শাবান-রমযান-১৪৪১   ||   এপ্রিল- মে ২০২০

প্রসঙ্গ : করোনা ভাইরাস
আলিমদের নির্দেশনা মেনে ঘরে থাকুন

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ

ইসলাম আমাদের যে কোনো পরিস্থিতির শান্ত ও সঠিক মূল্যায়নে উৎসাহিত করে। পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করণীয় সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বশর্ত। বর্তমানে যে বৈশ্বিক মহামারির পরিস্থিতি  তৈরি হয়েছে নিঃসন্দেহে তা ভয়াবহ। এ অবস্থায় কোনোরূপ ভাবাবেগের অনুগামী না হয়ে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের দেওয়া শরয়ী নির্দেশনার উপর আমল করা অতি প্রয়োজন।

মুসলিমমাত্রেরই দৃঢ় বিশ্বাস, আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য যা লিখে রেখেছেন তা-ই ঘটবে। এর বাইরে কিছুই ঘটবে না। এই বিশ্বাস আমাদের ঈমানের অংশ। ইসলাম আমাদের এই ঈমানী শিক্ষা দান করেছে। একই সাথে যথাসাধ্য সতর্কতা অবলম্বন ও উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনাও প্রদান করেছে।

এই বিশ্বাস ও কর্ম-পন্থার সমষ্টিই হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা। সাহাবা তাবেয়ীন ও সালাফে সালেহীনের নীতি ও কর্মপন্থাও তাই। বিশ্বাস ও কর্মের এই সমন্বিত আদর্শ অনুসরণ করাই মুমিনের বৈশিষ্ট্য। নিঃসন্দেহে এটি তাকওয়া। তাকওয়ার মূল কথাই হচ্ছে আল্লাহর ভয় এবং যে অবস্থায় শরীয়তের যে নির্দেশনা তার অনুসরণ। শরীয়তে সাধারণ অবস্থায় যেমন সাধারণ বিধান রয়েছে তেমনি বিশেষ অবস্থায় আছে বিশেষ বিধানও। এটি শরীয়তের সৌন্দর্য ও অনন্য বৈশিষ্ট্য।

শরীয়তের বিধান ও নির্দেশনার ভেতরে থেকে বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা ও যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা কিছুতেই তাকওয়া ও তাকদীরে-বিশ্বাসের পরিপন্থী নয়। মনে রাখতে হবে, তাকওয়া অর্থ বেপরোয়া হওয়া নয়, তাকওয়া অর্থ শরীয়তের নির্দেশনা পালনে সক্ষম হওয়া। আর এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ও হক্কানী উলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্তই অনুসরণীয়।

দ্বীনদারী রক্ষা যেমন শরয়ী বিধি-বিধানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তেমনি দ্বীনদারীর সাথে জান-মালের সুরক্ষাও শরীয়তের বিধি-বিধানের অন্যতম লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। এ সম্পর্কেও আমাদের ফকীহগণ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং বিভিন্ন ফিকহী নীতি প্রণয়ন করেছেন। বিশদ আলোচনায় না গিয়ে এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে শুধু একটি ঘটনা আলোচনা করছি।

খলীফায়ে রাশেদ হযরত ওমর ফারূক রা.-এর ঘটনাটি অনেকেরই জানা আছে। সংক্ষেপে তা এই যে, সাহাবায়ে কেরামের এক জামাতসহ তিনি যখন শামের নিকটে পৌঁছে সংবাদ পেলেন যে, ওখানে মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে তখন মুহাজির, আনসার ও অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের সাথে করণীয় নির্ধারণের বিষয়ে পরামর্শ করেন। পরামর্শে উপদ্রæত অঞ্চলে প্রবেশ করা ও না-করা দুই রকমের মতই এল। রেওয়ায়েতে আছে যে, ওমর রা. প্রথমে মুহাজির সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করেছিলেন। তাদের পক্ষ হতে দুই রকম মত আসে। এরপর আনসার সাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করেন। তাদের পক্ষ হতেও দুই রকম মত আসে। এরপর অন্যান্য বিচক্ষণ ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করেন। তারা একমত হয়ে উপদ্রæত অঞ্চলে না যাওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর ওমর রা. ঘোষণা করেন যে, তিনি মদীনায় ফিরে যাচ্ছেন।

এ সময় বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা. এর সাথে তাঁর যে কথোপকথন হয়েছিল তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ তাঁকে বললেনÑ

أَفِرَارًا مِنْ قَدَرِ اللَّهِ؟

আল্লাহর তাকদীর থেকে পলায়ন করে মদীনায় ফিরে যাচ্ছেন?

হযরত ওমর রা. বললেনÑ

لَوْ غَيْرُكَ قَالَهَا يَا أَبَا عُبَيْدَةَ؟ نَعَمْ نَفِرُّ مِنْ قَدَرِ اللَّهِ إِلَى قَدَرِ اللَّهِ، أَرَأَيْتَ لَوْ كَانَ لَكَ إِبِلٌ هَبَطَتْ وَادِيًا لَهُ عُدْوَتَانِ، إِحْدَاهُمَا خصبَةٌ، وَالأُخْرَى جَدْبَةٌ، أَلَيْسَ إِنْ رَعَيْتَ الخَصْبَةَ رَعَيْتَهَا بِقَدَرِ اللَّهِ، وَإِنْ رَعَيْتَ الجَدْبَةَ رَعَيْتَهَا بِقَدَرِ اللَّهِ؟

হে আবু উবাইদা! কথাটি যদি আপনি ছাড়া অন্য কেউ বলত! জ্বী, আমরা আল্লাহর তাকদীর থেকে আল্লাহর তাকদীরের দিকেই পলায়ন করছি। দেখুন, আপনার উটের পাল যখন কোনো চারণভমিতে নামে, এর এক পার্শ্বে যদি তৃণলতাপূর্ণ সজীব ভমি থাকে, অন্য পার্শ্বে থাকে বিরাণভমিতখন আপনি সজীব ভমিতে সেগুলোকে চরানোর ব্যবস্থা নিলে তা কি আল্লাহর তাকদীরের কারণেই নয়? ....... সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৭২৯

অর্থাৎ যথাসময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত ও যথার্থ ব্যবস্থাগ্রহণে সক্ষম হওয়াও তাকদীরের অন্তর্ভুক্ত। নিঃসন্দেহে তাকদীরে যা আছে তাই ঘটবে, কিন্তু মানুষের জানা নেই কী তার তাকদীরে আছে। তাকদীরে ভালো থাকলে ভালোর উপযোগী সিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণই তার জন্যে সহজ হবে।

অতএব যথাসময়ে সঠিক করণীয় সম্পর্কে সচেতন হয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম হওয়াও একটি লক্ষণ যে, সম্ভবত তার পক্ষে আল্লাহর ফয়সালা ভালো।

বান্দার কর্তব্য, বিচক্ষণতার সাথে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা এবং জান-মাল, ইজ্জত-আব্রæ ইত্যাদি রক্ষার ক্ষেত্রেও শরীয়ত-প্রদত্ত প্রশস্ততা গ্রহণে সচেষ্ট হওয়া। এটিও আল্লাহর পক্ষ হতে কল্যাণ-প্রার্থনার ও কল্যাণের প্রতি মুখোপেক্ষিতা প্রকাশের অন্যতম উপায়। তবে হাঁ, নীতিটি বলতে বা শুনতে যত সহজ বাস্তব ক্ষেত্রে এর সঠিক প্রয়োগ তত সহজ নয়। এর জন্যে বিজ্ঞ ও মুত্তাকী আলিমের দিক-নির্দেশনা অতি প্রয়োজন।

* * *

উপরোক্ত নীতির আলোকে আমরা বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে পারি। আমরা ইতিমধ্যে দেখছি যে,

এক. করোনা ভাইরাসটি গোটা পৃথিবীতে ভয়াবহ মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাও বিশ্বজুড়ে অচিন্তনীয়ভাবে বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশেও আক্রান্তের হার বাড়ছে ( আল্লাহ তাআলা হেফাযত করুন।)

দুই. বিষয়টির প্রকৃতি ও ভয়াবহতাও ইতিমধ্যে আলোচনায় এসেছে। বিষয়টি বোঝার দুটি উপায় রয়েছে,

ক. সাধারণ বিচার-বুদ্ধি এবং  খ. বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত।

সাধারণ বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ একটু চিন্তা করলেই বিষয়টির ভয়াবহতা বুঝতে পারবেন। পৃথিবীর দেশে দেশে একের পর এক লকডাউন ঘোষিত হয়েছে। কয়েকটি উন্নত রাষ্ট্রেও প্রথম দিকে এই ভাইরাস স্বল্পমাত্রায় ও মন্থরগতিতে ছড়ালেও একটা পর্যায়ে এসে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। কোথাও কিছুটা নিয়ন্ত্রণেএসেছে কোথাও এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

সৌদি আরবেও পূর্ণ লক ডাউন সত্তে¡ও আক্রান্তের হার বেড়েই চলেছে। আমাদের দেশে এখনও আক্রান্তের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম হলেও ক্রমেই তা বাড়ছে। (আল্লাহ হেফাযত করুন।)

ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের নাগরিকেরা বাংলাদেশ ছেড়েছেন।

খ. উপরোক্ত বিষয়গুলোর পাশাপাশি ধর্মপ্রাণ চিকিৎসক, অণুজীব বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও ভাইরাসটির ধরন ও বিস্তারের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাদের সম্মিলিত বক্তব্য ও মতামতকে উপেক্ষা করা উচিত নয়। শরীয়তে প্রত্যেক বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভারসাম্যপূর্ণ মূল্যায়ণের নীতি ও নির্দেশনা আছে।

তিন. সব ধরনের জমায়েত থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি জুমা-জামাতের প্রসঙ্গটিও আলোচনায় এসেছে।

জুমা-জামাতের দুটো দিক রয়েছে। এক. সাধারণভাবে মসজিদে জুমা-জামাত কায়েম থাকা।  দুই. ব্যক্তিগতভাবে জুমা-জামাতে শামিল হওয়া।

মসজিদ, মসজিদের আযান, জামাত, জুমা এগুলো যেহেতু ইসলামের শিআর ও নিদর্শন তাই ন্যূনতম পর্যায়ে হলেও যথাসাধ্য তা কায়েম রাখার চেষ্টা করা কাম্য।

আর প্রত্যেক ব্যক্তির জুমা-জামাতে শামিল হওয়ার প্রসঙ্গে সাধারণ অবস্থায় ওজরহীন সাবালক পুরুষের জন্য মসজিদের জামাতে শামিল হওয়া বিশেষভাবে কাম্য হলেও বিশেষ অবস্থা ও পরিস্থিতিতে এর ব্যতিক্রমও হতে পারে।

চার. বর্তমান পরিস্তিতিতে জুমা-জামাত বিষয়ে মুসল্লীদের করণীয় সম্পর্কে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাও এসে গেছে।

একটি জাতীয় দৈনিকের ইসলামী পাতায় মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার আমীনুত তালীম হযরত মাওলানা আব্দুল মালেক ছাহেবের সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তাঁর বক্তব্যের সারসংক্ষেপ এভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

বাংলাদেশে বর্তমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে সব ধরনের জমায়েত বন্ধের পাশাপাশি মসজিদগুলোয় জুমা ও জামাতে সম্মানিত মুসল্লিদের উপস্থিতি সীমিত পরিসরে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের বিজ্ঞ আলেমরা। মসজিদ বন্ধ থাকবে না তবে সুরক্ষা পদ্ধতি চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত ব্যক্তিরা মসজিদে যাবে নাঅনেকেই আলেমদের এই আহŸানের ব্যাখ্যা চাইছেন। মূলত মুসল্লিদের উপস্থিতি সীমিত রাখার উদ্দেশ্য হলো, এমন পরিস্থিতিতে যার জন্য মসজিদে আসা উচিত নয়তিনি আসবেন না।  তেমনিভাবে যার জন্য না আসার অবকাশ রয়েছেতিনিও আসবেন না।

এমন পরিস্থিতিতে যাদের জন্য মসজিদে আসা উচিত নয় তাঁরা হলেন,

ক. যাঁরা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।

খ. যাঁরা অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত রয়েছেন, কিন্তু আজিমত (শরিয়তের স্বাভাবিক সময়ের বিধান) অবলম্বনের জন্য মসজিদে উপস্থিত হয়ে থাকেন। তাঁদেরও এমন পরিস্থিতিতে মসজিদে আসা উচিত নয়।

গ. যারা সর্দি-কাশি ও ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত তাঁরা সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগে মসজিদে কোনোভাবেই আসবেন না।

ঘ. ষাট বা তদূর্ধ্ব মুরব্বিদের মসজিদে না আসা উচিত।

ঙ. বিশেষত যেসব মুরব্বি কোনো রোগে আক্রান্ত রয়েছেন তাঁরা একেবারেই মসজিদে আসবেন না।

চ. এ পরিস্থিতিতে নাবালেগ শিশুরা, বিশেষ করে যারা খুব ছোট তারা মসজিদে একেবারেই আসবে না।

ছ. যারা এমন কোনো অঞ্চল বা পরিবেশ থেকে এসেছেন যেখানে এই মহামারি বিস্তার লাভ করেছে, তারাও এমন পরিস্থিতিতে মসজিদে একেবারে আসবেন না।

জ. কোনো বিশেষ এলাকা যেমন কোনো বাড়ি, টাওয়ার, পাড়া, মহল্লা ইত্যাদির ব্যাপারে যদি সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কারণে বিশেষ নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয় তাহলে এমন লোকেরাও মসজিদে আসবে না।

উল্লিখিত মুসল্লিরা ঘরে নামাজ আদায় করবেন। অন্তরে মসজিদে উপস্থিত হতে না পারার কারণে আক্ষেপ পোষণ করবেন। ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ তাআলা তাঁদের আপন শান মোতাবেক সওয়াব দান করবেন।

ঝ. কোনো কোনো মসজিদে এ প্রচলন রয়েছে, যা না হওয়া উচিত, সেখানে নারী মুসল্লিরাও উপস্থিত হয়ে থাকেন। এ প্রচলন এমনিতেই সংশোধনযোগ্য। তথাপি এ পরিস্থিতিতে মসজিদে তাদের উপস্থিত হওয়ার প্রশ্নই আসে না।

অসুস্থ না হয়েও এ অবস্থায় যাদের মসজিদে না আসার অনুমতি রয়েছে তাঁরা হলেন,

ক. যাঁরা কারো শুশ্রƒষায় আছেন।

খ. আতঙ্কের কারণে যাঁকে তাঁর বাবা-মা অথবা স্ত্রী কিংবা ছেলেসন্তনরা বাইরে বের হতে বাধা দিচ্ছে।

গ. আতঙ্কের কারণে যাঁকে তাঁর প্রতিবেশী, একই ভবনের বাসিন্দা বাধা দিচ্ছে।

ঘ. যিনি নিজে আক্রান্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা বোধ করার দরুন মসজিদে উপস্থিত হওয়ার হিম্মত করতে পারছেন না।

এই মুসল্লিরা ছাড়া অন্যরা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে জামাতে উপস্থিত হবেন। তারপরও যাঁদের মধ্যে কোনো লক্ষণও নেই এবং পূর্বোক্ত দুই শ্রেণির আওতায়ও পড়েন না উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে তাঁদের কেউ যদি (পরিবার ও সমাজের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে) মসজিদে না আসেন তাহলে আশা করা যায় তাঁদেরও গুনাহ হবে না।

এই পরিস্থিতিতে যাঁদের জন্য জামাতে উপস্থিত হওয়া সংগত নয়, তারা জুমাতেও উপস্থিত হবেন না। আর যাদের জন্য জামাতে উপস্থিত না হওয়ার অনুমতি রয়েছে তাদের জন্য জুমাতেও উপস্থিত না হওয়ার অনুমতি রয়েছে। আর এই সময় এ রুখসত (ছাড়) গ্রহণ করায় সওয়াবও  বেশি। হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ এটাও পছন্দ করেন তাঁর  দেওয়া রুখসত বান্দা গ্রহণ করবে।

সুতরাং তারা ঘরে জোহরের নামাজ আদায় করবে। আর জুমার দিনের অন্যান্য আমলের প্রতি মনোযোগী হবে। যেমন সুরা কাহফ তিলাওয়াত করা, বেশি বেশি দরুদ পাঠ ইত্যাদি।

[মাসিক আল কাউসারের ওয়েবসাইটে ২৭ মার্চ ২০২০ প্রকাশিত দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের একাংশের গদ্যরূপ দিয়েছেন আবরার আবদুল্লাহ।] ( দৈনিক কালের কণ্ঠ, ২ এপ্রিল ২০২০ ঈ.)

হযরতুল উস্তাযের নির্দেশনার মর্মার্থ, আমি যদ্দুর বুঝেছি, খুবই স্পষ্ট। তবে প্রত্যেক শাস্ত্রেরই নিজস্ব উপস্থাপনা-পদ্ধতি থাকে। ফিকহের মাসআলা বর্ণনারও নিজস্ব নীতি ও পদ্ধতি আছে, যার তাৎপর্য শাস্ত্রবিদেরা বোঝেন। মাসআলা বর্ণনার ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের মতো ঢালাও সমীকরণ করা যায় না, যথার্থ স্তর বিন্যাস করেই কথা বলতে হয়। সেই পদ্ধতির সাথে ঘনিষ্ঠতা না থাকলে মনে হতে পারে যে, ‘পরিষ্কার ভাষায় তো মানা করা হল না।

একজন ফকীহ কীভাবে এমন একটি বিষয়ে শর্তহীনভাবে মসজিদে আসতে মানা করবেন। দেশে তো এখনও রাষ্ট্রীয়ভাবেও পূর্ণ লকডাউন ঘোষিত হয়নি।

তবে একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লেই বোঝা যাবে যে, খুবই স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরিষ্কারভাবে বলাও হয়েছে যে, এমন পরিস্থিতিতে যার জন্য মসজিদে আসা উচিত নয়তিনি আসবেন না। তেমনি যার জন্য না আসার অবকাশ আছেতিনিও আসবেন না। এরপর এই দুই শ্রেণির স্পষ্ট তালিকাও দেওয়া হয়েছে। এর চেয়ে স্পষ্ট বক্তব্য আর কী হতে পারে? শুধু এইটুকুর উপর আমল করলেওÑ চিকিৎসক ও অণুজীব বিশেষজ্ঞদের উপস্থাপিত বিভিন্ন প্রতিবেদন ও পরিসংখ্যান অনুসারে দৃশ্যতÑ করোনা ঝুঁকি অনেকখানি হ্রাস পেতে পারে। অথচ শোনা যাচ্ছে কোথাও কোথাও বৃদ্ধ ব্যক্তিরা এবং হাঁচি-কাশি নিয়েও কেউ কেউ জামাতে উপস্থিত হচ্ছেন। এটা কিন্তু অনুচিত হচ্ছে।

এরপর আরো বলা হয়েছে যে, ‘‘এই মুসল্লীরা ছাড়া অন্যরা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে জামাতে উপস্থিত হবেন। তারপরও যাদের মধ্যে কোনো লক্ষণও  নেই এবং পূর্বোক্ত দুই শ্রেণির আওতায়ও পড়েন না উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে তাদের কেউ যদি ( পরিবার ও সমাজের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে) মসজিদে না আসেন তাহলে আশা করা যায় তাদেরও গুনাহ হবে না।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে গুনাহ না হওয়াটাইকি যথেষ্ট নয়?

সারকথা হচ্ছে, নির্দেশনা খুবই স্পষ্ট। যেভাবে যে যে শর্তের সাথে বলা হয়েছে সেভাবে বুঝেশুনে সেই মানসিকতা নিয়ে তা অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়।

পাঁচ.  উপরোক্ত নির্দেশনার বাইরে গিয়ে এখন মসজিদের জুমা-জামাতে ঢালাওভাবে সব শ্রেণির মুসল্লীর অংশগ্রহণ শুধু ব্যক্তিগত ঝুঁকিরই প্রশ্ন নয়; বরং নিজের সাথে পরিবার-পরিজনের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি এবং নিজের অজান্তে অন্য মুসল্লীদেরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মত প্রকাশ করেছেন। তাই মসজিদের প্রতি মনের টান ও জামাতে হাজির হতে না পারার বেদনা নিয়ে সাময়িকভাবে উপরোক্ত ব্যক্তিদের ঘরে নামায পড়াই সঙ্গত।

শরীয়ত দ্বীনী কাজের কোনো কোনো প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে নিজের ঝুঁকি স্বীকার করাকে ছওয়াবের বিষয় সাব্যস্ত করলেও যেখানে অন্যদেরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কিংবা আমলের চেয়েও বড় বিপদের বাস্তব আশঙ্কা থাকে সেখানে এই ঝুঁকি স্বীকারে উৎসাহিত করা হয় না।

অতএব বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই শ্রেণির মুসল্লীদের কর্তব্য হবে, বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা অনুসারে ঘরে নামায পড়া এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও যথাসম্ভব অন্যান্য জমায়েতও এড়িয়ে চলা।

মনে রাখতে হবে যে, বিশেষ অবস্থা ও পরিস্থিতিতে বিশেষ বিধান অনুসারে আমল করা এবং শরীয়তের ছাড় ও প্রশস্ততা গ্রহণ করাও তাকওয়া। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তাঁর আনুগত্যের প্রেরণা নিয়ে এর অনুসরণ আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের এবং তাঁর রহমত লাভের উপায়।

* * *

একইসাথে আরো যে বিষয়গুলো লক্ষণীয় তা হচ্ছে :

এক. সব রকমের গুনাহ ও পাপাচার বর্জন করে একান্তভাবে আল্লাহ-অভিমুখী হোন। তাওবা-ইস্তিগফার, দুআ-কান্নাকাটি, বেশি বেশি দরূদ পাঠ, কুরআন তিলাওয়াত, বিশেষত বালা মুসিবত থেকে মুক্ত থাকার আমলগুলোতে নিজেও মশগুল থাকুন, ঘরের স্ত্রী-পুত্র-পরিজনকেও মশগুল রাখুন। একই সাথে উলামায়ে কেরাম এবং চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে দেওয়া সতর্কতামূলক নির্দেশনা-বিধিগুলোও মেনে চলুন।

দুই. ঘরে অবস্থানের সময়টুকুতে পরস্পরিক সুসম্পর্ক, সৎ ব্যবহার ও উত্তম আখলাকের চর্চা করুন। তবে সময় কাটানোর জন্য কোনো কোনো মহলের পক্ষ হতে প্রস্তাবিত ও সরবরাহকৃত বিভিন্ন মুভি ইত্যাদিতে লিপ্ত হওয়া থেকে বেঁচে থাকুন।

স্ব স্ব পরিসরে প্রত্যেকে অন্যের সাথে কোমল ও দয়ার আচরণ করুন। দরিদ্র অভাবীদের প্রয়োজন পূরণে এগিয়ে আসুন। হাদীস শরীফে আছে, তোমরা যমীনওয়ালাদের উপর রহম করো, তাহলে আসমানওয়ালা তোমাদের উপর রহম করবেন।

তিন. সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমগুলোতে সাধারণত যা হয়ে থাকে পরস্পর ব্যঙ্গ-বিদ্রæ, কটাক্ষ ইত্যাদি সম্পূর্ণরূপে পরিহার করুন। কারো মনে কষ্ট দেয়ার মতো কথা ও কাজ, বিশেষত মুত্তাকী উলামায়ে কেরাম এবং বৃদ্ধ-বয়স্ক ইবাদতপ্রাণ ব্যক্তিদের সম্পর্কে কট মন্তব্যের ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করুন। মনে রাখতে হবে যে, এখন আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন আল্লাহর রহমত। ব্যবস্থা যা কিছুই  আমরা গ্রহণ করি, আমাদের রক্ষা করবেন একমাত্র আল্লাহ। যারা আক্রান্ত হয়েছেন আল্লাহর হুকুমেই আক্রান্ত হয়েছেন, যারা রক্ষা পাবেন আল্লাহর হুকুমেই রক্ষা পাবেন।

তাই আল্লাহ তাআলা নারাজ হন এমন সব কথা, কাজ ও আচরণ থেকে অবশ্যই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।

চার. প্রত্যেক মুমিন একে অপরের জন্য দুআ করুন। এক মুমিনের অনুপস্থিতিতে অন্য মুমিনের দুআ বিশেষভাবে কবুল হয়ে থাকে।  আর এক মুসলিম যখন অন্য মুসলিমের জন্য কল্যাণের দুআ করেন তখন ফেরেশতাগণ তার জন্য অনুরূপ কল্যাণ প্রার্থনা করেন।

পাঁচ. শবে বরাতে অর্থাৎ ১৪ শাবান (বৃহস্পতিবার) দিবাগত রাতে নফল ইবাদতের জন্য মসজিদে জমায়েত হওয়া থেকে বিরত থাকুন। নিজ নিজ ঘরে আমল করুন। বেশি বেশি দোআ ইস্তিগফারে মশগুল থাকুন এবং মুক্তির এ রজনীকে পাপ-মুক্তির, রোগ-মুক্তির ও বালা-মুসিবত থেকে মুক্তির  সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করুন।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে হেফাযত করুন এবং তাঁর রহমতের নিরাপদ বেষ্টনীর মধ্যে রাখুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।

 

advertisement