জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪৩   ||   জানুয়ারি ২০২২

র্যা গিং : শিক্ষাঙ্গণে অপরাধ ও অশ্লীলতার দাগ!

মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ

ঈমান ও দ্বীনের সৌন্দর্যই জীবনের সৌন্দর্য। শিক্ষাদীক্ষা, আচার-আচরণ, আমল-আখলাক সব ক্ষেত্রে এই সৌন্দর্যের পরিচর্যা ও যত্নশীলতা মুমিনের জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। মুমিনের জীবনে উভয় জগতের (দুনিয়া-আখেরাত) সাফল্য নিয়ে আসে এই ঈমানী ও দ্বীনী সৌন্দর্য। সতর্ক, বুদ্ধিমান ও সুপথের পথিক ঈমানদারদের জীবনের পথচলা হয়ে থাকে এই সৌন্দর্যের পথেই। তবে ইবলিসের হাতছানি ও শয়তানী আহ্বানে এই সুস্থ দ্বীনী সৌন্দর্যের সঙ্গে সবসময় সব মুসলমান যুক্ত থাকার সৌভাগ্য লাভ করতে পারেন না। বরং একটি শ্রেণী নানাভাবে ঈমানী রাহনুমায়ী ও দ্বীনের পথ থেকে নিজেদের জীবনচর্চাকে দৃষ্টিকটূভাবে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়।

এবং অনেক সময় দ্বীনী সৌন্দর্য থেকে তাদের এই দূরত্বের মুঃখটা শুধু তাদের মধ্যেই আবদ্ধ থাকে না, বরং জীবনের দৃষ্টিকটূ অসৌন্দর্যগুলো তারা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার বেদনা তৈরি করে। জোর, চাপ ও অসহিষ্ণুতার মধ্য দিয়ে অশ্লীলতা ও অপরাধের দাগ তৈরিতে উদ্যোগী ও উৎসাহী কর্মীর ভূমিকা পালন করতে লেগে যায়। এসব উদ্যোগ ও উৎসাহের মধ্য দিয়ে জীবনে ঈমান ও দ্বীনের সৌন্দর্য থেকে সে নিজে কেবল দূরে থাকা বা বঞ্চিত হওয়ার পরিস্থিতির মধ্যে নিজেকে নিয়ে যায় না, বরং অন্য বহু মানব-মানবীর জীবনেও অশালীনতার বিষ ছড়িয়ে দিয়ে যায়।

দুই।

জীবনে ঈমানী ও দ্বীনী সৌন্দর্যের অন্যতম বিষয় হচ্ছে, শালীনতা। কথাবার্তা, পোশাক-আশাক, চলাফেরায় শ্লীলতা, শালীনতা ও লজ্জাশীলতা ধরে রাখাই মুমিনের জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কোনো মুসলিম-সমাজে এই শালীনতা ও যৌন সুস্থতার বিষয়ে একসময় আলাদা করে কোনো কথা বলতে হতো না। দ্বীনের সঙ্গে ন্যুনতম সম্পর্কের সূত্র হিসেবেই শিক্ষিত-শিক্ষাবঞ্চিত সব শ্রেণির মুসলমান জীবন-শালীনতার এই সৌন্দর্য ধরে রাখতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ইবলিসি আধুনিকতা, বেহায়া তথ্যস্রােত এবং দুষ্ট জীবনচর্চার অংশ হিসেবে ঘরে-বাইরে, পথে-ঘাটে, ক্যাম্পাসে এই অশালীনতার চর্চা শুরু হয়েছে। এবং একই সঙ্গে চর্চা হচ্ছে নানারকম জুলুম, উৎপীড়ন ও নির্যাতনের। পশ্চিমা জীবনজগত থেকে আমদানি করা র‌্যাগিং-র‌্যাগ-ডের নামে এসব অশ্লীল ও উৎপীড়ক জীবনচর্চা অতি উৎসাহে ক্ষেত্র বিশেষে মূল ভূখন্ডের চেয়েও বিকুত রূপে চালানো হচ্ছে এদেশে। এর সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে নানারকম জুলুমের উপাদান।

র‌্যাগ-ডে ও র‌্যাগিংয়ের নামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নানারকম উৎপীড়নমূলক ঘটনার খবর আগে থেকেই আসতো। সম্প্রতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি মফস্বলের কলেজগুলো থেকেও এ জাতীয় ঘটনার খবর গণমাধ্যমে আসছে। আর এর সঙ্গে বড় হয়ে আসছে নানারকম অশ্লীল উক্তি, কুরুচিপূর্ণ আচরণ ও লেখাজোখার বিভিন্ন চিত্র। দৃশ্যটা এমন হয় যে মনে হতে থাকে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে তরুণ-তরুনীদের মধ্যে এরকম অশ্লীলতার চর্চা চারপাশের অভিভাবকরা যেন স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিচ্ছে। যেন আধুনিক উচ্চ শিক্ষা ও সময়ের বিবর্তনে এরকম অশালীনাতার চর্চা (র‌্যাগ ডে-র নামে) এটা তেমন কোনো মন্দ বিষয় নয়। জীবনের সৌন্দর্য ও সুস্থতা বিঘিœত হওয়ার মতো কোনো উপাদান এতে নেই। অথচ বাস্তবতাটা তো এরকম না। কারণ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা ইরশাদ করেন-

اِنَّ الَّذِیْنَ یُحِبُّوْنَ اَنْ تَشِیْعَ الْفَاحِشَةُ فِی الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَهُمْ عَذَابٌ اَلِیْمٌ  فِی الدُّنْیَا وَ الْاٰخِرَةِ  وَ اللهُ یَعْلَمُ وَ اَنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ.

নিশ্চয়ই যারা চায় মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ুক, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না। -সূরা নূর (২৪) : ১৯

আল্লাহ তাআলার এই বাণী এবং এই বাণীর মধ্যে যে ভয়াবহ শাস্তির সতর্কবার্তা রয়েছে তা যেন আমাদের আধুনিক শিক্ষাপিঠের অভিভাবকেরা অনুধাবন করেন।

তিন।

র‌্যাগ-ডে ও র‌্যাগিংয়ের নামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলা উৎপীড়নমূলক ঘটনার খবর গত কয়েক বছরে দেশব্যাপী ব্যাপক উত্তেজনা ও ক্ষোভ তৈরি করেছে। এসব র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় অনেক তরুণ-তরুনীর জীবন বিপন্ন হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। তারপরও দেখা যাচ্ছে, কখনো কোনো রাজনৈতিক শক্তির সহযোগিতায় কখনো কোনো সাংস্কৃতিক রীতির দোহাই দিয়ে এ- জাতীয় উৎপীড়নধর্মী অনুষ্ঠানে একশ্রেনির ছাত্র-শিক্ষক উৎসাহী ভূমিকা রাখছেন। কেউ কেউ সংবাদপত্রে কলাম লিখে জানাচ্ছেন, র‌্যাগ-ডে মূলত কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগের ছাত্রদের বিদায় অনুষ্ঠানের দিন। এ উপলক্ষে কিছু দেখা-সাক্ষাত, মজা-ফূর্তি করার আয়োজন থাকে। র‌্যাগ-ডে  মৌলিকভাবে অতো খারাপ কিছু না! অপরদিকে গত নভেম্বরে নেত্রকোনা অঞ্চলের একটি সরকারি কলেজে র‌্যাগ-ডে পালন করতে না দেওয়ায় কলেজে গিয়ে ক্ষুব্ধ ছাত্ররা বিভিন্ন আসবাবপত্র কুপিয়ে নষ্ট করেছে বলে সংবাদপত্রে খবর এসেছে। অনেকটা নেশায় আসক্ত তরুণদের মতো কাজ করেছে এরা। উৎপীড়ন ও অশ্লীলতার বাহক র‌্যাগ-ডে পালন করতে না দেওয়ায় নিজেদের কলেজে গিয়ে কোপানো ও ভাংচুরের মহড়া দিয়ে গোটা দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

র‌্যাগ-ডে কেন্দ্রিক এসব অস্থিরতা-উত্তেজনা, ক্ষোভ এবং এজাতীয় ঘটনাপ্রবাহ একটি তিক্ত বাস্তবতাকে চোখের সামনে নিয়ে আসে। সেটি হচ্ছে, র‌্যাগিংয়ের মধ্য দিয়ে অশালীনতা-উৎপীড়নকে শিক্ষাঙ্গনের সহজাত বিনোদন কার্যক্রম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রকাশ্য চেষ্টা ও মনোভাব বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বিদ্যমান। একইভাবে এ-জাতীয় উৎপীড়ন, জুলুম-নির্যাতনের ঘটনাকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখা ও দেখানোর মতো মানসিকতাও সমাজে সক্রিয়। অশ্লীলতার বাইরে কেবলমাত্র এই জুলুমের ঘটনাও একটি ভয়ংকর ব্যাপার। স্বাভাবিক পরিসরে, ছোট-বড় শিক্ষাঙ্গনে।

হযরত লুকমান আ. তার ছেলেকে যে উপদেশ দিয়েছেন তার একটি বর্ণনা কালামুল্লাহ শরীফে-

وَ لَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَ لَا تَمْشِ فِی الْاَرْضِ مَرَحًا اِنَّ اللهَ لَا یُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُوْرٍ.

এবং মানুষের সামনে (অহংকারবশত) নিজের গাল ফুলিও না এবং মাটিতে সদম্ভে চলো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দর্পিত অহংকারীকে পছন্দ করেন না। -সূরা লুকমান (৩১) : ১৮

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

اتّقُوا الظّلْمَ، فَإِنّ الظّلْمَ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.

তোমরা জুলুম/সীমালংঘন/অত্যাচার করাকে ভয় করো। কারণ, কিয়ামতের দিনে জুলুম হবে অনেক অন্ধকার। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৭৮

এই জুলুম ও উৎপীড়নে যুক্ত হওয়া এবং শিকার হওয়ার হাত থেকে তরুণ-তরুণী শিক্ষার্থী নতুন প্রজন্মকে বাচানোর পদক্ষেপ নেওয়ার বড় দায়িত্ব অভিভাবকদের। এক্ষেত্রে ঘর ও বিদ্যালয়ের অভিভাবকদের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। রাষ্ট্রের অভিভাবকরাও চোখ খুলতে পারেন মন চাইলে।

চার।

সুস্থ জীবন ও জীবন সৌন্দর্য থেকে সরে যাওয়ার উপায়-উপলক্ষ সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। হাটে-ঘাটে, চলার পথে, ঘরে-কার্যালয়ে এবং ব্যক্তি জীবনের নিভৃতে অ-সুস্থতা ও গোনাহর হাতছানি এখন অনেক বেশি সক্রিয় ও বিস্তৃত। নফস ও ইবলিসের বাহ্য শক্তির চকমকা প্রভাব এমনিতেও একটু বেশি হয়ে থাকে। এবং একইভাবে এ-জাতীয় দুষ্ট হাতছানি যেমন তরুণ-তরুনীদের মাঝে চলে, তেমনি যুবক ও মধ্যবয়সী এমনকি জীবচনের পড়ন্ত বেলার মানুষদের মধ্যেও আল্লাহর স্মরণ থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখার আয়োজনের নানা রূপ নখদাঁত বিকশিত করে আছে। এমন একটি সময়ে মুসলিম সমাজের বৃহত্তম নতুন প্রজন্মের বিদ্যাপিঠগুলোতে অশ্লীলতা ও জুলুমের বিস্তারকে সয়ে যাওয়ারচোখে দেখতে থাকা বড়দের জন্য দায়িত্বশীল কোনো জীবন-অবস্থান হতে পারে না।

নানা রকম অশ্লীলতা ও অপরাধের উসকানি যারা দেয় এবং যারা উদ্যোগী হয়ে এসব অপকর্মে নিজেরা যুক্ত হয়ে অন্যদেরও শিকার বানায়, তারা তো অবশ্যই অপরাধী। যারা অভিভাবকত্বের জায়গায় অবস্থান করে এসব অপকর্ম ও অ-সুস্থতার নতুন নতুন প্রচলন ও প্রতিষ্ঠাকে নীরবে সহ্য করে সহযোগিতাৎ করে, তারাও কম অপরাধী নন। কারণ দায়িত্বশীল জায়গা থেকে এভাবে জোর করে চাপিয়ে এবং চালিয়ে দেওয়া অসভ্যতার গতি রোধ করে দিলে ভুল ও বর্জনযোগ্য একটি রেওয়াজ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জায়গা পেতে পারে না।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

مَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً حَسَنَةً، فَلَهُ أَجْرُهَا، وَأَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا بَعْدَهُ، مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْءٌ، وَمَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً سَيِّئَةً، كَانَ عَلَيْهِ وِزْرُهَا وَوِزْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا مِنْ بَعْدِهِ، مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَيْءٌ

যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোনো সুন্দর ধারা চালু করলো পরে লোকেরা সে সুন্দর ধারা অনুযায়ী কাজ করলো, সেই ব্যক্তি পরবর্তীদের আমলের সমান সওয়াব পাবে; যতিও পরবর্তীদের সওয়াবের কোনো ঘাটতি হবে না। এবং যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে মন্দ কোনো ধারা চালু করলো, পরে লোকেরা সে মন্দ ধারা অনুযায়ী কাজ করলো, সেই ব্যক্তির আমলনামায় পরবর্তীদের গোনাহে কোনো হ্রাস ঘটানো ছাড়াই তাদের গোনাহের দায় লেখা হবে। সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০১৭

নৈতিক অপরাধ, জুলুম ও অ-সুস্থতা জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে দুনিয়া এবং আখেরাতে। এ ধরনের পাপে ব্যক্তিগত যুক্ততা কিংবা অন্যদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার দায় আরো মারাত্মক রকম ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। বিশেষত নতুন নতুন মন্দকর্মের প্রচলনের বিষয়কে রুখে দেওয়ার চেষ্টা করা সবার দায়িত্ব। আমাদের নিজেদের জন্য, নতুন প্রজন্মের জন্য এবং সমাজের সুস্থ জীবনচর্চা ও জীবন-সৌন্দর্যের জন্য এসব নেতিবাচক বিষয়ের শুদ্ধির বিষয়ে আমাদের উদ্যোগী হওয়া আমাদের ভবিষ্যতকে কল্যাণময় করবে ইনশাআল্লাহ। শুধু র‌্যাগ -ডে বা র‌্যাগিংয়ের ঘটনা নয়, শুধু অশ্লীলতার সামাজিক চর্চা কিংবা ক্যাম্পাস-উৎপীড়ন নয়; সমাজের বিভিন্ন কোনায় কোনায়, বিভিন্ন অলিতে-গলিতে চালু করা মন্দের স্রাতে নির্জীব করে দিয়ে নেকির বাতাস বেগবান করার চেষ্টা করাই মুমিনের কাজ, মুমিনের সৌভাগ্য। ঈমান ও দ্বীন কেন্দ্রিক সুস্থতা এবং এর সৌন্দর্য ছাড়া মুমিনের জীবন সুন্দর পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে পারে না। সেজন্যই ছোট-বড়, সমাজের যে স্তর থেকেই জীবন-সৌন্দর্যের জন্য হানিকর কোনো উপাদান এসে যুক্ত হতে চাইলে তাকে থামিয়ে দেওয়া এবং রুখে দেওয়া অপরাপর সব সুস্থ মুমিনের দায়িত্ব হয়ে যায়। হ

 

 

advertisement