শাবান-রমযান-১৪৪১   ||   এপ্রিল- মে ২০২০

প্রসঙ্গ : করোনা ভাইরাস
বর্তমান পরিস্থিতিতে জুমা ও জামাতে উপস্থিতির ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের আহ্বান : কিছু জরুরি কথা

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

*** সাক্ষাৎকার ***

* আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

** ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

* গত ২৫ মার্চ ২০২০ ঈ. বুধবার ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ওয়েব সাইটে করোনা ভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করার প্রেক্ষাপটে ইসলামের বিধি-বিধান অনুসরণের বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট আলেমগণের আহ্বানশিরোনামে একটি লেখা পেয়েছি। হযরত মাওলানা আবদুল কুদ্দুস ছাহেব হুযুরসহ একাধিক আলেমের স্বাক্ষর সম্বলিত এ লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে- নির্ভরযোগ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষকগণের মতে, বাংলাদেশে বর্তমান করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে সর্বপ্রকার জমায়েত বন্ধের পাশাপাশি মসজিদসমূহে জুমআ ও জামাআতে সম্মানিত মুসল্লিগণের উপস্থিতি সীমিত পরিসরে রাখার জন্য দেশের বিজ্ঞ আলেমগণ সুপারিশ করেছেন। মসজিদ বন্ধ থাকবে না তবে সুরক্ষা পদ্ধতি চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত ব্যক্তিগণ মসজিদে গমন করবেন না।

এ ব্যাপারে বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেকেই যোগাযোগ করছেন। কেউ বলছেন, এই আহ্বানের অর্থ সুস্পষ্ট নয়, এর সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা আসা প্রয়োজন। কোনো কোনো ইমাম-খতীব ছাহেবান এই আহ্বানের শরঈ সূত্র এবং ফতোয়ার কিতাবসমূহ থেকে এর উদ্ধৃতিও তলব করছেন। এ প্রেক্ষিতে কিছু প্রশ্ন করার প্রয়োজন অনুভব করছি।

** অবশ্যই করুন। মাওলায়ে কারীম তাওফীক দিলে কিছু আরজ করা যাবে- ইনশাআল্লাহ।

* প্রথম প্রশ্ন তো এটাই যে, মুসল্লীগণের উপস্থিতি সীমিত রাখা বলতে কী বোঝায়?

** এর উদ্দেশ্য হল, এ ধরনের পরিস্থিতিতে যার জন্য মসজিদে আসা উচিত নয় তিনি আসবেন না। তেমনিভাবে যার জন্য না আসার অবকাশ রয়েছে তিনিও আসবেন না।

* এ ধরনের পরিস্থিতিতে কাদের জন্য মসজিদে আসা উচিত নয়?

** ক. যারা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। (বর্তমান পরিস্থিতিতে অবশ্য তাদের আসার তো সুযোগও নেই।)

খ. যারা অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত রয়েছেন, কিন্তু আযীমতের উপর আমল করে মসজিদে উপস্থিত হয়ে থাকেন। তাদেরও এ পরিস্থিতিতে মসজিদে আসা উচিত নয়।

গ. বিশেষকরে যারা সর্দি-কাশি ও ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত তারা সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পূর্বে মসজিদে কোনোভাবেই আসবেন না।

ঘ. ষাট বা তদূর্ধ্ব মুরব্বীগণ মসজিদে না আসা উচিত।

ঙ. বিশেষকরে যে সকল মুরব্বী কোনো রোগে আক্রান্ত রয়েছেন তারা বিলকুল মসজিদে আসবেন না।

চ. এ পরিস্থিতিতে নাবালেগ শিশুরা, বিশেষকরে যারা খুব ছোট তারা মসজিদে একেবারেই আসবে না।

ছ. যারা এমন কোনো অঞ্চল বা পরিবেশ থেকে এসেছেন যেখানে এ মসিবত বিস্তার লাভ করেছে, তারাও এমন পরিস্থিতিতে মসজিদে একেবারে আসবেন না।

জ. কোনো বিশেষ এলাকা যেমন- কোনো বাড়ি, টাওয়ার, পাড়া, মহল্লা ইত্যাদির ব্যাপারে যদি সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কারণে বিশেষ নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয় তাহলে এমন লোকেরাও মসজিদে আসবে না।

উল্লিখিত মুসল্লীগণ ঘরে নামায আদায় করবেন। অন্তরে মসজিদে উপস্থিত হতে না পারার কারণে আক্ষেপ পোষণ করবেন। ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে আপন শান মোতাবেক সওয়াব দান করবেন।

ঝ. কোনো কোনো মসজিদে এ প্রচলন রয়েছে, যা না হওয়া উচিত, সেখানে নারী মুসল্লীগণও উপস্থিত হয়ে থাকেন। এ প্রচলন তো এমনিতেই সংশোধনযোগ্য। তথাপি এ পরিস্থিতিতে মসজিদে তাদের উপস্থিত হওয়ার প্রশ্নই আসে না।

* যাদের জন্য মসজিদে না আসার অনুমতি রয়েছে, তারা কারা?

** যেমন- ক. যারা কারো শুশ্রূষায় রয়েছেন।

খ. আতঙ্কের কারণে যাকে তার বাবা-মা অথবা স্ত্রী কিংবা ছেলে সন্তানেরা বাইরে বের হতে বাধা দিচ্ছে।

গ. আতঙ্কের কারণে যাকে তার প্রতিবেশি, একই ভবনের বাসিন্দা বাধা দিচ্ছে।

ঘ. যিনি নিজে আক্রান্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা বোধ করার দরুন মসজিদে উপস্থিত হওয়ার হিম্মত করতে পারছেন না।

এ ধরনের মুসল্লীগণ মসজিদে না-ও আসতে পারেন।

* আপনি যাদের কথা বললেন তারা ব্যতীত সবাই কি মসজিদের জামাতে হাজির হবেন?

** হাঁ, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে জামাতে উপস্থিত হবেন।

* মসজিদে উপস্থিতি সীমিত রাখবে এবং যেকোনো গণসমাগম সংকুচিত করবে- এ জাতীয় কথা শুনে অনেক সুস্থ ব্যক্তি, যাদের মাঝে কোনো লক্ষণও নেই এবং পূর্বোক্ত দুই শ্রেণির আওতায়ও তারা পড়েন না, এ ধরনের কেউ যদি মসজিদে না আসেন তাহলে কী বিধান? তার উদ্দেশ্য হল, সে যেন অন্য কারো আক্রান্ত হওয়ার উপলক্ষ না হয়। আর সে মসজিদে না গেলে জমায়েতও সংকুচিত হবে। অর্থাৎ সে যেন ইছারতথা অন্যের স্বার্থে এমনটি করছে। এ পরিস্থিতিতে তো/কি তার জামাত তরক করার গুনাহ হচ্ছে না? অবশ্য সে স্বাভাবিক অবস্থায় মসজিদে এবং জামাতে উপস্থিত হওয়ার ব্যাপারে যত্নবান থাকে।

** আশা করা যায়, গুনাহ হবে না।

* জাযাকুমুল্লাহ, এতক্ষণ তো আমরা জামাত বিষয়ে শুনলাম। এখন জুমার ব্যাপারে কিছু বলবেন কি?

** এ পরিস্থিতিতে যাদের জন্য জামাতে উপস্থিত হওয়া সঙ্গত নয়, তারা জুমাতেও উপস্থিত হবেন না। আর যাদের জন্য জামাতে উপস্থিত না হওয়ার অনুমতি রয়েছে তাদের জন্য জুমাতেও উপস্থিত না হওয়ার অনুমতি রয়েছে। আর এ সময় এ রুখছত (ছাড়)  গ্রহণ করায় সওয়াবও বেশি। হাদীস শরীফে এসেছে- আল্লাহ তাআলা এটাও পছন্দ করেন যে, আল্লাহর দেওয়া রুখছত (ছাড়) বান্দা গ্রহণ করবে।

* এ শ্রেণির মুসল্লীগণ কী করবেন?

** তারা ঘরে যোহরের নামায আদায় করবেন। আর জুমার দিনের অন্যান্য আমলের প্রতি মনোযোগী হবেন। যেমন- সূরা কাহ্ফ তিলাওয়াত করা, বেশি বেশি দরূদ শরীফ পড়া ইত্যাদি আমলের প্রতি মনোনিবেশ করবেন।

* আলহামদু লিল্লাহ, এ তো অত্যন্ত খুশির খবর যে, আমাদের দেশে মসজিদ বন্ধ করা বা মসজিদে উপস্থিত হওয়ার ব্যাপারে পাবন্দি আরোপ করা হয়নি।

** এর তো প্রশ্নই আসতে পারে না। যথারীতি মসজিদ খোলা থাকবে, আযানের আওয়ায বুলন্দ হবে, জামাত ও জুমআ কায়েম হবে। মসজিদের উপর পাবন্দি আরোপ করার তো প্রশ্নই উঠে না।

* কিন্তু উপস্থিতি সীমিত করার অর্থ কেউ কেউ এমন বলেছেন যে, ইমাম, মুয়াযযিন এবং খাদেম ছাহেবান মিলে জামাত করবেন। যদি এমনই হয় তাহলে তো বন্ধ করে দেওয়ার মতোই হল!

** হাঁ, তাই তো। তবে সীমিত করার এমন অর্থ করা ভুল। কেউ কেউ এরকম প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। কিন্তু সিদ্ধান্তে তা গৃহীত হয়নি। সিদ্ধান্তের খসড়া কপিতে যখন সীমিত আকারে এবং ক্ষুদ্র পরিসরে নিয়ে আসার আহ্বানলেখা হয়েছিল তখন তা সম্পাদনা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র পরিসরেকথাটি বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা তো এজন্যই যাতে এ ধরনের ভুল বোঝাবুঝি না হয়।

* কিন্তু কোনো কোনো মিডিয়া যে প্রজ্ঞাপন প্রচার করেছে তাতে তো এ কথা বলা আছে!

** আশ্চর্যের কথা! কেউ হয়ত মূল সম্পাদিত কপি, যাতে দস্তখত হয়েছে এবং যার সিদ্ধান্তগুলো ফাউন্ডেশনের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সেটার পরিবর্তে সম্পাদিত কপির পূর্বের খসড়া কপি প্রচার করে দিয়েছে। যেই একাজ করেছে ভুল করেছে।

* সেখানে তো একথাও আছে যে, মসজিদগুলো বন্ধ থাকবে না তবে মানুষ যার যার ঘরে জামাতে নামায পড়ে নিবে।

** লা হাউলা ওয়ালা কুউয়াতা ইল্লা বিল্লাহ, একথাও সম্পাদনার সময় কেটে দেওয়া হয়েছে। ব্যস, সিদ্ধান্তের পূর্বের খসড়া কপি প্রচার করায় যে সকল জটিলতা তৈরি হয় এখানেও তাই হয়েছে। যাইহোক, এ কপি ধর্তব্য হবে না।

* আলহামদু লিল্লাহ, আপনার এ কথায় আশ্বস্ত হওয়া গেল। অনেকে এমনও বলাবলি করছিল যে, এ ধরনের একটা সিদ্ধান্ত কীভাবে মেনে নেওয়া হল? এখন বাস্তবতা বুঝে এসেছে। জাযাকুমুল্লাহু খাইরান।

** আচ্ছা, আর কোনো কথা?

* জি, উক্ত লেখায় এবং ২৫ মার্চ প্রচারিত ফাউন্ডেশনের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘সুরক্ষা নিশ্চিত না হয়ে মসজিদে গমন করবেন না’ -একথার কী অর্থ? সুরক্ষা নিশ্চিত হওয়ার পদ্ধতি কী?

** আরে ভাই, নিশ্চিত হওয়ার অর্থ কখনো এই নয় যে, কেউ গায়বের খবর জানতে পারবে। এটা তো সম্ভবই না। এর অর্থ হল, প্রথমে এটা জেনে নিবে যে, এ মুহূর্তে তার জন্য জামাতে উপস্থিত হওয়া উচিত কি না? না এ মুহূর্তে তার জন্য রুখছতের উপর আমল করাটাই উত্তম? এ অবস্থায় মসজিদে আসবে না।

এছাড়া অন্যরা জুমা এবং জামাতে শরীক হবে। তবে স্বাস্থ্য বিভাগ এবং আহলে ইলমের তরফ থেকে বাতলানো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবশ্যই অবলম্বন করবে। যেমন-

ক. ঘর থেকে ওযু করে আসবে।

খ. সুন্নত নামায ঘরে পড়ে নিবে।

গ. মাস্ক ব্যবহার করবে। বরং শরীরের উপরিভাগ রুমাল ইত্যাদি দিয়ে আবৃত করে নিলে আরো ভালো।

ঘ. মসজিদের ফ্লোরে বিছানোর জন্য এমন কোনো কাপড় নিয়ে যাবে, যাতে ডাস্ট না উড়ে ।

ঙ. মসজিদের সম্মুখে যদি হাত ধোয়ার কিংবা স্প্রের ব্যবস্থা থাকে তাহলে তা-ও গ্রহণ করবে।

চ. জামাত শেষ হওয়ার পর সেখানে বিলম্ব করবে না। ফরয পরবর্তী সুন্নতসমূহ এবং ওযীফা-আযকার ঘরে এসে আদায় করবে।

ছ. বর্তমানে মুছাফাহা-মুয়ানাকা থেকেও বিরত থাকবে।

মোটকথা, স্বাস্থ্য বিভাগ এবং আহলে ইলমের পক্ষ থেকে যে পরামর্শ এবং সুপারিশমালা দেওয়া হয়েছে তা পালনে যত্নবান হবে। বান্দার সাধ্যে তো এতটুকুই আছে। এরচে আগে বেড়ে সে আর কী করতে পারে!

* সতর্কতামূলক ব্যবস্থার ব্যাপারে আরও কিছু বলবেন কি?

** হাঁ, মসজিদ কর্তৃপক্ষের ব্যাপারে যে সকল নির্দেশনা রয়েছে তারা সে ব্যাপারে যত্নবান হবেন। বিশেষকরে মসজিদগুলোতে পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্ব দিন। খুব ভালোভাবে সাফাই করুন এবং বারবার করুন।

সম্মানিত ইমাম ছাহেবান মুসল্লীদেরকে যেভাবে তওবা-ইস্তিগফার এবং দুআ-দরূদের প্রতি সংক্ষিপ্তভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন পাশাপাশি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারেও জনগণকে উৎসাহিত করবেন। হাদীস শরীফে ইমামগণকে নামায সংক্ষিপ্ত করার যে তাকিদ করা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতি এটার উপর আমল করার উপযুক্ত সময়।

* জুমার ব্যাপারে কোনো বিশেষ নির্দেশনা?

** আমাদের একাধিক মুরব্বী তো এ ব্যাপারে বলেছেন। অর্থাৎ খুতবাও সংক্ষিপ্ত হবে এবং নামাযও। দুআ যত দীর্ঘ হবে তত ভালো। তবে এ মুহূর্তে দীর্ঘ দুআ-মুনাজাত মসজিদে নয়, ঘরে একাকী হবে।

আর জুমার পূর্বে বাংলা বয়ান, তা তো জুমার অংশই নয়। এ পরিস্থিতিতে বাংলা বয়ান একেবারে না করলেও কোনো সমস্যা নেই। অবশ্য চার-পাঁচ মিনিটে যদি এ বিষয়ে তওবা, তাওয়াক্কুল এবং সতর্কতা অবলম্বনের ব্যাপারে দু চার কথা বলে দেওয়া হয় তাহলে ভালো।

* এ পরিস্থিতিতে যাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, তারা ঘরেই নামায আদায় করবে। তেমনিভাবে যাদের জন্য ঘরে নামায পড়ার অবকাশ রয়েছে, তাদেরকেও ঘরে নামায পড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তো এসকল মুসল্লী ঘরে নামায আদায় করলে কি জামাতের সওয়াব লাভ করবে?

** যেহেতু তাদের নিয়ত ঠিক আছে। মাসআলা মোতাবেক আমল করার কারণে মসজিদে হাজির হওয়ার আকাক্সক্ষা থাকা সত্তে¡ও মসজিদে আসতে পারছেন না। ইনশাআল্লাহ, এ কারণে তারা সওয়াব লাভ করবে।

نية المؤمن خير من عمله

শরীয়তের এই নীতির দাবিও এমনটাই।

* এই মহামারির আতঙ্কে অনেকে এখন মসজিদমুখী হচ্ছে। এ মুহূর্তে উলামায়ে কেরামের এই আহ্বানকে অনেকে না-মুনাসিব মনে করছে।

** তারা মসজিদমুখী হয়েছে মানে আল্লাহর প্রতি রুজু করেছে। এজন্য তাদেরকে অসংখ্য মুবারকবাদ। এখন তাদের বুঝা দরকার, যখন আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তিত হওয়ার সুযোগ হয়েছে তো এখন তাদের কর্তব্য হল, তারা শরীয়তের বিধি-বিধান শিখবে। যদি এ মুহূর্তে তাদের প্রতি শরীয়তের হুকুম এই হয় যে, তারা রুখছতের হুকুম গ্রহণ করে ঘরে নামায আদায় করবে, আর মসজিদের সাথে অন্তর জুড়ে রাখবে, তাহলে তারা এমনটাই করবে। এটাই হবে আল্লাহমুখিতা এবং মসজিদমুখিতা।

মসজিদে উপস্থিত হওয়ার আসল পরীক্ষা তো তখন হবে যখন আল্লাহর মেহেরবানীতে ইনশাআল্লাহ এ পরিস্থিতি কেটে যাবে। তখন দেখার বিষয়, আমরা মসজিদে গুরুত্বের সাথে হাজিরী দেই কি না?

* আচ্ছা, অনেক মুসল্লী মসজিদে আসেন, তবে কাতারে ফাঁকা ফাঁকা হয়ে দাঁড়ান। ইমাম ছাহেবানের কি দায়িত্ব, তাদেরকে মিলে মিলে দাঁড়াতে তাগিদ করবেন?

** কাতারে মিলে মিলে দাঁড়ানো সুন্নত। ফাঁক রেখে দাঁড়ানো মাকরূহ। কিন্তু এমন পরিস্থিতির কারণে এভাবে দাঁড়ানোর অবকাশ হতে পারে। অতএব ইমাম ছাহেব যদি তাদেরকে আপন অবস্থায় ছেড়ে দেন তাহলে আশা করি কোনো সমস্যা হবে না।

* আলহামদু লিল্লাহ, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা চলে এসেছে। একটি জরুরি কথা থেকে গেছে। আর তা হল, রুখছত এবং ওযরের ভিত্তিতে যে আহ্বান জানানো হয়েছে, এর দলীল ও হাওয়ালা কী?

** আপনি প্রথমেই বলেছেন, কোনো আলেমের পক্ষ থেকে এ প্রশ্ন এসেছে। এজন্য আমি মনে করি এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলার প্রয়োজন নেই। সেই আলেম যদি নিজেই হাদীস ও ফিকহ-ফতোয়ার কিতাব থেকে বাবুল আযার ফী তারকিল জুমুআতি’-এই অধ্যায় মনোযোগ দিয়ে মুতালাআ করে নেন পাশাপাশি কাওয়াইদুল ফিকহ-এর কিতাবাদি থেকে সংশ্লিষ্ট ফিকহী কায়দাগুলোর ব্যাখ্যাও পড়ে নেন, তাহলে ইনশাআল্লাহ তাঁর ইতমিনান হবে।

مع ملاحظة أن النازلة إذا لم يوجد في حكمها نص فقهي صريح فلاغرابة في ذلك، وإلا فكيف تكون النازلة نازلة وحادثة، ولماذا احتاج فقهاء كل عصر إلى تدوين أحكام حوادث أعصارهم.

* অনেকে জানতে চান, এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি শহীদ হয়ে গেলে (মৃত্যু বরণ করলে) তার জানাযা এবং কাফন-দাফনের প্রসঙ্গটি এই মজলিসে আলোচনায় এসেছিল কি না?

** স্বতন্ত্রভাবে এই বিষয়টি মজলিসের আলোচ্য বিষয় ছিল না। অবশ্য এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হলে তার দাফনের ব্যাপারে সরকারি নির্দেশিকা, যার প্রথম সংস্করণ ১৫.০৩.২০২০ -এ প্রকাশিত হয়, তা মজলিসে পড়ে শোনানো হয়েছিল। তাতে বারবার এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, মুসলমান মাইয়েতের কাফন, জানাযা এবং দাফন শরঈ তরীকায় হওয়া জরুরি। অবশ্য তাতে গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুমের কথা বলা হয়েছে। উলামায়ে কেরাম সেখানে এ নোট লিখিয়ে দিয়েছেন যে, প্রথমে সতর্কতা অবলম্বন করে গোসল দেওয়ার ব্যবস্থা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। কোথাও যদি সতর্কতা রক্ষা করে এর ব্যবস্থা করা না যায় তখন বাধ্য হয়ে বিকল্প হিসাবে তায়াম্মুম করাবে। কর্তৃপক্ষ গুরুত্বের সাথে এই নোটটি টুকে রেখেছেন।

* মজলিসে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনায় এসেছে?

** হাঁ, হযরত মাওলানা আবদুল কুদ্দুস ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। হযরতের সংক্ষিপ্ত অথচ সারগর্ভ আলোচনার খোলাসা এই ছিল-

ওলামায়ে কেরাম যা বলছেন, স্বাস্থ্যবিভাগ সতর্কতা অবলম্বনের যে নির্দেশনা দিচ্ছে- আপন জায়গায় তা ঠিক আছে। কিন্তু এখন আমাদের জন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো-বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের নিজেদের গুনাহ পরিত্যাগ করি। তওবা করি, ইস্তেগফার করি, দোয়া করতে থাকি। তওবা, দোয়া ও ইস্তেগফার ছাড়া আল্লাহর আযাব থেকে নাজাত পাওয়ার কোন উপায় নেই।

আমরা আল্লাহ পাকের যিকির কতটুকু করছি, তওবা কতটুকু করছি, গুনাহ কতটুকু ছাড়ছি-এগুলোর কোনো ফিকির নেই! মওত কিভাবে হবে, কবরে কিভাবে থাকবো, হাশরে কিভাবে উঠবো-এগুলোর চিন্তা নেই আমাদের!!  

দেশে সব ধরণের অন্যায়-অবিচার, অশ্লীলতা বন্ধ হওয়া দরকার। রেডিও টেলিভিশন এবং চ্যানেলগুলোতে গান-বাদ্য, শয়তানী বন্ধ হওয়া দরকার। রেডিও টিভিগুলোতে তো এ পরিস্থিতিতে দোয়া হওয়ার দরকার ছিলো। কিন্তু হচ্ছে কী!! আমরা এই মজলিসের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই, যেন রেডিও টেলিভিশন এবং চ্যানেলগুলোতে গান বাদ্য এবং সকল অশ্লীলতা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

মোটকথা বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাই আল্লাহর দিকে রুজু করা দরকার, সবাই তওবা করা দরকার। তেলাওয়াত, যিকির-আযকার, দোয়া ইত্যাদিতে সবাই মশগুল থাকা দরকার। 

* বন্ধের দিনগুলো কিভাবে কাটবে?

** হাঁ, আপনি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন। সবচে বড় কথা হল- একটি মুহূর্তও যেন আল্লাহর নাফরমানিতে না কাটে। গুনাহই তো এ ধরনের বিপদাপদ ও মহামারির বড় কারণ। এজন্য এ সময়গুলোতে গুনাহে লিপ্ত হওয়া খুবই মারাত্মক। কখনো কখনো মসিবতকে তা আরো ভয়াবহ ও দীর্ঘমেয়াদী করে তোলে। আল্লাহ আমাদের মাঝে এ উপলব্ধি জাগিয়ে দিন। তো আমরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার খুব ইহতিমাম করি।

দ্বিতীয় কথা হল- অনর্থক ও অহেতুক কার্যকলাপ থেকে যদ্দূর সম্ভব দূরে থাকি।

তৃতীয় কথা হল- বিনোদনের নামে অশ্লীলতা চর্চা প্রকাশ্য গুনাহ। এ থেকে বেঁচে থাকা ফরয। আর এ মসিবত থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য তা আরো বেশি জরুরি। এজন্য টিভি থেকে দূরে থাকা চাই। মোবাইল কম্পিউটারের অপব্যবহার থেকে মুক্ত থাকা চাই।

চতুর্থ কথা হল- ইবাদত-বন্দেগীতে অলসতা থেকে বেঁচে থাকি। এখনও যদি এ হালত হয় যে, নামায কাযা হয়ে যায়, ঠিকমত ফযর পড়া হয় না, তাহলে হুঁশ আর কবে হবে?

পঞ্চম কথা হল- যিকির, দুআ এবং তিলাওয়াতে কুরআনের খুব ইহতিমাম করা চাই। সহীহ তিলাওয়াত না জানলে এখনই শেখার সংকল্প করুন।

যিকির ও দুআর ক্ষেত্রে ছয় তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ ১০০ বার, আলহামদু লিল্লাহ ১০০ বার, আল্লাহু আকবার ১০০ বার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ১০০ বার, যে কোন দুরুদ শরীফ যেমন- اللهم صل على محمد وعلى آل محمد ১০০বার, ইসতেগফার যেমন- أستغفر الله الذي لا إله إلا هو الحي القيوم وأتوب إليه  ১০০ বার। ছয় তাসবীহকে তিন তাসবীহও বলা হয়।) -এর খুব ইহতিমাম করা চাই। আর আয়াতে কারীমার [সূরা আম্বিয়া (২১) : ৮৭] দুআ-

لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ

-এরও খুব ইহতিমাম করা চাই। দিল হাযির রেখে এবং স্বীয় অপরাধ ও অসহায়ত্ব স্বীকার করে অনুতপ্ত হৃদয়ে এ দুআ যত পড়া যায় ততই ফায়দা।

* এখন তো মাদরাসার তালিবে ইলমরাও বাড়িতে অবস্থান করছে। তাদের জন্য যদি বিশেষভাবে কিছু বলতেন!

** তালিবুল ইলম ভাইরা তো জানেনই এ ধরনের মুহূর্তগুলো তারা কীভাবে কাটাবেন। ব্যস, সে মোতাবেক তারা সময়কে কাজে লাগাবেন। তাদের বোঝা উচিত, এ সময়গুলো তাদের জীবনের মূল্যবান অংশ। এর যথাযথ কদর করা তাদের উপর ফরয। এ সময়গুলোকে অযাচিত সুযোগ মনে করে এর না-কদরী করলে বড় দুর্গতি ডেকে আনবে।

হাফেয ছাহেবান আপন হিফয তাযা করবেন। গায়রে হাফেযগণ হিফয শুরু করে দিতে পারেন। আকাবিরের রাসায়েল মুতালাআ করার এটা মোক্ষম সময়। মা বাবার খেদমত আর যিকির, দুআ ও তিলাওয়াতের আমল তো আছেই। এই সময় তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ইমতেহানের প্রস্তুতি গ্রহণ করা। আর তা তো তারা নিজ গরজেই করে যাবেন।

মোটকথা, তাদের কর্তব্য হল, এ সময়গুলোকে তারা নিআমতে গায়রে মুতারাক্কাবাহ হিসাবে গ্রহণ করবেন, অযাচিত সুযোগ ভাববেন না। তলাবায়ে কেরামের খেদমতে একটি দরখাস্ত এও যে, যদিও মাদরাসার মাহোল ও পরিবেশ থেকে আপনি দূরে রয়েছেন, কিন্তু এই সুযোগে এই ভুল কাজটি মোটেও যেন না হয় যে, মোবাইল এবং নেটে নিজের কোনো সময় নষ্ট করছেন। কেউ এমনটি করলে নিজেকেই নিজে বরবাদ করল। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে হেফাযতে রাখুন।

* জাযাকুমুল্লাহু তাআলা খাইরান, আপনি অনেক সময় দিয়েছেন।

** আপনাকেও শুকরিয়া।

سبحنك اللهم وبحمدك أشهد أن لا إله إلا أنت أستغفرك وأتوب إليك.

সাক্ষাৎকার গ্রহণে : সায়ীদুল হ

 

 

advertisement