জুমাদাল উলা-জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪২   ||   জানুয়ারি ২০২১

ভাস্কর্য ও মূর্তি : কিছু আয়াত ও হাদীস

মাওলানা মুহাম্মাদ ইমরান হুসাইন

প্রাণীর প্রতিকৃতি বানানো এবং এর মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহার দুটোই শরীয়তে নিষিদ্ধ ও হারাম। এ প্রসঙ্গে যে হাদীসগুলো এসেছে তা অকাট্য ও মুতাওয়াতির। ইসলামের সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে গোটা মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্য ও ইজমা রয়েছে। এটা মুমিনদের ঐকমত্যপূর্ণ পথ। আর কুরআন মাজীদে মুমিনদের ঐকমত্যপূর্ণ পথ পরিহার করাকে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ বলা হয়েছে। [সূরা নিসা (৪) : ১১৫]

প্রাণীর প্রতিকৃতি নির্মাণের অবৈধতা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধান। এতে পূজার শর্ত নেই। এই অবৈধতার কারণ হল আল্লাহর সৃষ্টিগুণের সঙ্গে সাদৃশ্য গ্রহণ, যা বিভিন্ন হাদীসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।

গত (রবিউল আখির ১৪৪২ হি. মোতাবেক ডিসেম্বর ২০২০ ঈ.) সংখ্যায় ‘ভাস্কর্য ও মূর্তি এক না ভিন্ন : ইসলাম কী বলে?’ শিরোনামে এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। এ সংখ্যায় আমরা মূর্তি ও ভাস্কর্য বিষয়ক কিছু আয়াত-হাদীস ও ঐতিহাসিক বর্ণনা পেশ করছি।

মানব-ইতিহাসে যেভাবে শিরক ও অন্ধকার-যুগের সূচনা হয়

মুহাম্মাদ ইবনে কা‘ব কুরাযী রাহ. বলেন-

كَانَ لِآدَمَ خَمْسُ بَنِينَ فَسَمَّاهُمْ، قَالَ: وَكَانُوا عُبَّادًا، فَمَاتَ رَجُلٌ مِنْهُمْ فَحَزِنُوا عَلَيْهِ، فَجَاءَ الشَّيْطَانُ فَصَوَّرَهُ لَهُمْ ثُمَّ قَالَ لِلْآخَرِ إِلَى آخِرِ الْقِصَّةِ، -وَفِيهَا- فَعَبَدُوهَا حَتَّى بَعَثَ اللهُ نُوحًا.

আদম আলাইহিস সালামের পাঁচ ছেলে ছিল। তিনি তাঁদের নাম উল্লেখ করে বলেন, তাঁরা ছিলেন, ইবাদতগুযার। তাঁদের একজন মারা গেলে লোকেরা অস্থির হয়ে পড়ে। তখন শয়তান এসে তার আকৃতি নির্মাণ করে দিল। এভাবে একেকজন মারা গেলে তার আকৃতি তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে তাদের ইবাদত করা শুরু হয়। তখন আল্লাহ তাআলা নূহ আলাইহিস সালামকে প্রেরণ করেন। -ফাতহুল বারী ৮/৫৩৬

ভাস্কর্যপ্রীতি থেকেই নূহ আ.-এর গোত্রে শিরক ও জাহিলিয়াতের সূচনা

কুরআনে কারীমে উল্লিখিত ওয়াদ্, সুওয়া, ইয়াগূছ, ইয়াঊক ও নাসর নামক এই পাঁচটি মূর্তি কওমে নূহ-এর মাঝে প্রচলিত ছিল। এগুলোর প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে ইবনে আব্বাস রা. বলেন-

أَسْمَاءُ رِجَالٍ صَالِحِينَ مِنْ قَوْمِ نُوحٍ.

এগুলো হচ্ছে নূহ আ.-এর সম্প্রদায়ের কিছু পুণ্যবান লোকের নাম।

কীভাবে তাঁরা মূর্তিতে পরিণত হলেন? ইবনে আব্বাস রা. সে ইতিহাস শোনাচ্ছেন-

فَلَمَّا هَلَكُوا أَوْحَى الشَّيْطَانُ إِلَى قَوْمِهِمْ، أَنِ انْصِبُوا إِلَى مَجَالِسِهِمُ الَّتِي كَانُوا يَجْلِسُونَ أَنْصَابًا وَسَمُّوهَا بِأَسْمَائِهِمْ، فَفَعَلُوا، فَلَمْ تُعْبَدْ حَتَّى إِذَا هَلَكَ أُولَئِكَ وَتَنَسَّخَ العِلْمُ عُبِدَتْ.

তাদের মৃত্যুর পর শয়তান তাদের সম্প্রদায়কে এই কুমন্ত্রণা দিল যে, তাদের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলোতে ভাস্কর্য স্থাপন কর এবং তাদের নামে সেগুলোর নামকরণ কর। ভক্তিপ্রবণ লোকেরা শয়তানের কুমন্ত্রণায় তাদের ভাস্কর্য নির্মাণ করে। ওই প্রজন্ম যদিও এইসব ভাস্কর্যের পূজা করেনি, কিন্তু ধীরে ধীরে প্রকৃত বিষয় অস্পষ্ট হয়ে গেল এবং পরবর্তী প্রজন্ম তাদের পূজায় লিপ্ত হল। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৯২০; আখবারু মাক্কা, ফাকিহী ৫/১৬২-১৬৩ (৭১)

সুহায়লী রাহ. বিষয়টিকে আরো স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেন-

كُلّمَا هَلَكَ الْأَوّلُ صُوّرَتْ صُورَتُهُ، وَعُظّمَتْ لِمَوْضِعِهِ مِنْ الدّينِ، وَلِمَا عَهِدُوا فى دعائه من الإجابة، فلم يزالوا هَكَذَا حَتّى خَلَفَتْ الْخُلُوفُ، وَقَالُوا: مَا عَظّمَ هَؤُلَاءِ آبَاؤُنَا إلّا لِأَنّهَا تَرْزُقُ وَتَنْفَعُ وَتَضُرّ، وَاتّخَذُوهَا آلِهَةً.

এই পুণ্যবান ব্যক্তিদের কেউ মারা গেলে তার আকৃতি গঠন করা হত এবং এর ভক্তি-সম্মান করা হত। কারণ তিনি ছিলেন পুণ্যবান এবং তার দুআ কবুল হত। এভাবেই কয়েক প্রজন্ম তার ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে থাকে। পরের প্রজন্ম বলল, আমাদের পূর্বপুরুষগণ তো এই ভাস্কর্যগুলোর প্রতি এজন্যই ভক্তির অর্ঘ্য নিবেদন করত যে, তারা রিযিক দান করতে পারে, উপকার-অপকার করতে পারে। তখন তারা এগুলোকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে নেয়। -আররওযুল উনুফ ১/৩৫৯; ফাতহুল বারী ৮/৫৩৬

মূর্তিপূজা সূচনার ইতিহাসটা আরো সুন্দর করে চিত্রিত করেছেন উবায়দুল্লাহ ইবনে উবায়দ ইবনে উমায়ের রাহ.। তিনি বলেন-

أَوَّلُ مَا حَدَثَتِ الْأَصْنَامُ عَلَى عَهْدِ نُوحٍ، وَكَانَتِ الْأَبْنَاءُ تَبِرُّ الْآبَاءَ، فَمَاتَ رَجُلٌ مِنْهُمْ فَجَزِعَ عَلَيْهِ فَجَعَلَ لَا يَصْبِرُ عَنْهُ فَاتَّخَذَ مِثَالًا عَلَى صُورَتِهِ فَكُلَّمَا اشْتَاقَ إِلَيْهِ نَظَرَهُ ثُمَّ مَاتَ فَفُعِلَ بِهِ كَمَا فُعِلَ حَتَّى تَتَابَعُوا عَلَى ذَلِكَ فَمَاتَ الْآبَاءُ فَقَالَ الْأَبْنَاءُ: مَا اتَّخَذَ آبَاؤُنَا هَذِهِ إِلاَّ أَنَّهَا كَانَتْ آلِهَتَهُمْ فَعَبَدُوهَا.

নূহ আলাইহিস সালামের যমানায় মূর্তির সূচনা হয়েছে এভাবে-সন্তানেরা পিতাদের প্রতি সদাচারী ছিল। এক লোকের পিতা মারা গেলে সে অস্থির হয়ে পড়ে। কিছুতেই সে পিতার বিচ্ছেদ সইতে পারছিল না। তখন সে পিতার একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করল। যখনই পিতার কথা স্মরণ হয় পিতার ভাস্কর্যের দিকে তাকিয়ে সান্ত¡না লাভ করে। তার মৃত্যুর পর তার সন্তানেরা দাদার ভাস্কর্যের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা নিবেদন করতে থাকে। এভাবে কয়েক প্রজন্ম অতিবাহিত হওয়ার পর নতুন প্রজন্ম এসে বলল, আমাদের পূর্বপুরুষেরা তো এজন্যই এই ভাস্কর্যের প্রতি স্বশ্রদ্ধ ভক্তি প্রদর্শন করত যে, এটি তাদের উপাস্য ছিল। তখন এই প্রজন্ম ওই ভাস্কর্যের উপাসনা শুরু করে দিল। -আখবারে মাক্কা, ফাকিহী ৫/১৬২ (৯০); ফাতহুল বারী ৮/৫৩৭

আরব ভূখণ্ডে যেভাবে শিরক ও জাহিলিয়াতের শুরু

প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিৎ মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক রাহ. বলেন-

إِنَّ بَنِيَ إِسْمَاعِيلَ، وَجُرْهُمٍ، مِنْ سَاكِنِي مَكَّةَ ضَاقَتْ عَلَيْهِمْ مَكَّةُ، فَتَفَسَّحُوا فِي الْبِلَادِ، وَالْتَمَسُوا الْمَعَاشَ.

মক্কার বনী ইসমাঈল  ও জুরহুম গোত্রের লোকদের জীবন-জীবিকা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন তারা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং জিবিকার তালাশে লেগে যায়।

এরপর তাদের মধ্যে কীভাবে শিরক ও জাহিলিয়াতের বিস্তার ঘটে-মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক রাহ. এর বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন-

إِنَّ أَوَّلَ مَا كَانَتْ عِبَادَةُ الْحِجَارَةِ فِي بَنِي إِسْمَاعِيلَ أَنَّهُ كَانَ لَا يَظْعَنُ مِنْ مَكَّةَ ظَاعِنٌ مِنْهُمْ إِلاَّ احْتَمَلَ مَعَهُ مِنْ حِجَارَةِ الْحَرَمِ؛ تَعْظِيمًا لِلْحَرَمِ، وَصَبَابَةً بِمَكَّةَ وَبِالْكَعْبَةِ، حَيْثُمَا حَلُّوا وَضَعُوهُ فَطَافُوا بِهِ كَالطَّوَافِ بِالْكَعْبَةِ، حَتَّى سَلَخَ ذَلِكَ بِهِمْ إِلَى أَنْ كَانُوا يَعْبُدُونَ مَا اسْتَحْسَنُوا مِنَ الْحِجَارَةِ وَأَعْجَبُهُمْ مِنْ حِجَارَةِ الْحَرَمِ خَاصَّةً، حَتَّى خَلَفَتِ الْخُلُوفُ بَعْدَ الْخُلُوفِ، وَنَسُوا مَا كَانُوا عَلَيْهِ، وَاسْتَبْدَلُوا بِدِينِ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ غَيْرَهُ، فعَبَدُوا الْأَوْثَانَ، وَصَارُوا إِلَى مَا كَانَتْ عَلَيْهِ الْأُمَمُ من قَبْلهمْ مِنَ الضَّلَالَاتِ.

সর্বপ্রথম ইসমাঈল আলাইহিস সালামের বংশধরদের মধ্যে পাথর-পূজা শুরু হওয়ার ইতিহাস হল-মক্কা থেকে যে-ই অন্যত্র চলে যেত হারাম শরীফ থেকে সঙ্গে করে পাথর নিয়ে যেত। উদ্দেশ্য, হারাম শরীফের সম্মান করা এবং মক্কা ও কা‘বার প্রতি ভক্তি নিবেদন করা। তারা যেখানে গিয়ে বাসস্থান করত সেখানে এটা রাখত এবং কা‘বার মত পাথরটার তাওয়াফ করত। এই ভক্তি-শ্রদ্ধা তাদের এই পর্যন্ত নিয়ে গেল যে, তারা যে পাথরকেই ভালো মনে করত তার উপাসনা করা শুরু করে দিত। বিশেষ করে হারাম শরীফের পাথর হলে তো কথাই নেই। এভাবে পাথর-পূজার উপর প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলতে থাকে এবং তাদের পূর্বপুরুষদের নীতি-ধর্ম বিস্মৃত হয়ে যায়। ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিস সালামের ধর্মের পরিবর্তে অন্য ধর্ম গ্রহণ করে। তখন মূর্তিপূজা শুরু করে এবং পূর্ববর্তী জাতিবর্গের গোমরাহিতে নিমজ্জিত হয়। -আখবারু মাক্কা, ফাকিহী ৫/১৩৪-১৩৫ (২৮-২৯); আখবারু মাক্কা, আযরাকী ১/১৮৫-১৮৬ (১৩৯)

এই ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায়, ভক্তি করে তৈরি করা স্মারক-ভাস্কর্য -যদি তা পাথরও হয়-অন্ধকার ও শিরকী সংস্কৃতির পথ।

পাপাচারীদের স্মারক-ভাস্কর্যও মানুষকে শিরকে লিপ্ত করেছে

আরবের প্রসিদ্ধ দু’টি মূর্তি হল ইসাফ ও নায়েলা। কীভাবে এদের পূজা শুরু হয়-এ সম্পর্কে ইবনে ইসহাক রাহ. বলেন-

মক্কার জুরহুম গোত্রের লোকেরা পাপাচারে নিমজ্জিত হলে ইসাফ ও নায়েলা নামে দু’জন নারী-পুরুষ কা‘বা ঘরের ভিতরে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। তখন তারা আসমানী গযবে পাথরে পরিণত হয়ে যায়। (তিনি বলেন-)

فَأُخْرِجَا مِنَ الْكَعْبَةِ، فَنُصِبَ أَحَدُهُمَا عَلَى الصَّفَا، وَالْآخَرُ عَلَى الْمَرْوَةِ، وَإِنَّمَا نُصِبَا هُنَالِكَ لِيَعْتَبِرَ بِهِمَا النَّاسُ، وَيَزْدَجِرُوا عَنْ مِثْلِ مَا ارْتَكَبَا؛ لِمَا يَرَوْنَ مِنَ الْحَالِ الَّتِي صَارَا إِلَيْهَا، فَلَمْ يَزَلِ الْأَمْرُ يَدْرُسُ وَيَتَقَادَمُ حَتَّى صَارَا يُمْسَحَانِ، يَتَمَسَّحُ بِهِمَا مَنْ وَقَفَ عَلَى الصَّفَا وَالْمَرْوَةِ، ثُمَّ صَارَا وَثَنَيْنِ يُعْبَدَان.

এরপর তাদেরকে কাবা শরীফ থেকে বের করে একটিকে ‘সাফা’ পাহাড়ে আরেকটিকে ‘মারওয়া’ পাহাড়ে স্থাপন করা হয়; যাতে তাদের অবস্থা দেখে মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে এবং ব্যভিচার-পাপাচার থেকে বিরত থাকে। এভাবে বছরের পর বছর অতিবাহিত হওয়ার পর মানুষ মূল বিষয়টি বিস্মৃত হয়ে যায় এবং তাদের গায়ে হাত বুলানো শুরু হয়। এভাবে ভক্তি করতে করতে একপর্যায়ে এগুলো পূজার মূর্তিতে পরিণত হয় এবং তাদের উপাসনা শুরু হয়। -আখবারু মাক্কা, আযরাকী ১/১৮৯-১৯০; শিফাউল গারাম ২/৩৩৭

আরব ইতিহাসবিৎ আবু জাফর মুহাম্মাদ ইবনে হাবীব রাহ.-ও ইসাফ ও নায়েলার ভাস্কর্য পূজার মূর্তিতে পরিণত হওয়ার এই ইতিবৃত্ত বর্ণনা করেছেন। (দ্রষ্টব্য : আলমুহাব্বার, পৃ. ৩১১; আলমুফাস্সাল ফী তারীখিল আরাব কাবলাল ইসলাম ৬/২৬৭)

প্রাক-ইসলাম আরবের ইতিহাসবেত্তা ড. জাওয়াদ আলী এই মূর্তিদু’টি সম্পর্কে ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলো উদ্ধৃত করে বলেন-

ويظهر أن مرد هذا القصص الذي يقصه علينا أهل الأخبار عن الصنمين، إنما هو إلى شكل الصنمين. كان "إساف" تمثال رجل على ما يظهر من روايات الأخباريين، وكان "نائلة" تمثال امرأة.

ইতিহাসবেত্তাদের এসব বিবরণ থেকে পরিষ্কার হয় যে, এদু’টি ছিল মূর্তির আকৃতিতে। ইসাফ হল এক পুরুষের ভাস্কর্য আর নায়েলা হল এক নারীর ভাস্কর্য। -আলমুফাস্সাল ফী তারীখিল আরাব কাবলাল ইসলাম ৬/২৬৬

ভাস্কর্যও পথভ্রষ্টতার কারণ এবং ভাস্কর্যপ্রীতিও জাহিলিয়াতের বৈশিষ্ট্য 

আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ قَالُوْا لَا تَذَرُنَّ اٰلِهَتَكُمْ وَ لَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَّ لَا سُوَاعًا،  وَّ لَا یَغُوْثَ وَ یَعُوْقَ وَ نَسْرًا،  وَ قَدْ اَضَلُّوْا كَثِیْرًا.

আর তারা (কাফেররা) বলেছিল, তোমরা পরিত্যাগ করো না তোমাদের উপাস্যদের এবং পরিত্যাগ করো না ওয়াদ্, সুওয়া, ইয়াগূছ, ইয়াঊক ও নাস্রকে। অথচ এগুলো অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে। -সূরা নূহ (৭১) : ২৩-২৪

এই আয়াতে ওয়াদ, সুওয়া, ইয়াগূছ, ইয়াঊক ও নাসরকে পথভ্রষ্টকারী বলা হয়েছে। আর একটু আগেই ইবনে আব্বাস রা.-এর বক্তব্যে দেখেছেন যে, তারা ছিলেন নূহ আলাইহিস সালামের উম্মতের কতিপয় পুণ্যবান ব্যক্তি। তাঁদের মৃত্যুর পর ভক্তিপ্রবণ লোকেরা তাঁদের ভাস্কর্য তৈরি করে। অবশেষে এসব ভাস্কর্যই পরের প্রজন্মের ভ্রষ্টতার কারণ হয়।

এসব ভাস্কর্যের প্রীতি এবং এগুলোকে আঁকড়ে থাকা যে ঐ জাহেলদের বৈশিষ্ট্য তা তো আয়াতটির বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট।

প্রথম ভাস্কর্য নির্মাণকারী কে?

শিরক সবচেয়ে বড় ও জঘন্যতম পাপ। আর মূর্তি ও ভাস্কর্য শিরকের একটি বড় উপাদান। মানুষকে শিরকের পথে পরিচালিত করার প্রধান প্রচেষ্টাকারী হল ইবলীস। সে তার এই মিশন বাস্তবায়নের জন্য মানব ইতিহাসের সূচনা থেকেই সচেষ্ট ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইবলীস শয়তানই সর্বপ্রথম মূর্তি ও ভাস্কর্য নির্মাণ করে এবং বনী আদমের সামনে তা পেশ করে। নিবন্ধটির শুরুতে মুহাম্মাদ ইবনে কাব আলকুরাযীর বক্তব্যে পড়েছেন যে, আদম আলাইহিস সালামের পাঁচ ছেলে ছিল। তিনি তাঁদের নাম উল্লেখ করে বলেন, তাঁরা ছিলেন, ইবাদতগুযার। তাঁদের একজন মারা গেলে লোকেরা অস্থির হয়ে পড়ে। তখন শয়তান এসে তার প্রতিকৃতি নির্মাণ করে দিল। এভাবে একেকজন মারা গেলে তার প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে তাদের ইবাদত করা শুরু হয়। তখন আল্লাহ তাআলা নূহ আলাইহিস সালামকে প্রেরণ করেন। -ফাতহুল বারী ৮/৫৩৬

মুশরিকদের পূজার মূর্তিগুলো মূলত ভাস্কর্যই

আল্লাহ তাআলা বলেন-

اِذْ قَالَ لِاَبِیْهِ وَ قَوْمِهٖ مَا هٰذِهِ التَّمَاثِیْلُ الَّتِیْۤ اَنْتُمْ لَهَا عٰكِفُوْنَ،  قَالُوْا وَجَدْنَاۤ اٰبَآءَنَا لَهَا عٰبِدِیْنَ.

সেই সময়কে স্মরণ কর, যখন সে (ইবরাহীম আ.) নিজ পিতা ও নিজ সম্প্রদায়কে বলেছিল, এই ভাস্কর্যগুলো কী, যার সামনে তোমরা ধরনা দিয়ে বস? তারা বলল, আমাদের বাপ-দাদাদেরকে এদের পূজা করতে দেখেছি। -সূরা আম্বিয়া (২১) : ৫২-৫৩

ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এখানে তাঁর সম্প্রদায়ের মূর্তিগুলোকে ভাস্কর্য নামে উল্লেখ করেছেন।

মূর্তি-কেন্দ্রিক মৈত্রী ও বন্ধুত্বের স্বরূপ

মূর্তির প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শনকারী সম্প্রদায়ের ‘মূর্তিপ্রেমের’ স্বরূপ উন্মোচন করে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَ قَالَ اِنَّمَا اتَّخَذْتُمْ مِّنْ دُوْنِ اللهِ اَوْثَانًا، مَّوَدَّةَ بَیْنِكُمْ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا،  ثُمَّ یَوْمَ الْقِیٰمَةِیَكْفُرُ بَعْضُكُمْ بِبَعْضٍ وَّ یَلْعَنُ بَعْضُكُمْ بَعْضًا ؗ وَّ مَاْوٰىكُمُ النَّارُ وَ مَا لَكُمْ مِّنْ نّٰصِرِیْنَ.

তিনি (ইবরাহীম আ.) বললেন, তোমরা তো মূর্তিসমূহকে আল্লাহর পরিবর্তে গ্রহণ করেছ কেবল পার্থিব জীবনে পারস্পরিক বন্ধুত্ব বজায় রাখার জন্য। কিন্তু কিয়ামতের দিন তোমরা একে অপরকে অস্বীকার করবে এবং একে অপরকে অভিসম্পাত দিবে। তোমাদের আবাস হবে জাহান্নাম এবং তোমাদের কোনো সাহায্যকারী থাকবে না। -সূরা আনকাবূত (২৯) : ২৫

অর্থাৎ এই বন্ধুত্ব আদর্শ ভিত্তিক নয়; এটা উৎসারিত সাম্প্রদায়িক স্বার্থচিন্তা থেকে, তাওহীদের বিপক্ষে শিরকী গোষ্ঠীগুলোর মৈত্রীর নিদর্শন হিসেবে, কিন্তু এটা এমন এক বন্ধুত্ব, যা কিয়ামতদিবসে শত্রæতায় পর্যবসিত হবে।

কুরআন মাজীদের উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহবিমুখ সম্প্রদায়ের মূর্তিপ্রেমের অন্যতম প্রধান কারণটির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ইসলামী আদর্শের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধতা সৃষ্টি এবং তা অক্ষুণ্নরাখার পক্ষে মূর্তি হল অন্যতম প্রধান উপকরণ।

মূর্তি ও প্রতিকৃতি নির্মাণকারী প্রকারান্তরে দ্বীনকে অস্বীকারকারী

আলী রা. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন বললেন-তোমাদের মধ্যে কে আছে, যে মদীনায় যাবে এবং যেখানেই কোনো মূর্তি পাবে তা ভেঙ্গে ফেলবে, যেখানেই কোনো সমাধি-সৌধ পাবে তা ভূমিস্মাৎ করে দেবে এবং যেখানেই কোনো চিত্র পাবে তা মুছে দেবে?

আলী রা. এই দায়িত্ব গ্রহণ করলেন এবং কাজগুলো সম্পাদন করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানালেন। তখন তিনি বললেন-

مَنْ عَادَ لِصَنْعَةِ شَيْءٍ مِنْ هَذَا، فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمدٍ صَلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلمَ.

যে কেউ পুনরায় ওইসব বস্তু তৈরি করল সে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রতি নাযিলকৃত দ্বীনকে অস্বীকার করল। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৫৭; মুসনাদে আবী দাউদ তয়ালিসী, হাদীস ৯৭; মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদীস ৫০২

এই হাদীস থেকে স্পষ্ট জানা যাচ্ছে যে, যে কোনো প্রাণীর মূর্তিই ইসলামে পরিত্যাজ্য। আর এগুলো নির্মাণ করা ইসলামকে অস্বীকারকারী সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য।

প্রতিকৃতি প্রস্তুতকারীরা নিকৃষ্টতম জীব

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসুস্থতার সময় তাঁর জনৈকা স্ত্রী একটি গির্জার কথা উল্লেখ করলেন। গির্জাটির নাম ছিল মারিয়া। উম্মে সালামা ও উম্মে হাবীবা ইতিপূর্বে হাবাশায় গিয়েছিলেন। তাঁরা গির্জাটির কারুকার্য ও তাতে বিদ্যমান প্রতিকৃতিসমূহের কথা আলোচনা করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শয্যা থেকে মাথা তুলে বললেন-

أُولَئِكِ إِذَا مَاتَ مِنْهُمُ الرجُلُ الصالِحُ بَنَوْا عَلَى قَبْرِهِ مَسْجِدًا، ثُم صَوَّرُوا فِيهِ تِلْكَ الصورَةَ، أُولَئِكِ شِرَارُ الخَلْقِ عِنْدَ اللهِ.

তাদের কোনো পুণ্যবান লোক মারা গেলে তারা তার কবরের উপর ইবাদতখানা নির্মাণ করত এবং তাতে ঐ পুণ্যবান ব্যক্তির প্রতিকৃতি স্থাপন করত। এরা হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্ট। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৪১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫২৮

পূর্ববর্তী ধর্মেও ভাস্কর্য-প্রতিকৃতি নিষিদ্ধ ছিল

পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্যে যারা নেকলোকদের প্রতিকৃতি প্রস্তুত করত উপরের হাদীসটিতে তাদের নিকৃষ্ট জীব বলা হয়েছে। এর থেকে জানা যাচ্ছে যে, প্রাণীর প্রতিকৃতি নির্মাণ পূর্বের শরীয়তেও হারাম ছিল। তা না হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে আল্লাহর নিকৃষ্ট সৃষ্টি বলে আখ্যায়িত করতেন না। এছাড়াও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইতুল্লাহ্য় প্রবেশ করে ইবরাহীম আ. ও মারইয়াম রা.-এর প্রতিকৃতি দেখলেন। তখন তিনি যেসব পুণ্যাত্মাদের প্রতিকৃতি প্রস্তুত করা হয়েছে তাঁদের সম্পর্কে বললেন-

أَمَّا هُمْ لَقَدْ سَمِعُوا أَنَّ الْمَلَائِكَةَ لَا تَدْخُلُ بَيْتًا فِيهِ صُورَةٌ.

এঁরা তো (আল্লাহর এই বিধান) শুনেছেন যে, ফিরিশতারা সে গৃহে প্রবেশ করেন না, যাতে কোনো প্রাণীর প্রতিকৃতি থাকে। -সহীহ বুখারী হাদীস ৩৩৫১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৫০৮; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৮৫৮

অর্থাৎ প্রতিকৃতি সম্পর্কে এঁরা কখনও সম্মত থাকতে পারেন না। অথচ জাহেলরা তাঁদেরই প্রতিকৃতি তৈরি করেছে। এই হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিষ্কার বলেছেন যে, কা‘বাঘরে অতীতের যেসব সৎলোকদের প্রতিকৃতি নির্মাণ করা হয়েছে চিত্রাঙ্কন হারাম হওয়ার বিষয়টি তাদের জানা ছিল।

আল্লাহ তাদের বিনাশ করুন!

উসামা রা. বলেন, আমি কা‘বা ঘরের ভিতরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে গেলাম। তখন কিছু চিত্র তাঁর দৃষ্টিগোচর হল। তিনি এক বালতি পানি আনতে বললেন। আমি পানি উপস্থিত করলাম। তিনি তখন ছবিগুলো মুছতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন-

قَاتَلَ اللهُ قَوْمًا يُصَوِّرُونَ مَا لَا يَخْلُقُونَ.

আল্লাহ তাদের বিনাশ করুন, যারা এমন কিছুর প্রতিকৃতি তৈরি করে, যা তারা সৃষ্টি করতে পারে না। -মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী, হাদীস ৬৫৭; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৫৭২২, ৩৮০৬৫

নবীজী মদীনাকে চিত্র-মূর্তি থেকে মুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন

আলী রা. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি জানাযায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি তখন বললেন-

أَيكُمْ يَنْطَلِقُ إِلَى الْمَدِينَةِ فَلا يَدَعُ بِهَا وَثَنًا إِلا كَسَرَهُ، وَلا قَبْرًا إِلا سَوَّاهُ، وَلا صُورَةً إِلا لَطخَهَا؟

তোমাদের মধ্যে কে আছে, যে মদীনায় যাবে এবং যেখানেই কোনো মূর্তি পাবে তা ভেঙ্গে ফেলবে, যেখানেই কোনো সমাধি-সৌধ পাবে তা ভূমিস্মাৎ করে দেবে এবং যেখানেই কোনো চিত্র পাবে তা মুছে দেবে? -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৫৯

আপন পূর্বপুরুষদের প্রতিকৃতি নিজ হাতে মুছে দিয়েছেন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

ইসলাম ধর্ম মিল্লাতে ইবরাহীমের উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তাআলা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর উম্মতকে মিল্লাতে ইবরাহীমের অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। [দ্রষ্টব্য : সূরা নাহ্ল (১৬) : ১২৩, সূরা আলে ইমরান (৩) : ৯৫]

বংশের দিক থেকেও তিনি ইবরাহীম আ. ও ইসমাঈল আ.-এর বংশধর। মক্কা বিজয়ের সময় কাবার ভেতরে তাঁদের চিত্র রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের দিয়ে সেগুলো মোছার ব্যবস্থা করণে। এরপরও  চিত্রগুলো কিছু কিছু দেখা যাচ্ছিল। তার উপরও তিনি আপত্তি করলেন এবং ভালোভাবে মোছার কাজে নিজেও অংশগ্রহণ করেছেন। মোটকথা নিজ হাতে তিনি তাঁর এসব পূর্বপুরুষদের প্রতিকৃতি মুছে দেন। জাবির রা. বলেন-

دَعَا رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِزَعْفَرَانٍ فَلَطَّخَهُ بِتِلْكَ التَّمَاثِيلِ.

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাফরান আনতে বললেন এবং সেগুলোর উপর জাফরানের প্রলেপ দিয়ে দিলেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩৮০৬০; মুসনাদে ইবনে আবী শাইবা-আলমাতালিবুল আলিয়া, ইবনে হাজার আসকালানী, হাদীস ৪৩০৩

সাহাবায়ে কেরামও চিত্র-প্রতিকৃতি মিটিয়ে ফেলতেন

আবুল হাইয়াজ আসাদী বলেন, আলী ইবনে আবী তালিব রা. আমাকে বললেন-

أَلَا أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِي عَلَيْهِ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ أَنْ لَا تَدَعَ تِمْثَالًا إِلاَّ طَمَسْتَهُ وَلَا قَبْرًا مُشْرِفًا إِلاَّ سَوَّيْتَهُ. وفي رواية: وَلَا صُورَةً إِلاَّ طَمَسْتَهَا.

আমি কি তোমাকে ওই কাজের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না, যে কাজের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা এই যে, তুমি সকল প্রাণীর প্রতিকৃতি বিলুপ্ত করবে এবং সকল সমাধি-সৌধ ভূমিস্মাৎ করে দেবে।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, এবং সকল চিত্র মুছে ফেলবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯৬৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩২১৮; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ২০৩১

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চিত্র-প্রতিকৃতি না মিটিয়ে বাইতুল্লাহ্য় প্রবেশ করেননি

ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন-

إِنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا رَأَى الصُّوَرَ فِي البَيْتِ لَمْ يَدْخُلْ حَتَّى أَمَرَ بِهَا فَمُحِيَتْ، وَرَأَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ عَلَيْهِمَا السَّلاَمُ بِأَيْدِيهِمَا الأَزْلاَمُ، فَقَالَ: قَاتَلَهُمُ اللهُ، وَاللهِ إِنِ اسْتَقْسَمَا بِالأَزْلاَمِ قَطُّ.

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কায় এলেন তখন বাইতুল্লাহ্য় চিত্র ও প্রতিকৃতি দেখে তাতে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। তাঁর আদেশে সেগুলো মুছে দেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে ইবরাহীম আ. ও ইসমাঈল আ.-এরও প্রতিকৃতি ছিল। তাঁদের হাতে ছিল ভাগ্যনির্ধারণী ‘শর’! নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ ওদের ধ্বংস করুন, তাদের জানা ছিল যে, এই দুইজন কখনও শর দ্বারা ভাগ্যগণনার চেষ্টা করেননি। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩৫২; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৮৬১

জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত-

إِنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمَرَ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ زَمَنَ الْفَتْحِ وَهُوَ بِالْبَطْحَاءِ أَنْ يَأْتِيَ الْكَعْبَةَ، فَيَمْحُوَ كُلَّ صُورَةٍ فِيهَا، فَلَمْ يَدْخُلْهَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى مُحِيَتْ كُل صُورَةٍ فِيهَا.

মক্কাবিজয়ের সময় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-কে আদেশ দিলেন, তিনি যেন কাবা ঘরের সব প্রতিকৃতি মিটিয়ে দেন। সকল ছবি মোছার আগ পর্যন্ত তিনি কাবায় প্রবেশ করেননি। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪১৫৬; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস ৫৮৫৭

বিবর্ণ হয়ে গেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা

আয়েশা রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য একটি তাকিয়া প্রস্তুত করি, যাতে প্রাণীর প্রতিকৃতি ছিল। (তিনি বলেন-)

فَجَاءَ فَقَامَ بَيْنَ البَابَيْنِ وَجَعَلَ يَتَغَيَّرُ وَجْهُهُ.

তিনি এসে দরজায় দাঁড়াতেই (এটি দৃষ্টিগোচর হল এবং) তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩২২৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ২৫৭১৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৪০৮১

প্রাণীর প্রতিকৃতি দেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

আলী রা. বলেন-

صَنَعْتُ طَعَامًا، فَدَعَوْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَجَاءَ، فَدَخَلَ فَرَأَى سِتْرًا فِيهِ تَصَاوِيرُ فَخَرَجَ وَقَالَ: إِنَّ الْمَلَائِكَةَ لَا تَدْخُلُ بَيْتًا فِيهِ تَصَاوِيرُ.

আমি কিছু খাবার তৈরি করে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দাওয়াত করলাম। তিনি এলেন। ঘরে প্রাণীর চিত্র-অঙ্কিত একটি পর্দা ছিল। তা দেখে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন এবং বললেন-

إِنَّ الْمَلَائِكَةَ لَا تَدْخُلُ بَيْتًا فِيهِ تَصَاوِيرُ.

ফিরিশতারা ওই ঘরে প্রবেশ করেন না, যে ঘরে প্রাণীর প্রতিকৃতি থাকে। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৫৩৫১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৩৫৯

খালেদ ইবনে সা‘দ রাহ. বলেন-

عَنْ أَبِي مَسْعُودٍ أَنَّ رَجُلًا صَنَعَ لَهُ طَعَامًا فَدَعَاهُ فَقَالَ: أَفِي الْبَيْتِ صُورَةٌ؟ قَالَ: نَعَمْ فَأَبَى أَنْ يَدْخُلَ حَتَّى كَسَرَ الصُّورَةَ ثُمَّ دَخَلَ.

قال الحافظ في فتح الباري (9/158): سنده صحيح.

এক লোক আবু মাসউদ রা.-কে খাবারের দাওয়াত করল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন তোমার ঘরে কি প্রাণীর কোনো প্রতিকৃতি আছে? সে বলল, হাঁ। একথা শুনে আবু মাসউদ রা. তার ঘরে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। এরপর প্রাণীর প্রতিকৃতিটা ভেঙ্গে ফেলা হল। তারপর তিনি ঘরে প্রবেশ করলেন। -সুনানে কুবরা, বায়হাকী ৭/২৬৮, হাদীস ১৪৫৬৫

আল্লাহর সৃষ্টি-বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য গ্রহণকারীদের বলা হবে...

আবু যুরআ রাহ. বলেন-

دَخَلْتُ مَعَ أَبِي هُرَيْرَةَ فِي دَارِ مَرْوَانَ فَرَأَى فِيهَا تَصَاوِيرَ، فَقَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ: وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذَهَبَ يَخْلُقُ خَلْقًا كَخَلْقِي؟ فَلْيَخْلُقُوا ذَرَّةً، أَوْ لِيَخْلُقُوا حَبَّةً أَوْ لِيَخْلُقُوا شَعِيرَةً.

আমি আবু হুরায়রা রা.-এর সঙ্গে মারওয়ানের গৃহে প্রবেশ করলাম। সেখানে কিছু প্রতিকৃতি দৃষ্টিগোচর হল। তিনি তখন বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাআলা বলেন, ওই লোকদের চেয়ে বড় জালেম আর কে, যারা আমার সৃষ্টির মতো কোনো কিছু সৃষ্টি করতে চায়। (তাদের যদি সামর্থ্য থাকে তবে) তারা সৃষ্টি করুক-একটি কণা, একটি শস্যদানা কিংবা একটি যব! -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১১১; সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৫৩

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إِنَّ الَّذِينَ يَصْنَعُونَ هَذِهِ الصُّوَرَ يُعَذّبُونَ يَوْمَ القِيَامَةِ، يُقَالُ لَهُمْ: أَحْيُوا مَا خَلَقْتُم.

যারা এইসব প্রতিকৃতি তৈরি করে তাদেরকে কিয়ামতের দিন আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। তাদেরকে বলা হবে, যা তোমরা সৃষ্টি করেছিলে তাতে প্রাণ সঞ্চার কর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৫১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১০৭ (৯৬)

আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إِنَّ أَصْحَابَ هَذِهِ الصُّوَرِ يَوْمَ القِيَامَةِ يُعَذّبُونَ، فَيُقَالُ لَهُمْ: أَحْيُوا مَا خَلَقْتُمْ وَقَالَ: إِنَّ البَيْتَ الَّذِي فِيهِ الصُّوَرُ لاَ تَدْخُلُهُ المَلاَئِكَةُ.

যারা এইসব প্রতিকৃতি তৈরি করে তাদেরকে কিয়ামতের দিন আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। তাদেরকে বলা হবে, যা তোমরা সৃষ্টি করেছিলে তাতে প্রাণ সঞ্চার কর। নবীজী আরো বলেন, যে ঘরে চিত্র-প্রতিকৃতি থাকে সে ঘরে ফিরিশতা প্রবেশ করবেন না। -সহীহ বুখারী হাদীস ২১০৫, ৫১৮১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১০৮

এই হাদীসসমূহ বর্তমান সময়ের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, যখন ভাস্কর-চিত্রকর, এমনকি গল্পকার ও ঔপন্যাসিকদের ক্ষেত্রে পর্যন্তও ‘স্রষ্টা’ শব্দ বলতে শোনা যায় এবং তাদের কর্মকাণ্ডকে ‘সৃষ্টি’ বলা হয় এবং এতে সামান্যতম দ্বিধাবোধও হয় না। ভাষার এ ব্যবহার নিয়েও ভাবা উচিত; বিশেষ করে যদি তা চিন্তা-চেতনা ও মানসিকাতাকেও প্রভাবিত করে।

সহীহ বুখারীর বিখ্যাত ভাষ্যকার হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. লেখেন, এই ভাস্কর ও চিত্রকরেরা সর্বাবস্থাতেই হারাম কাজের মধ্যে লিপ্ত। আর যে এমন কিছু নির্মাণ করে, যার পূজা করা হয় তার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। আর যে স্রষ্টার সাদৃশ্য গ্রহণের মানসিকতা পোষণ করে সে তো কাফের। -ফাতহুল বারী ১০/৩৯৭ (৫৯৫০ নং হাদীসের আলোচনা)

আল্লাহর সৃষ্টিগুণের সাদৃশ্য গ্রহণকারীরা কঠিনতম আযাব ভোগ করবে

আয়েশা রা. বলেন-

دَخَلَ عَلَيَّ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَنَا مُتَسَتِّرَةٌ بِقِرَامٍ فِيهِ صُورَةٌ، فَتَلَوَّنَ وَجْهُهُ، ثُمَّ تَنَاوَلَ السِّتْرَ فَهَتَكَهُ، ثُمَّ قَالَ: إِنَّ مِنْ أَشَدِّ النَّاسِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ، الَّذِينَ يُشَبِّهُونَ بِخَلْقِ اللهِ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নিকট আসলেন। আমি একটা পর্দা ঝুলিয়েছিলাম, যাতে ছবি অঙ্কিত ছিল। তা দেখে নবীজীর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি পর্দাটা খুলে ছিঁড়ে ফেললেন এবং বললেন, কিয়ামতের দিন তাদেরকে কঠিন আযাব দেওয়া হবে, যারা আল্লাহর সৃষ্টি-বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য গ্রহণ করে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৫৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১০৭ (৯১)

মুসলিম ইবনে সুবাইহ্ বলেনআমি মাসরূকের সঙ্গে একটি ঘরে ছিলাম, যেখানে মারইয়াম রা.-এর প্রতিকৃতি ছিল।

মাসরূক জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কি কিসরার প্রতিকৃতি? আমি বললাম, না, এটি মারইয়াম রা.-এর প্রতিকৃতি। তখন মাসরূক বললেন-

سَمِعْتُ عَبْدَ اللهِ بْنَ مَسْعُودٍ يَقُولُ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَشَدُّ النَّاسِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْمُصَوِّرُونَ.

আমি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-কে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রতিকৃতি তৈরিকারীরা কিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন আযাবের মুখোমুখি হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১০৯; সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৫০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৩৫৫৮

সেদিন কি তারা চিত্র-প্রতিকৃতিতে প্রাণ সঞ্চার করতে পারবে?

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন-

سَمِعْتُ مُحَمدًا صَلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلمَ يَقُولُ: مَنْ صَورَ صُورَةً فِي الدنْيَا كُلِّفَ يَوْمَ القِيَامَةِ أَنْ يَنْفُخَ فِيهَا الروحَ، وَلَيْسَ بِنَافِخٍ.

আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে কেউ দুনিয়াতে কোনো চিত্র-প্রতিকৃতি তৈরি করবে তাকে কিয়ামতের দিন নির্দেশ দেওয়া হবে-তাতে প্রাণ সঞ্চার করতে; অথচ সে তা করতে সক্ষম নয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৬৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১১০ (১০০)

আরেক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো প্রতিকৃতি তৈরি করবে আল্লাহ তাআলা তাকে আযাব দেবেন-যে পর্যন্ত না সে তাতে প্রাণ দান করে; আর তার পক্ষে তো প্রাণ দান করা সম্ভবই নয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২২২৫

নিজ হাতে গড়া প্রতিকৃতির হাতেই কাল আখেরাতে শাস্তি ভোগ করতে হবে!

সাঈদ ইবনে আবুল হাসান রাহ. বলেন, জনৈক ব্যক্তি ইবনে আব্বাস রা.-এর নিকট এসে বলল, আমি চিত্র-প্রতিকৃতি তৈরি করি। এ সম্পর্কে ফতোয়া দিন। ইবনে আব্বাস রা. বললেন, তুমি আমার কাছে এসো। লোকটি এগিয়ে এল। তিনি বললেন, আরো কাছে এসো। সে আরো কাছে গেল। ইবনে আব্বাস রা. তখন নিজ হাত তার মাথায় রেখে (দরদের সাথে) বললেন-

أُنَبِّئُكَ بِمَا سَمِعْتُ مِنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: كُلُّ مُصَوِّرٍ فِي النَّارِ، يَجْعَلُ لَهُ بِكُلِّ صُورَةٍ صَوَّرَهَا نَفْسًا فَتُعَذِّبُهُ فِي جَهَنَّمَ، وقَالَ: إِنْ كُنْتَ لَا بُدَّ فَاعِلًا، فَاصْنَعِ الشَّجَرَ وَمَا لَا نَفْسَ لَهُ.

দেখ, আমি তোমাকে ঐ কথাই শোনাব, যা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যবান থেকে শুনেছি। আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, প্রাণীর প্রতিকৃতিকারীদের সকলেই জাহান্নামে যাবে। তার তৈরিকৃত প্রতিটি প্রতিকৃতিতে প্রাণ সঞ্চার করা হবে। এগুলো জাহান্নামে তাকে শাস্তি দিতে থাকবে। একান্তই যদি তোমার এই কাজ করতে হয় তাহলে গাছপালা-তরুলতা বা অন্যান্য প্রাণহীণ বস্তুর চিত্র তৈরি কর। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১১০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৮১০

ভাস্কর ও চিত্রকরদের উপর নবীজীর লানত!

আউন ইবনে আবু জুহাইফা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন-

إِنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَعَنَ آكِلَ الرِّبَا وَمُوكِلَهُ وَالوَاشِمَةَ وَالمُسْتَوْشِمَةَ وَالمُصَوِّرَ.

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদ ভক্ষণকারী ও সুদ প্রদানকারী, উল্কি অঙ্কণকারী ও উল্কি গ্রহণকারী এবং প্রতিকৃতি তৈরিকারীদের (ভাস্কর, চিত্রকরদের) উপর লানত করেছেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৬২

নবীজী প্রতিকৃতি নির্মাণ ও তার ব্যবহার নিষেধ করেছেন

জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন-

إنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَى عَنِ الصُّوَرِ فِي الْبَيْتِ، وَنَهَى الرَّجُلَ أَنْ يَصْنَعَ ذَلِكَ.

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে প্রাণীর প্রতিকৃতি রাখতে নিষেধ করেছেন এবং তা তৈরি করতেও নিষেধ করেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৭৪৯মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪৫৯৬

যেখানে প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্য থাকে সেখানে ফিরিশতা প্রবেশ করেন না

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لَا تَدْخُلُ الْمَلَائِكَةُ بَيْتًا فِيهِ تَمَاثِيلُ أَوْ تَصَاوِيرُ.

ফিরিশতারা ওই ঘরে প্রবেশ করেন না, যেখানে ‘তামাছীল’-ভাস্কর্য বা প্রাণীর ছবি রয়েছে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১১২

হযরত আবু তলহা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لَا تَدْخُلُ الْمَلَائِكَةُ بَيْتًا فِيهِ كَلْبٌ وَلا تَصَاوِيرُ.

ওই গৃহে ফিরিশতারা প্রবেশ করেন না, যাতে কুকুর বা প্রতিকৃতি রয়েছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৪৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১০৬

আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন-

وَعَدَ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جِبْرِيلُ، فَرَاثَ عَلَيْهِ، حَتَّى اشْتَدَّ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَخَرَجَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَقِيَهُ، فَشَكَا إِلَيْهِ مَا وَجَدَ، فَقَالَ لَهُ: إِنَّا لاَ نَدْخُلُ بَيْتًا فِيهِ صُورَةٌ وَلاَ كَلْبٌ.

একবার হযরত জিবরীল আ. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু আসছিলেন না। এতে নবীজীর  খুব কষ্ট হচ্ছিল। তিনি তখন বাইরে বের হলেন এবং জিবরীল আ.-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল। তখন তিনি কষ্ট পেয়েছেন বলে জিবরীলের প্রতি অনুযোগ পেশ করলেন। তখন জিবরীল আ. বললেন-

إِنَّا لاَ نَدْخُلُ بَيْتًا فِيهِ صُورَةٌ وَلاَ كَلْبٌ.

আমরা এমন ঘরে প্রবেশ করি না, যাতে কোনো চিত্র থাকে বা কুকুর থাকে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৬০

আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়েছেন-

أَنَّ المَلَائِكَةَ لَا تَدْخُلُ بَيْتًا فِيهِ تَمَاثِيلُ، أَوْ صُورَةٌ.

ফিরিশতারা ওই ঘরে প্রবেশ করেন না, যেখানে ‘তামাছীল’-ভাস্কর্য বা কোনো প্রাণীর প্রতিকৃতি রয়েছে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৮০৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১৮৫৮; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৮৪৯

ভাস্কর্য ও মূর্তি শিরক, জাহিলিয়াত ও অন্ধকার সংস্কৃতির অনুষঙ্গ

উপরের আলোচনায় আমরা দেখেছি, বড়দের স্মৃতি-রক্ষা, বড়দের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা ইত্যাদি ভালো (?) শিরোনামে ও উদ্দেশ্যেই স্মারক-ভাস্কর্যের সূচনা হয়েছিল। শয়তানও এ শিরোনামেই মানুষের সামনে ভাস্কর্য পেশ করেছিল। আর তার উদ্দেশ্য ছিল-যা পরবর্তীতে ঘটেছে!  সত্যিই ভাস্কর্যের প্রতি মানুষের এ ভক্তি-প্রবণতা থেকেই কালের বিবর্তনে শুরু হয়েছিল শিরক ও মূর্তি পূজার। শুরু হয়েছিল, জাহিলিয়াত ও অন্ধকার যুগের।

সুতরাং মূর্তি ও ভাস্কর্য-কেন্দ্রিক সংস্কৃতি আর যাই হোক মুসলিমের সংস্কৃতি হতে পারে না। শিল্প ও সংস্কৃতিকে আলোকিত ও অন্ধকার-এ দুই ভাগে ভাগ করা হলে মূর্তি ও ভাস্কর্য-কেন্দ্রিক শিল্প-সংস্কৃতিকে অখ্যায়িত করতে হবে অন্ধকার সংস্কৃতি হিসেবে।

আল্লাহ তাআলা সকলকে শিরক ও শিরকের সকল অনুষঙ্গ থেকে হেফাযত করুন। খালেস তাওহীদ ও একত্ববাদের উপর অটল-অবিচল রাখুন-আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন। হ

 

 

advertisement