি।

***

আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ...

আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদ...

সারাজীবন বহু দূর দূরান্ত থেকে দরূদ শরীফ পড়া হয়েছে। আজ বিরাট এক কাফেলা দরূদ পড়বে রওযায়ে মুবারকের সামনে দাঁড়িয়ে। ভাবতেই কেমন যেন লাগে। ভয় ও আনন্দের অপূর্ব মিশ্র অনুভূতি।

ভয়ের অনুভূতি এজন্য যে, সারাজীবন কত সুন্নত তরক করা হয়েছে। দ্বীনের বিষয়ে কত গাফলতি হয়েছে। আজ কোন্ মুখে হাজির হব তাঁর সামনে! কীভাবে সালাম দেব তাঁকে!

আনন্দের অনুভূতি এজন্য যে, দুনিয়ার সবচে প্রিয় ব্যক্তির কাছে যাওয়া হবে আজ। সবচে আপন মানুষের সামনে উপস্থিত হব আজ।

আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ...

মক্কা থেকে মদীনা পুরো পথে দরূদ পড়ছে সবাই।

ঐ যে মদীনা। মদীনাতুর রাসূল। নবীর শহর। চৌদ্দশ বছর আগের কত স্মৃতি এখানে। কত ঘটনা। কত ত্যাগ ও তিতিক্ষার সাক্ষী এ জমিন। হাদীস ও সীরাতের কিতাবে পড়া এবং বড়দের মুখে শোনা কত অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী এই ভূমি। এখানেই শুয়ে আছেন তিনি... যাঁকে ভালবাসে প্রতিটি মুমিন। জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসে তাঁকে।

এখানেই সবুজ গম্বুজ। এখানেই মসজিদে নববী। এখানেই আছে এক টুকরো বেহেশতি জমিন। রওযাতুম মিন রিয়াযিল জান্নাহ!!

উত্তমরূপে গোসল করে, পরিষ্কার সুন্দর পোশাক পরে, আতর খুশবু মেখে চলছে কাফেলা। রওযা অভিমুখে।

দূর আজমে পড়ে থাকা মুমিনের আছে শুধু কল্পনা। ভাগ্যবান মুমিনের কাফেলা তো হাজির হয়ে গেছে গন্তব্যে। সে কবে হাজির হবে! তার এ স্বপ্ন কবে বাস্তবতার মুখ দেখবে! আদৌ কি দেখবে কখনো? এই গরিবের নসীবে কি আসবে সেই পরম সৌভাগ্যের দিন? দৃষ্টি বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে যায় বারবার। আর ভাবতে পারে না সে। কী যেন বলতে চায়। কী যেন বলে রবের দরবারে হাত উঠিয়ে। তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে বারবার। ঐ যে কাফেলা। রওযা অভিমুখে ছুটছে। বড় ভাগ্যবান তারা!!...

 

 

advertisement