শাওয়াল ১৪৪২   ||   মে ২০২১

পশ্চিমা নীতির দ্বিচারিতা : সুইজারল্যান্ড থেকে আড়ং

মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ

আধুনিক বস্তুবাদী তত্ত্ব ও পশ্চিমা নীতি-পরিভাষার একটি বড় ফাঁক হল, যখনই ইসলাম ধর্মের নীতি-বিধানের কোনো বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তার প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হয়- তখনই শুরু হয় ডবল স্ট্যান্ডার্ড বা দ্বিচারিতা। একটি নীতি বা সংজ্ঞার পরিচিত পরিধিটা হঠাৎ বদলে যেতে থাকে। কখনো প্রতিযোগিতায় অসাধু জয়ের জন্য সেই সংজ্ঞার আওতা বাড়ানো হয়। কখনো চাতুর্যের সঙ্গে কমিয়ে আনা হয় সেটির বিস্তৃতি।

এই মার্চের শুরুতে সুইজারল্যান্ডে পর্দানশীন মুসলিম নারীদের মুখ ঢাকার জন্য যে নেকাব ব্যবহার করা হয়- সেটিকে নিষিদ্ধ করতে রীতিমতো গণভোটের আয়োজন করা হয়। গণভোটের আগে হিজাব-বোরকা ও নেকাব বিরোধী ব্যাপক প্রচারণাও চালানো হয়। খ্রিস্টান জগতে পরিচালিত উগ্র ডানপন্থিরাজনৈতিক শক্তিগুলো এই প্রচারণা চালায়। এরপরও মাত্র ৫১+ ভাগ ভোট পাওয়া যায় নেকাবের বিরুদ্ধে। ২ ভাগের মতো ভোটের ব্যবধানে নেকাব বিরোধী আইন অনুমোদিত হয়।

এই যে মুসলিম নারীদের মুখ ঢাকার আবরণ (নেকাব) ব্যবহার নিষেধাজ্ঞার আয়োজনটি হল এবং পাশ হল; প্রথমত এটা পশ্চিমের বয়ান করা নাগরিক ও মানবিক ব্যক্তি স্বাধীনতার সম্পূর্ণ উল্টো একটি ঘটনা বা নমুনা। পশ্চিমের সেকুলারিজম ও ব্যক্তি-স্বাধীনতাবাদের চোখে রাষ্ট্রের প্রতিটি পুরুষ-নারী নাগরিকের এই অধিকার আছে যে, সে যে কোনো রকম ব্যক্তি জীবন (বা যৌন জীবন) বেছে নিতে পারে, বেছে নিতে পারে যে কোনো রকম পোশাক ও সংস্কৃতি। সেখানে রাষ্ট্র সেই নাগরিকের ওপর কোনোরকম হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এই তত্ত্ব ও নীতিটি যে পশ্চিমের সেকুলার ও ব্যক্তি-স্বাধীনতাবাদী দেশগুলো শুধু মুখে মুখে মানে এমন নয়- বরং উন্নয়নশীল মুসলিম-অমুসলিম অথবা মিশ্র ধর্মাবলম্বীদের দেশে এজাতীয় নীতির অনুশীলন-বাস্তবায়নে তারা নানারকম সমর্থন ও চাপ প্রয়োগ করে থাকে।

এজন্যই কোনো মুসলিম-প্রধান দেশে কোনো শিক্ষার্থী কিংবা কোনো কর্মজীবী নারীকে হিজাব পরার জন্য কোনো নির্দেশনা দেওয়া হলে এবং সেই নির্দেশনার কথাটি গণমাধ্যমের বরাতে পশ্চিমা কূটনীতিক অঙ্গন ও গণমাধ্যমের বারান্দায় নিয়ে আছড়ে পড়লে তারা হিজাব পরতে বলার এই অমানবিকনির্দেশনাটি উল্টে দিতে প্রশাসনের উপর-নিচসহ সব জায়গায় চাপ তৈরি করে। একইসঙ্গে মুসলিম দেশে নারীদের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও পোশাক পছন্দের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে মর্মে পশ্চিমা দেশের দাসত্বপ্রেমী স্থানীয় গণমাধ্যম ও সুশীলমহলকে কান্নাকাটি করতে ময়দানে নামিয়ে দেওয়া হয়। নানা উপায়-কৌশল প্রয়োগ করে ব্যক্তি স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে মুসলিম দেশের মুসলিম নারীকে হিজাবের নির্দেশনার অধীনে আনতে বাধা দেয়। আবার তারাই ব্যক্তিস্বাধীনতার সব তত্ত্ব স্থগিতকরে দিয়ে তাদের দেশে মুসলিম নারীরা হিজাব-নেকাব পরতে চেয়ে আকুলতা প্রকাশ করলেও আইন করে বাধার প্রাচীর দাঁড় করায়। এভাবেই ইসলামী নীতি ও জীবনাচারের প্রশ্নে তাদের নীতি ও জীবনাচারের মূল দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্ন ও বিপরীত অবস্থান থাকলে তাদেরই অপরাপর যে কোনো নীতি, তত্ত্ব, দর্শন ও সংজ্ঞার আওতা-পরিধি বদলে যেতে থাকে, প্রয়োজনে ছোট-বড় হতে থাকে। তত্ত্বের দ্বিচারিতা ও নীতির দ্বিমুখিতা প্রকাশ্য হয়ে ওঠে।

এটি তো হল নেকাব বিরোধী সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তাদের নীতির আলোকেই তাদের পয়লা অসঙ্গতি। যথেচ্ছ ব্যক্তি স্বাধীনতাবাদ ও ব্যক্তি পছন্দবাদের কারণে হিজাব-নেকাব পরতে চাওয়া কোনো মুসলিম নারীকে কোনোভাবেই তাদের বাধা দেওয়া উচিত নয়। আর যেখানে মুসলিম দেশগুলোতে হিজাবের পক্ষে কোনো রকম নির্দেশনা দেখলে তারা ব্যক্তি স্বাধীনতাবাদ ক্ষুণ্নের ধুয়া তুলে পরিস্থিতি সপ্তমে নিয়ে যায়- সেখানে নিজেদের দেশে কীভাবে হিজাব-নেকাব পরতে চাওয়া নারীদের তারা তাদের মতো খোলামেলা পোশাক পরতে বাধ্য করতে চেষ্টা করে; আইন চাপিয়ে দেয়! এটা তো বৈপরীত্য ও দ্বিচারিতার আরো জঘন্য একটি দৃষ্টান্ত। অবশ্য জীবনদৃষ্টির উগ্র পক্ষপাতের কারণে এর চেয়েও কাঁচা দ্বিমুখিতা ও প্রকট বৈপরীত্যের পথ তাদের বেছে নিতে দেখা যায়। যেমন, সুইজারল্যান্ডের পর্দানশীন মুসলিম নারীদের মুখ ঢাকতে নেকাব ব্যবহার করা যাবে না- এমন আইন করা হলেও করোনা ভাইরাসের চলমান সময়ে স্বাস্থ্যবিধির অংশ হিসিবে নারী-পুরুষের কারোরই মুখে মুখ ঢাকা মাস্ক পরা যাবে না- এমন কোনো আইন কিন্তু সেখানে করা হয়নি। অর্থাৎ মুসলিম পর্দানশীন নারী মুখ ঢাকা নেকাব পরতে পারবে না, আইনে নিষেধ করা হয়েছে এবং এই আইন প্রণয়নে গণভোট’-এর সাহায্য নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পর্দানশীন ও বেপর্দা, মুসলিম ও অমুসলিম সব নারী-পুরষই মুখঢাকা মাস্ক পরে রাস্তায় বের হতে পারবে; বরং বলা উচিত, মুখঢাকা মাস্ক পরে রাস্তায় বের হতে হবে। গত কয়েক মাস আগে দেশে দেশে মাস্ক ব্যবহারে কিছুটা শৈথিল্য দেখা দিলেও সাম্প্রতিক সময়ে করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গের ধাক্কায় আবারো বিভিন্ন দেশে বাধ্যতামূলক মাস্ক ব্যবহারসহ বিভিন্ন রকম স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের নির্দেশনা  দেওয়া হচ্ছে। তার মানে হচ্ছে, নেকাব পরে মুখঢাকা নিষেধ হলেও মাস্ক পরে মুখঢাকা বাধ্যতামূলক!

আইন ও সিদ্ধান্তে নেকাব ও মাস্কের এই অসঙ্গতিটি দূর করার জন্য কিছু হাস্যকর শব্দ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন : স্বাস্থ্যগত কারণ ছাড়া কোনো ধর্মীয় কারণে মুখমণ্ডল ঢেকে জনপরিসরে বের হওয়া যাবে না। অর্থাৎ মুসলিম নারীরা ধর্মীয় কারণে হিজাবের সঙ্গে যে নেকাব ব্যবহার করে- সেটা ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। তবে, মাস্ক যেহেতু স্বাস্থ্যগত কারণে ব্যবহার করা হয় (এবং তাতেও মুখ ঢাকা হয়ে যায়) তাই মাস্ক ব্যবহারের বিষয়টি এই আইনের আওতায় নিষেধাজ্ঞার সীমানায় পড়বে না। দ্বিমুখিতার উগ্র ও অভব্য প্রকাশ এই আইনে করা হলেও শব্দের মারপ্যাঁচে দেখানো হল, মাস্কে মুখ ঢাকার বিষয়টি ভিন্ন, আর নেকাবে মুখ ঢাকার বিষয়টি ভিন্ন।

ইসলামী বিধান, নীতি, জীবনাচার ও সংস্কৃতির সঙ্গে পশ্চিমের সংজ্ঞা-পরিভাষার এই দ্বিচারিতা ও চাতুর্যের ব্যাপারগুলো শুধু সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মান, নেদারল্যান্ডসহ ইউরোপের কিছু দেশেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং অপরাপর বহু দেশের মতো পাশ্চাত্য-দাস বাংলাদেশি অভিজাত বলয়’, এনজিও, বহুজাতিক ব্যবসাকেন্দ্র, মিডিয়াচক্র ও সুশীল বৃত্তের অনুশীলনেও এজাতীয় দ্বিচারিতা বেশ প্রকাশ্য ও চর্চিত। গত মার্চের চৌদ্দ তারিখ ব্র্যাক-এর শাখা প্রতিষ্ঠান-আড়ংয়ে এক চাকরিপ্রার্থী তরুণকে দাড়ি রাখার কারণে প্রত্যাখ্যান করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এরপর হয় প্রতিবাদ ও মানববন্ধন। অবশেষে পোশাক প্রতিষ্ঠান আড়ং দুঃখ প্রকাশ করেসংবাদপত্রে বিবৃতি দেয়। আড়ংয়ের প্রথম আচরণে ছিল পশ্চিমের আধুনিকতা, সেকুলারিজম ও ব্যক্তি স্বাধীনতাবাদ (এবং এর সঙ্গে সূক্ষ্মভাবেই ইসলামী জীবনাচারের সঙ্গে দূরত্বের একটি সাংস্কৃতিক অবস্থান।) এজন্য প্রভাবক গণমাধ্যমগুলো শুরুতে আড়ংয়ের দাড়ি-বিমুখআচরণে কোনো অসঙ্গতি পায়নি। কারণ তারাও পশ্চিমের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি পক্ষপাতের রোগে আগে থেকেই আক্রান্ত। অথচ এই বছরকাল আগে ঢাকার পাশের একটি বড় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে জামাতের সঙ্গে নামায আদায়ে কর্মীদের মধ্যে নির্দেশনা দেওয়ায় গোটা গণমাধ্যম ও সুশীল বৃত্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। পরে ওই কর্তৃপক্ষ মাফ চেয়ে তাদের নির্দেশনা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছে।

অর্থাৎ আড়ং যখন ব্যক্তি স্বাধীনতাবাদ ও আধুনিকতার দোহাই দিয়ে দাড়ির কারণে কর্মীকে প্রত্যাখান করে তখন সেই কর্মীর পছন্দ-অপছন্দ তুচ্ছ ও গুরুত্বহীন। আর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি যখন নামাযের জামাতে শরিক হতে নির্দেশনা দেয়- আর এক-দুজন বেয়াড়া ও ফাঁকিবাজ কর্মী সেই নির্দেশনার বাইরে থাকতে চায়- তখন কর্মীর ইচ্ছা হয়ে গেল রাজ-আজ্ঞা। কর্মীর পছন্দই পছন্দ; মালিক বা ব্যবস্থাপনার নির্দেশনা অযাচিত ও অন্যায্য। এরই কাছাকাছি আরো বহু ঘটনা সাম্প্রতিক সময়গুলোতে পাওয়া যাবে। যেখানে দেখা যাবে, মালিক বা শ্রমিক মূল ব্যাপার নয় এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতাবাদ ও পছন্দনীতিও প্রধান ঘটনা নয়; বরং ইসলামী নীতি ও জীবনাচারের সঙ্গে যার পছন্দের মিল হয়েছে, তাকে ম্যানেজম্যান্ট, গণমাধ্যম ও সুশীলচক্র একসঙ্গে কোনঠাসা করে ফেলেছে। এসবের মধ্য দিয়ে মূলত মুসলিম জীবনাচারে ইসলামী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিপরীত চিন্তা ও সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটানোই উদ্দেশ্য। পশ্চিমা সমাজ ও বিভিন্ন মূলনীতি, তত্ত্ব ও সংজ্ঞার কথা বড় মুখে উচ্চারণ করা হলেও বাস্তবে ইসলামের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এলেই তাদের প্রায় সব নীতি ও তত্ত্বের মধ্যে দ্বিমুখি চেহারাটা প্রকট হয়ে ওঠে।

মুসলমান শুধু চিন্তার চোখটা খোলা রাখলেও পশ্চিমা নীতি-চিন্তার দুষ্ট সয়লাবের ফাঁকগুলো বার বার ধরতে পারবে। পারবে নিজের ঈমান-আমল ও ফিকিরের ক্ষেত্রে প্রশান্ত বোধ ও দৃষ্টি লালন করে যেতে। তাদের উচ্চারিত প্রায় প্রতিটি শ্রুতিমধুর আপাত নিরপেক্ষ শ্লোগানগুলোর অসদ্ব্যবহার ও চাতুর্যপূর্ণ প্রয়োগে চোখ রাখলে ধরতে পারবে তাদের ভ্রান্ত সৌধের বহু ফাঁক-ফোকর ও ফাটল। হ

 

 

advertisement