রবিউল আউয়াল ১৪২৯   ||   মার্চ ২০০৮

‘বিভিন্ন শাস্ত্রের ওয়াসায়েল শ্রেণীর বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে কল্যাণকর সংযোজন-বিয়োজনে কোনো ক্ষতি নেই’

মাওলানা সলীমুল্লাহ খান

[পাকিস্তানের বর্ষীয়ান বুযুর্গ আলেমে দ্বীন জামিয়া ফারূকিয়া করাচীর প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদীস এবং পাকিস্তান বেফাকুল মাদারিসের সভাপতি হযরত মাওলানা সলীমুল্লাহ খান সাহেব সম্প্রতি এক সংক্ষিপ্ত সফরে বাংলাদেশে তাশরীফ এনেছিলেন। তিনি ঢাকায়  অবস্থানকালে মাসিক আলকাউসারের পক্ষ থেকে তাঁর একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন মাসিক আলকাউসারের নির্বাহী সম্পাদক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ ও মাকতাবাতুল আশরাফের স্বত্বাধিকারী মাওলানা হাবীবুর রহমান খান।]

 

* পাকিস্তান বেফাকুল মাদারিস প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী? এবং তার কার্যক্রম কী?

** বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া পাকিস্তান-এর প্রতিষ্ঠার সূচনা হয়েছিল এ ভিত্তির উপর যে, সরকারের অন্যায় অনুপ্রবেশ যেন রুখে দাঁড়ানো সম্ভব হয়। আলহামদু লিল্লাহ এ লক্ষ্যে বেফাকের সাফল্য এসেছে। এরপর সে লক্ষ্যের সাথে এ উদ্দেশ্যটিও যুক্ত হয়ে গেছে যে, সব মাদরাসা একই সূতায় গ্রন্থিত হোক, বিচ্ছিন্নতা কেটে যাক, সব মাদরাসার নেসাবে তালীম [শিক্ষা সিলেবাস] অভিন্ন হোক, সকল মাদরাসার বার্ষিক পরীক্ষা বেফাকের অধীনে অনুষ্ঠিত হোক এবং তার অধীনেই ফলাফল বিন্যাস করা হোক ও সার্টিফিকেট চালু করা হোক। আলহামদু লিল্লাহ এসব উদ্দেশ্যও সফল হয়েছে। ইল্লা-মাশাআল্লাহ দু-একটি ছাড়া পাকিস্তানের সব মাদরাসাই বেফাকের সাথে যুক্ত হয়েছে। শিক্ষার উন্নয়নেও মূল্যায়নযোগ্য ও শুকরিয়া-উপযোগী সংযোজন ঘটেছে। এই একতা ও ঐক্যবদ্ধতার একটি উপকার এটিও হয়েছে যে, বহু মাদরাসা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেফাকের সাথে যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছে। কারণ, বেফাকের সাথে সংযুক্তি ব্যতীত সেসব মাদরাসায় ছাত্রগমন সম্ভব হতো না।

* পাকিস্তানে মূল বেফাকের সাথে বেরলবী-আহলে হাসীদসহ অন্য ফেরকাগুলোর বেফাকসমূহের যুক্ত হয়ে ঐক্যবদ্ধ বেফাক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য কী এবং তাতে ফায়েদা কী?

** পাকিস্তানে একটি বেফাক দেওবন্দি মাদরাসাগুলোর এবং এটিই আসল। এই বেফাকে ১২ হাজারের চেয়ে বেশি মাদরাসা অন্তর্ভুক্ত আছে। সকলের মিলিত মাদরাসাসংখ্যা যদি একশ হয় তাহলে সেখানে দেওবন্দি মাসলাকের মাদরাসার সংখ্যা সাতষট্টি এবং এই মাদরাসাগুলো বাস্তবে বিদ্যমান। অবশিষ্ট ৩৩% মাদরাসার মধ্যে রয়েছে বেরলবী, আহলে হাদীস, জামাআতে ইসলামী এবং শিয়াদের মাদরাসা। সেসব মাদরাসার অধিকাংশের অস্তিত্ব কেবল কাগজে-পত্রেই বিদ্যমান।

প্রশাসন যেহেতু বিভিন্ন কৌশল ও ছুতোয় মাদরাসাগুলোকে সরকারি হেফাজতে নিয়ে নিতে অথবা মাদরাসাগুলোকে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য [ইসলামী উলূমের প্রচার, ইসলামী রুচি-প্রকৃতি নির্মাণ এবং বাস্তব দ্বীনী তরবিয়ত] থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে ধারাবাহিক চেষ্টা করেই যাচ্ছে [যদিও সে চেষ্টায় সব সময়ই তারা ব্যর্থ হয়ে থাকে] তাই ‘ইত্তেহাদে মাদারিসে দ্বীনিয়্যা  পাকিস্তান’-এর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে, যেন সবে মিলে প্রশাসনের ষড়যন্ত্র ও ছলচাতুরিকে প্রতিরোধ করতে পারে।

* বাংলাদেশে বেফাকুল মাদারিসের সনদের সরকারি স্বীকৃতির ব্যাপারে এখানকার উলামায়ে কেরামের মধ্যে দুটি মত লক্ষ্য করা যায়। কেউ কেউ এটাকে উপকারী মনে করেন আর কেউ কেউ এটাকে ক্ষতিকর মনে করেন। এ বিষয়ে হযরতের অভিমত কী?

** বেফাকের সনদের সরকারি পর্যায়ে স্বীকৃতি উপকারী। এ স্বীকৃতির উপকারিতা অস্বীকার করা সঙ্গত নয়।

* মাদরাসাসমূহের প্রচলিত সিলেবাসে কোনো সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজন রয়েছে কি?

** কুরআন ও  সুন্নাহর উলূমের প্রয়োজনীয়তা স্বস্থানে সর্বজন স্বীকৃত। সেখানে কোনো বিয়োজনের প্রশ্নই উঠতে পারে না। অবশ্য বিভিন্ন শাস্ত্রের ওয়াসায়েল শ্রেণীর বিষয়গুলো যেমন- নাহু, সরফ, লুগাত, ইশতিকাক, মানতিক, ফালসাফা ইত্যাদির ক্ষেত্রে কল্যাণকর সংযোজন-বিয়োজনে কোনো ক্ষতি নেই।

* জামিয়া ফারূকিয়া করাচি প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, বর্তমান কর্মতৎপরতা ও ভবিষ্যত লক্ষ্য কী? পাকিস্তান এবং পাকিস্তানের বাইরে তার খেদমত সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?

** জামিয়া ফারূকিয়া করাচি ১৯৬৭ সনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম দিকে ৮ বছর পর্যন্ত উপায়-উপকরণের কমতি ছিল। উস্তাযগণের বেতনের ইন্তেজাম ছিল না, থাকার সুব্যবস্থা ছিল না, বিদ্যুৎ বিল এবং ছাত্রদের অজীফারও সহজ কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সবকিছুই বাকিতে আঞ্জাম দেওয়া হতো। এরপর হক্ব তাবারক ওয়া তাআলা প্রশস্ততা দান করলেন। সহজতা বাড়তে লাগলো। এ মুহূর্তে নির্দিষ্ট হিসাব-পরিসংখ্যান আমার জানা নেই, কিন্তু এ কথা নিশ্চিতভাবে জানা আছে যে, জামিয়া ফারূকিয়া করাচির বার্ষিক বাজেট কয়েক কোটি রুপিয়া।

জামিয়া ফারূকিয়া করাচির একটি শাখা ফয়সল টাউনে। সেখানে চার একর জমিতে পাঁচ তলা ইমারত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জামিয়ার শাখা হিসেবে এখানে স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। ফলে রেওর রোডে সাত একর জমিতে নতুন ইমারত নির্মাণ করা হচ্ছে। সেখানে এ বছর [১৪২৯হি.] তালীমের সূচনা করা হয়েছে। জামিয়ায় দরসে নেযামিতে বর্তমানে ছাত্র সংখ্যা ৩ হাজার; যাদের দু’হাজারেরই খাদ্যের দায়িত্ব বহন করে জামিয়া। এছাড়াও তাখাসসুস ফিল হাদীস, তাখাসসুস ফিল ফিক্হ এবং তাখাসসুস ফিল আদাবিল আরবীর শাখাসমূহও রয়েছে। জামিয়া ফারূকিয়া করাচির ফুযালা দুনিয়ার বহু জায়গায় দ্বীনী খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে এরা উল্লেখযোগ্য খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন। এসবই মহান আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ।

* ব্যাংক ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালিত করার জন্য যেসব প্রচেষ্টা ও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে এ সম্পর্কে হযরতের পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা ও অভিমত কী?

** অধিকাংশ আলেম খোদ পাকিস্তানে এবং পাকিস্তানের বাইরে বিভিন্ন দেশে ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে শরয়ী নিয়ম ও নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালনা করা হচ্ছে বলে মনে করেন না। তাছাড়া ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী চলার দাবিদার ব্যাংকগুলো যেসব নীতিমালাকে ভিত্তি হিসেবে ঘোষণা করে নিজেদের কর্মপদ্ধতি বলে প্রচার করছে সেসব ব্যাংকের কর্মচারীরা বাস্তব ক্ষেত্রে সেই নীতিমালার বিপরীত কাজ করে থাকে। যেহেতু সুদের সাদৃশ্যকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে তাই আমাদের দৃষ্টিতে এই প্রয়াস সঠিকভাবে চলছে না।

* মাদরাসাসমূহের উস্তায ও ছাত্রদের বাস্তব রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা উচিত কি না?

** কিছুতেই না।

* পাকিস্তান বেফাকের উদ্যোগে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত বিগত মজলিসে হযরত নতুন যেসব প্রস্তাব পেশ করেছিলেন তা কী ছিল?

** আসলে দুটি মজলিসে আমি দুটি প্রস্তাব পেশ করেছিলাম। বেফাকের একটি মজলিসে মুরাওওয়াজা সিয়াসতে ওলামায়ে কেরামের  অংশগ্রহণ সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। আরেকটি মজলিসে আমি মাদরাসাগুলোর অধীনে এমন স্কুল চালু করার প্রস্তাব করেছি, যেখানে সিলেবাস সরকারিই থাকবে। তার সাথে দ্বীনীয়াত যুক্ত করা হবে এবং পরিবেশ থাকবে দ্বীনী। দ্বীনী পরিবেশে দ্বীনীয়াত শিক্ষাসহ যেন সাধারণ শিক্ষিত নাগরিক তৈরি হন এ ব্যবস্থা বড় বড় মাদরাসাগুলো নিতে পারেন- একথাই সে প্রস্তাবে বলেছি।

দারুল উলূম করাচির অধীনে এ ধরনের স্কুল আগে থেকেই ছিল, জামিয়া ফারূকিয়াতেও এখন শুরু করা হয়েছে।

[বিশেষ দু’টি ইলমী প্রশ্ন]

* গোনাহগার হওয়ার কারণে মৃত্যুর পর যারা প্রথম পর্যায়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, কবর ও বরযখে তাদের কী অবস্থা হবে?

** কবরেও তাদের শাস্তি হবে। কারণ বিচারের পর প্রথম পর্যায়েই যারা জান্নাতে যাবেন না, তাদের তো দোযখে শাস্তি হবে। আর এটা স্পষ্ট বিষয় যে, কবরে শান্তিতে থাকবে আর হাশরের পর শাস্তি হবে তা হতে পারে না। সুতরাং কবরেও তাদের শাস্তি হবে।

* হাদীস শরীফে বলা হয়েছে-

وفرقوا بينهم في المضاجع

‘দশ বছর বয়স হলে তাদের মাঝে শয়নস্থল পৃথক করে দাও।’ এ হাদীসের মর্ম কী? আপন ভাইদেরও কি এক চৌকিতে শয়ন করা অনুচিত? এর আলোকে মাদরাসাসমূহের বর্তমান দারুল ইকামার শয়নব্যবস্থা সম্পর্কে আপনি কী পরামর্শ দেন?

** উক্ত হাদীসে বাচ্চাদের ১০ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর তাদেরকে এক বিছানায় না রেখে বিছানা পৃথক করে দেওয়ার যে কথা বলা হয়েছে তা পরিষ্কার। চৌকি আলাদা করতে না পারলে দু’জনের মধ্যে একটা তেপায়া বা অন্য কিছু রেখে দেওয়া যেতে পারে। মাদরাসায় ঢালাও শয়নব্যবস্থা আর্থিক অসঙ্গতি ও জায়গার অভাবে করা হয়। যেখানে সম্ভব আলাদা চৌকির ব্যবহারই করা চাই। ফারূকিয়ার নতুন শাখায় জায়গা প্রশস্ত থাকায় আলাদা চৌকির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

 

 

advertisement