শাবান-রমযান ১৪৪৩   ||   মার্চ-এপ্রিল ২০২২

উস্তাযের আস্থাভাজন তালিবে ইলম
কিছু গুণ কিছু বৈশিষ্ট্য

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

الحمد لله، نحمده ونستعينه ونستغفره ونؤمن به ونتوكل عليه، ونعوذ بالله من شرور أنفسنا ومن سيئات أعمالنا، من يهده الله فلا مضل له، ومن يضلل فلا هادي له، وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له، وأشهد أن محمدا عبده ورسوله، اللهم صل على محمد وعلى آل محمد كما صليت على إبراهيم وعلى آل إبراهيم، إنك حميد مجيد، اللهم بارك على محمد وعلى آل محمد، كما باركت على إبراهيم وعلى آل إبراهيم إنك حميد مجيد.

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَ لْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍ ۚ وَ اتَّقُوا اللهَ اِنَّ اللهَ خَبِیْرٌۢ بِمَا تَعْمَلُوْنَ.

أما بعد:

তালিবে ইলম ভাইদের সঙ্গে বসতে পারা সাআদাতের বিষয়। আমরা কয়েকজন তালিবে ইলম ভাই সফরে বেরিয়েছি। মুখতাসার সফর। আজকের এই মজলিস, এই প্রতিষ্ঠানের যিয়ারত এবং তালিবে ইলমদের যিয়ারত আমাদের নসীব হয়েছে; সেজন্য আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করি- আলহামদু লিল্লাহ।

তালিবে ইলম ভাইদের খেদমতে আরয করার মত অনেক বিষয় আছে। কিন্তু সেগুলো আসাতিযায়ে কেরাম বলতে থাকেন, তাম্বীহ করতে থাকেন এবং তাযকীর করতে থাকেন। আমরা যারা মাদরাসার যিয়ারত ও তালিবে ইলমদের সঙ্গ গ্রহণের জন্য এসে থাকি, একেক সময় একেকজন আসেন বিভিন্ন মুনাসাবাতে, আমাদের মাকসাদ মূলত থাকে- যে মাহৌলে আসি সে মাহৌলের বরকত লাভ করা এবং কিছু খুশবু ও কিছু আলো গ্রহণ করা। মাদরাসার মুনতাযিমগণ অনেকসময় হুকুম করেন কিছু কথা বলার জন্য। সেজন্য যা বলা হয়, তার অধিকাংশ তাকরার। উস্তাযগণের কাছ থেকে যা শুনি সেগুলোই বলি। এখানে যে আসাতিযায়ে কেরাম ও মুরব্বীগণ আছেন তারাও তাদের আসাতিযায়ে কেরাম ও আকাবির থেকে যা শুনেছেন বলেন। তাই কথাগুলো ও চিন্তাগুলো অভিন্ন হয়ে থাকে। খুব আজনবী কথা সাধারণত হয় না। একই সূত্রে পাওয়া জিনিস তো। ইবারতে অনেকসময় পার্থক্য হয়। তবে কথা ও চিন্তা একই হয়ে থাকে সাধারণত।

এখানের তালিবে ইলমদের সামনে আমি কী আরয করব খুঁজে পাচ্ছি না। কারণ এখানের আসাতিযায়ে কেরাম, নেগরান ও মুরব্বীগণের মধ্যে হযরত মুফতী আহমাদুল্লাহ ছাহেব হুজুর দামাত বারাকাতুহুম আছেন। তিনি আমাদের বড়দের অনেকের সোহবত পেয়েছেন। দেশের ও দেশের বাইরের অনেক আকাবিরের সোহবত  লাভ করেছেন। তিনি এখানকার নেগরান। তাঁর তত্ত্বাবধানে এখানে যে আসাতিযায়ে কেরাম আছেন তারাও মাশাআল্লাহ অনেক ইমতিয়াযের অধিকারী। তাদের রাহনুমায়ী ও রাহবারী আমাদের জন্য সাআদাতের বিষয়। এই রাহনুমায়ী ও রাহবারীকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করার চেষ্টা করি। এটা আমার প্রথম আরয।

দ্বিতীয় আরয হল, আমরা যারা তালিবে ইলম, আমাদের মধ্যে অনেক সূক্ষ¥ রোগ থাকে। কিছু রোগ তো প্রকাশ্য। আবার কিছু রোগ আছে অপ্রকাশ্য।

তালিবে ইলম যদি এমন হয়, যার প্রতি আস্থা আছে উস্তাযগণের, তাহলে এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আজকালের তালিবে ইলমদের মধ্যে যেসব সমস্যা প্রকট, সেগুলোর একটা হল উস্তাযের আস্থা হারিয়ে ফেলা বা আস্থা সৃষ্টি না হওয়া। অনেকের হালত তো হল, তার প্রতি উস্তাযের আস্থা-ই তৈরি হয় না। কিংবা আস্থা তৈরি হচ্ছিল কিন্তু পরে আর থাকেনি। এটা তালিবে ইলমের জন্য অনেক বড় ক্ষতি।

আর তালিবে ইলমের পক্ষে অনেক বড় সাআদাতের বিষয় এই যে, তার প্রতি উস্তাযের আস্থা আছে। সে কিছু বললে উস্তাযের তারাদ্দুদ হয় না। ভাবেন, সে যা বলে ঠিক হবে। এটা আস্থার বিষয়।

কিছু তালিবে ইলম অবাস্তব ও বানোয়াট কথা বলে কিংবা অর্ধ সত্য বলে। এরকম দু-চারবার ঘটলে তার প্রতি উস্তায আর বিশ্বাস রাখতে পারেন না। এটা শুধু উস্তাযের বিষয় নয়; ঘর ও পরিবারের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়।

তালিবে ইলমের প্রতি উস্তাযের আস্থা কী কারণে নষ্ট হয়? বিভিন্ন কারণে।

এক. মিথ্যা বলার কারণে। মিথ্যা কথা যে কারো আস্থা নষ্ট করে দেয়। দু-চারটা মিথ্যা প্রমাণিত হলে আস্থা শেষ।

দুই. বে-উসূলীর কারণে। তালিবে ইলম বে-উসূলী করতে থাকলে উস্তাযের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়।

তিন. উস্তাযের রাহবারী ও রাহনুমায়ী যে কবুল করে না তার প্রতি উস্তাযের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। এখানে থাকাবস্থায় এখন যে তালিবুল ইলম উস্তাযদের রাহনুমায়ী কবুল করে না সে সামনে গিয়ে কী করবে? তার ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো আস্থা পয়দা হয় না উস্তাযদের দিলে। তাকে নিয়ে, তার ভবিষ্যত নিয়ে উস্তাযদের দিলে কোনো আশা ও কোনো তামান্না পয়দা হয় না।

পক্ষান্তরে যে মেহনত করে, মাদরাসার উসূল মেনে চলে এবং উস্তাযদের রাহনুমায়ী গ্রহণ করে তার প্রতি উস্তাযদের আস্থা হয়- ইনশাআল্লাহ এর দ্বারা ভবিষ্যতে কাজ হবে। এর ব্যাপারে চিন্তা করা যায় যে, এর থেকে আমরা কী খেদমত নেব? উম্মতের কোন্ কাজে তাকে লাগাব? দ্বীনের কোন্ খেদমতে তাকে যুক্ত করব?

যে তালিবে ইলমের ভবিষ্যত নিয়ে উস্তায ভাবেন সে সাআদাতমান্দ তালিবে ইলম। একটা তো হল, সব তালিবে ইলমের ভবিষ্যত নিয়ে উস্তায ভাবেন। কারণ তাদের পেছনে উস্তাযগণ মেহনত করেনই তাদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল হওয়ার জন্য। এটার কথা বলছি না এখন। বরং সুুনির্দিষ্টভাবে কোনো তালিবে ইলমের সুুনির্দিষ্ট ভবিষ্যত নিয়ে উস্তায ভাবেন- এটা তালিবে ইলমের জন্য সাআদাতের বিষয়। এই ভাবনা ওই তালিবে ইলমের জন্য আসে, যে উস্তাযের আস্থাভাজন।

সেটা কীভাবে হবে? বিভিন্নভাবে।

ক. সিদকের মাধ্যমে।

খ. আমানতের মাধ্যমে।

গ. উসূলের পাবন্দি করার মাধ্যমে। এগুলো উস্তাযের মনে আস্থা তৈরি করে।

উসূলের পাবন্দির একটি দিক হল, গায়রে হাযির না থাকা। সবসময় উপস্থিত থাকা। হযরত মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম কখনো সবকে গায়রে হাযির ছিলেন না। লালবাগে পড়াকালীন একবার এক উস্তাযের নিকট ছুটি নিচ্ছিলেন। ডাক্তার দেখাতে হবে। কিন্তু ডাক্তার দেখালে একটা সবক ছুটে যাবে। অথচ না দেখিয়ে উপায় নেই। বিশেষ জরুরত। অবিলম্বে ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। ছুটি পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তিনি উস্তাযকে গিয়ে বললেন, ডাক্তার দেখানোর জরুরত। তখন উস্তায তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার তো সবকে গর হাযিরী নেই; আচ্ছা ঠিক আছে। এটা তো আগের দিনের ঘটনা। পরের দিন উস্তায ওই দরসে আসেননি। তাঁকে ছুটি দিয়েছেন জরুরতের কারণে আর এদিকে তিনি দরসে আসেননি। ভেবেছেন, দরসে আসলে বেচারার সবক ছুটে যাবে অথচ ইতিপূর্বে সে সবকে কখনো অনুপস্থিত থাকেনি। আজকে ওজরের কারণে তাকে যেতে হচ্ছে; সুতরাং আজকে দরস না হোক।

এই হল তালিবে ইলম। তিনি তাঁর জরুরতে ছুটি চেয়েছেন। কিন্তু তাঁর প্রতি উস্তাযের এত আস্থা যে, তাঁর অনুপস্থিতিটা যাতে না হয় সেজন্য উস্তায সেদিন দরস করাননি। এর নাম তালিবে ইলম।

আজকালের তালিবে ইলমরা তো উস্তাযের মহব্বত চায়ও না। সাধারণত আমরা যা দেখি, আমভাবে তালিবে ইলমরা উস্তাযের মহব্বত চায়ও না-والله أعلم

নামের মহব্বত চায়; কিন্তু আসলে মহব্বত যেটাকে বলে, সেটা খুব কম তালিবে ইলম চায়। উস্তাযের কাছে মহব্বত চাইতে হয় না। উস্তায তো নিজের মহব্বত দিতে এবং ছাত্রের মহব্বত নিতে প্রস্তুত। শফীক ও দরদওয়ালা উস্তায তো এমনই হন। কিন্তু হতে হবে তোমাকে। সেরকম পাত্র তো লাগবে। উস্তাযরা তো টেনে নেন। তুমি এমন হওয়ার চেষ্টা কর, তোমাকে বলতে হবে না, উস্তায নিজেই তোমাকে টেনে নেবেন।

ঘ. ইনহিমাক ও ফানা ফিল ইলম। উস্তায যার মধ্যে ফানা ফিল ইলম দেখবেন তার প্রতি উস্তাযের এমনিই মহব্বত হবে।

আমি মারকাযুদ দাওয়াহ্য় এমন হালত দেখেছি- কোনো মেহমান এসেছেন; একটু খেদমত দরকার। দারুল মুতালাআয় গিয়ে দেখি সবাই ইনহিমাকের সঙ্গে মুতালাআ করছে। আমি কাউকে ডাকিনি। খেদমত দরকার, আসা দরকার এ কথা কাউকে বলিনি। অন্যভাবে ওই জরুরত সেরেছি। এরকম দৃশ্য একবার আমিও দেখেছি মারকাযুদ দাওয়াহ্য়। সেটা পাওয়া যায় না সবসময়। শায-নাদের পাওয়া যায়। ওই ইনহিমাক যদি কোনো উস্তায দেখেন, তার মন তো এমনিতেই বাগবাগ হয়ে যাবে খুশিতে। আমি বলিনি তাদেরকে, ওঠো, আসো, কাজ করো। মনে হয়েছে, আমি কীভাবে একজন তালিবে ইলমকে ইনহিমাক ছাড়তে বলব?

হযরত মাওলানা সাহবান মাহমুদ ছাহেব রাহ. বলতেন, আরে! তোমরা তো অনেকসময় নামাযীর সামনে দিয়ে হাঁটো। অথচ আমি কারো মুনাজাতের সামনে দিয়ে হাঁটতে চাই না। একজন মুনাজাতে মুনহামিক। আমি তার সামনে দিয়ে হেঁটে যাব; তার মুনাজাতের ইনহিমাকে ক্ষতি হবে- এটা আমি চাই না। তিনি তাঁর যওক ও জযবার কথা বলেছেন। এটা কোনো মাসআলা নয়; মুনাজাতরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে যাওয়া জায়েয আছে। কিন্তু কেউ ইহতিয়াত করলে গুনাহও নেই।

ইনহিমাকের বড় কদর। ইনহিমাক কাকে বলে? মুদাওয়ামাতের সঙ্গে ইলমের তলবে ও ইলমের পথ চলায় নিমগ্ন থাকা এবং ইলমের পথে প্রতিবন্ধক এমন সবকিছু থেকে দূরে থাকা। একে বলে ইনহিমাক।

ইনহিমাকের সিফাত, একাগ্রতার সিফাত এবং খলওয়াতের সিফাত- এগুলো অত্যন্ত জরুরি। ইলমের জন্য আমি খালি, আমি ফারেগ। ইলম ও ইলম সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বাইরে আমার কোনো শোগল নেই। এর বাইরের জিনিসগুলোকে আমি আপদ মনে করি।

لكل شيء آفة،و للعلم آفات.

সেগুলোকে আমি আপদ মনে করি। আল্লাহর কাছে পানাহ চাই- আল্লাহ! آفات العلم  থেকে আপনি আমাকে রক্ষা করুন।

যাহোক ইনহিমাক তালিবে ইলমের জন্য উসতাযের মনে মহব্বত, কাশিশ ও আস্থা তৈরি করে। এটা মূলত সিদকের অংশ। আমি তালিবে ইলম। আমার তলবটা সাদিক হতে হবে। আমি যদি সাদিক ও আমীন তালিবে ইলম হই, আমার মুনহামিক না হয়ে কোনো উপায় নেই। ওর মধ্যেই বিষয়টা আছে। কিন্তু সিদক ও আমানত বললে তো এত কিছু যেহেনে আসে না; সেজন্য ভিন্ন করে বললাম।

ঙ. আদব।

চ. তাওয়াযু। এগুলোর দ্বারাও তালিবে ইলমের প্রতি উস্তাযের দিলে আস্থা তৈরি হয়।

কোনো না কোনো কাশিশ তো তোমার মধ্যে থাকতে হবে। মারগূব ফীহ হওয়ার জন্য কোনো না কোনো দিক থেকে তোমার মধ্যে কাশিশ থাকতে হবে। বরং কাশিশের একাধিক কারণ নিজের মধ্যে থাকতে হবে।

কাশিশের কারণ তো নেই; উল্টো দূরত্বের কারণ আছে আমার মধ্যে। উস্তায ও শাগরিদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে এরকম অনেক কারণ আছে আমার মধ্যে। তাহলে কীভাবে উস্তাযের সঙ্গে আমার মহব্বত হবে?

দূরত্ব তৈরি করে যেসব জিনিস সেগুলোরও তালিকা আছে। ইতিপূর্বে কয়েকটি উল্লেখ করেছি। ওগুলো থেকে বাঁচতে হবে। কাশিশের কারণ যেগুলো বললাম সেগুলোর বিপরীতগুলোই দূরত্বের কারণ। সিদকের অভাব, আমানতের অভাব, উসূলের পাবন্দির অভাব, ইনহিমাক ফিল ইলমের অভাব- এগুলো দূরত্ব তৈরি করে। আদবের বিপরীতে সূয়ে আদব এবং তাওয়াযুর বিপরীতে উজব ও কিবর- এগুলো দূরত্ব তৈরি করে। উস্তায যা চান এবং উস্তায আমাকে নিয়ে যা আশা করেন সেটার প্রতি আমার কোনো তাওয়াজ্জুহ নেই; এর দ্বারা দূরত্ব তৈরি হবে কি না? অবশ্যই।

অতএব উস্তাযদের দিলে আমাদের প্রতি কাশিশ ও আস্থা তৈরি করে- এমন সিফাত আমাদেরকে অর্জন করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমাদের সবাইকে কবুল করুন- আমীন।

وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.

 

[গত ২৮-০৫-১৪৪৩ হি. মোতাবেক ০৪-১২-২০২১ ঈ. দারুল উলূম ফেনীর তালিবে ইলমদের উদ্দেশে প্রদত্ত বয়ান। মুসাজ্জিলা থেকে পত্রস্থ করেছেন মাওলানা মাহমুদ বিন ইমরান।]

 

 

advertisement