মুহাররম ১৪৪১   ||   সেপ্টেম্বর ২০১৯

মহীয়সী নারীদের জীবনকথা

হাফসা বিনতে সীরীন ও মাওলানা ইমদাদুল হক

মক্কা, মদীনা, কুফার ন্যায় বসরা নগরীও ছিল দ্বীনের এক উর্বর ভূমি। এ উর্বর ভূমিতে জন্ম নিয়েছেন হাজারো আলেম, মুহাদ্দিস, ফকীহ, ক্বারী, আরবী ব্যাকরণবিদ, আবেদ, যাহেদ। হাসান বসরী, মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন, রাবেয়া বসরী, মুয়াযা আল আদাবিয়া, ছিলা ইবনে আশইয়াম, ইয়াস ইবনে মুয়াবিয়া এ মহামনীষীগণ এ বসরা নগরীরই সন্তান। হাফসা বিনতে সীরীনও তাদের একজন। নারী তাবেয়াদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম সারির।

তিনি ইলম, প্রজ্ঞা, ইবাদাত-বন্দেগী, পরহেযগারী ইত্যাদিতে হাসান বসরী ও আপন ভাই মুহাম্মাদ ইবনে সীরীনের সমকক্ষ। নবীজীর একান্ত খাদেম হযরত আনাস রা.-এর সাথে ছিল তার পারিবারিক সম্পর্ক। তাঁর কাছ থেকে হাফসা বিনতে সিরীনের ভাই-বোন সকলে ইলম, আমল, আখলাক শেখেন।

নুসায়বা বিনতে কা‘ব নামে একজন বড় সাহাবিয়া ছিলেন। নবীজীর সাথে অনেক যুদ্ধে শরীক ছিলেন। অসুস্থদের সেবা করতেন। আহতদের চিকিৎসা করতেন। নবীজীর কন্যা ইন্তেকাল করলে তাঁকে তিনিই গোসল করান। মৃতের গোসলের পদ্ধতির ক্ষেত্রে তাঁর হাদীসই মূল। ইবনে আবদুল বার রাহ. বলেন-

كانت من كبار نساء الصحابة

তিনি নারী সাহাবীগণের মধ্যে উপরের তবকার সাহাবিয়া ছিলেন।

হাফসা বিনতে সীরীন এ মহান সাহাবিয়া থেকেও ইলম শেখেন এবং তাঁর আমল, আখলাক ও প্রজ্ঞা দ্বারা আলোকিত হন।

বসরাতে ছিলেন আরেক মহান তাবেয়ী আবুল আলিয়া রুফাই ইবনে মেহরান। তাবেয়ীদের মাঝে ইলম, আমল ও প্রজ্ঞায় যারা শীর্ষে, তিনি ছিলেন তাদের একজন। আবু বকর ইবনে আবু দাউদ বলেন, সাহাবীদের পর কুরআন সম্পর্কে আবুল আলিয়া থেকে বেশি জ্ঞানী কেউ নেই। হাফসা বিনতে সীরীন এ মহান তাবেয়ী থেকেও ইলম অর্জন করেন।

এছাড়াও বসরার অন্যান্য আলেম থেকেও ইলম অর্জন করে। অসংখ্য ছাত্র তার থেকে ইলম আহরণ করে। ঐ যুগের বড় বড় আলেম তার থেকে ইলম অর্জন করতে আসেন। আইয়ূব আসসাখতিয়ানী, খালিদ আলহাযযা, আছিম আল আহওয়াল, আবদুল্লাহ ইবনে আওন, কাতাদা, ইবনে সীরীন, হিশাম ইবনে হাসসান, কাযী ইয়াস ইবনে মুয়াবিয়া; যারা ছিলেন ঐ যুগের বিদগ্ধ প-িত মুহাদ্দিস, যারা ছিলেন ঐ যুগের ইলমের ইমাম। এরা সকলে তার ছাত্র। তার কাছ থেকে হাদীস অর্জন করেন।

সম্ভবত হাদীসের এমন কোনো কিতাব পাওয়া যাবে না, যেখানে তার হাদীস নেই। হাদীসশাস্ত্রে যেসব ব্যক্তি শীর্ষ চূড়ায় উন্নীত, যাদের হাদীস গর্ব সহকারে হাদীস বিশারদগণ বর্ণনা করতেন হযরত হাফসা এদের অন্যতম।

হাদীসের ক্ষেত্রে তিনি যেমন বিদগ্ধ প-িত ছিলেন তেমনিভাবে জ্ঞানী ছিলেন কুরআনের বিষয়েও। কুরআন পাঠের অনেক নিয়মনীতি আছে। মদ-গুন্নাহ, মাখরাজ, সিফাত, ওয়াকফ-ওয়াস্ল-সহ অনেক বিষয় রয়েছে, যার কায়দা-কানুন অনেক। আবার কুরআনের অসংখ্য শব্দ এমনও রয়েছে, যা বিভিন্নভাবে পড়া যায়, যাকে পরিভাষায় ‘কিরাত’ বলে। এটা স্বতন্ত্র এক বিরাট শাস্ত্র। হযরত হাফসা এ শাস্ত্রেও পা-িত্য অর্জন করেন; বরং মাত্র বার বছর বয়সেই এ শাস্ত্র আয়ত্ব করেন।

হাফসা বিনতে সীরীন হলেন মহান তাবেয়ী মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন-এর বোন। ইবনে সীরীন ইবাদাত-বন্দেগীসহ যাবতীয় বৈশিষ্ট্যে হাসান বসরীর সমকক্ষ; বরং কোনো কোনো বৈশিষ্ট্যে তিনি এগিয়ে। দু’জন একই সময়ের এবং একে অপরের বন্ধু। এ ইবনে সীরীনের মত মহাপ-িতও কুরআনের কোনো কোনো বিষয়ে বোন হাফসার শরণাপন্ন হতেন। বর্ণনাকারী বলেন, কুরআনের পাঠরীতির কোনো বিষয়ে ইবনে সীরীনের খটকা হলে বলতেন, যাও তোমরা হাফসাকে জিজ্ঞেস কর। আর সে কীভাবে পাঠ করে শোন।

আর ইবাদত-বন্দেগীতে তিনি এমন ছিলেন, যা আমাদের জন্য অবিশ্বাস্য। হিশাম বলেন, তার নামাযের ঘরে জোহরের সময় যে প্রবেশ করতেন আর বের হতেন না। ইবাদত-বন্দেগীতে ডুবে থাকতেন। সেখানে আসর, মাগরিব, ইশা, ফজর পড়ে যখন ভালোভাবে সূর্য উদিত হত তখন নামায পড়ে বের হতেন। এসময় অযু গোসল ও ঘুম সেরে নিতেন। এরপর যখন যোহরের সময় হত তখন পুনরায় নামাযঘরে চলে যেতেন। মাহদী ইবনে মায়মূন বলেন, হাফসা তার নামাযের ঘরে ত্রিশ বছর ছিল; তা থেকে কোনো প্রয়োজন  ছাড়া বের হত না।

তার বাদীকে জিজ্ঞাসা করা হল, তুমি তোমার মুনীবকে কেমন দেখেছ? বাদী সহজ-সরল ছিল, সে বলল, মুনীব তো অনেক নেককার, ভালো মানুষ, তবে মনে হয় তিনি বড় কোনো গুনাহ করেছেন, তাই সারা রাত শুধু কাঁদেন আর নামায পড়েন।

তিনি সর্বদা রোযা রাখতেন। প্রতি রাতে পনের পারা কুরআন তিলাওয়াত করতেন। 

শরীয়তের এমন অগাধ জ্ঞান ছিল ও শরীয়তের এমন পাবন্দ ছিলেন যে, আছিম বলেন, আমরা একবার তার নিকট যাই। তিনি তখন বড় ওড়না দিয়ে মুখম-লসহ নিজেকে ঢেকে নেন। তখন তিনি বয়োবৃদ্ধা, আমরা বললাম কুরআনে তো আছে-

وَ الْقَوَاعِدُ مِنَ النِّسَآءِ الّٰتِیْ لَا یَرْجُوْنَ نِكَاحًا فَلَیْسَ عَلَیْهِنَّ جُنَاحٌ اَنْ یَّضَعْنَ ثِیَابَهُنَّ غَیْرَ مُتَبَرِّجٰتٍۭ بِزِیْنَةٍ.

[যেসব বয়োবৃদ্ধা নারী, যাদের বিবাহের বয়সই শেষ, তারা যদি সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তাদের অতিরিক্ত বস্ত্র খুলে রাখে তাতে কোনো দোষ নেই। -সূরা নূর (২৪) : ৬০]

তিনি জবাবে বললেন, আয়াতের পরের অংশে কী আছে পড়, আমরা বললাম-

وَ اَنْ یَّسْتَعْفِفْنَ خَیْرٌ لَّهُنَّ

(তবে এ থেকে বিরত থাকাই তাদের জন্য উত্তম।)

বলে উঠলেন, এজন্যই এ বড় ওড়না।

হিশাম বলেন, তিনি আমাদের বলতেন, হে যুবকরা! আমল যা করার যৌবনেই কর। কেননা আমার নিকট যৌবনের আমলই আমল এবং যৌবনে যত করা যায় পরে ততটুকু হয় না।

মোটকথা, ইলম, ইবাদত, আখলাকসহ সব গুণে তিনি ছিলেন অনন্য। এসব গুণাবলীতে তিনি অনেক পুরুষকে ছাড়িয়ে যান। হাসান বসরী তো সবার নিকট প্রসিদ্ধ, তেমনি হাফসার ভাই ইবনে সীরীনও তাবেয়ীদের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব। কেউ কেউ বলেন, হযরত হাফসা এদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।

ইসলামী ইতিহাসে বিচারক ইয়াস ইবনে মুয়াবিয়া বিরাট এক ব্যক্তিত্ব। বিচারকার্যে তার দক্ষতা ও তার বুদ্ধির প্রখরতা প্রবাদ হয়ে রয়েছে। বলা হয়, পূর্ণ বুদ্ধিমান ব্যক্তি প্রতি শতাব্দীতে একজন করে জন্ম নেয়। ইয়াস তাদের একজন। এ ইয়াস ছিলেন বসরার বিচারক। তিনি বলেন, আমি যাদেরকে দেখেছি তাদের সবার থেকে হাফসাকে শ্রেষ্ঠ দেখেছি। তখন তাকে প্রশ্ন করা হল, হাসান বসরী, ইবনে সীরীন থেকেও? তিনি বললেন, হাঁ, তাদের থেকেও। আবু দাউদ বলেন, নারী তাবেয়ীদের মধ্যে সেরা হলেন হাফসা। তারপর আমরা, তারপর (ছোট) উম্মুদ দারদা। প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ ইমাম সফদী ও ইমাম যাহাবী তার জীবনী এভাবে সমাপ্ত করেন-

كانت عديمة النظر في نساء وقتها، فقيهة صادقة فاضلة، كبيرة القدر.

তার সময়কার উপমাহীন এক মহান নারী। ফকীহা- দ্বীনী ইলমে প্রাজ্ঞ। অনেক বড় মর্যাদার অধিকারী মহীয়সী নারী।

হযরত হাফসার পিতা হলেন সীরীন। কূফাতে তাদের বাড়ী ছিল। তিনি অমুসলিম ছিলেন। হযরত আবু বকর রা.-এর খেলাফতকালে খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ কূফা জয় করেন। তখন সীরীন যুদ্ধবন্দী হন। বন্দীদের মদীনায় নিয়ে আসা হয়। বণ্টনে তিনি নবীজীর খাদেম হযরত আনাস রা.-এর ভাগে পড়েন। হযরত আনাস রা. তাকে কিছু মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্ত করে দেন। এরপর মুসলমান হন। তিনি পাতিল তৈরি করতেন আর এর ব্যবসা করতেন। ব্যবসা ভালো হয়। বিবাহের সময় হলে হযরত আবু বকর রা.-এর বাদী সাফিয়্যাকে বিবাহ করেন এবং বড় ওলীমা করেন। অনেক সাহাবী তাতে শরীক হন এবং দুআ করেন। আল্লাহর মহিমা, এ গোলাম সীরীনের পরবর্তী যে কয়জন সন্তানই হয় সবাই ইলম, আমল, প্রজ্ঞা, দুনিয়াবিমুখতা ইত্যাদিতে শীর্ষে পৌঁছেন।

হাফসা বিনতে সীরীনের আলোচনা তো হল। মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন (ইবনে সীরীন)-এর প্রসিদ্ধি জগৎজোড়া। কুরআন-হাদীসের ইলম, ইবাদত ও পরহেযগারী তো আছেই, স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদানের ক্ষেত্রে তার পরে তার মত কোনো ব্যক্তি জন্ম নেয়নি। তাদের আরেক ভাই হলেন ইয়াহইয়া ইবনে সীরীন। তিনি মহামারীতে ভাই-বোনদের মধ্যে সর্বপ্রথম মারা যান। তিনি এত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন যে, কারো কারো মতে, তিনি হাফসা ও ইবনে সীরীন থেকেও শ্রেষ্ঠ। তাদের আরেক ভাই হলেন আনাস ইবনে সীরীন। তিনিও অনেক বড় মুহাদ্দিস। হাদীসের কিতাবে তার বর্ণনা পর্যাপ্ত। তাদের এক বোনের নাম কারীমা। তিনি বোন হাফসার মত এত ইবাদত করতেন যে, বোনের মত পনের বছর তার নামাযের ঘর থেকে বিনা প্রয়োজনে বের হননি।

ইসলাম ও অন্য ধর্মের মাঝে পার্থক্য এখানেই। যে যুদ্ধবন্দি হত্যার উপযুক্ত, তাকে হত্যা না করে মুসলমানদের ঘরে আপন হয়ে থাকার সুযোগ, অতপর মুক্তি, এরপর ইসলামের মর্যাদার ক্ষেত্রে অপরাপর মুসলিমদের সমান হতে হতে ইলম ও সম্মানের শীর্ষ চূড়ায়। তো যে ছিল লাঞ্ছিত এক বন্দি, কিছুদিন পরেই সে মুসলামানদের ইমাম-রাহবার।

শুধু সে নয়, গোলামের ছেলে গোলাম না হয়ে বরং তার সকল ছেলে-মেয়ে হয়ে যায় সে যুগের ও পরবর্তী যুগের শ্রদ্ধেয়-বরেণ্য ব্যক্তি, অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।

আমরা যারা মুক্ত অবস্থায়ই পৃথিবীর প্রথম শ্বাস গ্রহণ করেছি তাদের জন্য রয়েছে এ গোলামদের জীবনে এক বিশেষ বার্তা, যা কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

আর এ শুধু একটি-দুটি ঘটনা নয়; বরং ইসলামের ইতিহাসে বহু গোলাম মুসলিম সমাজে সম্মানের শীর্ষ চূড়ায় আরোহণ করেছে। মুহাদ্দিস, মুফতী, কারী, ব্যাকরণবিদ, বিচারক, গভর্নর, সেনাপতিসহ মুসলিম সমাজের শীর্ষপদে আরোহণ করেছে। আজ আমরা তাদেরকে সর্বোচ্চ সম্মানের সাথে স্মরণ করি ও মেনে চলি। অন্য কোনো ধর্ম, অন্য কোনো জাতি তাদের ইতিহাস থেকে এমন নযীর পেশ করুক।

সুতরাং যুদ্ধবন্দি ও গোলাম-বাদীর বিষয়ে যারা ইসলাম ও মুসলিমকে বিভিন্ন মিথ্যা অপবাদ দেয়ার অপচেষ্টা চালায় তারা জ্ঞানপাপী ও মানবতার দুশমন। আল্লাহ আমাদেরকে আমাদের দ্বীনের মূল্য বোঝার এবং এ নিআমতের কদর করার তাওফীক দান করুন- আমীন।

তথ্যসূত্র : তাহযীবুল কামাল, সিয়ারুল আ‘লামিন নুবালা, তাবাকাতে ইবনে সাআদ, তারিখুল ইসলাম

 

 

advertisement