শাবান-রমযান ১৪৪০   ||   এপ্রিল-মে ২০১৯

রক্তস্নাত আননূর মসজিদ : মুসলমানের এই পবিত্র রক্তে দূর হোক বর্ণবাদের কালিমা

গত ১৫ই মার্চ শুক্রবারে নিউজিল্যান্ডের দুটি মসজিদে সমবেত মুসল্লীদের উপর গুলি চালিয়ে নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি শুধু মুসলিমদেরই কাঁদায়নি, বিশ্বের নানা প্রান্তের বহু অমুসলিমকেও নাড়া দিয়ে গেছে। মিডিয়ার ভাষ্যমতে, ঐ হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৫০ জন এবং আহত হয়েছেন ২০ জনের মতো। এদের মধ্যে রয়েছেন কয়েকজন নারী ও শিশু।

নিউজিল্যান্ড দেশটি মোটামুটি শান্ত একটি দেশ হিসেবেই পরিচিত। দুটি বড় দ্বীপ নিয়ে  দেশটি গঠিত। উত্তরের দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত রাজধানী শহর ওয়েলিংটন আর দক্ষিণের দ্বীপের সবচেয়ে বড় শহর ক্রাইস্টচার্চ। এই ক্রাইস্টচার্চের আননূর মসজিদে জুমার নামাযের কিছুক্ষণ আগে সমবেত মুসল্লীদের উপর হামলা চালায় এক অস্ট্রেলিয়ান বন্দুকধারী।

২৮ বছর বয়েসী এই সন্ত্রাসী সম্পর্কে জানা গেছে যে, তার নাম ব্রেন্টন ট্যারান্ট। সে একজন কট্টর শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী। একইসাথে চরম মুসলিম বিদ্বেষী। ২০১১ সালে নরওয়েতে ৭৭ জন মানুষ হত্যা করেছিল এন্ডার ব্রেভিক নামক যে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী- ব্রেন্টন তার পছন্দের ব্যক্তি  হিসেবে এই এন্ডার ব্রেভিকের নাম বলেছে, অপর যার নাম সে বলেছে, তিনি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ধারণা করা যায়, এরা দু’জনই হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট বা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী।

পশ্চিমা দেশগুলোতে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসের ভয়াবহ বিস্তারের পিছনে ট্রাম্পের মতো রাজনীতিকদের অবদান অনেক বেশি। আমাদের প্রতিবেশী দেশেও উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিস্তারের পিছনে অন্যতম কারণ এটা। পশ্চিমের ‘শ্বেতাঙ্গ-শ্রেষ্ঠত্ববাদে বিশ্বাসীরা’ সাদা চামড়া ছাড়া অন্যদের বোঝাতে ‘ইনভেডর’ শব্দটি ব্যবহার করে, যার অর্থ, আগ্রাসী হামলাকারী! তবে ‘ইনভেডর’ বলতে এরা সাধারণত মুসলিম জনগণকেই বুঝিয়ে থাকে। ব্রেন্টন ও তার মতো লোকেরা শ্বেতাঙ্গ ছাড়া দুনিয়ার আর সবাইকে হত্যা করা বৈধ মনে করে।

হামলাকারী ব্রেন্টনের রাইফেলের গায়ে আলেসান্দ্রে বিসনেত্তা ও লুকা ত্রাইনির নাম লেখা ছিল। প্রথম জন অর্থাৎ আলেসান্দ্রে বিসনেত্তা ২০১৭ সালে কানাডাতে একটি মসজিদে হামলা চালিয়ে ছয় জনকে হত্যা করেছিল। অপরজন অর্থাৎ লুকা ত্রাইনি ২০১৮ সালে ইতালীতে আসা শরণার্থী আফ্রিকানদের উপর গুলি চালিয়েছিল। সন্ত্রাস ও বর্ণবাদের কী জঘন্য রূপ!

শে^তাঙ্গ বর্ণবাদীদের সন্ত্রাসের ভয়াবহতা বোঝার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা-সংস্থা অ্যান্টি ডিফেমেশন লীগের একটি তথ্য কিছুটা সহায়তা করতে পারে। তাতে বলা হয়েছে, গত দশ বছরে (২০০৮ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত) আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে যে হামলা হয়েছে, তার শতকরা  ৭১ ভাগ হামলার ঘটনার সাথে জড়িত শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীরা। এরা খ্রিস্টান, ইহুদী এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী।

অথচ বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে মুসলমানদেরই সন্ত্রাসী ও জঙ্গি বলে আখ্যায়িত করা হয়। বেদনার বিষয় হচ্ছে, মুসলিম দেশগুলোর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তো বটেই, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে কর্মরতদের মাঝেও এই প্রপাগান্ডা বেশ  পাকাপোক্তভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে এই অন্যায় প্রপাগান্ডা অবশ্যই খণ্ডন করতে হবে।

বর্তমান বিশ্বে বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার যে ভয়াবহ বিস্তার তা কোনো চিন্তাশীল মানুষকে উদ্বিগ্ন না করে পারে না। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধি থেকে কীভাবে মানবজাতির মুক্তি ঘটবে?

বর্তমান অসুস্থ বিশ্বের দিকে তাকালে বিদায় হজ্বে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই সারগর্ভ নির্দেশনার তাৎপর্য ও যথার্থতা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়া থেকে বিদায় নেবার আগে গোটা বিশ্ববাসীকে লক্ষ্য করে যে শিক্ষা দান করে গেছেন সেই শিক্ষার দিকেই মানবজাতিকে আবার ফিরে আসতে হবে।

يَا أَيّهَا النّاسُ، أَلَا إِنّ رَبّكُمْ وَاحِدٌ، وَاِنَّ أَبَاكُمْ وَاحِدٌ، أَلَا لَا فَضْلَ لِعَرَبِيٍّ عَلَى عَجَمِيٍّ ، وَلَا لِعَجَمِيٍّ عَلَى عَرَبِيٍّ، وَلَا أَحْمَرَ عَلَى أَسْوَدَ، وَلَا أَسْوَدَ عَلَى أَحْمَرَ، إِلّا بِالتّقْوَى.

হে লোকসকল! সাবধান! তোমাদের রব একজন, তোমাদের বাবাও একজন। সাবধান! কোনো আরবীর শ্রেষ্ঠত্ব নেই কোনো আজমীর উপর, কোনো আজমীর শ্রেষ্ঠত্ব নেই কোনো আরবীর উপর; কোনো লাল চামড়ার মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নেই কালো চামড়ার মানুষের উপর, কোনো কালো চামড়ার মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নেই লাল চামড়ার মানুষের উপর। শ্রেষ্ঠত্ব শুধু তাকওয়ার দ্বারা। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৪৮৯

এই ঘোষণা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐসময় দান করেছেন যখন আল্লাহ তাআলা ইসলামকে জয়যুক্ত করেছেন এবং অচিরেই এই দ্বীন বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়বে, রোম-ফারিসের অপশাসনের অবসান ঘটবে এবং সে ভ‚খণ্ডে ন্যায় ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার আমানত মুসলিম উম্মাহর উপর অর্পিত হবে- এই আসমানী প্রতিশ্রূতি তিনি সাহাবীদেরকে জানিয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বনবী রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী কী তাৎপর্য বহন করে তা আজ চিন্তা-ভাবনা করা  উচিত। সময়ের বিবর্তনে আজ যারা বিশ্ব রাজনীতিতে ক্ষমতার মঞ্চে  তাদের কর্তব্য বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা ও জীবনাদর্শের সাথে নিজেদের অবস্থানকে মিলিয়ে দেখা।

বিশ্বের জাতিসমূহের মাঝে মর্যাদার আসন লাভের উপায় জুলুম-অত্যাচার নয়, মর্যাদার আসন পাওয়ার উপায় হচ্ছে, নীতি, আদর্শ, ন্যায়বিচার ও পরোপকার। দেশে দেশে ক্ষমতাসীনদের এই মহাসত্যটি উপলব্ধি করতে হবে। আরবী ভাষার একটি প্রবাদ ‘আন্ নাসু আলা দ্বীনি মুলূকিহিম’। অর্থাৎ রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম। রাজা যদি সৎ ও ন্যায়পরায়ণ হন প্রজাসাধারণের মধ্যে সততা ও ন্যায়পরায়ণতার বিস্তার ঘটে আর রাজা যদি হয় অসৎ ও উৎপীড়ক তাহলে সে দেশের অসৎ ও উৎপীড়ক শ্রেণি প্রেরণা ও প্ররোচনা লাভ করবে। আজ বিশ্ব রাজনীতির যারা নিয়ন্ত্রক তাদের সংকীর্ণ মতাদর্শেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে এসব মর্মান্তিক ঘটনার মধ্য দিয়ে।

আজ যারা নিরস্ত্র মুসলিমদের উপর কাপুরুষোচিত হামলা করছেন, এর মধ্য দিয়ে তারা প্রকাশ করছেন নিজেদের ক্ষুদ্রতা, হিংস্রতা ও পাশবিকতা। তারা মুসলিমদের পরাস্ত করছেন না, পরাস্ত করছেন নিজেদের।

নিউজিল্যান্ডে জুমার নামাযের আগে বন্দুকের গুলি চালিয়ে যে নিরস্ত্র মুসলিমদের হত্যা করা হয়েছে আমাদের অন্তর তাদের জন্য বেদনাহত, কিন্তু বুকে বেদনার পাথর চাপা দিয়ে যে কথাটি আমরা বলব, তা হচ্ছে, আমরা প্রত্যাশা করি, আল্লাহ তাআলা আমাদের এই ভাই-বোনদের শাহাদাতের মর্যাদা দান করবেন!

জুমার পবিত্র দিনে তারা ইবাদতের প্রেরণা নিয়ে মসজিদে এসেছেন। ঈমান-তাওহীদ ও আল্লাহর স্মরণের পরিবেশে তাঁরা ছিলেন। আর সেসময় তাদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। ঐ শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীর হয়ত জানা নেই, এই ধরনের মৃত্যু আমাদের ইসলামী বিধানে শ্রেষ্ঠ মৃত্যু তথা শাহাদাতের মৃত্যুরই এক প্রকার। কাজেই হে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী! কীভাবে তুমি মুসলমানকে পরাস্ত করবে?!

নিউজিল্যান্ডের ঐ মর্মান্তিক ঘটনায় একদিকে যেমন স্থাপিত হয়েছে পশ্চিমের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের পুঁতিগন্ধময় দৃষ্টান্ত, অন্যদিকে তা মুসলিম সমাজের কিছু উন্নত বৈশিষ্ট্যেরও স্মারক হয়ে থাকবে। বন্দুকধারী যখন নিরস্ত্র মুসল্লীদের উপর গুলি চালাতে শুরু করে তখন কয়েকজন মুসলিম নিজের জান বাজি রেখে ঐ সন্ত্রাসীকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে একজন পাকিস্তানী বংশদ্ভ‚ত নাঈম রাশেদ, যিনি নিরস্ত্র অবস্থায় অতি সাহসিকতার সাথে ঐ সশস্ত্র সন্ত্রাসীকে ধাওয়া করেন। ফলে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হলেও ঐ সন্ত্রাসী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় এবং অনেক মুসল্লী প্রাণে বেঁচে যান। এরকম আরেকজন হচ্ছেন, বাংলাদেশী হুসনে আরা পারভীন। তিনি ও তার স্বামী ঐদিন আননূর মসজিদে নামায পড়তে গিয়েছিলেন। ২০০৪ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় দুই পা হারান স্বামী ফরিদ আহমেদ। সেই থেকে তিনি হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন। স্বামীকে  সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করেন হুসনে আরা। গত শুক্রবার স্বামীকে মসজিদে নিয়ে যান তিনি। ফরিদ আহমেদ বলেন, গুলির শব্দ শুরু হতেই আমি হতভম্ভ হয়ে পড়ি। সবাই চারদিকে ছোটাছুটি শুরু করেন। আমি হুইল চেয়ারে বসে মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকি। হঠাৎ দেখি, আমার স্ত্রী এসে আমাকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। সে দ্রæত আমাকে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে বলল, তুমি এখানে থাক। আমি আটকে পড়া মহিলা ও শিশুদের বের করার চেষ্টা করি। একথা বলে সে আবার মসজিদে প্রবেশ করে। ইতিমধ্যে বন্দুকধারী আবার গুলি চালাতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ পেলাম!

ফরিদ আহমেদ বলেন, আমার অসংখ্য বন্ধুর সাথে আমার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকেও যার কারণে হারাতে হয়েছে আমি তার প্রতি কোনো ঘৃণা পোষণ করছি না। আমার স্ত্রীর ইচ্ছা অনুযায়ী আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আমার স্ত্রী সবসময় বলতেন, কারো প্রতি ঘৃণার মনোভাব দেখিও না। সবাইকে সবসময় ভালবাসবে। তাহলেই পৃথিবীতে শান্তি আসবে।

হে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী! যাকে তুমি গুলি করেছ এই হচ্ছে তার পরিচয়!

এই মর্মান্তিক হামলার পর নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী যে সৌজন্য ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন সেটাও সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। আমরা মনে করি, নিউজিল্যান্ডের এই নারী ট্রাম্পের মতো পুরুষদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ!

 

 

advertisement