রজব ১৪৩১   ||   জুলাই ২০১০

মরুর বুকে বিলাসিতার প্রতীক

ইসহাক ওবায়দী

মিসর-বিজয়ী সেনাপতি হযরত আমর ইবনুল আস রা.-এর নাম আমরা সবাই জানি। মিসর বিজয়ের পর পরাজিত রাজন্যবর্গের উদ্দেশৌ তিনি একটি ভোজের আয়োজন করেছিলেন। তাতে আরব মুসলমানদের সাধারণ খাবারের ব্যবস'া করা হয়েছিল। তিনি লক্ষ করলেন, রাজারা এসব সাধারণ খাবার খেতে পারছে না। তবু ভদ্রতার খাতিরে খাওয়ার ভান করে যাচ্ছে এবং একে অপরকে ইশারায় বলছে, ‘এমন অসভ্য জাতি (যারা খাওয়া পর্যন- জানে না) কীভাবে আমাদের পরাস- করল?’ হযরত আমর ইবনুল আস রা. দ্বিতীয় দিনও ভোজের আয়োজন করলেন এবং খুব চিকন ও সুস্বাদু খাবারের ব্যবস'া করলেন। উপরন' প্রত্যেকের জন্য ছিল আলাদা ব্যবস'া। রাজারা আজ তৃপ্তির সাথে খেলেন এবং একে অপরকে বললেন, ‘এরা তো সবই জানে দেখছি’। সে সময় আমর ইবনুল আস রা. অতিথিদের লক্ষ করে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। সে ভাষণে তিনি বললেন, ‘মুসলমানরা বিলাসিতা সম্পর্কে অজ্ঞ নয়; তবে বিলাসিতার জন্য তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়নি। মুসলমানরা শুকনা রুটি ও মোটা কাপড়ে অভ্যস- বলেই তোমাদের উপর বিজয়ী হয়েছে। পক্ষান-রে তোমরা বিলাসিতার কারণে পরাজিত হয়েছ। মুসলমানরা যেদিন বিলাসিতায় অভ্যস- হবে সেদিন তারাও তোমাদের মতো পরাজিত হবে।’ কালের পরিক্রমায় হযরত আমর ইবনুল আস রা.-এর কথা বার বার সত্য হয়েছে। মুসলমানদের কোনো গোষ্ঠী যখন ত্যাগের জীবন ছেড়ে ভোগের জীবনে মত্ত হয়েছে তখনই তাদের পতন ঘটেছে। যার মর্মানি-ক ইতিহাস আঁকা আছে স্পেনের আলহামরা, আগ্রার তাজমহল এবং মুসলিম জাহানের বিভিন্ন বিলাসী স'াপনায়। আজ গোটা পৃথিবীতে মুসলমানদের যে অবর্ণনীয় দুর্দশা তার কারণ যদি জানতে চান তাহলে মুসলমানদের জীবন-যাত্রার দিকে তাকান। আত্মবিস্মৃতির এক মর্মানি-ক চিত্র দেখতে পাবেন। একটি দৃষ্টান- দেখুন, ইসরাইল যখন পারমাণবিক বোমায় তার আস্ত্রাগার সমৃদ্ধ করছে এবং রোবোটিক ওয়ারের সকল প্রস'তি সম্পন্ন করছে তখন দুবাই নগরীতে নির্মিত হয়েছে ‘বুর্জে খলীফা’! এই গগনচুম্বী স'াপনার উদ্বোধন হয়েছে গত ৪ জানুয়ারি। তার আগের দিন পর্যন- নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এমার প্রপার্টিজ ভবন নিয়ে বিশ্ববাসীকে রহস্যের মধ্যে রেখেছে। বিশ্বকে জানতে দেয়নি আসলে তাদের ভবনটির উচ্চতা কত। উদ্বোধনের পরপরই জানা গেল বুর্জ খলীফা গোটা দশেক বিশ্বরেকর্ড করে বসে আছে। উচ্চতম দালানের রেকর্ড তো আছেই তার সঙ্গে যোগ হয়েছে উচ্চতম মসজিদ, উচ্চতম সুইমিং পুল এবং এলিভেটরে চড়ে দীর্ঘতম ভ্রমণের রেকর্ড। ১৬০ তলা বিশিষ্ট বুর্জ খলীফা উচ্চতায় এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের দ্বিগুণ। বুর্জ খলীফা তৈরির আগ পর্যন- পৃথিবীর উচ্চতম দালান ছিল তাইওয়ানের তাইপে ১০১। তাইপের উচ্চতা ১৬৬৭ ফুট। বুর্জ খলীফা এখন শুধু বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবনই নয় এটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে উচু স'াপনাও বটে। পোল্যান্ডের ওয়ারশ রেডিও টাওয়ারকে (২,১২০,৬৭ ফুট) টপকে বিশ্বের সর্বোচ্চ স'াপনার রেকর্ডও দখলে নিয়ে নিয়েছে বুর্জ খলীফা। দুবাইয়ের এই দানবীয় ভবনটির নির্মাণে খরচ হয়েছে পাক্কা দেড়শ কোটি মার্কিন ডলার। সময় লেগেছে পাঁচ বছর। ২০০৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ভবনটির কাজ আরম্ভ হয়। ১৬০ তলার এই দালানে সাত তারা হোটেলসহ রেসে-ারাঁ, করপোরেট অফিস, আবাসন ব্যবস'া, মসজিদ, সুইমিংপুল ইত্যাদি সব কিছুই আছে। অভ্যন-রীণ সজ্জায় এক হাজার চিত্রকর্ম স'ান পেয়েছে। ভবনের ১৯ থেকে ৩৭ তলা এবং ৭৭ থেকে ১০৮ তলায় রয়েছে আবাসনের ব্যবস'া। প্রায় ৯০০ এপার্টম্যান্ট রয়েছে এই ভবনে। নির্মাতাদের দাবি, বিক্রির ঘোষণা দেওয়ার মাত্র আট ঘণ্টার মাথায় সব কটি এপার্টমেন্ট বিক্রি হয়ে যায়। বুর্জ খলীফার প্রতি বর্গফুট জায়গার মাসিক ভাড়া (অফিস-আদালতের জন্য) চার হাজার ডলার বা দুই লক্ষ আশি হাজার টাকা। বুর্জ খলীফাকে ঢাকতে ১৫ লক্ষ ২৮ হাজার বর্গফুট কাঁচ লেগেছে। বহিরঙ্গে সাজসজ্জার জন্য চীন থেকে আনা হয়েছে ৩০০ বিশেষজ্ঞ। বিশাল এই ইমারতটি একসঙ্গে ২৫ হাজার লোকের ভার সইতে পারবে। এই ভবনে ৫৭ টি লিফট আছে, আছে ৮টি চলন- সিড়ি। এত উঁচুতে ওঠা যেন ক্লানি-কর না হয় তাও বিবেচনায় রাখা হয়েছে। বিশ্বের দ্রুততম লিফট বানিয়ে দেওয়া হয়েছে বুর্জ খলীফার জন্য। একেকটি এলিভেটর সেকেন্ডে ৩৩ ফুট ওপরে উঠতে পারে। বস'ত মরুর বুকে বিলাসিতার এক মূর্ত প্রতীক ‘বুর্জ খলীফা’। এবং অবশ্যই মুসলমানদের নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম স্মারক। তাজমহলের মতো বুর্জ খলীফার নির্মাণের পেছনেও রয়েছে হাজার হাজার শ্রমিকের বঞ্চনার অশ্রু। নির্মাণ-শ্রমিক আনা হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়া থেকে। অভিযোগ আছে, সেসব শ্রমিকের পারিশ্রমিক ঠিকমতো দেওয়া হয়নি। একজন দক্ষ কাঠমিস্ত্রি রোজ ৪ দশমিক ৩৪ পাউন্ড করে পারিশ্রমিক পেত। আর সাধারণ শ্রমিকদের দেওয়া হত দৈনিক ২.৮৪ পাউন্ড করে। এই যৎসামান্য পারিশ্রমিক প্রায়ই আটকে দেওয়া হত। এসবের প্রতিবাদে আড়াই হাজার শ্রমিক ২০০৬ সালে ২১ মার্চ কর্মবিরতি ঘোষণা করে বিক্ষোভ করে। অনেক ক্ষেত্রে বৃহৎ স'াপনা মানেই শ্রমিকের ঘামের সাথে বেইনসাফীর ইতিহাস। সে হোক মিসরের পিরামিড কিংবা আগ্রার তাজমহল। অথবা সামপ্রতিক সময়ের বুর্জ খলীফা। এই প্রতিযোগিতা যদি কোনো অমুসলিম দেশে হত তাহলে দুশ্চিন-ার কিছু ছিল না। কিন' যখন মুসলিম দেশগুলোতে দেখি, ভোগ-বিলাসের প্রতিযোগিতা তখন একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠে বাগদাদ, স্পেন ও দিল্লী পতনের মর্মন'দ দৃশ্য এবং সারা শরীর শিউরে উঠে আরেকটি মহা পতনের আশঙ্কায়। শুধু বুর্জ খলীফাই নয়, দুবাই এখন বিশ্বের সবচেয়ে বিলাসবহুল ‘আধুনিক’ শহর। সাগরতীরে মুক্ত বিনোদনের জন্য নাকি তৈরি হয়েছে শত শত প্রমোদ-ভবন। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে একদিকে চলছে শ্রমিক ছাটাই অন্যদিকে উদ্বোধন হচ্ছে এই সব পাপনিকেতনের। আসলে পতন সম্মুখে নয়, পতন তো শুরু হয়ে গেছে অনেক আগেই। ইঙ্গ-মার্কিন হায়েনারা গোটা আরববিশ্বকে চুষে নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন কলাকৌশলে। পশ্চিমানুরক্ত, পোশাকী মুসলিম রাজাদের পাহারাদারি ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার মিথ্যা অজুহাতেই নিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি ডলার। অথচ মুসলমান কোনো বিলাসী জাতির নাম নয়, মুসলমান হচ্ছে এমন এক জাতির উপাধি, যারা ‘ফোরসানুন বিননাহার’ ও ‘রোহবানুন বিল লায়ল’। দিবসের সংগ্রাম আর রজনীর রোনাযারীই হল এই জাতির পরিচয়। পৃথিবীতে তাদের আবির্ভাব ভোগ-বিলাসের জন্য নয়; বরং একমাত্র আল্লাহর বন্দেগীর জন্য। আর মানবজাতিকে রিপুর গোলামী থেকে মুক্ত করে এক আল্লাহর গোলামীতে নিয়োজিত করার জন্য। মুসলমান যখনই এক আল্লাহর গোলামী ছেড়েছে তখনই তারা আবদ্ধ হয়েছে হাজার বস'র গোলামীতে। ফলে যে শির আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে নত হওয়ার কথা ছিল না তা অবনত হয়েছে অর্থের সামনে, ক্ষমতার সামনে এবং নারী ও নৃত্যের সামনে। মুসলমানের ইতিহাস তো প্রাসাদ নির্মাণের নয়, জাতির ভবিষ্যত নির্মাণের। মুসলমানের ইতিহাস তো আমীরির মাঝে ফকীরির, পেটে পাথর বেঁধে জিহাদের ময়দানে শাহসওয়ারীর এবং রাতের আঁধারে ঘুমন- প্রজাদের পাহারাদারীর ইতিহাস। মুসলমানের ইতিহাস তো চল্লিশ বছর ইশার অযু দ্বারা ফজর আদায়ের ইতিহাস। মুসলমান যখন আদর্শের রাজপথ ছেড়ে সুর ও সুরায় লিপ্ত হয়েছে তখনই সে পরিণত হয়েছে অনাগত প্রজন্মের জন্য মর্মানি-ক ও শিক্ষণীয় দৃষ্টানে-। ইতিহাস বারবার ফিরে এসেছে, কিন' মুসলমানদের বড় অংশটাই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি। পতনকালে তারা ইসলামের শিক্ষা তো বটেই ইতিহাসের শিক্ষাকেও বিস্মৃত হয়েছে। গোটা পৃথিবীতে মুসলমানের সংখ্যা দেড়শ কোটি, তবু তারা পরাজিতদের কাতারে। পরাশক্তিগুলোর প্রায় সমস- কাঁচা রসদের মালিক হয়েও তারা লাঞ্ছিত ও অপদস-। এর একমাত্র কারণ হল, সঠিক, সংযমী ও সৈনিকের জীবন ছেড়ে তারা মত্ত হয়েছে ভোগের জীবনে। আবার যদি আমাদের ফিরে যেতে হয় সম্মান ও মর্যাদার দিকে তাহলে সেই সোনালী ইতিহাসের দিকেই আমাদের ফিরে যেতে হবে। একমাত্র আল্লাহই আমাদের ভাগ্য পরিবর্তনের মালিক।

 

advertisement