মুহাররম ১৪৪২   ||   সেপ্টেম্বর ২০২০

ওয়া তিলকাল আইয়ামু নুদাউইলুহা...
আবারও আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত আয়াসোফিয়া

মাওলানা শাহাদাত সাকিব

মসজিদ আল্লাহর ঘর। ইসলামের প্রাণকেন্দ্র। মুসিলম জীবনের প্রাণের উৎস। মসজিদে এসে প্রাণ সজীবতায় পূর্ণ হয়ে মুসলিম আবার ফিরে যায় জীবনের ময়দানে। মসজিদকে কেন্দ্র করেই একটি মুসলিম সমাজ গড়ে ওঠে। মসজিদকে ঘিরেই আবর্তিত হয় এর সকল চাঞ্চল্য। তাই তো ইসলামে মসজিদের এত গুরুত্ব। মদীনায় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের পর প্রথম নির্মাণ ছিল মসজিদ। কারণ মসজিদ ছাড়া মুসলিম সমাজ কল্পনা করা যায় না।

সব মসজিদই আল্লাহর ঘর। কিন্তু পারিপার্শ্বিক কারণে কিছু মসজিদ বিশেষ মর্যাদা লাভ করে থাকে। তার সাথে জুড়ে থাকে গর্ব ও গৌরবের অনেক কিছু। আয়াসোফিয়া এমনই একটি মসজিদ। এ মসজিদ ছিল একসময়ের তুর্কী খেলাফতের প্রাণকেন্দ্র। গর্ব ও গৌরবের প্রতীক। মুসলিম খেলাফতের সম্মান ও মর্যাদা জড়িয়ে আছে এ মসজিদের সাথে। তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরের বসফরাস প্রণালির তীর ঘেঁষে এর অবস্থান। এ অঞ্চলটি বর্তমানে ‘মিনতাকাতু সুলতান আহমাদ’ নামে পরিচিত। নান্দনিক কারুকার্যে শোভিত এ মসজিদ সর্বপ্রথম ১৪৫৩ ঈসাব্দে জামে মসজিদে রূপান্তরিত হয়। উসমানী সালতানাতের সুলতান মুহাম্মাদ আলফাতিহ ইস্তাম্বুল বিজয়ের পর সর্বপ্রথম এ মসজিদেই জুমা আদায় করেন। এরপর থেকে তা হয়ে ওঠে খেলাফতে উসমানিয়ার গৌরবের প্রতীক। শুরু থেকেই তুর্কি জাতি ও উসমানী খলীফাদের কাছে তা বিশেষ মর্যাদা লাভ করে। উসমানীয় শাসনামলে তুরস্কজুড়ে নির্মিত মসজিদগুলোতে এর গঠনশৈলির প্রভাব সুস্পষ্ট।

১৯২৩ সালে কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এবং উসমানী খেলাফতকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। এরপর তুরস্কজুড়ে শুরু করে অনৈসলামিকরণ অভিযান। কামাল ছিল পশ্চিমা প্রভাবে প্রভাবিত একজন কট্টর ধর্মবিদ্বেষী। কোথাও ধর্মের সামান্য উপস্থিতিও তার জন্য ছিল মাথাব্যাথার কারণ। তার কথিত উন্নতির পথে সে প্রধান অন্তরায় মনে করত ইসলামকে। তাই কোথাও যদি ইসলামের সামান্যতম উপস্থিতিও দেখতে পেত সেখান থেকে তা বিলুপ্ত করার ব্যবস্থা করত। সে মসজিদ বন্ধ করে দেয়। হিজাবকে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ সাব্যস্ত করে। আরবী ভাষার পরিবর্তে ল্যাটিন অক্ষরে তুর্কি ভাষা লিখতে বাধ্য করে। মদের বৈধতার লাইসেন্স দেয়। জুয়ার আসর উন্মুক্ত করে; ফলে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার উদ্দাম স্রোতে ভেসে যায় নতুন তুরস্ক। যে তুরস্ক একসময় ছিল ইসলামী খেলাফতের ধারক সে তুরস্কেই ইসলাম হয়ে পড়ে নিষিদ্ধ ধর্ম। কুরআন শেখাও অপরাধ ছিল কামাল আতাতুর্কের তুরস্কে।

এরই ধারাবাহিকতায় আয়াসোফিয়ার উপরেও পড়ে তার নগ্ন থাবা। তুর্কি খেলাফতের গৌরবের প্রতীকরূপে খ্যাত এ মসজিদকে ১৯৩৪ সালে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে জাদুঘরে রূপান্তর করার ঘোষণা আসে এবং ১৯৩৫ সালে এ ঘোষণা বাস্তবায়ন করা হয়। তখন থেকে একসময়ের ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদটি জাদুঘর হিসেবেই ব্যবহৃত হতে থাকে।

আয়াসোফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করার এ ঘোষণা তুর্কিসহ সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। যা তাদের অশ্রুভেজা লিখনীতেও ফুটে উঠেছিল। আলী তানতাবী রাহ. আয়াসোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের ঘোষণা শুনে লিখেছিলেন-

আয়াসোফিয়াতে আজ নামায পড়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, আজকের পর থেকে  সেখানে আর নামায অনুষ্ঠিত হবে না। মুআযযিনের আল্লাহু আকবার ধ্বনি থেমে যাবে। এ মিনার থেকে আর আল্লাহর দিকে মানুষকে ডাকবে না। তাকবীর-তাহলীলের সুমধুর আওয়াজে চারদিক গুঞ্জরিত হবে না। মুমিনদেরকে এ মসজিদ থেকে দূরে সরে যেতে হয়েছে। অশ্রæসিক্ত নয়ন ছাড়া তারা আর সেখানে ঢুকবে না।

আয়াসোফিয়া! যার মিনার থেকে ৮৭২৩৫০ বার ডাকা হয়েছে-

حي على الصلاة، حي على الفلاح، الله اكبر الله اكبر، لاإله إلا الله

এরপর মুসলমানরা দাঁড়িয়ে গেছে নামাযে সারিবদ্ধভাবে। আনত দৃষ্টি, বিনীত হৃদয় ও প্রশান্ত মনে। দুনিয়াকে পায়ের নিচে ফেলে বিনয় ও নম্রভাবে আল্লাহমুখী হয়েছে। ইসলামের বদৌলতেই আল্লাহ তাআলা তাদেরকে দান করেছেন নামাযের এ বিনয়; দান করেছেন ঈমানের নূরে আলোকিত অন্তর। আল্লাহর বড়ত্বে ও শক্তিতে বলীয়ান সে অন্তর ছিল পৃথিবীর চেয়েও বড়। এ প্রশস্ত হৃদয় দিয়েই তারা বিশ্ব জয় করেছে।

আয়াসোফিয়া! মুসলমানরা যেখানে ১৭৪৪৭০ রাত যাপন করেছে। যার ভেতর তাসবীহ, তাকবীর, তাহলীলের আওয়ায সদা গুঞ্জরিত ছিল। যার প্রতি বিঘত ভূমি মুসল্লির পা, যিকির-তিলাওয়াতকারীর মজলিস, কিংবা মুদাররিস বা তালিবুল ইলমের বসার জায়গা ছিল। শুধু আল্লাহই ভালো জানেন এখানে কতবার কুরআন খতম করা হয়েছে, কত দরস প্রদান করা হয়েছে। কত নামায এখানে আদায় করা হয়েছে।

আয়াসোফিয়া! যার প্রতিটি পাথর সাক্ষ্য দেয়, যার আকাশ-বাতাস সাক্ষ্য দেয়, যার সুদৃশ্য গম্বুজ সাক্ষ্য দেয়, যার সুউচ্চ মিনার সাক্ষ্য দেয় এবং আল্লাহ, ফিরিশতাকূলসহ সকল মানুষ সাক্ষ্য দেয়- আয়াসোফিয়া আল্লাহর ঘর। তাওহীদের সুদৃঢ় দুর্গ। ইবাদতের স্থান।

আয়াসোফিয়া আজ তাগুতের হাতে চলে যাচ্ছে। তাতে ঝুলানো হচ্ছে, মূর্তি ও ছবি। ইসলাম ও মুসলমানদের থেকে ছিনিয়ে তা কাফের ও  পশ্চিমাদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। অথচ আয়াসোফিয়ার জন্য কত পবিত্র রক্ত ঝরানো হয়েছে। কত অসংখ্য প্রাণ শহীদ হয়েছে। সেই মুহাম্মাদ আলফাতিহের যুগ থেকে আবদুল হামীদের যুগ পর্যন্ত!

এসকল রক্ত কি বৃথা যাবে? এসকল প্রাণ কি নিষ্ফল হয়ে যাবে? আজ ৪৮৭ বছর পর আয়াসোফিয়া এমন হয়ে গেল, যেন কখনো তাতে আল্লাহর যিকির করা হয়নি, কুরআন তিলাওয়াত হয়নি। তার মিনার থেকে আযানের ধ্বনি গুঞ্জরিত হয়নি। (মিন নাফাহাতিল হারাম, পৃষ্ঠা ৭০)

আলী তানতাবী রাহ. আয়াসোফিয়ার যে চিত্র অংকন করেছেন এতদিন পর্যন্ত এটাই ছিল এ মসজিদের অবস্থা। জাদুঘর হিসেবে প্রতি বছর প্রায় ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষ তা দেখতে আসত। কিন্তু গত কয়েক বছর যাবত আয়াসোফিয়াকে আবার মসজিদে রূপান্তরিত করার দাবি উঠতে থাকে। ২০১২ ঈসাব্দ সালের ২৭ মে মুহাম্মাদ আলফাতিহ-এর কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের ৫৫৯ তম বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে তাওহীদী জনতা আয়াসোফিয়ার কাছে এসে নামায আদায় করে। প্রতিবাদকারীরা শ্লোগান দিতে থাকে- শিকল ভেঙ্গে দাও, আয়াসোফিয়াকে মসজিদ হিসেবে খুলে দাও। বন্দী মসজিদকে মুক্ত কর।

তুর্কি জনগণের অব্যাহত দাবির প্রেক্ষিতে ধীরে ধীরে আয়াসোফিয়াতে ধর্র্মীয় কার্যক্রম শুরু হয়। ১৪৩৭ হিজরীর রমযান মাসে প্রতিদিন আয়াসোফিয়ার ভেতরে কুরআন তিলাওয়াতের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় এবং বিশেষ করে ২৭ রমযানের রাতে "خير من ألف شهر" শিরোনামে আয়াসোফিয়ার ভিতরে একটি দ্বীনী প্রোগ্রাম অনুষ্ঠিত হয়। যে অনুষ্ঠানের শেষে তুর্কি মুআযযিন শায়েখ ফাতেহ কুজা ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আযান দেন, যেখান থেকে ৮৩ বছর পূর্বে আয়াসোফিয়ার ভেতর সর্বশেষ আযান দেয়া হয়েছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, মাঝখানের এ সময়টাও হাজার মাসের। অবশেষে এ আন্দোলনের চ‚ড়ান্ত বিজয় লাভ হয় ১০ জুলাই ২০২০। আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আয়াসোফিয়াকে মসজিদ হিসেবে ব্যবহার করার ঘোষণা দেয়া হয় এদিন।

এ সিদ্ধান্তকে তুরস্কসহ সারা বিশ্বের তাওহীদী জনতা স্বাগত জানিয়েছে এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্টকে এ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেয়ায় মোবারকবাদ দিয়েছে। এ ঘোষণার পর পরই হাজার হাজার মানুষ আয়াসোফিয়ার সামনে সিজদায়ে শোকর আদায় করতে দেখা গেছে। আদালতের সিদ্ধান্তের পর এরদোগান তার ভাষণে বলেন- ১৯৩৪ সালে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল তা শুধু ইতিহাসের সাথে গাদ্দারীই ছিল না, তা ছিল বেআইনী। কারণ আয়াসোফিয়া রাষ্ট্র কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। এটা মূলত সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ-এর ওয়াকফকৃত সম্পত্তি। আর তিনি তার ওয়াক্ফের দলীলের মধ্যে উল্লেখ করেছেন- (যা ছিল শতাধিক পৃষ্ঠাজুড়ে) “যে ব্যক্তি এ ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তির কোনো কিছু পরিবর্তন কিংবা পরিবর্ধন করবে। মসজিদ সংশ্লিষ্ট কোনো কিছুতে হস্তক্ষেপ করবে সে অনেক বড় গুনাহের কাজ করবে। এ ওয়াক্ফকৃত সম্পদে হস্তক্ষেপকারী কোনো ব্যক্তি হোক বা জামাত, তাদের উপর সর্বদা আল্লাহ, তাঁর নবী, ফিরিশতা, শাসকবর্গ ও সমস্ত মুসলমানদের পক্ষ থেকে লানত বর্ষিত হবে।” এরদোগান ওয়াক্ফের এ দলীল তুলে ধরে বলেন, এর মধ্যে যা উল্লেখ করা হয়েছে সেটাই আমাদের ভিত্তি। এর ফলে আয়াসোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করার অধিকার তুরস্কের আছে।

এরদোগান তার ভাষণে শহীদ কবি উসমানের সেই বিখ্যাত কবিতাও উদ্ধৃত করেন, যার ফলে তাকে শহীদ করে দেওয়া হয়েছিল-

আয়াসোফিয়া! হে মহান ইবাদতখানা! তুমি বিষন্ন হয়ো না; মুহাম্মাদ আলফাতিহ-এর রূহানী সন্তানেরা সব মূর্তি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে তোমাকে আবার মসজিদে রূপান্তরিত করবে। তারা তাদের চোখের পানি দিয়ে ওযু করে  তোমার দেয়ালের পাশে সেজদায় লুটিয়ে পড়বে। তাকবীর-তাহলীলের গুঞ্জরণে তোমার পরিবেশকে আবার মুখরিত করে তুলবে। সেদিন হবে আমাদের দ্বিতীয় বিজয়। নতুন করে আবার আযানের আওয়ায গুঞ্জরিত হবে। নিশ্চুপ নির্জীব মিনারগুলো তাকবীর ধ্বনীতে আবার সজীব হয়ে উঠবে। আল্লাহর বড়ত্ব ও তার নবীর মহত্বের আলোয় মিনারগুলো আবার আলোকিত হয়ে উঠবে। এমনকি মানুষ তখন ভাববে, ফাতিহ নতুন করে আবিভর্‚ত হয়েছে।

আয়াসোফিয়া! এ সবকিছুই হবে। আমাদের দ্বিতীয় বিজয় হবে মৃত্যুর পর পূণরুত্থানের মত। এটা নিশ্চয়ই হবে। তুমি দুশ্চিন্তা করো না। সেদিন খুব কাছেই। হয়তো আগামীকাল কিংবা আরো সন্নিকটে।

আয়াসোফিয়ার পেছনের ইতিহাস

পঞ্চম খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান জগৎ দুটি বিরাট সাম্রাজ্যে বিভক্ত ছিল। তাদের ধর্মীয় কেন্দ্রও ছিল বিভক্ত। পূর্ব সাম্রাজ্যের ধর্মনেতাকে বলা হতো পেট্রিক, আর গির্জাকে বলা হতো দ্যা হোলি অর্থোডক্স চার্চ। পক্ষান্তরে পশ্চিমা সাম্রাজ্যের প্রধান ধর্মনেতাকে বলা হতো পোপ, আর গির্জাকে বলা হতো রোমান ক্যাথলিক চার্চ। অর্থোডক্স চার্চের কেন্দ্রীয় গির্জা ছিল আয়াসোফিয়া, যা ভ্যাটিকানের চেয়ে প্রাচীন। ৩৬০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম খ্রিস্টান সম্রাট কনস্টান্টিনোপল আয়াসোফিয়া নির্মাণ করেন। আয়াসোফিয়ার বর্তমান কাঠামো তৈরি করা হয় তৎকালীন বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ানের নির্দেশে ৫৩৭ সালে। ৫৩৭ থেকে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অর্থোডক্স গির্জা হিসেবে আয়াসোফিয়া ব্যবহৃত হয়। চতুর্থ ক্রুসেডের সময় ক্যাথলিক খ্রিস্টানেরা অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল আক্রমণ করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এবং আয়াসোফিয়াকে অর্থোডক্স গির্জা থেকে ক্যাথলিক গির্জায় রূপান্তরিত করে। যার দরুন আয়াসোফিয়া ১২০৪ থেকে ১২৬১ সাল পর্যন্ত ক্যাথলিক গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এরপর অর্থডোক্স খ্রিস্টানরা পুনরায় তা দখল করে অর্থোডক্স গির্জায় পরিণত করে। ১৪৫৩ সালে উসমানী সুলতান মুহাম্মাদ আলফাতিহ কনস্টান্টিনোপল, তথা আজকের ইস্তাম্বুল বিজয় করলে আয়াসোফিয়া উসমানীদের অধীনে আসে। এরপর সুলতান মুহাম্মাদ আলফাতিহ জাযকশ্রেণী থেকে নিজ অর্থব্যয়ে আয়াসোফিয়া গির্জাটি কিনে নেন এবং একে মসজিদের জন্য ওয়াকফ করেন। এভাবেই আয়াসোফিয়া মসজিদে রূপান্তরিত হয়।

আয়াসোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করার ঘটনা দিয়ে মুহাম্মাদ আলফাতিহকে কিছু খ্রিস্টান গবেষক সংকীর্ণমনা চিত্রায়ন করার কূট চেষ্টা করে। কিন্তু ইস্তাম্বুল বিজয়ের পর তিনি তৎকালীন খ্রিস্টানদের সাথে যে উদার আচরণ করেছেন তা তারা বেমালুম ভুলে যায়।

এসকল খ্রিস্টান গবেষকদের উচিত আয়নায় সর্বপ্রথম নিজেদের চেহারা দেখা। মুহাম্মাদ আলফাতিহের ইস্তাম্বুল বিজয়ের মাত্র কয়েক বছর পর স্পেনে মুসলিম শাসকদের পতন হয়। সর্বশেষ গ্রানাডাও চলে যায় মুসলমানদের হাত থেকে। গ্রানাডা পতনের সময় খ্রিস্টান শাসকদের সাথে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয় মুসলমানেরা। যার মধ্যে সাতষট্টিটি শর্ত ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, গ্রানাডার বিশিষ্ট সাধারণ সকল নাগরিকের জান-মাল ও পরিবারের নিরাপত্তা দান করা হবে। প্রত্যেকের ঘর-বাড়ি, জায়গা-জমি ও  ক্ষেত-খামার নিজ দখলেই থাকবে। আরও উল্লেখ ছিল, প্রত্যেকে আপন আপন শরীয়ত পালন করতে পারবে। তাদের বিচারকার্য কেবল তাদের শরীয়ত অনুযায়ীই হবে। মসজিদ ও অন্যান্য ওয়াক্ফ সম্পত্তি যেমন আছে তেমনই থাকবে। খ্রিস্টানরা কোনো মুসলমানের ঘরে প্রবেশ করতে পারবে না। কাউকে অপহরণ করতে পারবে না।

তারা কোনো মসজিদে প্রবেশ করতে পারবে না। মুসলিম নাগরিকগণ জান-মালের নিরাপত্তা সহকারে খ্রিস্টান অঞ্চলে যেতে পারবে। কোনো মুআযযিন, মুসল্লী, রোযাদার বা অন্য কোনো ইবাদত পালনকারীকে ধর্মীয় বিধি-বিধান পালনে কোনোরূপ বাধা প্রদান করা যাবে না। মুসলমানদের ইবাদত-কর্ম দেখে কেউ হাসি-ঠাট্টা করলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : নাফহুত তীব, ৪/৫২৪-৫২৭)

কিন্তু এ চুক্তি খ্রিস্টানরা কতটুকু রক্ষা করেছিল? ইতিহাস থেকেই আমরা তা জানতে পারি।

খ্রিস্টান স্পেন তার মুসলিম নাগরিকদের বড় কঠিন ও লোমহর্ষক পন্থায় খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার নীতি অবলম্বন করেছিল। আর পুরো প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হয়েছিল গির্জা-কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। গ্রানাডা দখলের সময় মুসলমানদের সঙ্গে কৃত চুক্তি খ্রিস্টান জাতির এই ক্রুসেডীয় মনোভাবের সামনে সামান্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে এ চুক্তি প্রহসনের চুক্তি ছাড়া আর কিছুই ছিল না এবং এ চুক্তি ছিল ধর্ম ও খোদাভীতির পোশাকের অন্তরালে স্প্যানিশ প্রতারণামূলক নীতিতে পরিপূর্ণ। মুসলমানরা যখন খ্রিস্টানদের বিকৃত ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসকে প্রত্যাখান করে এবং এ ধরনের ভ্রান্ত নীতি গ্রহণ করা হতে বিরত থাকে তখন স্প্যানিশ খ্রিস্টানরা তাদেরকে বিদ্রোহী ও মাগরেব-কায়রো-কনস্টান্টিনোপলের বহিরাগত পক্ষের কর্মী বলে আখ্যায়িত করে। এরপর শুরু হয় এসব মুসলমানদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা। গ্রানাডা, বাইয়াযিন ও বাশারাতের মুসলমানগণ এ সময়ে নির্ভীকতার সঙ্গে লড়াই করে যান এবং একপর্যায়ে তাদেরকে নির্মম ও নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়। (আন্দালুসের ইতিহাস, পৃ. ৩২২)

কিন্তু এর বিপরীতে তুরস্ক বিজয়ের পর খ্রিস্টানদের সাথে মুহাম্মাদ আলফাতিহের আচরণ তারা দেখুক। তিনি চাইলেই তাদের উপর দমন-পীড়নের স্ট্রিমরোলার চালাতে পারতেন। খ্রিস্টানদের রক্ত-বন্যায় ভাসিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি তাদের দিয়েছেন যথাযথ ধর্মীয় স্বাধীনতা। খ্রিস্টানদের নিজ ধর্ম পালনে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ তিনি করেননি। কোনো ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করেননি। এরপরও পশ্চিমাদের চোখে তিনি হচ্ছেন একজন ‘বর্বর রাজ্যবিজেতা’। হায়! এরই নাম কি ইনসাফ!

যাইহোক, ৮৬ বছর পর উদ্ধার হওয়া আয়াসোফিয়া আমাদের মাঝে প্রবলভাবে এ আশার সঞ্চার করছে যে, ২৮ বছর পূর্বের শহীদ বাবরী মসজিদ আবার জিন্দা হবে। ইনশাআল্লাহ অচিরেই তার মিনারেও ধ্বনিত হবে আল্লাহু আকবার ধ্বনি।

وَ تِلْكَ الْاَیَّامُ نُدَاوِلُهَا بَیْنَ النَّاسِ...

এ তো (সুখ-দুঃখ ও জয়-পরাজয়ের) দিন-পরিক্রমা, যা মানুষের মাঝে আমি পালাক্রমে পালাবদল করতে থাকি। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৪০

 

 

advertisement