রবিউল আখির ১৪৪৩   ||   নভেম্বর ২০২১

কুরআন-অবমাননা
সহিংসতা-অবিচার নয়, সংযম ও ন্যায়বিচারই শান্তি প্রতিষ্ঠার উপায়

অক্টোবরের মাঝামাঝিতে কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটল, তার নিন্দা করার ভাষা আমাদের নেই। যে বা যারাই যে উদ্দেশ্যেই এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকুক, তারা অত্যন্ত ভয়াবহ একটি অপকর্ম সংঘটিত করেছে। এর শাস্তি তাদের ভুগতেই হবে। আল্লাহ তাআলার পবিত্র কালামের সাথে অবমাননাকর আচরণের শাস্তি যে কী ভয়াবহ- তা তারা দুনিয়ার জীবনে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে না পারলেও আখেরাতে অবশ্যই বুঝতে পারবে। সে জীবনে প্রত্যেকে তার কৃতকর্মের পূর্ণ ফল পেয়ে যাবে।

বর্তমান সময়ের নানা ঘটনায় দেখা যাচ্ছে যে, এখন শুধু মুসলিমেরই নয়, ইসলামের ইজ্জত-আব্রুও যেন সবচেয়ে মূল্যহীন বস্তু। তা না হলে ধর্মপ্রাণ মুসলিমের এই দেশে এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা কীভাবে ঘটতে পারে? স্বভাবতই এ ঘটনা ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের আবেগ-অনুভূতিকে মর্মান্তিকভাবে আহত করেছে। তাদের এই অনুভূতির প্রতি সম্মান ও সহমর্মিতা প্রকাশ করা দরকার ছিল। কিন্তু এই সৌজন্য ও ভদ্রতার বহিঃপ্রকাশ না মিডিয়ায়, না দায়িত্বশীলদের বক্তব্যে, না সুশীলসমাজের মন্তব্য ও পর্যবেক্ষণে- কোথাও সাধারণভাবে দেখা যায়নি।

প্রশ্ন হতে পারে, এই ঘটনার পর যেভাবে হিন্দু-সম্প্রদায়ের লোকদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে তাতেই ঐ ব্যাপারটা গৌণ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা বোধ হয় এত সরল নয়। কুমিল্লার পূজামণ্ডপে কুরআন অবমাননার ঘটনার পর বিভিন্ন স্থানে হিন্দু-সম্প্রদায়ের লোকদের উপর হামলার ঘটনা কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়, কিন্তু সে কারণে দেশের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ নিরপরাধ মুসলিমের আবেগ-অনুভূতির বিষয়টি গৌণ হয়ে যাবে কেন? কুরআন অবমাননার ঘটনার সাথে যেমন দেশের হিন্দু-সম্প্রদায়ের সকল লোক জড়িত নয়, তেমনি এর জের ধরে ঘটা সহিংসতার সাথেও তো সকল মুসলিম জড়িত নয়। তাহলে সহিংসতায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের অন্যায় কাজের শাস্তি ও সমালোচনার পাশাপাশি সংখ্যাগরিষ্ঠ মর্মাহত মুসলিম জনগণের আবেগ-অনুভূতির প্রতিও দু-চারটি সহমর্মিতার বাণী কি খুবই অপ্রাসঙ্গিক ছিল? পূজামণ্ডপের কর্তা ব্যক্তিরা কি সহিংসতাকারীদের বিচারের দাবির পাশাপাশি এ দেশের বিপুলসংখ্যক মর্মাহত মুসলিমদের প্রতি সৌজন্যমূলক হলেও খানিকটা দুঃখ প্রকাশ করতে পারতেন না! কুরআন-অবমাননার সাথে জড়িত না হয়ে থাকলেও যেহেতু পূজাম-পেই তা ঘটেছে তাই নিজেদের সাফাই বর্ণনার পাশাপাশি দুঃখ স্বীকার করাও তো স্বাভাবিক ভদ্রতার মধ্যেই পড়ে। আমাদের অনেক মসজিদেই তো নিরপরাধ অমুসলিমের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুর উপর হামলার নিন্দা জানানো হয়েছে, মন্দিরের কর্তা ব্যক্তিরাও যদি মুসলিমদের আবেগ-অনুভূতির ব্যাপারে সৌজন্য ও শ্রদ্ধাবোধের প্রকাশ ঘটান তাহলে সেটা কি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য ইতিবাচক হয় না? কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ভদ্রতা, সৌজন্য ও ভারসাম্যের এই ধারাটা কেন যেন তৈরি হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে শান্তিপ্রিয় চিন্তাশীল ব্যক্তিদের চিন্তা-ভাবনা করা উচিত বলে মনে হয়। 

এ প্রসঙ্গে সরকারপ্রধানের একটি বক্তব্য অনেক পর্যবেক্ষকের কাছেই অত্যন্ত সাহসিকতাপূর্ণ ও ব্যতিক্রমী বক্তব্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তিনি আমাদের প্রতিবেশী দেশের উদ্দেশে একটি তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছেন। ১৬ অক্টোবর প্রকাশিত বিবিসি বাংলার একটি রিপোর্টে উল্লেখিত হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী সতর্ক করেন, বাংলাদেশের হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতকেও সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, ‘সেখানেও (ভারতে) এমন কিছু যেন না হয়, যার প্রভাব আমাদের দেশে এসে পড়ে, আর আমাদের হিন্দু-সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত আসে।বিভিন্ন দিক থেকে তার এই বক্তব্য একটি ব্যতিক্রমী বক্তব্য। বাংলাদেশ শান্তিপ্রিয় ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের প্রিয় মাতৃভূমি। এদেশে অরাজকতা, সহিংসতার বিস্তার, শান্তি-শৃঙ্খলার অবনতি, নাগরিকদের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু, আবেগ-অনুভূতি ঝুঁকিতে পড়ে যাওয়া কিছুতেই কাম্য নয়। কাজেই সহিংসতা, হানাহানির কারণগুলোও যাতে ঘটতে না পারে সেজন্য সচেতনতা ও ব্যবস্থা দুটোই শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন।

একইসাথে বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় সর্বস্তরের মুসলিম জনগণকে অনেক বেশি সংযম, সতর্কতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। অন্যথায় শয়তানের মিঠাই লাগানোর মত ঘটনাগুলোর জেরে দিনশেষে আক্রান্তও হবেন তারা, দোষীও হবেন তারাই। আল্লাহ তাআলাই একমাত্র রক্ষাকর্তা। ইতিপূর্বেও বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গেছে, সহিংসতার ঘটনায় মুসলমানদের উপর সরাসরি গুলি চালানো হয়েছে। কুমিল্লার ঘটনাটিতেও বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের রিপোর্ট অনুযায়ী বেশ কজন মুসলিম প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা গেছে। উপরন্তু তারা ব্যাপকভাবে আখ্যায়িত হচ্ছেন ধর্মান্ধ, মৌলবাদী ইত্যাদি নানা বিশেষণে।

বিষয়টি এখন অনেকটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। কাজেই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিগুলোকে দূরদর্শিতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে মোকাবেলা করার পাশাপাশি ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের কার্যক্রমকে জোরদার করতে হবে।

ইসলামের সৌন্দর্য ও শালীনতা, ইসলামী বিধি-বিধানের ভারসাম্য ও যথার্থতা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার সর্বাত্মক প্রয়াস গ্রহণ করতে হবে।

ইসলামের দৃষ্টিতে অমুসলিমের অধিকারের সাথে মুসলিমেরাও যে মানুষ, তাদের প্রাণ, রক্ত ও ধর্মীয় অনুভূতিরও যে মূল্য আছে এ বিষয়টি শালীন ও যুক্তিসঙ্গত উপস্থাপনায় তুলে ধরতে হবে। বর্তমান সমাজ-বাস্তবতায় এটিও এখন প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। হ

 

 

advertisement