সফর ১৪২৯   ||   ফেব্রুয়ারি ২০০৮

খাদ্যদ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি : গরীবের কী হবে

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়েই চলেছে। বিশেষত চাল, আটা, তেল, দুধ ও ডালের দাম অনেক দিন থেকেই সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার উপরে অবস্থান করছিল। এরই মধ্যে গত মাসে স্বল্পআয়ী লোকজন পড়েছে আরো বিপদে। হঠাৎ বজ্রপাতের মত একদিনেই চালের মূল্য বেড়েছে ৪০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত। তখন এ নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মুখী চেষ্টা করা হয়। সরকারিভাবে শহর এলাকাগুলোতে ওএমএস (খোলা বাজারে বিক্রয়) কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। একজন লোককে সর্বোচ্চ তিন কেজি চাল ২৫ টাকা কেজি হিসাবে দেওয়া শুরু হয়। যা এর আগে ছিল প্রতি কেজি ২০ টাকা। এরই মধ্যে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের মধ্যে পাঁচ সদস্য বিদায় নেন এবং তাদের জায়গা পূরণ করেন নতুন পাঁচজন।

নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের এ মূল্যস্ফীতি আমাদের মত দরিদ্র দেশের জন্য ভয়াবহ একটি সমস্যা। যে দেশের অধিকাংশ লোক খেটে-খাওয়া দিনমজুর বা কৃষক-শ্রমিক ও ঠেলা বা রিকশাওয়ালা, আবার বহু লোক সম্পূর্ণ কর্মহীন, যেখানে একজন শ্রমিকের সারাদিনের ঘামে ঝরানো কামাইয়ের পরিমাণ খুবই সীমিত সেখানে খাদ্যদ্রব্যের এ ঊর্ধ্বমূল্য দেশের অসংখ্য দরিদ্র ও স্বল্পআয়ী লোকদেরকে অর্ধাহারে দিন যাপন করতেই বাধ্য করছে।

খাদ্যমূল্যের এ ঊর্ধ্বগতির ব্যাখ্যা বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে প্রদান করেছেন। অনেকেই বলেছেন, এটি ব্যবসায়ীদের কারসাজি। একশ্রেণীর মুনাফালোভী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। আবার সরকারের তরফে বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যমূল্যের বৃদ্ধি এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্যঘাটতির কথা। অবশ্য সদ্য হজ্ব ফেরত সেনাপ্রধান তাঁর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকেই দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছেন। চাল কিনে কারসাজি করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কথাও তিনি বলেছেন বলে একটি পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছে। আবার কারো কারো মতে হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধি কিছুটা বাস্তবতার নিরিখেই ঘটেছে, সাথে ব্যাপক কারসাজিও ছিল। এ ছাড়া এক বছরের মধ্যে দুটি বন্যা ও ঘুর্ণিঝড় সিডর-এর প্রেক্ষাপটে খাদ্যের ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল কর্তৃক আগে থেকেই যথাসময় প্রস্ত্ততি না নেওয়াকেও দুষেছেন কোন কোন অভিজ্ঞ মহল। খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির উপরোক্ত কারণগুলোর সার-সংক্ষেপ নিম্নরূপ-

* ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজি

* আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও খাদ্যঘাটতি

* উপরোক্ত উভয়টি

* সরকারের অপ্রস্ত্ততি

* চাহিদা ও যোগানের বাস্তবভিত্তিক পরিসংখ্যানের অনুপস্থিতি

উপরোক্ত কারণগুলোর মধ্যে প্রথমটি অর্থাৎ সিন্ডিকেট প্রতিরোধে ইসলামী নীতিমালার উপর একটি লেখা আলকাউসারে প্রকাশিত হয়েছিল সম্ভবত বছরখানেক আগে। সেখানে কৃত্রিমভাবে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে ইসলামের নির্দেশনাগুলোর কথা তুলে ধরা হয়েছিল। অসৎ ব্যবসায়ীদের গোপন অাঁতাত ও মজুদদারী কঠোরভাবে বন্ধ এবং সকল মধ্যস্বত্বভোগকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে কুরআন হাদীসের শিক্ষাগুলো পালন করা হলে এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেত আরো আগেই।

আর বিজ্ঞানের এ যুগের খাদ্যের যোগান-চাহিদার পরিসংখ্যানের অনুপস্থিতি এবং বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ না থাকা সত্যিই বড় বেমানান। কুরআনুল কারীমের সূরা ইউসুফের সে ঘটনা নিশ্চয় সকলেরই জানা রয়েছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইহলোকে আসার কয়েকশ বছর আগে মিসরীয় শাসকের স্বপ্নের ব্যাখ্যায় কারাবন্দি নবী হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম সম্ভবত দীর্ঘ মেয়াদি খরা ও দুর্ভিক্ষের সময়ে খাদ্যসংকট থেকে রেহাই পেতে যে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা ও সমাধান পেশ করেছিলেন তা ওই দেশের হাজার হাজার নাগরিককে রক্ষা করেছে অনাহারী জীবন-যাপন থেকে।

খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির আরেকটি কারণ পেশ করা হয় আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, তেল ও আটার মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টিকে। যেহেতু এসব দ্রব্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আমদানি-নির্ভর দেশ, তাই বেশি দামে খরিদ করে আনলে কম মূল্যে বিক্রি করবে কীভাবে? যদিও এ ব্যাপারে অনেকেরই ভিন্ন মত রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারের খোঁজখবর নিয়ে কেউ কেউ হিসাব-নিকাশ করে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, বিদেশে যে হারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে আমাদের দেশে ঘটেছে আরো অনেক বেশি হারে। কেউ কেউ ব্যবসায়ীদের আমদানি মূল্য যাচাই করেও এমন দাবি করেছেন খবরের কাগজে। তবে যে বা যে সকল কারণেই মূল্য বৃদ্ধি ঘটুক এবং কাউকে দোষী বা নি©র্দাষ করে যত ব্যাখ্যাই এক্ষেত্রে হাজির করা হোক মূল সমস্যা তো থেকেই যাচ্ছে। অর্থাৎ স্বল্পআয়ী লোকজন তো এখন আর তাদের উপার্জিত অর্থ দিয়ে আগের সমান চাল, ডাল, আটা ইত্যাদি কিনতে পারছেন না। তাদের পরিবারের লোকজনকে তো অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতেই হচ্ছে।

খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির সমস্যাটি আসলে আপেক্ষিক বিষয়। এটি কারো কারো জন্য তেমন কোন সমস্যাই নয়। আবার অনেকের জন্য মহামুসিবতের কারণ। উন্নত রাষ্ট্রে যেখানে মানুষের পর্যাপ্ত ক্রয়ক্ষমতা পরিমাণ আয় রয়েছে, রয়েছে বেকার ভাতার ব্যবস্থা, সেখানে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি মানুষের জীবনযাত্রায় বড় কোন প্রভাব ফেলে না। আমাদের দেশেও বহু বিত্তশালী এমন রয়েছেন যাদের মাসিক আয়ের ৫-১০ শতাংশও সাধারণ খাদ্যদ্রব্যের পেছনে ব্যয় হয় না। বলাবাহুল্য, সরকারি-বেসরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বড় বড় শিল্পপতি, ব্যবসায়ী সকলেই এ সম্প্রদায়ভুক্ত। চাল, ডাল, আটা, তেলের মূল্য তাদের জন্য তেমন কোন সমস্যাই নয়; কিন্তু খাদ্যমূল্য স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকা অবস্থায় যে পরিবারের কর্তার আয়ের ৫০-৯০ ভাগ পর্যন্ত বা পুরোটাই ভাত, ডাল ও রুটি ইত্যাদির পেছনে ব্যয় হয়ে যেত, বর্তমানে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির পর তাদের অবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা একটু চিন্তা করলেই তো বুঝে আসে। খোলা বাজারে সরকারি চালের দামও ২৫% বৃদ্ধি পেয়ে ২০ টাকা থেকে এক লাফে ২৫ উঠেছে। তবুও ওএমএস-এর এ চালের জন্য শুধু নিম্নশ্রেণীর লোকজনই ভিড় করছে না; বরং অনেক ভদ্র, শিক্ষিত ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গও লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ৩ কেজি চাল সংগ্রহ করছেন। এতেই বোঝা যায় মানুষের অবস্থা কত করুন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে!

স্বল্পআয়ী কোটি কোটি মানুষের এ সমস্যা লাঘবের জন্য সাধারণ দৃষ্টিতে দুটি পথ খোলা রয়েছে- (১) দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী লাগামকে টেনে ধরে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা, (২) স্বল্পআয়ী মানুষের বেতন-ভাতা, মজুরি ও পারিশ্রমিক সমহারে বাড়িয়ে দিয়ে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। লক্ষণীয় যে, এ দুটি পদ্ধতির প্রথমটির ক্ষেত্রে কয়েক বছর থেকেই সরকারগুলো ব্যর্থ হচ্ছে। এমনকি অক্টোবর ০৬এর মেয়াদ পূর্ণ করা নির্বাচিত সরকারের বড় ব্যর্থতা হিসাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকেই চিহি্নত করা হয়েছে। আর এর পরবর্তী এক বছরের অবস্থা যে এ ক্ষেত্রে কত শোচনীয় তা তো সকলেই পর্যবেক্ষণ করছে।

খাদ্যমূল্যসংক্রান্ত সমস্যা লাঘবের দ্বিতীয় পদ্ধতি হল মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়া। অর্থাৎ সাধারণ লোকও যেন উচ্চমূল্যের খাদ্যদ্রব্য খরিদ করতে পারে সে পরিমাণে তাদের বেতন, ভাতা ও মজুরি বৃদ্ধি করা। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এটি যে প্রথমটি থেকে আরো কঠিন তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তাহলে উপায় কী?

গত ডিসেম্বর ০৭-এ যেদিন হঠাৎ করে মোটা চালের মূল্য ৪০ শতাংশ বৃদ্ধির খবর এলো এবং চারদিকে শুরু হল চালের জন্য হাহাকার, সেদিন বারবার মনে পড়ছিল যদি এ মুহূর্তে দেশে ইসলামী অর্থনীতি চালু থাকত, যদি দেশের কৃষি বিভাগ ও ব্যবসা সেক্টর ইসলামী নীতিতে পরিচালিত হত তাহলে এ মুহূর্তে কী ব্যবস্থা নেওয়া হত? কীভাবে সমাধান করা হত এ সমস্যার? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে কুরআন হাদীস ও ফিকহের আলোকে যে কথাগুলো মনে এসেছে তাই প্রিয় পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হচ্ছে।

প্রথমেই যে কথা বলা দরকার তা হল, খাদ্য ও পানি সকল মানুষের জন্মগত অধিকার। শুধু মানুষই নয়, বরং পবিত্র কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী সকল প্রাণীই এ অধিকার রাখে। জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষই দুমুঠো আহার পাওয়ার অধিকার রাখে। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম মক্কা মুকাররমায় বসবাসকারী মুসলমানদের জন্য রিযিকের দুআ করায় মহান আল্লাহ আরো ব্যাপকতার সাথে তাঁর দুআ কবুলের ঘোষণা দিয়েছেন এ বলে যে, আমি কাফেরদেরও ইহজগতের খাবার দেব। এরপর আখেরাতে গেলে সে দোযখের শাস্তি ভোগ করবে।

দুনিয়া যেহেতু দারুল আসবাব তথা উপায়-উপকরণের জগৎ তাই মহান আল্লাহ মানবকুল ও প্রাণীকুলের রিযিকের ব্যবস্থা করেছেন তাঁর নিজস্ব হেকমত ও কুদরতে। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর রিযিকের ব্যবস্থা যে পদ্ধতিতে করা হয়েছে সৃষ্ট মাখলুক মানুষের ক্ষেত্রে সে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়নি। কুরআন হাদীসের বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ জাল্লা শানুহু ও তাঁর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাদ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক অসংখ্য বাণী এসেছে।

মানুষের জন্মলগ্ন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বয়সের বিভিন্ন স্তরে তার রিযিকের দায়িত্ব বিভিন্নভাবে ঠিক করে দিয়েছে ইসলাম। শিশুকালে তার পিতামাতা বা অভিভাবকদের উপর, যখন সে রুজী-রোজগারের সামর্থবান হবে তখন তার নিজ দায়িত্বে এবং যখন সে বৃদ্ধ হয়ে কামাই-রোজগারের সামর্থ্য হারাবে তখন তার সন্তানাদির উপর তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যে ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিজেরাই অসচ্ছল হবে তখন কী ব্যবস্থা হবে?

এমন ক্ষেত্রেই ইসলাম দায়িত্ব অর্পণ করেছে সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর। আয়হীন ও স্বল্পআয়ী লোকজন এবং কামাই-রোজগারে সামর্থহীন ব্যক্তিদেরই নিকটত্মীয় কর্তৃক তাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা না হলে তাদের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে সামর্থবান পাড়া-পড়শী ও সমাজের বিত্তশালীদের উপর। যদি তাতেও উদ্দেশ্য পূর্ণ না হয় তবে এ দায়িত্ব পালন করবে রাষ্ট্র তথা সরকার।

মহান আল্লাহ তাআলা বিত্তশালীদেরকে দান-খয়রাত করতে উদ্বুদ্ধ করার আগে তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, তোমরা যা কিছুর মালিক তা মূলত আমারই সম্পদ। তোমরা যা দান করবে তা আমার দেওয়া সম্পদ থেকেই দান করবে। সূরা বাকারার শুরুতে আল্লাহ তাআলা এমন ঘোষণা দিয়েছেন সুস্পষ্টভাবে।

এমনিভাবে হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, যে নিজে উদর পুরে খেল অথচ তার পড়শী ক্ষুধার্ত সে মুমিন হতে পারে না।

ইসলাম বিত্তশালীদেরকে দরিদ্রদের প্রতি করুণার কথা বলেনি, বরং বলেছে যে বিত্তবানদের সম্পদে অনাথ-গরীবদের অধিকার রয়েছে।

এভাবে ধনীদের উপর গরীবদের সাধারণ জীবন চলার খরচের দায়িত্ব অর্পণ করে আল্লাহ তাআলা তাদের রিযিকেরও নির্দেশনা দিয়েছেন। ধনীদের যাকাত, উশর, ফেতরা ও সাধারণ দানের মাধ্যমে একটি সমাজ গড়ে উঠবে সত্যিকারের ইনসাফভিত্তিক পন্থায়।

উপরোক্ত পন্থায়ও সমস্যার সমাধান না হলে সে দায়িত্ব অর্পিত হবে সরকারের উপর। বাইতুল মাল তথা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তখন মানুষের খাদ্যের যোগান দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। মানবতার ইহ ও পরকালের রাহবার রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি সম্পদ রেখে মারা যাবে তার সম্পদ পাবে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশরা, আর যে সম্পদবিহীন পরিবার-পরিজন রেখে যাবে তার দায়িত্ব আমার (ইসলামী রাষ্ট্রের)।

এটি ওই রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত রূপ যেখানে প্রচলিত পদ্ধতির ট্যাক্সের বিধান নেই। যে রাষ্ট্রের কোষাগারে (বাইতুল মালে) জমা হবে শুধু যাকাত, উশর, গণীমত ও খনিজ সম্পদের ২০% এবং মানুষের স্বতস্ফূর্ত দান। কিন্তু যে রাষ্ট্র জনগণ থেকে সরাসরি বিভিন্ন প্রকার শুল্ক নিয়ে থাকে, যে ব্যবস্থায় সমাজের ধনী ও গরীব সকলকে এমন কি ভিখারীকেও তাদের জ্ঞাতসারে বা অজান্তে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিভিন্ন প্রকারের ট্যাক্স দিতে হয়, নাগরিকদের প্রতি সে রাষ্ট্রের দায়িত্ব যে আরো কত বেশি হওয়া উচিত তা তো বলার অপেক্ষা রাখে বলে মনে হয় না।

এ সংক্ষিপ্ত লেখায় ইসলামের এ বিষয়ক শিক্ষা ও নির্দেশনাগুলো সবিস্তারে পেশ করা সম্ভব নয়। এখানে শুধু বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা থাকলে কী সমাধান হতে পারত- এ পর্যায়ে তা সংক্ষিপ্ত আকারে পেশ করা হচ্ছে। যেহেতু সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সফল হচ্ছে না এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও প্রয়োজন অনুপাতে বাড়ছে না, তাই বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটার আগ পর্যন্ত যা করণীয় তা হল-

সুষ্ঠু পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেশের লোকদের আর্থিক অবস্থা ও পরিবারের কর্তা ব্যক্তির আয়ের পরিমাণ এবং তার উপর নির্ভরশীল লোকজনের সংখ্যা উল্লেখ করে একটি ডাটা তৈরি করতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে একাজ করানো যেতে পারে, যা সরকারের বিভিন্ন সংস্থার লোকদের মাধ্যমে নিরীক্ষিত হয়ে চূড়ান্ত করা হবে। প্রয়োজনে এক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে।

এরপর যে সকল পরিবারের কর্তা ব্যক্তির আয় তাদের অতিজরুরি খাদ্য, পানীয় ও পুষ্টির জোগাড়ের জন্য যথেষ্ট নয়, তাদেরকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের আয় দ্বারা কত টাকা মূল্যে তারা চাল, ডাল, আটা, তেল ও শিশুখাদ্য ক্রয়ে সক্ষম সে হিসাব লাগিয়ে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি রেশন কার্ড চালু করতে হবে এবং সামর্থ অনুযায়ী কার্ডধারীদেরকে ১০/১৫/২০ বা এ ধরনের যে মূল্যে তারা চাল, আটা খরিদে সক্ষম, সে মূল্যে তাদেরকে তা সরবরাহ করতে হবে। এমনিভাবে ডাল, তেল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিও নিয়ন্ত্রিত মূল্যে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরবরাহ করতে হবে। আর যারা একেবারেই আয়হীন তাদের জন্য চালু করতে হবে প্রয়োজন অনুপাতে সরকারি রিলিফ।

উপরোক্ত কথাগুলো ভাবনায় আসার পর তা প্রকাশ করতে গেলে পুঁজিবাদী এ সমাজ তা কীভাবে নেবে এবং বিষয়টিকে হাস্যকর মনে করবে কিনা তা নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল। এমনি সময়ে পত্রিকায় নজর পড়ল সাবেক সচিব ও উপদেষ্টা জনাব ড. আকবর আলী খানের একটি বক্তব্যের প্রতি। তিনি দাবি করেছেন দেড় কোটি লোককে ফ্রি খাদ্য সরবরাহ করার। তাঁর মত একজন অভিজ্ঞ জাঁদরেল ব্যক্তিত্বের এ বক্তব্য থেকে এ কথা বোঝা যায় যে, এ সময়ের সরকারের জন্যও উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা সম্ভব।

বাজেট সংক্রান্ত লেখায় বলা হয়েছিল যে, সরকার যদি বিলাসিতা এবং বাহুল্য খরচাদি ত্যাগ করে এবং জরুরি খরচাদি নিয়ন্ত্রণ করে তবে এ সকল খাত থেকে বেঁচে যাওয়া টাকা দিয়েও বহু কিছু করা সম্ভব। বিশেষত যেখানে গত এক বছর রাষ্ট্রকে কোন স্ফীত আকারের মন্ত্রিসভা এবং তাদের পিএস ও এপিএস ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের পালতে হচ্ছে না, পরিশোধ করতে হচ্ছে না সাড়ে তিনশর মত সংসদ সদস্যের বেতন ও বিভিন্ন ধরনের সম্মানি, সে ক্ষেত্রে এসব খাত থেকে বেঁচে যাওয়া অর্থও গরীব-দুঃখী ও স্বল্পআয়ী লোকদেরকে রেশনিংয়ের মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহের কাজে লাগানো যেতে পারে। এছাড়া অসৎ পন্থায় উপার্জিত যে কোটি টাকা বর্তমান সরকার আদায়ে সফল হয়েছে তা-ও এ খাতে ব্যয় করা যেতে পারে। উপরোক্ত প্রস্তাব উচ্চাভিলাষী কোন বক্তব্য নয়, বরং বাস্তবভিত্তিক ইসলামী নির্দেশনা।

মোটকথা দেশের কোন লোক, সে যে ধর্ম, গোত্র বা দলেরই হোক না কেন, যেন অনাহারে বা অর্ধাহারে কষ্টভোগ না করে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার সমাজ ও রাষ্ট্রের। বিত্তবানগণ ঠিকমত যাকাত আদায় করলে এবং তাদের বিলাসবহুল খরচগুলো কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে সে টাকা যথাযথ পন্থায় দান-খয়রাত করলে অথবা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার আওতায় হলে সে তহবিলে সহায়তা করলে বর্তমান সমস্যা কাটিয়ে ওঠা অবশ্যই সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ।

বলা হয়ে থাকে যে, এ দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হল এ দেশের জনশক্তি। সে জনশক্তি টিকিয়ে রাখতে হবে সময়োচিত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার মাধ্যমে। পরিস্থিতির উন্নয়নে এ বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আল্লাহ তাআলা সকলকে নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে আদায় করার তাওফীক দিন। আমীন।

 

 

advertisement