সফর ১৪৪২   ||   অক্টোবর ২০২০

ঘুম থেকে উঠে মুমিনের ভাবনা

মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াছ খান

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আমরা যা করি; যেমন পানাহার, চলাফেরা, ঘুম ইত্যাদি, এগুলো যদি আমরা নবীজীর সুন্নত অনুযায়ী করি, সকল কাজের শুরু- শেষের মাসনূন দুআগুলো পড়ি তাহলে এ কাজগুলোও নেকী অর্জনের মাধ্যম হয়ে যাবে। এর মাধ্যমে আমরা অগণিত নেকী লাভ করতে পারব এবং আমলের খাতা সমৃদ্ধ করতে পারব।

নিয়ত ও সুন্নাহসম্মত কর্মপন্থা গ্রহণের দ্বারা দৈনন্দিন জীবনের এসব আদত-অভ্যাস ও কর্মই হয়ে যায় নেকী অর্জনের মাধ্যম। তাই মুমিন যখন খাওয়া ও ঘুমের মত অভ্যাসগত কাজগুলোও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নবীজীর সুন্নত অনুযায়ী করে এর দ্বারা মুমিন অজ¯্র নেকী লাভ করে।

দৈনন্দিন কাজের শুরু ও শেষের মাসনূন দুআগুলো মুসলিম উম্মাহ্র এক মহা সম্পদ। উম্মাহ্র প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহামূল্যবান তোহফা। এগুলোর অর্থ ও মর্ম এবং ভাব ও আবেদন অনেক গভীর। এগুলোর শব্দে শব্দে ফুটে উঠেছে রাব্বে কারীমের সামনে বিনীত বান্দার হৃদয়ের আকুতি।

বান্দা কীভাবে তার মালিককে সম্বোধন করবে, কীভাবে তাঁর সামনে নিজেকে পেশ করবে, কীভাবে রাব্বে কারীমের হামদ-শোকর ও প্রসংশা-কৃতজ্ঞতা আদায় করবে-  তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এসকল দুআ। এতে যেমন আছে শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ তেমনি জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বোঝার শ্রেষ্ঠ নির্দেশনা। এগুলো বান্দাকে ভাবতে শেখায়, জীবনের ব্যাপারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে সহায়তা করে।

সব কাজে মুমিনের ভাবনা কেমন হবে, মুমিনের জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, চাওয়া-পাওয়া কেমন হওয়া উচিত- তা অত্যন্ত সুন্দরভাবে উল্লেখিত হয়েছে দৈনন্দিন জীবনে পঠিত বিভিন্ন দুআয়। যদি প্রতিটি কাজের আগে-পরের দুআগুলো গুরুত্বের সাথে পড়া হয় এবং এর অর্থ ও মর্ম নিজের মাঝে ধারণের চেষ্টা করা হয়; তাহলে তা হবে আল্লাহর সাথে বান্দার গভীর ভালবাসা ও মজবুত সম্পর্কের সেতুবন্ধন।

এ দুআগুলোর শব্দে শব্দে বান্দার আবদিয়াত ও দাসত্ব, তুচ্ছতা ও অসহায়ত্ব এবং তার হৃদয়ের ব্যাকুলতার প্রকাশ ঘটে। এসব দুআর মাধ্যমে মহান সত্তার সামনে নিজের দুর্বলতা ও অযোগ্যতার এবং তার বড়ত্ব ও মহত্বের গভীর প্রকাশ ঘটে। একারণেই এগুলো মুমিন বান্দার অন্তরে সৃষ্টি করে শোকরগোযার ও বিনয়াবনত হওয়ার অনুপম শিক্ষা। আর বান্দা যখন এ অনুভতি নিয়ে মহান মালিকের দরবারে দুআ নিবেদন করতে পারে তখন তার দেহ-মন তথা গোটা সত্তা লাভ করে অনাবিল আনন্দ ও জান্নাতী প্রশান্তি।

তাই তো রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব কাজেই দুআ শিক্ষা দিয়েছেন।

এসকল দুআর একটি হল, ঘুম থেকে উঠে আমরা যে দুআ পড়ি-

الحَمْدُ لِلهِ الّذِي أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا، وَإِلَيْهِ النّشُورُ.

অর্থ : প্রশংসা  সব আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে (ঘুম নামক) মৃত্যু দেয়ার পর আবার জীবিত করেছেন। আর তাঁর কাছেই আমাদের পুনরুত্থান হবে (ফিরে যেতে হবে)। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৩৯৪

ঘুমালে মানুষ জীবন ও জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জাগ্রত হওয়ার পর শরীরে কিছুটা জড়তা থাকে। ঘুম ঘুম ভাব থাকে। আড়মোড়া দিয়ে ধীরে ধীরে সজাগ হয় একজন মানুষ। আবার জীবনের স্বাভাবিক কাজকর্মে যুক্ত হয়; ঘুমানোর কারণে যা থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এ যেন জীবনের নতুন সূচনা! এসময়ও বান্দা যেন তার মালিককে না ভোলে। দীর্ঘক্ষণ ঘুমের গাফলত যেন তাকে গাফেল না করে দেয় এবং আল্লাহ যে তাকে আবার জীবন ও জগতের সাথে যুক্ত হওয়ার তাওফীক দিলেন- এর কৃতজ্ঞতা যেন বান্দা আদায় করে। এ উদ্দেশ্যেই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআ শিখিয়েছেন-

الحَمْدُ لِلهِ الّذِي أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا، وَإِلَيْهِ النّشُورُ.

এ শব্দগুলোর উচ্চারণ এবং একটু ভাবনা আমাকে নিয়ে যেতে পারে মালিকের খুব সন্নিকটে, যার নৈকট্য লাভ মুমিন-জীবনের সাধনা-কামনা। পাশাপাশি এ দুআ সুন্দরভাবে দিনটি শুরু করে নতুনভাবে সুন্দর একটি জীবন গড়ে তোলার প্রতি উদ্যমী করে তোলে। সাথে সাথে বান্দা যেন আখেরাত না ভোলে এবং এ মৃত্যু থেকে জীবন লাভের সময় আসল মৃত্যুপরবর্তী জীবনকে ভুলে না যায়- এ দুআ ও তার শব্দ-মর্ম আমাদের সামনে  এ শিক্ষাকেও খুব স্পষ্টভাবে মেলে ধরে।

আমরা জানি, ঘুম হল মৃত্যুর মত। এজন্যই বলে-  النوم أخو الموت -ঘুম মৃত্যুর ভাই। এই ঘুম থেকে আল্লাহ আমাকে জাগ্রত করেছেন এবং নতুন একটি জীবন দান করেছেন। আর প্রতিটি দিনই তো জীবনের নতুন সূচনা। পৃথিবীতে একটি জীবন যেমন একবারই আসে তেমনি জীবনের একটি দিনও একবারই আসে। একবার চলে গেলে কখনো তা আর ফিরে আসে না। প্রতিটি নতুন দিন যেন নতুন নতুন এক একটি জীবন।

আল্লাহ যেন বান্দাকে বলছেন-

হে বান্দা! ঘুম থেকে উঠে তুমি আমাকে স্মরণ করো। একটু ভাব, দিন শেষে ক্লান্তিভরা শরীর নিয়ে তুমি ঘুমিয়েছিলে। তখন তোমার শরীরজুড়ে নেমে এসেছিল প্রশান্তির ঘুম। তারপর সকালে ঘুম থেকে উঠেছ সকল ক্লান্তিমুক্ত শরীরে। আর পেয়েছ নতুন একটি নিআমত, একটি নতুন দিন, আরো অনেক কাজ করার সুযোগ, অনেক নেকী কামাইয়ের সুযোগ, জীবনটাকে আরো একটু এগিয়ে নেয়ার সুযোগ।

তাই তুমি শোকর কর। তোমার মত কতজন ঘুমিয়েছিল, কিন্তু তার জীবনে আর আসেনি এমন একটি দিন! এ রাতের ঘুমই ছিল তার শেষ ঘুম! জীবন থেকে অর্জন করার সুযোগ তার শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু নেক আমলের পরিমাণ আরো একটু বৃদ্ধি করার সুযোগ তুমি পেয়েছ। এ মহাসুযোগ যেন তোমার গাফলতের ঘোরে নষ্ট না হয়ে যায়।

তাই তুমি অন্তরের গভীর থেকে শোকর কর। দেহ-মন উজাড় করে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদন কর। বলো, হে আল্লাহ! সকল প্রশংসা কেবল তোমার। আমাকে তুমি নতুন একটি দিন দিয়েছ। তোমার প্রতি আমি অক্ষম বান্দার হাজার শোকর। একদিন আমি তোমার সামনে উপস্থিত হব। তোমার দেয়া এ দিনটি থেকে আমি যেন অর্জন করতে পারি সেদিনের জন্য কিছু পাথেয়। আর তোমার রহমত ও করুণা দিয়ে ভরে দিও আমার এ জীবন। অধম বান্দার এই শুধু প্রার্থনা। এর প্রতি উত্তরেই বান্দা যেন ঘুম থেকে উঠেই বলছে-

الحَمْدُ لِلهِ الّذِي أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا، وَإِلَيْهِ النّشُورُ.

প্রশংসা সব তোমার হে আমাদের রব! তুমিই তো ঘুম নামক মৃত্যুর পর আমাকে আবার জীবিত করেছ, দান করেছ নতুন এক দিন, নতুন এক জীবন। আর আমি বিশ্বাস করি, ছোট মৃত্যু ও পুনরুত্থানের ধারা শেষ হয়ে একদিন চূড়ান্ত পুনরুত্থান হবে এবং তোমারই কাছে আমাকে ফিরে যেতে হবে। দাঁড়াতে হবে তোমার সামনে। আজকের এ ক্ষণস্থায়ী সুন্দর দিনের মত চিরস্থায়ী সুন্দর দিন দান করো আমাকে- এ-ই প্রার্থনা।

এমনই সুন্দর ও পবিত্র অনুভুতি নিয়ে মুমিন বান্দা ঘুম থেকে উঠবে- এই শিক্ষাই দেয় ইসলাম। একটু কল্পনা করি, একজন মানুষ ঘুম থেকে উঠছে আর এভাবেই নিজেকে সমর্পণ করছে আল্লাহর সামনে। দিনটি তখন তার কত সুন্দর কাটবে! এই পবিত্র অনুভতির পরশ তার জীবনকে কত পবিত্র করবে! আর ঘুম থেকে ওঠার সময়ের এ অনুভতি যদি সে ধারণ করতে পারে সারা দিনের সব কাজে তখন তার দুনিয়ার জীবন হবে জান্নাতী জীবন।

প্রত্যেক মুমিনের চিন্তা, অনুভব ও অনুভতি এমনই হোক। আর এক্ষেত্রে ঘুম থেকে ওঠার পরের দুআ এবং প্রাত্যহিক কাজের দুআগুলো হতে পারে সর্বোত্তম সহায়ক।

 

 

advertisement