সফর ১৪২৯   ||   ফেব্রুয়ারি ২০০৮

মাছনূন দুআ : অলৌকিক ভাবের উদ্ভাস

প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান

আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ পাকের শোকর আদায় করছি। আল্লাহ পাক আবার আপনাদের সামনে দ্বীনি কিছু আলোচনার জন্য একত্র হওয়ার সৌভাগ্য দিলেন। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা উলামায়ে কেরামের মুখে শুনে থাকি যে, এ ধরনের মজলিস আল্লাহ তাআলার কাছে অত্যন্ত প্রিয়। এ ধরনের মজলিসে অংশগ্রহণকারীদেরকে রহমতের ফেরেশতারা ঘিরে রাখে, রহমত তাদেরকে ঢেকে ফেলে, তাদের উপর সকীনা নামের বিশেষ রহমত নাযিল হয়। ফেরেশতারা তাদের জন্য মাগফেরাতের দুআ করে। আল্লাহ তাআলা নিকবর্তী ফেরেশতাদের কাছে এ ধরনের মজলিসে অংশগ্রহণকারীদের কথা আলোচনা করেন। এ জন্য আমাদের মাওলানা আবারারুল হক [রহ.] বলতেন, এ ধরনের মজলিসে বসতে পারাটাই মস্তবড় আমল।

আমি যে আয়াতটা পাঠ করলাম তাতে আল্লাহ তাআলা বলেন, হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর। প্রত্যেকেরই চিন্তা করা উচিত আগামীকালের জন্য সে কী পাঠিয়েছে। আমাদের মজলিস আগামী কালের জন্য পাঠানোর মজলিস। আমাদের এই সময়টা আমাদের পরবর্তী সময়ের জন্য পাঠানো হয়ে গেল। আল্লাহ কবুল করুন। আমীন। হযরত মাওলানা আবরারুল হক [রহ]. বলতেন, এই মজলিস অত্যন্ত দামি। অনেকে অনেক দূর থেকে আসে, কিন্তু কেউ যদি বলে মাইকের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, মজলিসে যা হচ্ছে সব তো শোনাই যাচ্ছে। আমার বাড়িতে বসে শুনলে সমস্যা কি? হযরত বলেন, না এই ব্যক্তি ধোঁকার মধ্যে পড়ে গেল। সে ফেরেশতাদের বেষ্টনির ওই মর্যাদা পাবে না। রহমতের নিচে থাকার মর্যাদা পাবে না। ওয়াজ-নসীহতের কথা সে শুনবে। হয়তো সে কথার মধ্যে জরুরি মাসআলা-মাসায়েল জানবে, কিন্ত মজলিসের মধ্যে ফেরেশতাদের মধ্যে থাকা, খাস রহমত ও সকীনার নিচে থাকা-এগুলো থেকে সে বঞ্চিত হবে। এ জন্য কী কথা আলোচনা হল, কে কথা বলল, কতখানি ভালো লাগলো এগুলো দুই নম্বর। এক নম্বর এই যে, আমরা আল্লাহ পাকের যিকিরের মজলিসে বসেছি, আমাদের সময় কাজে লেগেছে-এটাই বড় সঞ্চয় পরবর্তী জীবনের জন্য ইনশাআল্লাহ।

প্রত্যেকেরই চিন্তা করা উচিত আগামী কালের জন্য সে কী পাঠিয়েছে। কুরআন শরীফে এই কথা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় এসেছে। আমপারার মধ্যে আছে, কাফেররা আফসোস করে বলবে, হায় আফসোস! দুনিয়াতে থাকতে আমরা যদি এই জীবনের জন্য পাঠাতাম! কেন তখন পাঠালাম না! মওতের আগে কামাই পাঠালাম না!

এখন তো মওতের পরের যিন্দেগি সম্পর্কে আলোচনাই নেই; অথচ সেটাই ইসলামের মৌলিক বিষয়। আমাদের দৈনিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন, রেডিও, টেভিতে নামকেওয়াস্তে একটুখানী কুরআন তেলাওয়াত হল, তাফসীর হল, আলোচনা হল, কিন্তু বাকি সবটা জুড়ে দুনিয়া, দুনিয়া, দুনিয়া। আখেরাতের আলোচনা নেই। আল্লাহকে সযত্নে সরিয়ে রাখে। কুরআন মজীদে সে কথাই বলা হয়েছে। যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে না, তাদের সামনে যখন আল্লাহর আলোচনা হয় তখন তাদের দিলটা সংকুচিত হয়ে যায়। অর্থাৎ আল্লাহর নাম পছন্দ হয় না। অন্যদিকে আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কথা বললে তখন তারা খুব খুশি। কী আজীব আয়াত। এই যামানায়ও এরকম। আল্লাহর নাম নিলেই বেজার, আল্লাহর নাম না নিয়ে ন্যাচার [প্রকৃতি] বললে খুব খুশি। আজকাল এক নতুন শব্দ বের হয়েছে ইন্টেলিজেন্ট ইউনিভার্স। বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মহাবিশ্ব। স্রষ্টার উপর যেহেতু বিশ্বাস নেই তাই ইন্টেলিজেন্ট ইউনিভার্স। বুদ্ধিমান মহাবিশ্ব। আল্লাহর মোকাবেলায় কতকিছু দাঁড় করিয়েছে। আল্লাহ বলেন, আমার সঙ্গে মোকাবেলা দাড় করায়। যখন আমার কথা বলা হয় তখন ভাল লাগে না। আর যখন আমার সঙ্গে শরীক করে অন্যান্য জিনিসের কথা বলা হয়, তখন তারা খুব খুশি। সারা দুনিয়াতে এভাবে চলছে।

আল্লাহ পাকের কালামে তাদের সম্পর্কে বলেছেন, এর আগে ওরা ছিল আমার আদরের দুলাল। দুনিয়াতে যত বড় লোক- চেয়ারম্যান, কমিশনার, সেক্রেটারি, প্রফেসর, যত লোক দুনিয়ার মধ্যে সেরা, তাদের নাম কুরআন শরীফে দিয়েছে مترفين আদরের দুলাল। কী আজীব শব্দ! আল্লাহ বলেন, তোরা আমার আদরের দুলাল। আর তোরা আমার নাফরমানি বেশি করিস। নবীদের সঙ্গে, আখেরাতের সঙ্গে, ঈমানের সঙ্গে, সবচেয়ে উল্টামত করে কারা? আল্লাহ পাক বলেন, আমার আদরের দুলালেরা। তারা কী করে? আমার বড় বড় নাফরমানি করে আর সে কথা বুক ফুলিয়ে বলে। অপূর্ব ভঙ্গিতে আল্লাহ পাক কালামে পাকে এগুলো বলেছেন। মানুষ কেন নাফরমানি করে? এ কথাটাও আল্লাহ পাক বলে দিয়েছেন সূরা আলাকে। আপনারা জানেন যে, কুরআনের মধ্যে এই সূরার প্রথম পাঁচ আয়াতই সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছে। সেই সূরায় আল্লাহ পাক বলেছেন, মানুষ এরকম নাফরমানি কেন করে? অহমিকা কেন করে? এত গর্ব কেন করে? একটাই কারণ, সে মনে করে আমার কীসের ঠেকা। আমার তো সবকিছু আছে। টাকা-পয়সা আছে, বাড়ি-গাড়ি আছে। এই অহমিকায় অন্ধ হয়ে বলে, নামায পড়লে টাকা আসবে মিয়া? যারা পড়ে তারাও জামাতে যায় না, জামাতের খবর নেই।

আল্লাহ তাআলা আখেরাতের বিষয়ে মানুষকে সজাগ করেছেন এবং বলেছেন, প্রত্যেকেরই চিন্তা করা উচিত আগামী কালের জন্য সে কী পাঠাল। অর্থ হল, তোমরা আগামীকালের জন্য পাঠাও। অন্য জায়গায় বলেন, তোমাদের নিজেদের জন্য আগে থেকে পাঠাও। মওতের আগে দুনিয়ায় থাকতেই পাঠাও। পাঠানোর জিনিস কী? পাঠানোর জিনিস হল নেক আমল।

আমাদের এই মজলিস আল্লাহ কবুল করেন। মজলিসের মধ্যে দ্বীনী বিষয় আলোচনা করা হয়। অন্তর যদি আল্লাহর দিকে রুজু হয়; আখেরাতের দিকে রুজু হয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের দিকে রুজু হয়, তাহলে সে আসুক আমাদের মজলিসে। মজলিসের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য এটা। আমাদের হযরত মাওলানা আবরারুল হক [রহ.] বলতেন, এ ধরনের মজলিস বেশি বেশি কর, বিভিন্ন জায়গায় কর, তিনি কুরআন শরীফের ওই আয়াত বলতেন-

وَذَكِّرْ فَإِنَّ الذِّكْرى تَنْفَعُ الْمُؤْمِنِينَ

আপনি বারবার আলোচনা করুন। বারবার নসীহত করুন। নিশ্চই বারবার বলা ঈমানদারকে উপকৃত করবেই করবে। এ জন্য তিনি বলতেন, এ ধরনের মজলিস ঘরে ঘরে কর।

একটা কথা বলি, এ ধরনের মজলিস বেশি বেশি করার পথে একটি বড় বাধা হল খানাপিনার আয়োজনের দিকে মনোযোগ দেওয়া। এই আয়োজন করতে গেলেই মজলিস বেশি করা যায় না। আমার এক দোস্ত আছে যার বাড়িতে মজলিস করলে তিনি এসব আয়োজন করবেনই। গরুর গোশত, খাশির গোস্ত, মুরগির গোশত আরো কত কি! যতই বলি মানে না। এটা হল সি। প্রথমে হল এ প্লাস, তার পরে এ, তার নিচে এ মাইনাস, তার নিচে বি প্লাস, তার নিচে বি, তার নিচে বি মাইনাস, তার নিচে সি। এ কাজটাই হল সি। আমাদের হযরত মাওলানা আবরারুল হক [রহ.] বারবার বলতেন, আল্লাহর কথা বল, দ্বীনের কথা বল, বিসমিল্লাহর কথা বল, সুন্নতের কথা বল। কত বলতেন, সালাম ঠিক কর। প্রতিদিন সালাম দাও। তোমাদের সালাম ঠিক নাই। তোমরা বল, সালামালাইকুম। এভাবে সালাম বললে নম্বর কম। বলতে হবে আসসালামু আলাইকুম। এই আল্লাহর ওলী এই বুনিয়াদি কথাগুলোই বারবার বলতেন।

৮১ সনে হাফেজ্জী হুজুর [রহ.]-এর দাওয়াতে বাংলাদেশে প্রথম আসলেন, আর সবশেষে আসলেন ২০০৪এর ডিসেম্বরে। মোট ২৪ বছর আল্লাহ তাঁকে ঢাকা দেখার সৌভাগ্য দিয়েছেন। বাংলাদেশে বিভিন্ন শহরে তাঁর সঙ্গে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁর বাড়ি হারদুঈতে তাঁকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। মক্কায়, মদীনায় দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সব জায়গায় আল্লাহর ওলী ওই বুনিয়াদি কাজের কথাগুলোই বারবার বলতেন- সালাম অশুদ্ধ হলে সওয়াব কম হবে। এই সালামে যে পরিমাণ রহমত ও বরকত পেতে তা কমে যাবে। বেশি রহমত বেশি বরকত পাওয়ার উপায় হল, এটাকে শুদ্ধ করে বলা। হারদুঈতে গেলে ছাত্ররা আমাদের মুখোমুখি বসে, আর বলে একটু শুদ্ধ করে সালাম বলুন, আমরা বলি সালামালাইকুম। এরপরে বলে এবার শুদ্ধ করে বলুন, আমরা বলি আসসালামু আলাইকুম। এটা হযরতের তালীম। আল্লাহু আকবার! কী কাজ করেছেন মাওলানা আবরারুল হক [রহ.]!

হাফেজ্জী হুজুর [রহ.] কথা কম বলতেন, কিন্ত এমন এক ভাই তিনি এনে দিয়েছেন, যিনি অনেক্ষণ কথাই বলতেন। কথাই বলতেন। সালাম ঠিক করে দাও। আসসালামু আলাইকুম বল। সালাম বেশি দাও। তোমরা মুখ চিনে চিনে সালাম দিয়ে থাক। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখ চিনে সালাম দিতে বলেননি। আপনি আজকে মনে করে দেখুন তো কয়জনকে সালাম দিয়েছেন যাদের আপনি চেনেন না। যত সালাম দিয়েছেন সবাই পরিচিত মানুষ। দেখেন তো ঠিক কি না? অপরিচিত যাদের সাথে রাস্তায় দেখা হয় এমন কয়জনকে সালাম দিয়েছেন, গুনে বের করলে পাওয়া যাবে না। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিচিত অপরিচিত সবাইকে সালাম দেওয়ার কথা বলেছেন। অথচ আমরা বাড়িতে সালাম দেই না, বউকে দেই না, মাকে দেই না।

তিনি আরও বলতেন যিকিরের কথা। নিচে নামতে সুবহানাল্লাহ, সুবহানাল্লাহ বল। হযরতের কথা বিস্তারিত। হাফেজ্জী হুজুরের কথা ছিল সংক্ষিপ্ত। তিনি বলতেন, এমনভাবে থাকেন যেন সামান্য সময়ও আল্লাহর যিকির থেকে শূন্য না যায়। তিনি নিজেও এমন ছিলেন। এটা হল সংক্ষেপ। মাওলানা আবরারুল হক [রহ.] বলতেন, নিচে নামতে বলবে সুবহানাল্লাহ, সুবহানাল্লাহ। আর উপরে উঠতে আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। আবার বলতেন, কেউ যদি ভুলে নিচে নামার সময় আল্লাহু আকবার বলল, তাহলেও সওয়াব পাবে। এটাও তো আল্লাহর যিকির। তাবে উত্তম হল নিচে নামতে সুবহানাল্লাহ, উপরে উঠতে আল্লাহু আকবার।

তিনি আরও বলতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যবানে যিকির বিভিন্ন ধরনের হত। এগুলো হল মৌলিক যিকির। আর কতগুলো হল বিশেষ অবস্থার যিকির। ঘুম থেকে উঠেছেন, তখন আল্লাহর যিকির হল এই দুআ পড়া-

الحمد لله الذي أحيانا بعد ما أماتنا وإليه النشور

সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে জীবিত করলেন। আমি তো রাতে মরেই গিয়েছিলাম। কুরআনের ভাষায় এটাকে এভাবে বলা হয়েছে-

الله يتوفى الأنفس حين موتها والتي لم تمت في منامها.

আল্লাহ তাআলা তোমাদের রূহকে কবয করে নেন মওতের সময়, আর যারা জীবিত থাকে তাদের রূহ কবয করেন ঘুমের সময়। কুরআনের শব্দ- আল্লাহ আমাদের রূহ নিয়ে যান। লোকে কয়, তাহলে আমাদের বুকে যে ধুকধুক করে। এটা আল্লাহ পাকের কুদরত। বুক ধুকধুক ঠিকই করে। হার্টবিট ঠিকই চলে। শরীরের সব কাম-কাজ চলে। কিন্তু আপনি নেই। কয়, কেমনে? বেশি বুঝার দরকার নেই। এতটুকুই বোঝেন। কেননা রূহ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেই দিয়েছেন, রূহ কী ওরা জিজ্ঞাসা করে। আল্লাহ পাক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জওয়াব দেন, তুমি এভাবে জবাব দাও- قل الروح من امر ربي রূহ হল আমার মাবুদের হুকুম। কী বুঝলাম? কিছুই বুঝিনি। আল্লাহ নিজেই বলেন, জ্ঞানের অতি সামান্যই তোমাদের দেওয়া হয়েছে। আর বুঝবে না, এই পর্যন্তই বুঝ।  এই রূহ যার কারণে আমরা মানুষ। রূহ গেলেই তার নাম মওত। আল্লাহ বলেন, আল্লাহই রূহ নিয়ে যান, মৃত্যুর সময়। আর যারা মরছে না তাদের ঘুমের সময়। অর্থাৎ প্রতিদিনের ঘুমের সময় আল্লাহ আমাদের রূহ নিয়ে যান। ছেলে-মেয়েরা ডেকে বলে, আববা ওঠেন, আম্মা ওঠেন। মা-বাবা ওঁহ, উহ শব্দ করেন। এই যে এখন রূহ ফিরে আসছে। রাসূলের শেখানো দুআর মধ্যে এ কথাটা রয়েছে। রাসূলের দুআগুলো এত অপূর্ব। প্রথমে বলেছেন, তিনি আমাদেরকে জীবিত করেছেন, আমাদের মৃত্যু দেওয়ার পর। এবারের শেষ কথা যেটা, সেটা অদ্ভুত। وإليه النشور এভাবে একদিন কবর থেকে তার সামনে কিয়ামতের মাঠে হাজির হব। প্রতিদিনের ঘুম থেকে ওঠার দুআয় এ কথা বলার কী দরকার ছিল?

আমার এক বন্ধু, যার নাম ড. সুলায়মান মেহেদি, এক আজীব ইনসান। এখনও আছেন, জিদ্দায় থাকেন। আমাদের সঙ্গে ফার্স্ট হয়েছিলেন। ১৯৫৫তে সারা পূর্বপাকিস্তানে এক সাথে পরীক্ষা। সেখানে তিনি তৃতীয় হয়েছিলেন। আই.এস.সি-র সময় ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট হয়েছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ফার্স্ট হয়েছিলেন। তিনি আমাকে আজ থেকে ২০ বছর আগে বলেছিলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুআগুলো সম্পর্কে কেউ যদি যত্ন করে গবেষণা করে তাহলে তার অন্তর সাক্ষ্য দেবে যে, কোনো মানুষ এরকম দুআ রচনা করতে পারে না। আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার! কিন্তু তিনি আলেম-ওলামার ধারে কাছে আসেন না। তার নিয়ম হল, তিনি একাএকা পড়াশোনা করবেন। কুরআন নিয়ে পড়াশোনা করবেন। তিনি বুয়েটে ছিলেন ৭৫ সাল পর্যন্ত। পরে চলে গেছেন সৌদি আরবে। একদিন তিনি আমাকে বললেন, তুমি এই আয়াতটা খেয়াল করেছ? আমি বললাম, কোন আয়াত? তিনি বললেন-

الذي جعل لكم من الشجر  الاخضر نارا

সূরা ইয়াসিনের আয়াত। তিনি তোমাদের জন্য সবুজ গাছের মধ্যে থেকে আগুন বানিয়েছেন। তিনি আমাকে বললেন, হামিদ, আল্লাহ পাক এই কথা কেন বললেন- الشجر الاخضر সবুজ গাছ। এটা বলার দরকার কী? শুধু গাছ বললেই তো হত, সবুজ শব্দ কেন? তিনি বললেন, এখন বিজ্ঞান বলে, সবুজ শব্দটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। সবুজ না হলে গাছ খাদ্য তৈরি করতে পারত না। যারা বিজ্ঞান পড়ে তারা জানে, গাছের খাদ্য তৈরির এই প্রক্রিয়ার নাম ফটোসিনথেসিস (PHOTOSYNTESIS) বাংলায় সালোকসংশ্লেষণ। সালোক-সংশ্লেষণের জন্য প্রধান আইটেম হল সবুজ ক্লোরোপ্লাস্ট। সবুজ রঙবিশিষ্ট এই জিনিস অনুবীক্ষণ যন্ত্রে পরিষ্কার দেখা যায়। ক্লোরোপ্লাস্ট হল কারখানা। এ কারখানার কাঁচামাল হল এক নম্বরে সূর্যের আলো। আকাশ থেকে সূর্যের আলো আসে, বাতাস থাকে কার্বনডাইঅক্সাইড, যা আমরা প্রশ্বাসে ছাড়ি। এই কার্বনডাই অক্সাইডও কাঁচামাল। জমিন থেকে গাছ নেয় পানি। এটা হল তিন নম্বর কাঁচামাল। আর আসল কারখানা ক্লোরোপ্লাস্ট। এটা গ্লুকোজ তৈরি করে, যেটা খাদ্য। এই খাদ্যের কারণে পাতাটা বড় হয়। গাছ নিজের খাদ্য নিজেই তৈরি করে। কী অপূর্ব কুদরত আল্লাহর! সারা দুনিয়ার যত গাছ, যত খাদ্য- ধানগাছ, গমগাছ সবই তো জমিন থেকে বের হয়। এ কথা আল্লাহ পাক বলেছেন, তোমাদের কোন সাধ্য নেই এই পাতাটা বের করার। এই পাতাটা বের করে কে? আল্লাহ। এখন বিজ্ঞান বলে, এই পাতার মধ্যে যে সবুজ রং আছে, এর কারণেই বাতাসের কার্বনডাই অক্সাইডের কার্বনটা যায়। যত খাবার তাতে কার্বন আছে। আমরা ছেলেদের পরীক্ষা করে দেখাই, তুমি একটুখানি লবণ নাও। তাওয়ার মধ্যে দাও। গরম কর। যত গরম করবে লবণ সাদাই থাকবে। কিন্তু চিনি নাও, তাওয়ার মধ্যে দাও, কতক্ষণ পরে দেখবে কয়লা হয়ে পড়ে আছে। এভাবে গাছের পাতা নাও, ধান নাও, ভাত নাও, মাছ নাও, গোশত নাও সব কিছুর মধ্যে কার্বন আছে। লবণে কার্বন নেই। আপনি যত খুশি গরম করেন দেখবেন লবণ সাদাই সাদা। এক বিন্দুও রং পাল্টাবে না। কারণ কী? কারণ হল লবণের মধ্যে কার্বন নেই। চিনির মধ্যে কার্বন আছে, গোশতের মধ্যে কার্বন আছে, মাছের মধ্যে কার্বন আছে, ধানের মধ্যে কার্বন আছে, গমের মধ্যে কার্বন আছে। কার্বন আসল কোত্থেকে? বাতাস থেকে এসেছে। এসেছে কীসের জন্য? সবুজ রংয়ের জন্য। তিনি আমাকে বললেন, হামিদ, তুমি চিন্তা করেছ আল্লাহ পাক একথা কেন বলেলেন-الشجر الاخضر কারণ আগুনের জন্য কার্বন লাগবে। কার্বন ছাড়া হবে না। আগুনের কথা আল্লাহ আমাদের বলেছেন-

اانتم انشأتم شجرتها ام نحن المنشؤون

আগুনের গাছ তোমরা বানাও নাকি আমি বানাই?

এই আল্লাহর বান্দা কুরআন শরীফ অপূর্ব পড়া পড়ে, অপূর্ব চিন্তা করে। কিন্তু কোনো আলেমের ছোহবতে যায় না। গত বছর আমি জেদ্দায় গিয়েছিলাম, তাকে কত সাধাসাধি করলাম আসার জন্য কিন্তু আসল না। কিন্তু আজীব তার কথাবার্তা। সে বলে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুআগুলো নিয়ে কেউ যদি আলোচনা করে, তার মন সাক্ষ্য দেবে, কোনো মানুষ নিজে নিজে এই দুআ রচনা করতে পারে না। আরেকটি দুআ দেখুন। খাবার শেষের দুআ-

الحمد لله الذي أطعمنا وسقانا وجعلنا من المسلمين

সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে খাওয়ালেন, পান করালেন এবং যিনি আমাদের মুসলমান বানিয়েছেন।

হযরত মাওলানা আবরারুল হক [রহ.] আমাদের গল্প শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমার বয়স যখন দশ-এগার, তখন আমি আমার আববাজানের সাথে হাকীমুল উম্মতের কাছে গিয়েছিলাম। সেখানে খাওয়া-দাওয়ার পর খানার দুআ সম্পর্কে আলোচনা হল। আমার আববাজান হাকীমুল উম্মতকে বললেন, হযরত, খাওয়ার পর একথা বলা যে, সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে খাওয়ালেন, পান করালেন- এটা তো বুঝে আসল, কিন্তু যিনি আমাদের মুসলমান বানিয়েছেন-এ কথাটা এখানে কেন আনা হল? খাবারের সাথে এর কী সম্পর্ক? একথা শুনে হাকীমুল উম্মত বললেন, এটা তো আলেমদের বলার কথা, আলেমরা এসব বিষয় তাহকীক করবে। হযরত নিজে আবার মাঝখানে টীকা লাগালেন, আমার আববাজান যদিও একজন বিখ্যাত এ্যাডভোকেট ছিলেন, তবে তিনি ছিলেন হযরতের খলীফা- মুজাযে সোহবত। আলেমদের মধ্যেই ছিলেন। এরপর বলেন, হাকীমুল উম্মত বললেন, দুনিয়ার সবচেয়ে সহজবোধ্য দুই নেয়ামতের একটি হল ক্ষুধার সময় খাদ্য, দ্বিতীয়টি হল পিপাসার সময় পানীয়। এই দুইটা নেয়ামত বুঝতে পারে না এমন কোন মানুষ নেই। এই দুই সহজবোধ্য নেয়ামতের সাথে আল্লাহ তাআলার সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত ঈমানের কথা উল্লেখিত হয়েছে। অথচ মানুষের স্মরণেও আসে না যে, আল্লাহ তাআলা আমাদের মুসলমান বানিয়েছেন। যতবার খাওয়া-দাওয়া করি যদি রাসূলের দুআটা পড়ি, তাহলে আল্লাহ পাক আমাদের যে ঈমান দিয়েছেন, সবচেয়ে বড় নেয়ামত দিয়েছেন, এর জন্যও শুকরিয়া আদায় করা হল।

গাড়িতে চলার দুআতো কুরআন মজীদে এসেছে-

سبحان الذى سخر لنا هذا وما كنا له مقرنين وانا الى ربنا لمنقلبون.

সমস্ত গৌরব, সমস্ত প্রশংসা, সমস্ত পবিত্রতা আল্লাহর জন্য, যিনি এই বাহনকে আমাদের অধীন করে দিয়েছেন। আমাদের সেবায় নিয়োজিত করে দিয়েছেন। আমাদের কোনোই সাধ্য ছিল না এটাকে এভাবে আমাদের কাজে লাগানোর। এর পরের কথাটা লক্ষ্য করুন। কথাটা এই যে, নিশ্চয় আমরা আমাদের রবের কাছে ফিরে যাব। আজ যাচ্ছি আজিমপুর থেকে মুহাম্মাদপুর। একদিন যাব কোথায়? আখেরাতের সফরে। গাড়িতে চড়তে ওই একই কথা আখেরাতকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়।

ঘুমাতে যাবেন, ঘুমানোর দুআ দুইটা আছে। আরো থাকতে পারে। মাওলানারা জানবেন। একটা হল-

اللهم باسمك أموت وأحي

আরেকটা বড় দুআ-

بإسمك ربي وضعت جنبي وبك أرفعه إن أمسكت نفسي فارحمها وإن أرسلتها فاحفظها بما تحفظ به عبادك الصالحين.

হে আল্লাহ, আমার এই পার্শ্বদেশকে বিছানার মধ্যে লাগালাম আপনার নামের উপর। আপনার জন্য আবার আমি উঠব। যদি আজ রাতে আপনি আমার রূহ কবয করেন, তাহলে তাকে রহম করুন। আর যদি তাকে ছেড়ে দেন তবে তাকে সেভাবেই রক্ষা করবেন যেভাবে নেককারদের রক্ষা করে থাকেন।

কীভাবে প্রতিটি দুআর মধ্যে আখেরাতের কথা নিয়ে এসেছেন। মাওলানা আবরারুল হক [রহ.] বারবার প্রতিদিনে প্রতিক্ষণে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র অভ্যাস, পবিত্র উচ্চারণ ওই মূল যিকিরগুলো সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং বিভিন্ন আমালের সময় যে দুআগুলো ওইগুলোর জন্য খুব বেশি তাকিদ করতেন। খাবারের বিভিন্ন দুআ আমরা পড়তাম।

اللهم أطعم من أطعمني واسق من سقاني

পড়তাম। কিন্তু হযরত এসে আরেকটা দুআ শেখালেন। কারো বাড়িতে মেহমান হলে মেজবানের জন্য এই দুআ করবে-

أكل طعامكم الأبرار وصلت عليكم الملائكة وأفطر عندكم الصائمون

হযরতের ওখানে আমরা নাস্তা খেলে হযরত বলতেন-

وہ دعا پرہو

এই দুআয় মেহমান মেজবানের জন্য দুআ করছে। অর্থ হল আপনার বাড়ির খানা যেন আল্লাহর নেক বান্দারা খায়, ফেরেশতারা যেন আপনার জন্য দুআ করে এবং রোযাদার ব্যক্তিরা যেন আপনার ঘরে ইফতার করে।

রোগী দেখার দুআ আছে। রোগী দেখতে যায় হাজার হাজার মানুষ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটা সুন্নত এখানে পালিত হয়। অসুস্থ মানুষকে দেখতে হাসাপাতাল লোকে ভর্তি। ছেলে-মেয়ে ছোট-বড় অনেকে যায়। কিন্তু পর্দার কোনো খবর নেই। কাজেই এখানে এ গোনাহের কাজ অনেক হয়। আর এ সময়ের দুআ কেউ পড়ে না। হযরতকে দেখতে গেলে সাতবার এই দুআ পড়তে হয়। অপূর্ব দুআ-

أسأل الله العظيم رب العرش العظيم أن يشفيك

আমার মক্কা শরীফে একটি অভিজ্ঞতা হল আজ থেকে বছর খানেক আগে। এক মাওলানা সাহেবের আববা অসুস্থ ছিলেন, তিনিও দেওবন্দের আলেম। দেখতে গেলাম, আমি তার জন্য দুআ পড়ছি-

أسأل الله العظيم رب العرش العظيم أن يشفيك

তিনি বলেন আমীন। তিন বাক্যে একবার। সাতবার পড়তে মোট একুশ বাক্যের সময় লাগে। ইতিমধ্যে ওই দল হাজির হয়েছে। আমীর সাহেব বাংলাদেশের বিখ্যাত আলেম, বড় খতীব। নাম বললে অনেকে চিনে ফেলবেন। হাফেজ সাহেব মাওলানা সাহেব মুহাদ্দিস সাহেব। তিনি শেষ দুইবার শুনে পাশে দাঁড়ালেন। আমাকে বললেন, প্রফেসর সাহেব, আপনি এই দুআ কোথায় পেলেন? আমি বললাম, আমাদের মাওলানা আবরারুল হক সাহেব শিখিয়েছেন। তিনি বললেন দেখেন, এই দুআ আমি হাদীসে কতবার পড়িয়েছি, কিন্তু আমলের সৌভাগ্য হয়নি। তিনি অকপটে বিনয় প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, আপনারা হাদীস পড়েননি, কিন্তু মাওলানা আবরারুল হক সাহেবের ওসীলায় আমল করতে পেরেছেন। এই আল্লাহর বান্দা তার অকল্পনীয় নম্রতা অকপটে স্বীকার করলেন। হযরত মাওলানা আবরারুল হক সাহেব [রহ.] আমাদেরকে শিখিয়েছেন, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতকে যিন্দা কর। আমরা বলে থাকি, সুন্নত-নফল না পড়লে গোনাহ নেই। অথচ আল্লাহ পাকের ওলী হওয়ার জন্য ওইগুলি সবচেয়ে দামি। দুনিয়াতে কয়টা কাজ আছে যা আমাদের জন্য জরুরি। অফিস টাইমের বাইরে বাকি সময়গুলো কী করি আমরা? খবরের কাগজ পড়ি। এটা পড়া কি ফরয? এটা পড়লে কোনো কাজ হবে? কোনো পয়সা কামাইও হবে না, অথচ আমরা কীভাবে পড়ি। কীভাবে আমরা ম্যাগাজিন পড়ি? কীভাবে নাউযুবিল্লাহ টিভির দিকে চেয়ে চেয়ে দেখি। বললে আবার কয়, আপনারা টিভি দেখতে নিষেধ করেন, তাহলে কি আপনারা আমাদেরকে মধ্য যুগে নিয়ে যাবেন? জ্বী না, আমরা মধ্য যুগে নিতে চাই না, আপনাদেরকে জান্নাতের দিকে নিয়ে যেতে চাই।

আপনার কাছে যতই আধুনিকতা মনে হোক, মাওলানা আবরারুল হক সাহেবের পরিষ্কার কথা, টিভি হল সাপের বাক্সা। এটা এমন সাপের বাক্সা যেটা তোমাকে দোযখে নিয়ে যাবে। দুনিয়াতে সাপে কামর দিলে কোনো মাওলানা বলবে না, তোমাকে দোযখে যেতে হবে। কিন্তু টিভির বাক্সা তোমাকে দোযখে নেবে। মাওলানা আবরারুল হকের বিখ্যাত কথা গোনাহ ছাড়, সুন্নত ধর। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।

 

 

advertisement