জুমাদাল আখিরাহ-রজব ১৪৪০   ||   মার্চ ২০১৯

যেভাবে আমার স্ত্রী এ পৃথিবী ছেড়ে গেলেন

মুহাম্মাদ জাহিরুল আলম

[জনাব জাহিরুল আলম একজন আইনজীবী, সাংবাদিক ও সুলেখক। সঙ্গে সঙ্গে একজন আল্লাহভক্ত মানুষ। উলামায়ে কেরামের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক তাঁর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তাঁর স্ত্রীও নেককার নারী ছিলেন।

একজন নেককার নারীর কিছু কথা পাঠিকা ও পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন তাঁর স্বামী নিজেই। -সহ সম্পাদক]

 

পবিত্র রমযানুল মুবারকের নাজাত পর্বে অর্থাৎ শেষ দশকে বেজোড় সংখ্যার দিনে আমার স্ত্রী মিসেস শাহনাজ জাহির ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

আমার স্ত্রীর ইন্তেকালের দিনটি আমার জীবনের সীমাহীন কষ্টবহ দিন। প্রায় বায়ান্ন বছরের বিবাহিত জীবনের সবগুলো দিনই ছিল সুন্দর, যা সে সাজিয়েছিল তার একক ভাবনায়। সে ছিল একজন সুন্দর আখলাকের মানুষ। তার সাজানো সংসার ছিল একটি শান্তিময় ভুবন, যার পরিবেশ ছিল  একেবারে স্বর্গীয়।

মানুষের মৃত্যু পূর্বনির্ধারিত, যা কোনো ক্রমেই না এক মুহূর্ত পেছাবে না এক মুহূর্ত এগিয়ে যাবে। আর এই বিশেষ মুহূর্তটি সকল মানুষের নিকটেই আল্লাহ তাআলা রেখেছেন অজানা। যখন যার এই মুহূর্তটি উপস্থিত হবে তখন ঠিক সেই মুহূর্তেই সে যাত্রা করবে- অন্য এক অজানা জীবনের উদ্দেশে। পৃথিবীর কোনো মহাশক্তিই তা রহিত করতে পারবে না। ক্ষণকালের জন্যও নয়। কেননা তা মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার অমোঘ নির্দেশ। আমার স্ত্রীও যাত্রা করেছে সে অজানা জীবনের উদ্দেশে, গত ১০ জুন ২০১৮ তারিখে।

আমার আম্মা এই পৃথিবী ছেড়েছেন প্রায় ২৫ বছর পূর্বে। সে ক্ষত এখনো আমার হৃদয়ে কাঁচা। অনেক পরে উপলব্ধি করেছি যে, এ ক্ষত শুকাবার নয়। জীবনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে সে ক্ষত। সুতরাং জীবন যতদিন ক্ষতও ততদিনের।

এবার এলো স্ত্রী বিয়োগ। সে এ পৃথিবী ছেড়েছে পবিত্র রমযানুল মুবারকের নাজাত দশকে। নাজাত অর্থ হল, মুক্তি; জাহান্নাম থেকে মুক্তি। জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত বা মুক্তি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এ সময়টাই আমার স্ত্রীর ইহকাল ত্যাগের সময় হিসেবে নির্ধারণ করে রেখেছিলেন।

আমরা মৃত্যুটাকে বড় করে দেখে অভ্যস্ত, মৃত্যুর সময়টাকে নয়। কারণ আমাদের ধর্মজ্ঞানের অভাব। এত সুন্দর এত পবিত্র আর রহমত-বরকতে ভরপুর একটা সময় পরম করুণাময় আমার স্ত্রীর পরকাল-যাত্রার সময় হিসেবে নির্ধারণ করেছেন বলে আমি তাঁর পবিত্র দরবারে সীমাহীন শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।

আমার স্ত্রীর আখলাক ছিল সৌন্দর্যম-িত। আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও যার সাথেই যখন তার পরিচয় হয়েছে তারা সকলেই তার সুন্দর চরিত্রে মুগ্ধ হয়েছে। উপরন্তু তিনি সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন, পবিত্র পোশাক-আশাকে সজ্জিত হয়ে থাকতে ভালোবাসতেন। জীবনে বহুবার এমন হয়েছে যে, নতুন আগন্তুক ছাড়াও আত্মীয়-স্বজন কোনো কারণে হঠাৎ  করে বাসায় এলে প্রবেশ করেই প্রশ্ন করেছেন, আপনারা কি বাইরে যাচ্ছেন? উত্তরে ‘না’ বললে তারা প্রত্যুত্তরে বলেছেন, তবে বাইরে বেরুবার পরিচ্ছদে রয়েছেন? এমন ঘটনা ঘটেছে জীবনে অনেকবার। কিন্তু তা আজ প্রথম প্রকাশ করলাম, তার ইন্তেকালের পর।

তার কাজকর্ম ও জীবনের প্রায় সবকিছুই এত সুন্দর আর আকর্ষণীয় ছিল যে, তা কারো স্মৃতি থেকে ঝরে পড়বার নয়।

সদা হাস্যময় সুন্দর চেহারা। সন্তানদের প্রতি প্রয়োজনের চেয়েও অতি মনোযোগী ও তৎপর। সংসারের সকল বিষয়ে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সকল আত্মীয়-স্বজনের সাথেই সুন্দর সম্পর্ক রক্ষা করে চলার অপরূপ কৌশল নিয়েই যেন সে জন্মগ্রহণ করেছিল।

খুব স্বল্পদিনের অসুস্থতাও কাটিয়ে উঠতে পারেননি আমার স্ত্রী। বিদায় নিল নিভৃতে নিরালায়। অসুস্থ অবস্থায়ও রাত-বিরাতে আমাকে ঘুম থেকে জাগাতে বিব্রত বোধ করত সে। যদিও তাকে আমি প্রায়ই বলতাম, যখন তখন আমাকে নির্দ্বিধায় জাগাবে। যখন দরকার তখনই ডাকবে। সে জানত যে, আমার ঘুম খুব হলকা। একবার ডাকলেই আমি শুনতে পাই। তবুও বিব্রত বোধ করত আমাকে ডাকতে। শেষ দিকে প্রতি রাতেই ওকে উঠতে হতো বার কয়েক।

অবশ্য আমাদের বড় সন্তান ডা. নাজমুল পাশেই লিভিং রুমে সোফার ওপর রাত কাটাত তাকে সেবা দেবার জন্য। মা-ও শেষ সময়টায় ওকেই ডাকত ঘন ঘন নিঃসঙ্কোচে।

আমার স্ত্রীর প্রারম্ভিক রোগ ছিল উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিক ইত্যাদি। চিকিৎসা ঠিকমত সঠিক নিয়মে চললেও ক্রমে ক্রমে তা ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথিতে রূপ নেয় এবং পরে ধীরে ধীরে এডিমা এবং আরো পরে তা ফুসফুসে আঘাত হানলে শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে শুরু করে। বিগত কয়েক বছরে কেবল ঔষধ বৃদ্ধি আর পরিবর্তন চলতে থাকে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের চিকিৎসাধীন থেকে এবং উন্নততর চিকিৎসা গ্রহণ সত্ত্বেও রোগ না কমে এমনভাবে বৃদ্ধি পায় যে, তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

অবশেষে এল সে বেদনার মুহূর্ত। এ পৃথিবীকে চির বিদায় জানাবার মুহূর্ত। পবিত্র রমযানুল মুবারকের একেবারে শেষ দিক। হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম পবিত্র লাইলাতুল কদর তালাশে শেষ দশক অতিক্রম করছে মুসলিম উম্মাহ। ১০ জুন ২০১৮। আমি যোহরের সালাতে শরীক হতে তৈরি হচ্ছি, মসজিদে যাব বলে। আমাদের তিন সন্তানই তাদের মায়ের কাছে রয়েছে হাসপাতালে। ছোট ছেলে রাইয়ান ফোন করে আমাকে জানাল যে, তার স্ত্রী আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে আসছে। আমি যেন তৈরি থাকি। আমি তো তৈরিই ছিলাম।

হাসপাতালে পৌঁছেই শাহনাজের বেডের পাশে রাখা চেয়ারে বসে ওকে আস্তে করে ডাকতেই ও চোখ মেলে তাকাল আমার দিকে। বড় বড় চোখের ডাগর দৃষ্টিতে অসুস্থতার ক্লান্তি রয়েছে কিন্তু কোনক্রমেই পৃথিবী ছেড়ে যাবার কোনো লক্ষণ তাতে ছিল না।

অসুস্থ বলে ওর দিকে আমি কখনও অধিক্ষণ ধরে তাকাতে পারতাম না। কারণ আমার কেবল বুক ফেটে কান্না চলে আসত। কান্না রোধ করার আমার কোনো ক্ষমতাও ছিল না। মাঝে মাঝেই কেবল ডুকরে কেঁদে কেঁদে উঠতাম।

প্রায় বায়ান্ন বছরের সার্বক্ষণিক সঙ্গীকে অবশিষ্ট জীবনের জন্য হারাব তা মন কোনোক্রমেই মেনে নিতে পারছিল না। এত বছরের বিবাহিত জীবনের দীর্ঘ পরিসরে যেখানে ওর সামান্যতম ত্রুটিও আমাকে কখনও বিব্রত করেনি। অসংলগ্ন অন্যায় আচরণ যেখানে সে শেখেইনি। খারাপ শব্দ ব্যবহার করে কথা বলার শিক্ষা যার নেই। স্বামীর প্রতি ভালোবাসা কেবল ভালোবাসাই যার একমাত্র পুঁজি- আজ আমি তাকেই হারাতে বসেছি?

যে আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের জন্য আল্লাহর রহমত স্বরূপ, আমার সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনাই কেবল যার জীবনের উদ্দেশ্য; সে কি আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে চিরতরে?

আল্লাহ যা করেন সব মানুষের কল্যাণের জন্য। আমরা মানুষেরা কেবল নিজেরাই নিজেদের নানান বিভ্রান্তির মধ্যে ঠেলে দেই। ভুল বুঝি। ভুল করি। ভুল-ভ্রান্তিতে ভরপুর স্বল্পতর সময়ের জন্য অবস্থানস্থল এই পৃথিবীকে স্থায়ী ভেবে কেবল কল্পনার প্রাসাদ রচনা করে চলি। ভেবে দেখি না যে, আমরা এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছি কেবল একদিন মৃত্যুবরণ করব বলে। অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে আমরা কেউই পরিত্রাণ পাব না। একদিন হিসেব-নিকেশের সম্মুখীন হতে হবে আমাদের। যে মুহূর্তে একজনের মৃত্যু আসে সে মুহূর্ত থেকেই তার কিয়ামত শুরু। সে কিয়ামতের জন্য সকল মানুষেরই প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। সে প্রস্তুতির সময়টিই হল এই পৃথিবীর অবস্থানকালটা। যে এই কালটাকে কাজে লাগাতে পারবে পরকালের প্রস্তুতির জন্য সে-ই কেবল সফল ব্যক্তি।

যা হোক, কাছে বসে আস্তে করে ডাকতেই শাহনাজ বড় বড় করে তাকাল আমার দিকে। আমি ওর কপালে হাত রাখতেই দেখি কপালটা একেবারে ঘামে ভিজে গেছে। ভিজে চপ চপ হয়ে গেছে কপালটা। আমি একটা টিস্যু নিয়ে মুছে দিলাম। উচ্চারণ করলাম কালেমা তায়্যিবা- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’, উচ্চারণ করলাম কালেমা শাহাদাত। সেও আমার সাথে উচ্চারণ করতে চেষ্টা করেছে, তা তার ঠোঁট নাড়ানো থেকেই প্রতীয়মান হয়। তারপর আমি সূরা ইয়াসীনেরও কিছু অংশ তিলাওয়াত করলাম। বাসা থেকে বের হবার পূর্বে আমি সূরা ইয়সীন পাঠ করেছি। ইচ্ছা ছিল ওর পাশে বসে আরো দুবার সূরা ইয়াসীন পাঠ করব। সে আশা পূর্ণ হয়নি। শাহনাজের দুচোখ থেকে দু’ফোঁটা পানি মুক্তোর মত বেরিয়ে এল এবং আমার হাতের উপরই সে যাত্রা করল তার স্থায়ী আবাসের দিকে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

আমি আমার চোখের পানি সংবরণ করতে পারিনি। অনবরত পানির স্রােত বেয়ে আসল আমার দুচোখে। শাহনাজ চলে গেল আমাদের ছেড়ে, চিরতরে।

শাহনাজ ভালোবাসতো তার ভাইবোনদের। ভালোবাসতো আমার ভাইবোনদেরও। সকলের প্রতি তার ¯েœহ-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ছিল বর্ণনাতীত। তার মৃত্যুর পর তাযথাযথ উপলব্ধি করা গেছে। সর্বস্তরে অকৃত্রিম কাঁন্না যেভাবে শুরু হয়েছে তার বর্ণনা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব।

মানুষ পৃথিবীতে স্থায়ী নয়। একদিন তাকে এই পৃথিবী অবশ্যই ছেড়ে যেতে হবে।  আল্লাহর এ বার্তা প্রায় সকলেরই জানা। তবুও প্রাণপ্রিয় কেউ এই পৃথিবী ছেড়ে গেলে অন্যরা কষ্ট পাবে। আঘাতে জর্জরিত হবে, কান্নায় ভেঙ্গে পড়বে এটা পৃথিবীরই সাধারণ বিধান। শাহনাজের বিদায়েও একই রকম হবার কথা। কিন্তু তার বেলায় ছিল ব্যতিক্রম। শাহনাজের ভাইবোনেরা ছিল তার সন্তানেরই মত। তারা বোনকে নয় যেন আবার অনেকদিন পর তাদের মা’কেই হারিয়েছে। সব ভাইবোনই প্রায় বিধ্বস্ত।

হে রাব্বুল আলামীন! তুমি দয়া করে ওকে ক্ষমা করে দাও। ক্ষমা করে দাও তার সকল পাপ, সগীরা, কবীরা, জাহেরী, বাতেনী, বেদআতী, জানা-অজানা সকল পাপ সকল অপরাধ। তুমিই ভালো জানো, আর আমি তার স্বামী হিসেবে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, যা ওর সম্পর্কে বলেছি তার সব কথা সত্য। তুমি তাকে দয়া করে ক্ষমা কর এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে আবাসস্থল দান কর- আমীন, ছুম্মা আমীন।

 

 

advertisement