মুহাররম ১৪২৮   ||   ফেব্রুয়ারি ২০০৭

এ আগুন ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী

আমার এক সহকর্মী বন্ধু, শিক্ষকতায় আমরা বেশ কবছর এক সঙ্গে ছিলাম। বর্তমানে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে আমাদের দূতাবাসে কর্মরত। শুনেছি সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াবেন বলে বেশ কিছুদিন যাবত দেশে আছেন। তিনি প্রথম আমাকে চরমোনাইর মরহুম পীর সাহেব সৈয়দ মুহাম্মাদ ফজলুল করীম সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলেন।

যদিও পীর মাশায়েখ সম্পর্কে আমার বিশ্বাস, ধারণা ও অভিজ্ঞতা খুবই সুন্দর। কারণ নীতিগতভাবে আমি পীরপন্থী। আমার পরিবারও উলামা মাশায়েখ ও পীরের খান্দান। বাংলাদেশে তথা উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে পীর-মাশায়েখের ভূমিকাই সর্বশ্রেষ্ঠ। কিন্তু বর্তমানে প্রকৃত ইলমের অভাবে পীরতন্ত্র ভয়াবহ এক ফেতনার রূপ নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের দ্বীন-ঈমান ও আখলাকের ক্ষতি করে চলেছে। হক্কানী পীর-মাশায়েখের অভাব এবং প্রবৃত্তি পূজারী মূর্খ ও ব্যবসায়ী পীরদের প্রাদুর্ভাব এ বিষয়ে আমাকে কিছুটা নির্মম করে তোলে। তখন এই বন্ধুটি আমাকে চরমোনাইর পীর সাহেব সম্পর্কে ভাল কিছু তথ্য দিয়ে নিশ্চিন্ত ও নমনীয় করার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, গত কিছুদিন আগে আমি এক মাহফিলে গিয়েছিলাম। চরমোনাইর পীর সাহেবের বয়ান শুনে প্রভাবিত হই। আল্লাহর বান্দারা যেভাবে আবেগাপ্লুত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করেন এবং আল্লাহর ভয়ে কাঁদেন সাধারণত দেশীয় পীরদের মাহফিলে এমন দেখা যায় না। তিনি চরমোনাইর পীর সাহেবের ইলম সর্ম্পকেও আমাকে ধারণা দেন। এরপর আমি আমার আব্বার মুখে এই পীর সাহেবের পিতা মরহুম সৈয়দ মুহাম্মাদ ইসহাক রহ. সম্পর্কে বিস্তারিত শুনতে পাই এবং আমি আশ্বস্ত হই যে, এটি একটি শুদ্ধ সিলসিলা। এর কিছুদিন পর চরমোনাইর মরহুম পীর মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ ফযলুল করীম সাহেবকে দেখার এবং তাঁর কথা শোনার সুযোগ হয়। যদিও এসময় তাঁর নাম ও পরিচিতি বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন ও রাজনীতির অঙ্গনে বেশ ভালোভাবেই আলোচিত হতে শুরু করেছিল। হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর খেলাফত আন্দোলনের তিনি বিশিষ্ট নেতা হিসাবে কাজ করেন। উলামা-মাশায়েখের ঐক্য প্রক্রিয়ায়ও তিনি ছিলেন মধ্যমণি। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন যখন ব্যাপক আকারে শুরু হয় তখন তিনি ছিলেন এর প্রধান মুখপাত্র। দেশের নানামুখী পীরদের তৎপরতা জনমনে ব্যাপক আকর্ষণ বা সংশয় সৃষ্টি করলে হক্কানী উলামায়ে কেরাম শুদ্ধ বিকল্প হিসাবে চরমোনাইর এই ধারাটিকে পছন্দ করেন এবং স্বীকৃতি দেন। নির্দোষ এবং অনুমোদিত পীরালির যতগুলো গণমুখী ধারা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে এর মধ্যে চরমোনাইর এই ধারাটি ব্যাপক ও জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে উলামায়ে কেরামের উপরোক্ত ছাড় ও স্বীকৃতির ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। আশা করি আগামী দিনগুলিতেও এ নমনীয়তা, স্বীকৃতি ও ছাড় ধরে রাখার দিকে চরমোনাইর বর্তমান পীর সাহেব খুব খেয়াল রাখবেন।

যতদুর মনে পড়ে রাজধানীর লালমাটিয়া বড় মাদরাসার এক মহাসম্মেলনে চরমোনাইর মরহুম পীর মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ ফজলুল করীম সাহেবকে প্রথম দেখি। তিনি তার বয়ানে من رأى منكم منكرا হাদীসটির একটি সুন্দর ব্যাখ্যা দেন। শুনে খুশি হই এবং তাঁর সম্পর্কে একটি ভালো ধারণা লাভ করি। এরপর চট্টগ্রাম জামিয়া দারুল মাআরিফ আলইসলামিয়ায় তাঁকে দাওয়াত করে নিয়ে যাই। আমাদের উস্তাদ দারুল মাআরিফের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক দামাত বারকাতুহুম এর আগ্রহে এ দাওয়াত দেওয়া হয়। পীর সাহেবের স্বাভাবিক চট্টগ্রাম সফরের ভেতর থেকেই একটু সময় বের করে তিনি দারুল মাআরিফ যান। তরুণ ও সপ্রতিভ শিক্ষক হিসাবে আমিই প্রোগ্রাম উপস্থাপন করি। পীর সাহেবের সম্মানে একটি মানপত্র রচনা ও পাঠ করি। এই প্রথমবারের মত পীর সাহেবের সাথে আমার মুখোমুখি সাক্ষাত ও পরিচয় ঘটে। এরপর থেকে প্রায় বিশ বছর তার দুআ,  স্নেহ ও মমতা পেয়ে এসেছি। এর কিছুদিন পর তাঁর মুরিদেরা পীর সাহেবকে বহু চেষ্টাচরিত করে কিশোরগঞ্জ নিয়ে যান। কোনো উপলক্ষে আমিও তখন বাড়িতে ছিলাম। এই প্রথম পীর সাহেবের মাহফিলের সাধারণ বয়ান শোনার সুযোগ পাই। দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা তিনি বয়ান করেন, যার পুরোটাই ছিল অশ্রুসিক্ত এবং ইখলাস ও আন্তরিকতায় পূর্ণ। মানুষের মনে আল্লাহ ও আখেরাতের ভয় জাগ্রত করার এমন সরাসরি প্রক্রিয়া আমাদের দেশে সম্ভবত আর কোথাও চালু নেই। এরপর দীর্ঘ পনেরো বছরের ঢাকার কর্মজীবনে বহুবার তাঁর আলোচনা শোনার সুযোগ হয়েছে। আমার বাসার কাছে প্রতি বছর তিনি মাহফিল করতেন। বাইতুল মুকাররমে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তাঁর প্রোগ্রাম থাকত। জাতীয় নানা সংকটে তিনি দিক নির্দেশনা দিতেন। প্রতি বছর রমজানে বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় ও ইফতার করতেন। পীর সাহেব হুজুর ও তাঁর সহকর্মীরা আমাকে ভালবাসতেন বলেই কাছে টানতেন। আমিও তাঁদের ভালবাসতাম। বিশেষ করে আমার ছোট ভাই কবি মুহিব খান ছিল হুজুরের একান্ত স্নেহধন্য। সর্বশেষ গত রমজানে তার সাথে ইফতার করি হোটেল রাজমণি ঈশাখাঁয়। বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের সামনে পীর সাহেব গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। প্রশ্নোত্তর ও মন্তব্য পর্বে আমাকে কিছু বলতে বলা হলে আমি চরমোনাইর পীর সাহেব ও তাঁর শাসনতন্ত্র আন্দোলন সম্পর্কে আমার একটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরি। পীর সাহেব এতে খুবই প্রীত হন। ইফতারের সময় বরাবরের মতোই একই টেবিলে বসি এবং খাওয়ার চেয়ে কথা বার্তা বেশি হয়। আযানের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ইনসুলিন গ্রহণ করেন এবং অল্প কিছু ইফতার নেন। আমাকে বলেন ডায়াবেটিসের কারণে খুবই কমজোর। শাসনতন্ত্র আন্দোলনের কাজ কীভাবে ব্যাপক ও গতিময় করা যায় চিন্তা ফিকির করবেন। মাগরিবের পর পীর সাহেবের পুত্র মুসাদ্দিক বিল্লাহ আলমাদানী ও ভাবশিষ্য হাফেজ মাওলানা অধ্যাপক এটিএম হেমায়েতুদ্দীনের সাথে পীর সাহেব আলাপ করিয়ে দেন এবং বলেন, আপনারা একসাথে বসে কাজ এগিয়ে ও নেয়ার বিষয়ে পরামর্শ করুন।

এরপর মুসাদ্দিক বিল্লাহ সাহেব সাক্ষাতে ও টেলিফোনে দুই তিন বার কথা বলেছেন। পীর সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য বাইরে যান। পীর সাহেবের অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হয়। একসময় কিছুটা সুস্থবোধ করেন। কিন্তু পারতপক্ষে তিনি ঘরমুখী হননি। বছরের তিনশ ষাট দিন দেশব্যাপী দাওয়াত ও ইসলাহের কাজে উল্কার মত ছুটে বেড়ানো এ মানুষটি মৃত্যুর কোলে ঢলে না পরা পর্যন্ত আর দম নেননি।

গত ২৪শে নভেম্বর ২০০৬ প্রথম বারের মত আমি বরিশাল যাই। তারুণ্যদীপ্ত আলেম মাওলানা কামরুল ইসলামের আগ্রহে এ সফর হয়। বরিশাল শহরের দ্বীনী প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্রমণ করি। রাত একটা পর্যন্ত সুধী সমাবেশ হয়। ঢাকা ফেরার তাড়া ছিল বলে পরদিন বাদ ফজর রওয়ানা করি। প্রোগ্রাম এই ছিল যে, এদিন সকাল দশটার দিকে নদী পার হয়ে চরমোনাই যাব। কিন্তু আগে পরে দেশব্যাপী অবরোধ আন্দোলন প্রভৃতি কারণে দ্রুত কর্মস্থলে ফিরে আসার চিন্তাটাই প্রাধান্য পায়। ঢাকা ফেরার পথে বেলা এগারোটায় আরিচা ঘাট ফেরীতে বসে মোবাইলে খবর পাই ঘণ্টাখানিক আগে পীর সাহেব হুজুরের ইন্তেকাল হচ্ছে,। সারাদেশ ঘুরে বেড়ালেও বরিশাল আমার খুব দেরিতে যাওয়া হয়। সাক্ষাতের প্রোগ্রাম পাল্টে প্রয়োজনে ঢাকায় চলে আসি। আশ্চর্য যোগাযোগ এই যে, আমি যখন ঢাকায় এসে পৌঁছি তখন আমার সহকর্মী ও সতীর্থ আলেমগণ পীর সাহেবের জানাযায় শরীক হওয়ার জন্য বরিশাল রওয়ানা হচ্ছিলেন এবং বিস্ময়করভাবে সেদিনগুলোই ছিল চরমোনাইর বার্ষিক মাহফিল।

আমরা মরহুম পীর সাহেবের রুহের মাগফিরাত কামনা করি। তাঁর আরাদ্ধ কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য সহকর্মীদের অনুরোধ জানাই। তাঁর জানাশীন পীর মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ রেযাউল করীম যেন তাঁর পিতা ও শায়খের পদাঙ্ক সর্বক্ষেত্রেই অনুসরণ করতে পারেন, আল্লাহর দরবারে এই মুনাজাত করি। বাংলাদেশের অতিসাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে দ্বীনী চেতনা জাগ্রত করার যে অতুলনীয় কাজ চরমোনাইর এই ধারাটির দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে তা যেন আরও দীর্ঘকাল অব্যাহত থাকে। সাধারণ মানুষের মধ্যে ঈমান আমল ও আখলাকের ব্যাপক প্রভাবপূর্ণ পরিবর্তন চরমোনাইর এই ধারার বৈশিষ্ট। আমি বারবার চেষ্টা ও চিন্তা করেছি, সংশ্লিষ্টদের বলেছি, এই নিষ্ঠা, এই প্রেম, এই পরিবর্তন কেবল সমাজের সাধারণ মানুষ নয়, সকল স্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া যায় কি না।

 

 

advertisement