রবিউল আখির ১৪৪০   ||   জানুয়ারি ২০১৯

শয়তান যেভাবে মুসলিম ভ্রাতৃত্ব বিনষ্ট করে

মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানভী

কুরআন অধ্যয়নের আলোকে বুঝা যায়, ঈমানের পর ঐক্য ও একতা মুসলিম জাতির উপর আল্লাহ তাআলার সবচে বড় নিআমত। আর বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা সবচে বড় শাস্তি। কুরআন আমাদের বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হওয়ার পরিবর্তে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরতে বলে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে নিজ অনুগ্রহের কথা এভাবে বর্ণনা করেছেন-

وَ اعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللهِ جَمِیْعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوْا وَ اذْكُرُوْا نِعْمَتَ اللهِ عَلَیْكُمْ اِذْ كُنْتُمْ اَعْدَآءً فَاَلَّفَ بَیْنَ قُلُوْبِكُمْ فَاَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهٖۤ اِخْوَانًا،  وَ كُنْتُمْ عَلٰی شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَاَنْقَذَكُمْ مِّنْهَا،  كَذٰلِكَ یُبَیِّنُ اللهُ لَكُمْ اٰیٰتِهٖ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُوْن...

আল্লাহর রশিকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখ। এবং বিভেদ করো না। আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন তা স্মরণ রাখ যখন তোমরা একে অন্যের শত্রু ছিলে। অতপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরসমূহ জুড়ে দিলেন। ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকু-ের প্রান্তে ছিলে। আল্লাহ তোমাদেরকে সেখান থেকে মুক্তি দিলেন। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১০৩

পবিত্র কুরআনে আদেশ করা হয়েছে, আমরা যেন বিভেদ সৃষ্টি না করে রাসূলের আনুগত্য করি। নতুবা আমাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি হারিয়ে আমরা শত্রুদের চোখে হেয় প্রতিপন্ন হব। ইরশাদ হয়েছে-

وَ اَطِیْعُوا اللهَ وَ رَسُوْلَهٗ وَ لَا تَنَازَعُوْا فَتَفْشَلُوْا وَ تَذْهَبَ رِیْحُكُمْ وَ اصْبِرُوْا،  اِنَّ اللهَ مَعَ الصّٰبِرِیْنَ .

তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং পরস্পর কলহ করো না। অন্যথায় তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব বিলুপ্ত হবে। আর ধৈর্য ধারণ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। -আল আনফাল (৮) : ৪৬

পবিত্র কুরআনে পারস্পরিক মতভেদ দূর করার উপায়ও বলে দেওয়া হয়েছে। কুরআন আমাদের বলে, কোনো বিষয়ে মতভেদ হলে তোমরা সমস্যা সমাধানের জন্য তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদালতে পেশ কর। এরপর কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক যে ফায়সালা আসে তা সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নাও । ইরশাদ হয়েছে-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَطِیْعُوا اللهَ وَ اَطِیْعُوا الرَّسُوْلَ وَ اُولِی الْاَمْرِ مِنْكُمْ،  فَاِنْ تَنَازَعْتُمْ فِیْ شَیْءٍ فَرُدُّوْهُ اِلَی اللهِ وَ الرَّسُوْلِ اِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ،  ذٰلِكَ خَیْرٌ وَّ اَحْسَنُ تَاْوِیْلًا.

হে মুমিনগণ তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, তাঁর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা এখতিয়ারধারী তাদের। অতপর তোমাদের মধ্যে যদি কোনো বিষয়ে বিরোধ দেখা দেয় তাহলে তোমরা আল্লাহ ও পরকালে সত্যিকারে বিশ্বাসী হয়ে থাকলে সে বিষয়কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ন্যস্ত কর। এটাই উৎকৃষ্টতর পন্থা এবং এর পরিণামও সর্বাপেক্ষা শুভ। -সূরা নিসা (৪) : ৫৯

আরো ইরশাদ হয়েছে-

فَلَا وَ رَبِّكَ لَا یُؤْمِنُوْنَ حَتّٰی یُحَكِّمُوْكَ فِیْمَا شَجَرَ بَیْنَهُمْ ثُمَ لَا یَجِدُوْا فِیْ اَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَیْتَ وَ یُسَلِّمُوْا تَسْلِیْمًا.

(হে নবী) তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না নিজেদের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের ক্ষেত্রে তোমাকে বিচারক মানে, তারপর তুমি যে রায় দাও সে ব্যাপারে নিজেদের অন্তরে কোনোওরূপ কুণ্ঠাবোধ না করে এবং অবনত মস্তকে তা গ্রহণ করে নেয়। -সূরা নিসা (৪) : ৬৫

দুই মুসলমানের মাঝে  ব্যক্তিগত কোনো বিষয়ে মনোমালিন্য হলে ইনসাফ ও তাকওয়ার ভিত্তিতে তাদের মাঝে সন্ধি স্থাপন করে দেয়াটাই অন্যদের প্রতি কুরআনের নির্দেশ। ইরশাদ হয়েছে-

اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَةٌ فَاَصْلِحُوْا بَیْنَ اَخَوَیْكُمْ وَ اتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ .

প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মুসলিম ভাই ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দু ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমাদের প্রতি রহমতের আচরণ করা হয়। -সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১০

আল্লাহ না করুন, এ বিভেদ যুদ্ধের রূপ নিলে এবং মুসলমানরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়লে কুরআন আমাদের বলে, রং ও বর্ণ, দেশ ও জাতীয়তা এবং গোত্র ও আত্মীয়তার সম্পর্কের ঊর্ধ্বে উঠে চিন্তা করা, এদের মধ্যে হক ও সত্যের পথে কে আছে; আর কে সীমালংঘন করছে। যে পক্ষ সীমালঙ্ঘন করবে তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করা আবশ্যক। এবং সীমালংঘন ছেড়ে আল্লাহর হুকুম মেনে না নেওয়া পর্যন্ত তাদের সাথে কোনো ধরনের সন্ধি করতে কুরআনে স্পষ্ট নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ اِنْ طَآىِٕفَتٰنِ مِنَ الْمُؤْمِنِیْنَ اقْتَتَلُوْا فَاَصْلِحُوْا بَیْنَهُمَا،  فَاِنْۢ بَغَتْ اِحْدٰىهُمَا عَلَی الْاُخْرٰی فَقَاتِلُوا الَّتِیْ تَبْغِیْ حَتّٰی تَفِیْٓءَ اِلٰۤی اَمْرِ اللهِ،  فَاِنْ فَآءَتْ فَاَصْلِحُوْا بَیْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَ اَقْسِطُوْا،  اِنَّ اللهَ یُحِبُّ الْمُقْسِطِیْن.

মুসলিমদের দুটি দল আত্মকলহে লিপ্ত হলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিও। অতপর তাদের একটি দল যদি অন্য দলের উপর বাড়াবাড়ি করে তবে যে দল বাড়াবাড়ি করছে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যাবৎ না সে আল্লাহর হুকুমের দিকে ফিরে আসে। সুতরাং যদি ফিরে আসে তবে তাদের মাঝে ন্যায়সঙ্গতভাবে মীমাংসা করে দিও। এবং (প্রতিটি বিষয়ে) ইনসাফ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদের ভালোবাসেন। -সূরা হুজুরাত (৪৯) : ৯

শয়তান যে সকল কূটকৌশল ব্যবহার করে মুসলমানদের মাঝে বিভেদ ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে পবিত্র কুরআনে সেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রথম : মুসলমানদের মনে পরোপকারিতা, অন্যের কল্যাণকামিতা ও মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনা দুর্বল হয়ে পড়া এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের অন্যতম কারণ। ইসলামের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা হৃদয়ে না থাকলে মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ ও ইসলামী ঐক্যের গুরুত্ব মনে না থাকাই স্বাভাবিক। তখন বিভিন্ন দলে বিভক্ত হওয়াকে আর দোষের কিছু মনে হয় না।

দ্বিতীয় : মুসলিম ভ্রাতৃত্বকে দুর্বল ও নিস্তেজ করে দেওয়ার দ্বিতীয় মৌলিক মাধ্যম হল, এক মুসলমান অপর মুসলমানের প্রতি কুধারণা পোষণ করা। পবিত্র কুরআনে স্পষ্টভাবে কুধারণা থেকে বেঁচে থাকতে বলা হয়েছে এবং অমূলক ধারণাকে গুনাহ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

إِيّاكُمْ وَالظّنّ، فَإِنّ الظّنّ أَكْذَبُ الحَدِيثِ.

তোমরা কুধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কুধারণা সবচেয়ে বড় মিথ্যা। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫১৪৩

তৃতীয় : কুধারণা থেকে গীবত ও অপবাদের মতো বিভিন্ন দূরারোগ্য ব্যাধি জন্ম নেয়। কারো প্রতি কুধারণা সৃষ্টি হলে মনের ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দোষগুলো মনের আনন্দে বর্ণনা করার একটা পঙ্কিল ধারা তখন শুরু হয়ে যায়। কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ-ত্রুটি আলোচনা করাকে গীবত বলা  হয়। কুরআনের দৃষ্টিতে গীবত মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার নামান্তর। গীবত এত সূক্ষ্ম গুনাহ যে, কোনো কোনো পরহেযগার ব্যক্তিও এ গুনাহে জড়িয়ে পড়ে। তখন এটা গুনাহ হওয়ার বিষয় তাদের মনে জাগ্রত থাকে না । কারণ অন্যের দোষ বর্ণনা করার মধ্যে মন এক ধরনের মিথ্যা আনন্দ খুঁজে পায়। তাই মধু মনে করে এ বিষ পান করতে থাকে।

চতুর্থ : চতুর্থ বিষয় ভুল ও মিথ্যা সংবাদ প্রচার করা। কারো প্রতি ঘৃণা জন্মালে অনেক সময় তা শুধু গীবতের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং তখন অলীক সব কল্পকাহিনী বানিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সত্য-মিথ্যা কথা প্রচার করা হয়। কখনো তো মূল ব্যাপারটি একরকম থাকে তবে এর সাথে নিজ থেকে বিভিন্ন কথা জড়িয়ে রং লাগিয়ে বিষয়টিকে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ দেওয়া হয়। বাস্তবতা তখন পুরোপুরি বদলে যায়। অনেক কবীরা গুনাহের সমন্বয়ে এ পরিবর্তন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। মিথ্যা, গীবত, অপবাদ, মুসলমানকে লাঞ্ছিত করা, মনে কষ্ট দেওয়া ইত্যাদি কবীরা গুনাহ এর সাথে জড়িয়ে থাকে। তাই কারো ব্যাপারে কোনো কিছু শুনলে যাচাই-বাছাই ছাড়া তা বিশ্বাস করা এবং সত্য মনে করে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য পবিত্র কুরআনে আদেশ করা হয়েছে। সেইসাথে এমন অবাস্তব সংবাদদাতাদের ফাসিক আখ্যায়িত করে তাদেরকে অবিশ্বাসযোগ্য ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

একে অন্যের বিরুদ্ধে যখন এমন ভুল ও মিথ্যা সংবাদ ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে থাকে তখন পরস্পরের মাঝে শত্রুতার আগুন জ্বলে উঠে। ফলে মুসলমানদের যে সময় ও শক্তি কাফেরদের মোকাবেলায় ব্যয় হওয়া উচিত ছিল তা নিজেদের কোন্দল ও রেষারেষির মাঝেই ব্যয় হয়ে যায়। প্রত্যেকেই অন্যকে দোষী প্রমাণিত করে খাটো করে দেখানোর জন্য নিজের সমস্ত মেধা ও প্রতিভা খরচ করে। এভাবে মুসলমানদের সময় ও শক্তি, যোগ্যতা ও প্রতিভা এবং ধন-সম্পদ নিজেদের মাথা ফাটাফাটিতে শেষ হয়ে যায়। আর ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে থাকে। কারণ, এ অবস্থায় মুসলমানেরা নিজ শত্রুদের প্রতি দৃষ্টি দিতে পারবে না। আফসোস! বর্তমানে পুরো মুসলিম সমাজ এ ভয়াবহ শাস্তির আগুনেই জ্বলছে।

মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও বিদ্বেষ সৃষ্টি এবং লড়াই ও ঝগড়া বাঁধানোর জন্য শয়তানের আবিষ্কৃত কিছু কিছু উপায় এমন, যা কেউ খারাপ চোখে দেখে না। এ বিভেদ ও বিদ্বেষ সৃষ্টির জন্য শয়তান কখনো ধর্মের পথ বেছে নেয় এবং কিছু চিন্তা-বিভ্রান্ত লোকের মাথায় নিত্যনতুন ধারণা প্রসব করতে থাকে। কখনো রাজনীতির অঙ্গন বেছে নেয় এবং মুসলমানদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামার আগুন জ¦ালিয়ে দেয়। কখনো আঞ্চলিক ভালোবাসা, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের মূর্তি নির্মাণ করে কিছু ‘সামেরীকে’ তার পূজায় লাগিয়ে দেয়, যারা মুসলিম ভ্রাতৃত্বের সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে মুসলিম উম্মাহকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কখনো শ্রেণিগত বৈষম্য উসকে দিয়ে  মুসলমানদের রক্তপাত ঘটাতে এবং  সমাজ ও পরিবেশকে রণক্ষেত্রে পরিণত করতে উদ্বুদ্ধ করে। এসব কিছু আজ মুসলিম সমাজকে জাহান্নামের নমুনা বানিয়ে দিয়েছে । আর শয়তানের তৈরি এ জ্বলন্ত অগ্নিস্ফুলিঙ্গে মুসলমানরাই ইন্ধনে পরিণত হচ্ছে।

আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার তাওফিক দান করুন এবং শয়তানের সমস্ত চক্রান্ত থেকে হেফাজত করুন। হ

 অনুবাদ : শাহাদাত সাকিব

 

 

advertisement