রবিউল আউয়াল ১৪২৯   ||   মার্চ ২০০৮

রবিউল আউয়াল এলে...

মাওলানা মুহাম্মদ মনযুর নোমানী [রহ.]

‘‘তিনি সেই মহান সত্তা যিনি পাঠিয়েছেন তাঁর দূত হেদায়েত ও সত্য ধর্মসহ সে ধর্মকে সকল ধর্মের ওপর বিজয়ী করার জন্য। সাক্ষ্যদাতারূপে আল্লাহই যথেষ্ট।’’

আজ থেকে চৌদ্দশ’ বছর আগে, যখন মানবভুবনটি ডুবন্ত ছিল অন্ধকারের সমুদ্রে, আত্মিকতা পরাজিত হয়ে চলেছিল শয়তানতন্ত্রের কাছে তখন জগতের মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁর শেষ নবী এবং প্রিয়তম রাসূল হযরত মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে [আমার আত্মা ও হৃদয় উৎসর্গীত হোক তাঁর প্রতি] এই পৃথিবীতে পাঠালেন, যেন তিনি হেদায়েতের জ্যোতি দিয়ে গোমরাহির অন্ধকার ছিন্ন করে দেন এবং মিথ্যার ওপর সত্যকে বিজয়ী করে দেন। আমাদের মাতা-পিতা তাঁর প্রতি উৎসর্গীত হোক। তিনি তাশরীফ আনলেন। আসা মাত্রই তিনি আল্লাহর সিদ্ধান্তে পৃথিবীর রুখ পাল্টে দিলেন। বান্দাদের ধ্বসে পড়া সম্পর্ক খোদার সঙ্গে জুড়ে দিলেন। যে ভাগ্যবিড়ম্বিত জন লাঞ্চনার গহবরে পতিত ছিল তাকে সেখান থেকে উঠিয়ে উচ্চতার চূড়ায় পৌঁছে দিলেন। শিরককারীদের বানালেন একত্ববাদী। কাফেরদের বানালেন বিশ্বাসী। প্রতিমাপূজারীদের বানালেন খোদাপুরুস্ত। মূর্তিনির্মাতাদের বানালেন মূর্তিনাশী। রাহজানদের শেখালেন রাহনুমায়ী। দাসদের শেখালেন নেতৃত্ব্। একদার চোর পরিণত হলো চৌকিদারে। উৎপীড়ক হলো সহমর্মী। জগৎজোড়া আওয়ারা হয়ে গেল সবচেয়ে বড় সভ্যজন এবং যাদের জাতীয় মর্যাদা সম্পূর্ণ পঁচে গলে গিয়েছিল তা আবার পরিপূর্ণ সজীব ও পুনর্গঠিত হয়ে উঠলো। আত্মিকতার ফেরেশতা প্রবল হলো শয়তানতন্ত্রের উপর। কুফুর ও শিরিকের, বেদআত ও ভ্রান্তির এবং সব রকমের গোমরাহির ঘটলো চরম পরাজয়। দুর্ভাগ্য ও বদবখতির মওসুম বদলে গেলো। সীমালংঘন ও বিদ্রোহের এবং বিপর্যয় ও নাফরমানির শক্তি খতম হয়ে গেলো। সত্য ও সত্যবাদিতার এবং কল্যাণ ও সৌভাগ্যের বিশ্বজনীন বিজয় হলো। আর পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হলো এমনই এক নিরাপত্তা ও ন্যায়ের বাদশাহী!

যে সময় মানবভুবনের এই মহান পরিত্রাতা এই পানি ও ফুলের, এই রস ও তৃণের পৃথিবীতে তাঁর প্রথম কদমটি রেখেছিলেন সেটি ছিল রবিউল আউয়াল মাস এবং যখন তাঁর বয়স চল্লিশ বছর পূর্ণ হলো তখনও এই মাসেই তাঁকে সোপার্দ করা হয়েছিল জগৎশুদ্ধির কাজ। সুতরাং এ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, রবিউল আউয়ালই এই সর্বজনীন রহমত বিকাশের শুরুক্ষণ এবং এই আত্মিক কল্যাণ ও সুষমার ঝর্নাধারার উৎসমুখ। আর এ কারণেই যখন মুবারক এ মাসটি আসে তখন মুসলমানদের হৃদয়ে [এমনকি সেসব অন্তরেও, অন্য মওসুমে যারা থাকেন সম্পূর্ণ উদাসীন] সেই মহান অস্তিত্বের স্মরণ সজীব হয়ে উঠে এবং বিভিন্ন ধরনের খুশি ও আনন্দের প্রকাশ ঘটানো হয়ে থাকে। আল্লাহ তাআলার বড় কোনো নেয়ামতের স্মরণে আনন্দিত হওয়া কোন খারাপ জিনিস নয়। বরং শরীয়তের সীমারেখা অতিক্রম না করলে এটি একটি পর্যায় পর্যন্ত প্রশংসনীয়ও। ... কিন্তু আজ আমাকে নিবেদন করতে হচ্ছে-

উৎসবের এসব ক্ষণে এবং আনন্দের এসব মুহূর্তে আপনারা বিলাপযোগ্য এ বাস্তবতাকে যেন ভুলেই যাচ্ছেন যে, এই পবিত্র ও সৌভাগ্যপ্রাপ্ত অস্তিত্ব এই মুবারক মাসে মহান তাশরীফ আনয়নের মধ্য দিয়ে আপনাদেরকে যা কিছু করেছিলেন, নিজেদের মন্দ আমলের কারণে আপনারা তার সব কিছুই খুইয়ে ফেলেছেন। রবিউল আউয়াল যদি আপনাদের জন্য বিচিত্র খুশির মওসুম এবং নানাবিধ আনন্দের পয়গাম হয়ে থাকে তাহলে তা এজন্য যে, এ মাসে দুনিয়ার গোমরাহির হেমন্তকে হেদায়েতের বসন্ত এসে চরমভাবে পরাজিত করে ছেড়েছিল এবং এই মাসেই সেই মহান হেদায়েতের কান্ডারী জগতে উজ্জ্বল পদার্পণ করেছিলেন; যিনি এসে আপনাদের জন্য আধ্যাত্মিকতার দরজাসমূহ খুলে দিয়েছিলেন এবং সেসব নেয়ামত আপনাদের দান করেছিলেন যা থেকে আপনারা সব সময় থাকতেন বঞ্চিত ও দূরবর্তী। তাহলে এর কী কারণ থাকতে পারে যে, গত হয়ে যাওয়া বসন্তের জন্য আনন্দ তো উদযাপন করছেন কিন্তু হেমন্তের বর্তমান লাঞ্চনা-গঞ্জনা নিয়ে অশ্রু ঝরাচ্ছেন না।

আপনারা রবিউল আউয়ালে আগমনকারী সত্তার প্রতি ইশক-মহববতের দাবি করেন এবং তাঁর স্মরণে মজলিস বসান, কিন্তু আপনারা এটা ভেবে দেখেন না যে, আপনাদের যবান যাকে স্মরণের দাবি করে যাচ্ছে তাকে ভুলে যাওয়ার জন্য আপনাদের প্রতিটি আমলই স্বাক্ষী এবং যার প্রতি সম্মান-সমীহের দাবি আপনারা করছেন, আপনাদের গোমরাহিপূর্ণ জীবন, বরং আপনাদের অস্তিত্বের দ্বারাই তার মর্যাদায় কলঙ্কের দাগ লেগে যাচ্ছে।

যদি আপনাদের প্রেম-ভালোবাসার এই দাওয়া এবং সম্মান ও মর্যাদার এই দাবির ক্ষেত্রে কোনো সত্যতা থাকতো এবং বাস্তবেই তাঁর সাথে আপনাদের গোলামির ন্যূনতম সম্পর্ক থাকতো তাহলে আপনাদের ধর্মীয় অবস্থা কিছুতেই এ পরিমাণ বরবাদ হতো না। তাঁর আনিত শরীয়তের সাথে আপনাদের সম্পর্ক এতটা বেগানা হয়ে যেতো না। আপনারা নামাযে অভ্যস্ত হতেন, যাকাতের ওপর আমলকারী হতেন, তাকওয়া আপনাদের অনিবার্য বৈশিষ্ট্য হতো এবং সুন্নতের অনুসরণ হতো আপনাদের অনন্যতার লক্ষণ। হালাল-হারামে আপনারা পার্থক্য করতেন। আপনাদের জীবন হতো সাহাবায়ে কেরামের নমুনা এবং আপনাদের আমল হতো ইসলামের আয়না।

সুতরাং যখন আপনাদের অবস্থা এমনটি নয় এবং আপনারা আপনাদের অন্তরসমূহকে জিজ্ঞাসা করলে সেখান থেকেও এজবাবই আসবে যে, হাঁ নেই তখন বিশ্বাস করে নিন যে, রবিউল আউয়াল চলাকালে আপনাদের এই প্রেম-ভালোবাসার প্রদর্শনী নিছক নফসের ধোঁকা, যে ধোঁকার জালে আপনারা কিংবা আপনাদের বাহ্যদর্শী বন্ধুরা ফেঁসে যেতে পারেন, কিন্তু সর্বজ্ঞ ও সর্ববিষয়ে সম্যক অবগত খোদাওয়ান্দ তাআলা এ ধোঁকায় পড়তে পারেন না এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও আপনারা এই বাস্তবতা-বর্জিত প্রদর্শনী দ্বারা ধোঁকা দিতে পারেন না।

এজন্যই আমি আপনাদেরকে বলছি এবং আল্লাহর কসম! শুধু আপনাদের কল্যাণ কামনার জন্যই বলছি, আপনারা নিজেদের এসব প্রথাগত মজলিসসসূহের সজ্জিত আয়োজনের পূর্বে নিজেদের উজাড় হয়ে যাওয়া অন্তরের খবর নিন। ঝাড়বাতিগুলো আলোক সজ্জিত করার পরিবর্তে নিজেদের অন্তরগুলোকে ঈমানের নূর দ্বারা আলোকিত করার ফিকির করুন।

আপনারা অন্যদের অনুকরণে মেকী ফুলের স্তবক সাজাচ্ছেন, কিন্তু আপনাদের পুণ্য ও সৌন্দর্যের যে বাগিচা বিরান হয়ে যাচ্ছে সেটির সংরক্ষণ ও সজীবতার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না। আপনারা রবিউল আউয়ালের বরকত ও রহমতসমূহের কল্পনা করে আনন্দের গীত গাইছেন, কিন্তু নিজেদের সেই বিপর্যয় নিয়ে মাতম করছেন না যে, আপনাদের খোদা আপনাদের ওপর ক্রুব্ধ হয়ে আছেন; আপনাদের মন্দ আমলসমূহের কারণে নারাজ হয়ে তিনি নিজের দেওয়া নেয়ামতসমূহ আপনাদের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন। আপনারা এখন নেতার পরিবর্তে দাস, শাসকের পরিবর্তে শাসিত, ধনীর পরিবর্তে দরিদ্র, অর্থশালীর পরিবর্তে নিঃস্বই শুধু নন, বরং ঘরহীন উদ্বাস্ত্ত মানুষে পরিণত হয়েছেন। আপনাদের ঈমানের বাতি নিভু নিভু। আপনাদের নেক আমলের ফুল শুকিয়ে গেছে। আর এসব গযবের পরও বড় গযব হলো, আপনারা এ দুরবস্থার বিষয়ে সম্পূর্ণ গাফেল হয়ে আছেন।

অতএব এই বঞ্চণা এবং এই ক্রোধ নিপতিত অবস্থার মধ্যেও কি আপনাদের এ অধিকার থাকে যে, অতীত-ভবিষ্যতের দ্বীন ও দুনিয়ার নেয়ামতসমূহ আনয়নকারী রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন-স্মরণে রবিউল আউয়ালে আনন্দ উদ্যাপন করবেন?

আল্লামা আবুল কালাম আযাদ বলেন, ‘মৃত্যু ও ধ্বংসের কি এ অধিকার থাকে যে, জীবন ও প্রাণের সঙ্গী বানাবে সে নিজেকে? এমন একটি মৃত লাশের ব্যাপারে দুনিয়ার বুদ্ধি-চেতনা কি হাসবে না- সেই লাশ জীবিতদের মতোই যদি জীবনকে স্মরণ করে? হাঁ, এটা সত্য যে, সূর্যের কিরণের মধ্যে দুনিয়ার জন্য বড়ই আনন্দ বিদ্যমান। কিন্তু অন্ধজনের কবে এ সৌভাগ্য হয় যে, সূর্যের উদয় হলে সেও চক্ষুষ্মানদের মতো উৎফুল্ল হবে।’

তাই উম্মতের হে উদাসীন সঙ্গীরা! আপনাদের উদাসীনতার জন্য শত আক্ষেপ, শত আফসোস! আপনাদের আত্মতৃপ্তির জন্য শত সহস্র কান্না ও মাতম! যদি আপনারা এই মুবারক মাসের প্রকৃত সম্মান ও বাস্তবতা থেকে বে-খবর থাকেন এবং শুধু মুখের গীতে, দেয়ালের সজ্জায় এবং আলোর ঝাড়বাতিগুলোর মাঝেই তাঁর স্মরণের উদ্দেশ্যকে হারিয়ে ফেলেন, তাহলে আপনাদের জেনে রাখা উচিত যে, এই মুবারক মাসটি হচ্ছে উম্মতে মুসলিমার ভিত্তি স্থাপিত হওয়ার প্রথম দিন, খোদাওয়ান্দী বাদশাহী প্রতিষ্ঠার প্রথম ঘোষণা, জমিনে খেলাফতে ইলাহীর উত্তরাধিকার দানের সবচেয়ে প্রথম মাস। সুতরাং এ মাসটি আগমনের আনন্দ এবং তার চর্চা ও স্মরণের স্বাদ গ্রহণের বিষয়টি ওই ব্যক্তির প্রাণের জন্য হারাম যিনি তার ঈমান ও আমলে সেই পয়গামে ইলাহীর তামীল ও অনুসরণ এবং সেই উসওয়ায়ে হাসানার অনুকরণ-পায়রবির কোনো নমুনা রাখতে পারেননি। ‘অতএব আপনি সুসংবাদ দিন তাদের, যারা কথা শুনে এরপর তারা তার উত্তমটাকে অনুসরণ করে। তারাই ওরা যাদেরকে আল্লাহ হেদায়েত দান করেছেন এবং তারাই বুদ্ধিমান।’ #

[আলফুরকান, রবিউল আউয়াল ১৩৫৫ হি.]

ভাষান্তর : শরীফ মুহাম্মদ

 

 

advertisement