শাবান-রমযান ১৪৪০   ||   এপ্রিল-মে ২০১৯

যবান যার সিক্ত ছিল যিকিরের বৃষ্টিতে

সায়ীদুল হক

আলকাউসার জানুয়ারী ২০১৯ঈ. সংখ্যার ‘যবান যেন সিক্ত থাকে যিকিরের বৃষ্টিতে’ লেখাটি ভালো লেগেছে। পর্দানশীন পাতায় লেখাটি ছাপা হলেও, সবার জন্যই তা উপকারী। কিছুদিন পূর্বে  ঘরোয়া মজলিসে  একজন মহিয়সী নারীর কিছু হালাত শোনার তাওফীক হয়েছে। শুনেছি তারই দুই ছেলের যবানীতে। তাঁর আমল-আখলাক, ইবাদত-বন্দেগী, তাকওয়া-আল্লাহভীতি, আখেরাতের ভয়, আতিথেয়তা, আচার-ব্যবহার, চিন্তা-চেতনা, সন্তানদেরকে বা-আমল আলেম বানানোর ক্ষেত্রে অসাধারণ তরবিয়ত- সবই উল্লেখ করার মত। তাঁর সব বৈশিষ্ট্যের মাঝে যিকির ছিল অন্যতম। তার ব্যাপারেই বলা যায়- ‘যবান যার সিক্ত ছিল যিকিরের বৃষ্টিতে’।

তিনি ফাযায়েলে আমালের অনুবাদক মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ রাহ.-এর প্রথম কন্যা। মাওলানা মুশতাকুন্নবী হাফিযাহুল্লাহ (মুহতামিম, সুধন্যপুর মাদরাসা কোটবাড়ী, কুমিল্লা)-এর মুহতারামাহ আম্মা। গত ২৫-০৮-২০১৫ ঈ. আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।

মরহুমার দুই ছেলে মাওলানা ওমায়ের ছাহেব ও মাওলানা মারুফ ছাহেবের যবানীতে তাঁর কিছু বিবরণ তুলে ধরছি-

সারা জীবন আম্মুর মৃত্যুর একটা প্রস্তুতি ছিল। ঘরের যাবতীয় কাজ-কর্মের পাশাপাশি সবসময় যিকির করতেন। কোনো কাজ না থাকলে তিলাওয়াতে বসে যেতেন। তিলাওয়াত করতে থাকতেন, দীর্ঘ সময় তিলাওয়াত করতে থাকতেন।

সাধারণত মাসে ৩-৪  খতম আর রমযানে তা বেড়ে ১০-১২ খতম পর্যন্ত  হত। কারো মৃত্যুর খবর শুনলে ঐদিন খাবারের কথা ভুলে যেতেন। সারাদিন তিলাওয়াত করতেন আর কাঁদতেন। কিছুক্ষণ পর পর বড় বড় নিশ্বাস ফেলতেন  আর বলতেন- ‘হায়রে! কবরে কেমনে থাকব...!’ ‘হায়রে মওত রে...!’  শুধু কাঁদতেন আর কাঁদতেন।

ফজরের বেশ আগে ঘুম থেকে উঠতেন। শীতকাল হলে আব্বুর জন্য পানি গরম করতেন। নিজে অযু করে নামায পড়তেন। যিকির-আযকার করতেন। এরপর তিলাওয়াত করতে থাকতেন। ফজরের পর আবার তিলাওয়াতে বসতেন। এশরাক পর্যন্ত তিলাওয়াতে মশগুল থাকতেন। এশরাকের নামায পড়ে এরপর উঠতেন। সাধারণত এর ব্যতিক্রম হত না। এরপর সবার জন্য নাশতা তৈরি করতেন। সবাইকে খাওয়াতেন। আল্লাহ তাআলা তাকে দশজন পুত্রসন্তান ও তিনজন কন্যাসন্তান দান করেছিলেন।

নয়টার মধ্যে রান্নাবান্না শেষ হয়ে যেত। খাওয়া-দাওয়া শেষে সকলকে মাদরাসায় পাঠিয়ে দিতেন। আম্মুর হেকমতপূর্ণ শাসন ও প্রজ্ঞাপূর্ণ কঠোরতার কারণেই  আমরা দশ ভাইয়ের কেউই মাদরাসায় অনুপস্থিত থাকতে পারতাম না। সবাই মাদরাসায় চলে গেলে আম্মু আবার যিকির-তিলাওয়াতে মগ্ন হয়ে যেতেন। বেশিরভাগ সময় তিলাওয়াতে কাটাতেন। আল্লাহর কালামের সাথে তাঁর এক গভীর ভালোবাসা ছিল।

বেশি বেশি কালেমায়ে তায়্যিবার যিকির করতেন। একবার নিকটতম এক আত্মীয়কে বলেন- এত পান খেলে তুমি যিকির-তিলাওয়াত কর কখন?!

তিনি অনর্থক কথাবার্তা, গল্প-গুজব  মোটেই পছন্দ করতেন না। কাউকে উচ্চস্বরে হাসতে দেখলে খুব কষ্ট পেতেন এবং বলতেন, আল্লাহর নবী বলেছেন- বেশি হাসলে দিল মরে যায়। নিজে কখনো জোরে হাসতেন না, মুচকি হাসতেন। কম হাসতেন।

বাড়ির কাজ সবই করতেন। এত বড় সংসারের কাজকর্ম নিজেই করতেন, অন্যদেরকে (কন্যা, পুত্রবধু) সহযোগী হিসেবে রাখতেন। আব্বুর কাজগুলো কখনো এদিক সেদিক হত না। এত খেয়াল রাখতেন।

সারাদিন কাজকর্ম যিকির আযকার তিলাওয়াতের পাশাপাশি কয়েকটা বিষয়ে আম্মুর এস্তেকামাত উল্লেখযোগ্য-

১. নিয়মিত এশরাকের নামায পড়তেন।

২. সবসময় অযু অবস্থায় থাকতেন।

৩. ঘরে প্রবেশের সময় এহতেমামের সাথে সালাম দিতেন।

কখনো এর ব্যতিক্রম দেখিনি। শেষ বয়সে যখন পা ভেঙে গিয়েছিল তখনো না।

আমার অন্য খালাগণও তিলাওয়াত ও যিকিরের আমলে দায়েম ছিলেন। যতক্ষণ যবানে শক্তি আছে, যিকির করতে থাকেন। কাজ করছেন যিকিরও করছেন। আমার এক খালা সময়কে তিন ভাগ করে নিয়েছেন- আট ঘণ্টা কাজকর্ম, আট ঘণ্টা যিকির-তিলাওয়াত, আট ঘণ্টা ঘুম। রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তিনি তিলাওয়াতে বসে যান।

আমাদের আরেক খালা মদীনা মুনাওয়ারায় থাকেন। তিনি রাতে ঘুমান না। রাতভর যিকির-তিলাওয়াতে মশগুল  থাকেন। দীর্ঘ সময় নিয়ে তাহাজ্জুদ পড়েন। ফজরের পর সকালের যিকির-অযিফা শেষ করে এশরাক পড়ে তারপর বিশ্রাম করেন। এটা তাঁর নিয়মিত রুটিন। কয়েক দিনে খতম করেন। রমযান মাসে ১৫/১৬ খতম করেন।

এ বৈশিষ্ট্যগুলো তাঁরা নানুর কাছ থেকে পেয়েছেন। নানু অনেক বড় বুযুর্র্গ আবেদা নারী ছিলেন।

আম্মুর ইন্তেকালের পর আব্বু (হযরত মাওলানা আবদুল কুদ্দুস ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম, প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ, টুমচর ইসলামিয়া ফাযিল মাদরাসা, সদর, লক্ষ্মীপুর) স্বপ্নে দেখেছেন, আম্মু বসে বসে তিলাওয়াত করছেন। অনুরূপ স্বপ্ন আমিও (মাওলানা ওমায়ের) দেখেছি। আম্মু আখেরাতের নেকীর বিষয়ে খুব বেশি ফিকির করতেন; মনে হয় মৃত্যুর পরও সেটি ভুলেননি।

আল্লাহ তাআলা আম্মুকে পরিপূর্ণ মাগফিরাত দান করুন। নিজ অনুগ্রহে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন- আমীন।

 

 

advertisement