রবিউস আখির ১৪৪১   ||   ডিসেম্বর ২০১৯

রুফাইদা রাযিআল্লাহু আনহা : মানবসেবায় নিবেদিতপ্রাণ এক মহীয়সী নারী সাহাবী

বিনতে হাসান

আমাদের সোনালি ইতিহাসের উজ্জ্বল পাতায় মানবসেবায় নিবেদিতপ্রাণ বহু মহামানবের উপস্থিতি রয়েছে- তা হয়ত আমরা কম মানুষই জানি। তারা অন্যের সেবায় জীবন কাটিয়েছেন। অন্যের হাসিতে তারা সদা নিজের আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন, অন্যের দুঃখে নিজেকে দুঃখী ভেবেছেন। তারা আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। তাদের পথচলার প্রতিটি পদ-নিশান আমাদের আগামীর পথনির্দেশক। আখিরাতের পথে তারা রাহবার।

এমনই এক মহামানবের উদ্ভাসিত জীবনের সামান্য কিছু আলোচনা করব। তিনি ছিলেন এক আনসারী সাহাবিয়া। খাযরাজের শাখাগোত্র আসলামের এক উজ্জ্বল প্রদীপ। এক মহীয়সী নারী।

সারাজীবন যিনি অন্যের ঘরে আলো জ্বেলেছেন। প্রদীপ-হাতে ঘুরে বেরিয়েছেন। যেখানেই প্রয়োজন-ছুটে গিয়েছেন।

তিনি ছিলেন চিকিৎসায় পারদর্শী। আহতদের চিকিৎসা, বিনামূল্যে অসুস্থদের  সেবা- এই ছিল তার জীবনের ব্যস্ততা। দুর্বল ও অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতেন। যুদ্ধের ময়দানে আহতদের সেবা, তৃষ্ণার্তকে পানি পান করানো তার বিশেষ কাজের অন্যতম। তরবারির ঝনঝন শব্দ আর ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি।

তার জীবনের বিশদ বিবরণ তো ইতিহাসে আসেনি, কিন্তু যতটুকু এসেছে তা দ্বারাই আমরা এই মহীয়সী নারীর উজ্জ্বল কীর্তিগাঁথা সম্পর্কে জানতে পারি।

তার সম্পর্কে মুসলিম মনীষীদের কিছু বক্তব্য তুলে ধরছি :

ইবনে ইসহাক রাহ. বলেন, তিনি আহতদের সেবা করতেন। আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের আশায় অসহায় মুসলমানদের সেবা করতেন। (দ্র. তারীখুত তবারী ২/৫৮৬; আলইস্তিআব ৩৩৪০; উসদুল গাবাহ ৬৯২৫; আলইসাবা ১১১৮১)

তার মানবসেবা ছিল কোনোরূপ বিনিময় ছাড়া। পার্থিব কোনো স্বার্থ ছাড়া। পরম লক্ষ্য ছিল আপন রবের সন্তুষ্টি, কেবল তাঁরই রেযামন্দি।

ইবনে সা‘দ রাহ. বলেন, তিনি হিজরতের পরে বাইআত হয়েছেন। মসজিদে নববীর পাশেই তার তাঁবু ছিল।  সেখানে তিনি অসুস্থ এবং আহতদের সেবা করতেন। সা‘দ বিন মুআয রা.-এর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তার সেবা করেছেন। তিনি খায়বার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। (তাহযীবুত তাহযীব ২৭৯১; তবাকাতে ইবনে সা‘দ)

ওয়াকিদী রাহ. বলেন, তিনি আহতদের সেবা করতেন। অসুস্থদের চিকিৎসা করতেন। অসহায় এবং অনাথের পাশে দাঁঁড়াতেন। মসজিদের পাশেই তার খীমা ছিল। আর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা‘দ বিন মুয়াযকে তার খীমাতেই রেখেছিলেন। (কিতাবুল মাগাযী ২/৫১০)

মনীষীদের এসব উক্তি থেকেই আমরা তার জীবন সম্পর্কে জানতে পারি। আর হাদীসে রাসূলে তার সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-

মাহমুদ বিন লাবীদ রা. বলেন, খন্দকের যুদ্ধে যখন সা‘দ বিন মুয়ায রা. আহত হলেন তখন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা তাকে রুফাইদার খীমাতে নিয়ে যাও। বর্ণনাকারী বলেন, রুফাইদা রা. হলেন এমন এক নারী, যিনি আহতদের সেবা করতেন। এরপর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকাল-সন্ধ্যা তার খবর নিতেন। (আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ১১২৯)

অর্থাৎ খাইমাতু রুফাইদা (রুফাইদার তাঁবু) যেন মানুষের কাছে এক প্রসিদ্ধ নাম ছিল, আহতদের সেবার এক আস্থাভাজন কেন্দ্র ছিল। তাই তো মসজিদের নিকটেই ছিল তার তাঁবু। নবীজীর খুব কাছাকাছি। মুআয রা. আহত হলেই নবীজী তাকে রুফাইদার তাঁবুতে পাঠিয়ে দিলেন। কত আস্থার সাথে। কত নির্ভরতার সাথে। বললেন, তাকে (সা‘দ বিন মুআয রা.) রুফাইদার তাঁবুতে নিয়ে যাও, যেন আমি তাকে সকাল-সন্ধ্যা দেখতে পারি।

রুফাইদা রা.-এর মত আরো অনেক নারী সাহাবী জিহাদের কঠিন মুহূর্তেও আহতদের সেবায় নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখতেন। বিশেষত আসলাম গোত্রের নারীরা। এই গোত্রেরই আরেক নারী হলেন উম্মে সিনান আসলামী। নবীজীর কাছে জিহাদে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন; আহতদের ঘায়ে মলম, পিপাসার্তের মুখে পানি- এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ আঞ্জামের জন্য। নবীজী অনুমতি দিলেন এবং বললেন, আল্লাহর বরকত নিয়ে বের হও। তোমার কওমের আরো অনেক নারী আছে, আমি যাদেরকে অনুমতি দিয়েছি, তুমি চাইলে তাদের সাথে থাকতে পার। (আততাবাকাতুল কুবরা, ইবনে সা‘দ ৪২৪৪)

রুফাইদা রা.-ও আসলাম গোত্রের একজন ছিলেন। দিন-রাত এক করে তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন মানবসেবায়। যুদ্ধের কঠিন মুহূর্তেও সেবা বন্ধ থাকেনি। অস্ত্রের ঝনঝনানির মাঝেও তার কাজ থেমে থাকেনি। মানুষও ছুটে আসত তার তাবুতে। তাইতো অনেক ঐতিহাসিক ‘খাইমাতু রুফাইদা’কে মুসলিম ইতিহাসের প্রথম মুসতাশফা বা চিকিৎসালয় আখ্যা দিয়েছেন।

যুদ্ধ ছাড়াও সাধারণ সময়েও মানুষের কাছে তার তাঁবু ছিল বাতিঘরের মত। তা ছিল অসুস্থ মানুষের আস্থার ঠিকানা। মুখে মুখে তাই ছড়িয়ে গিয়েছিল ‘খাইমাতু রুফাইদা’র নাম।

হাদীসের ভাষ্য এবং মুসলিম মনীষীদের বক্তব্য থেকেই আমরা তাঁর এই ‘মুসতাশফা’ এবং তার জীবন সম্পর্কে জানতে পারি। আসুন, আমরা আলোকিত এই প্রদীপ থেকে আলো গ্রহণ করি।

 

 

advertisement