জুমাদাল উলা ১৪৪০   ||   ফেব্রুয়ারি ২০১৯

গোমরাহী ছেড়ে হেদায়েতের উপর আসা ছাড়া গোমরাহী দূর হয় না

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

গোমরাহী ও হেদায়েত একটি অপরটির বিপরীত। গোমরাহীর শিকার ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যে পর্যন্ত গোমরাহীর বিষয়গুলো ছেড়ে সঠিক পথে না আসে ঐ পর্যন্ত তাদের গোমরাহী দূর হয় না। গোমরাহী যে পর্যায়েরই হোক- কুফর-শিরক পর্যায়ের হোক কিংবা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর পথ থেকে বিচ্যুতি ও ‘ইহদাস ফিদ্দীন’ পর্যায়ের হোক- তা দূর হওয়ার একমাত্র উপায় গোমরাহী ছেড়ে হেদায়েতের পথে চলে আসা।

এই কথাগুলো খুব সূক্ষ্ম ও কঠিন কথা নয়, খুবই সহজ-স্বাভাবিক কথা। এরপরও তা বলার প্রয়োজন হচ্ছে এইজন্য যে, কিছু লোক জেনে-বুঝে কিংবা না জেনে-না বুঝে বিষয়টি ঘোলাটে করছেন। তাদের ধারণা এবং অন্যদেরও তারা এই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে, গোমরাহীকে পর্দার আড়ালে নিয়ে যাওয়া, কিংবা তার কোনো রকম ব্যাখ্যা-তাবীল করে ফেলা, কিংবা আমজনতার একটি অংশকে ভুলভাল বুঝিয়ে পক্ষে টানতে সক্ষম হওয়া কিংবা কোনো মাদরাসা-পড়–য়া মৌলভী সাহেবের সমর্থনসূচক কিছু বলে দেওয়া বা লিখে দেওয়াই গোমরাহী শেষ হয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। এজাতীয় কিছু ঘটে গেলেই গোমরাহীর শিকার ব্যক্তি বা গোষ্ঠী গোমরাহীর কারণগুলো বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও এমন হয়ে যাবে, যেন তাদের মাঝে কোনো গোমরাহীই নেই!

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এজাতীয় চিন্তা-ভাবনা ও কার্যকলাপের দ্বারা গোমরাহী তো দূর হবেই না; বরং তা গোমরাহীর লালন-বর্ধন এবং প্রতিষ্ঠা ও বিস্তারে সহায়ক হবে। কাজেই এইসব গোঁজামিল বাদ দিয়ে মনে-প্রাণে সর্ব প্রকারের গোমরাহী ত্যাগ করে সঠিক পথে ফিরে আসাই মুমিনের ঈমানী যিম্মাদারি।

গোমরাহী থেকে একজন কেন ফিরে আসবে? ফিরে আসবে আল্লাহর নারাজি থেকে বাঁচার জন্য। আল্লাহর নারাজি থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে, সত্যি সত্যি গোমরাহী ত্যাগ করা। আল্লাহর সাথে কি ধোঁকাবাজি করা যায়? কুরআন মাজীদে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে যে, ওরা আল্লাহর সাথে ধোঁকাবাজির আচরণ করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা ধোঁকা দেয় নিজেদেরকেই। মানুষকে ভুলভাল বুঝিয়ে, অসত্য কথন, অপব্যাখ্যা ও অপপ্রচারের আশ্রয় নিয়ে কী লাভ হবে? হয়তো কিছু সহজ-সরল মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে, তাদের কাছে ভালো থাকা যাবে, আখিরাতে কি নাজাত পাওয়া যাবে? আখিরাতের নাজাতের জন্য তো সত্যি সত্যি গোমরাহী ছাড়তে হবে। মনেপ্রাণে গোমরাহী ছাড়তে না পারলে গোমরাহীর স্তর ও পর্যায় অনুসারে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। এটা তো ব্যক্তির নিজের ক্ষতি। কুরআন মাজীদে মুনাফিক সম্প্রদায়ের যে বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে তার সাথে কোনোরূপ সাদৃশ্য সৃষ্টি হওয়াও তো মুমিনের শানের উপযোগী নয়। তাই মানুষকে বিভ্রান্ত করা নয়; খাঁটি মনে তওবা করে ফিরে আসা কর্তব্য।

আজকাল তো গোমরাহীর শিকার লোকজনকে এমন কথাও বলতে শোনা যায় যে, অমুক ব্যক্তি যখন তাদের সাথে মুসাফাহা বা মুআনাকা করেছেন তখন তাদের গোমরাহী শেষ হয়ে গেছে। এই মুসাফাহা-মুআনাকাই যেন তাঁর পক্ষ হতে সনদ যে, তিনি এদেরকে এদের সকল গোমরাহী সহকারেই ‘হেদায়েত-প্রাপ্ত’ ঘোষণা করে দিয়েছেন।

এগুলো যে সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত কথাবার্তা তা ওরাও ভালো করেই বোঝে। কোনো সম্মিলিত দ্বীনী কাজের জন্য কারো সাথে এই মর্মে সমঝোতা করা যে, উভয় পক্ষ ঐ নির্দিষ্ট কাজটি সঠিক পন্থায় সম্পন্ন করবে, এ ধরনের কোনো সমঝোতা সঠিক উপায়ে হলে তা যেমন অবৈধ নয়, তেমনি তা একথাও প্রমাণ করে না যে, আহলে হক এ গোমরাহীর শিকার লোকদেরকে হকপন্থী বলে স্বীকৃতি দিলেন। তেমনি এই সাময়িক ও নির্দিষ্ট কাজে অংশগ্রহণের অর্থও কিছুতেই এই হয় না যে, গোমরাহীর পথ থেকে ফিরে না এসেও ওরা হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়ে গেছে এবং তাবলীগ বা আসল তাবলীগ শিরোনামে নিজেদের ভ্রান্ত মতবাদ প্রচার করার অধিকার পেয়ে গেছে। (নাউযুবিল্লাহ) এমনটা মনে করা নিতান্তই অর্থহীন চিন্তা।

কে না বোঝে যে, এজাতীয় নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে একসাথে কাজ করতে সক্ষম হওয়ার অর্থ এটাও নয় যে, জালিমের ইতিপূর্বেকার সকল জুলুমকে জুলুম নয় বলে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, কিংবা তার বিচারের দাবি ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। জুলুম ও গোমরাহী সব স্বস্থানে আছে। এইসব সত্ত্বেও হকপন্থী ব্যক্তিগণ যে একটি দ্বীনী কাজের স্বার্থে ঐ নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে একত্রে কাজ করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন এটা তাদের উদারতা ও সহনশীলতার আরেকটি দৃষ্টান্ত।

তো আহলে হক বুযুর্গদের পক্ষ হতে এ ধরনের ক্ষেত্রে সমঝোতার কোনো প্রচেষ্টা হলে একে শ্রদ্ধার সাথে নেওয়া উচিত। সফলতার জন্যে মনেপ্রাণে দুআ করা উচিত। আর তা তখনই হতে পারে, যদি ভুল পথে থাকা পক্ষটি সংশোধিত হওয়ার নিয়ত করে এবং নিজেদের অতীত কর্মকা-ের জন্য লজ্জিত হয়। তবে এর এই অপব্যাখ্যা কিছুতেই সঠিক নয় যে, সমঝোতার চেষ্টাকারীগণ গোমরাহীর অভিযোগে অভিযুক্ত লোকদেরকে হকপন্থী মনে করছেন এবং গোমরাহীর অভিযোগকে ভুল মনে করছেন। এটা এই উদার প্রয়াসের প্রতি অশ্রদ্ধাই শুধু নয়, এর মারাত্মক অপব্যাখ্যাও বটে।

এ তো গেল সাময়িক কোনো ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের ব্যাপার। সাধারণভাবেও আহলে হক বুযুর্গানে দ্বীন যখন বিবাদ নিষ্পত্তির চেষ্টা করেন তখন তার শর্ত পূরণ করেই তা করেন। বিবাদ নিষ্পত্তির গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে বিবাদ-বিশৃঙ্খলার সূত্র যদি হয় কোনো পক্ষের কোনো গোমরাহী তখন প্রথমে ঐ গোমরাহীর সংশোধন কাম্য হয়। সংশোধন বিহীন সমঝোতা একে তো সম্ভবই হয় না, দ্বিতীয়ত সম্ভব হলেও টেকসই হয় না।

আল্লাহ তাআলা বড়দের প্রচেষ্টাকে সাফল্যমণ্ডিত করুন এবং সকল জুলুম ও গোমরাহীর সংশোধনের সাথে সঠিক সমঝোতার তাওফীক দান করুন-আমীন।

اللّهُمّ أَلِّفْ بَيْنَ قُلُوبِنَا، وَأَصْلِحْ ذَاتَ بَيْنِنَا، وَاهْدِنَا سُبُلَ السّلَامِ، وَنَجِّنَا مِنَ الظّلُمَاتِ إِلَى النّورِ، وَجَنِّبْنَا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ.

 

 

 

advertisement