রবিউল আখির ১৪৪০   ||   জানুয়ারি ২০১৯

ঝাড়ফুঁক-তাবীয : একটি দালীলিক বিশ্লেষণ

মাওলানা এমদাদুল হক

[গত মুহাররম ১৪৪০/অক্টোবর ২০১৮ সংখ্যায় এ প্রবন্ধের প্রথম কিস্তি ছাপা হয়েছে। সেখানে শুরুতেই ভূমিকা স্বরূপ ঝাড়ফুঁক-তাবীয বিষয়ে মৌলিক এগারটি কথা বলা হয়েছে, যা পুরো প্রবন্ধটি বোঝার জন্য সহায়ক। এরপর ঝাড়ফুঁক-তাবীয বিষয়ে হাদীসে বর্ণিত নির্দেশনা পেশ করা হয়েছে এবং সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগে ঝাড়ফুঁক-তাবীযের ব্যবহার বিষয়ক বর্ণনা সামনে আনা হয়েছে। গত সফর ১৪৪০/নভেম্বর ২০১৮ সংখ্যায় হাদীসে বর্ণিত তামীমা ও তাবীযের পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। এ সংখ্যায় উলামায়ে সালাফের বক্তব্য তুলে ধরা হল এবং যারা তাবীযকে শিরক বলেন, তাদের বক্তব্য ও পর্যালোচনা পেশ করা হল।

যারা  প্রথম দুটি কিস্তি পড়েননি তারা এ সংখ্যার লেখার সাথে আগের সংখ্যার লেখা মিলিয়ে পড়লে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে।]

 

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

 

ইমাম মালেক রাহ. ও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রাহ.

ইমাম মালেক রাহ.-কে জিজ্ঞাসা করা হয়-

قيل : فيكتب للمحموم القرآن؟ قال: لابأس به، ولابأس أن يرقى بالكلام الطيب، ولا بأس بالمعاذة تعلق، وفيها القرآن وذكر الله إذا أحرز عليها أدم.

জ¦রাক্রান্ত রোগীর জন্য কুরআনের আয়াত লিখতে কোনো অসুবিধা আছে? জবাবে বললেন, না কোনো অসুবিধা নেই এবং উত্তম কথা দিয়ে স্ফকরতেও নিষেধ নেই। তেমনিভাবে কুরআন ও আল্লাহর (যিকির) নাম-সিফাত সম্বলিত তাবীয পরিধান করতেও অসুবিধা নেই, যদি তা চামড়া দিয়ে আবৃত করা হয়। -কিতাবুল জামে, আবু যায়দ আলকায়রাওয়ানী ২৩৭-২৩৮

ইমাম লাইছ ইবনে সা‘দ বলেন-

لا بأس أن يعلق على النفساء، والمريض شيء من القرآن إذا أحرز عليه أدم.

অসুস্থ এবং ঋতুমতী নারীর গায়ে কুরআন (লিখে) ঝুলাতে কোনো অসুবিধা নেই, যদি তা চামড়া দিয়ে আবৃত করা থাকে। -প্রাগুক্ত ২৩৯

এক বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম আহমাদ রাহ. যদিও তাবীয ঝুলানোকে অপছন্দ করতেন কিন্তু একথা প্রমাণিত যে, ক্ষেত্রবিশেষে নিজেও তাবীয লিখেছেন এবং ব্যবহারের ফতোয়া দিয়েছেন। ইমাম আহমাদের পুত্র আব্দুল্লাহ বলেন-

رأيت أبي يكتب التعويذ للذي يفزع، وللحمى.

আমি আমার পিতাকে রাতে ভয় পাওয়া ব্যক্তি ও জ¦রাক্রান্ত ব্যক্তির জন্য তাবীয লিখতে দেখেছি। -যাদুল মাআদ ৪/৩২৬

তিনি আরো বলেন, কোনো নারীর প্রসব কঠিন হয়ে গেলে আমার পিতা তার জন্য সাদা একটি পেয়ালায় বা পরিষ্কার কোনো পাত্রে ইবনে আব্বাসের আমলটি লিখে দিতেন। আমলটি হল-

لا إله إلا الله الحليم الكريم، سبحان الله رب العرش العظيم، الحمد لله رب العالمين، كأنهم يوم يرون ما يوعدون، لم يلبثوا إلا ساعة من نهار بلاغ، كأنهم يوم يرونها، لم يلبثوا إلا عشية أو ضحاها.

 -প্রাগুক্ত ৪/৩২৭

ইমাম আহমাদের বিশেষ শাগরিদ আবু বকর মারওয়াযী বলেন, একদা আমি জ¦রাক্রান্ত হই। সংবাদটি ইমাম আহমাদের কাছে পৌঁছে, তখন তিনি এক টুকরো কাগজে লিখে দেন-

بسم الله الرحمن الرحيم، بسم الله وبالله، محمد رسول الله، قلنا: يا نار كوني بردا وسلاما على إبراهيم، وأرادوا به كيدا فجعلناهم الأخسرين، اللهم رب جبرائيل وميكائيل وإسرافيل، اشف صاحب هذا الكتاب بحولك وقوتك وجبروتك، إله الحق آمين.

আবু বকর মারওয়াযী আরো বলেন, একদা এক লোক ইমাম আহমাদের কাছে এসে বলল, এক মহিলা দুদিন যাবৎ তার প্রসব কঠিন হয়ে গেছে। তখন ইমাম আহমাদ তাকে একটি বড় পেয়ালা ও যাফরান আনতে বললেন। অতপর তাতে দুআ লিখে দিলেন। -প্রাগুক্ত ৪/৩২৭

ইমাম আবু উবায়দ কাসিম ইবনে সাল্লাম রাহ. (মৃত্যু : ২২৪ হিজরী)

ইমাম আবু উবায়দ রাহ. তার গরীবুল হাদীস গ্রন্থে- إن التمائم والرقى والتولة من الشرك (নিশ্চই তামীমা ঝাড়ফুঁক ও তিওয়ালা শিরক থেকে) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লেখেন-

وإنما أراد بالرقى والتمائم عندي ما كان بغير لسان العربية مما لا يدرى ما هو؟

এ হাদীসের উদ্দেশ্য হল, সেসব ঝাড়ফুঁক ও তামীমা, যা অস্পষ্ট অনারবী ভাষায় লেখা হয়, যার অর্থ বুঝা যায় না। -গরীবুল হাদীস ২/১৯০

আবু উবায়দ রাহ.-এর কথা থেকে বুঝা যায় যে, লিখিত তাবীযও আরবী ভাষায় ‘তামীমা’। অথচ তামীমা হল পাথর। তাই ইবনে কুতায়বা তার এ কথার উপর একাধিক জায়গায় কলম ধরেছেন, যা ‘তামীমা’র অর্থের আলোচনায় আমরা উল্লেখ করেছি। তো আবু উবায়দ রাহ. কর্তৃক তাবীযকেও তামীমা বলা ভুল হলেও তার একথা থেকে এটা পরিষ্কার যে, ঝাড়ফুঁক ও তাবীয যদি আরবী ভাষায় অর্থাৎ যার অর্থ বুঝা যায় এবং শিরকমুক্ত হয় তাহলে তা শিরক-এর অন্তর্ভুক্ত নয়।

 

ইমাম তহাবী রাহ. (মৃত্যু : ৩২১হিজরী)

ইমাম তহাবী রাহ. ‘তামীমা’ ঝুলানো নিষেধ হওয়ার কারণ বর্ণনা করে বলেন-

فقد يحتمل أن يكون ذلك العلاق مكروها في نفسه، لأنه كتب فيه ما لا يحل كتابته، فكرهه رسول الله صلى الله عليه وسلم لذلك، لا لغيره.

সম্ভবত এ ঝুলন্ত বস্তুতে এমন কিছু লিখা ছিল, যা লিখা জায়েয ছিল না। তাই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা অপছন্দ করেছেন, অন্য কোনো কারণে নয়। -শরহু মাআনিল আছার ৪/১৪, কিতাবুল কারাহিয়াহ

তাহলে বুঝা যায় যদি তাতে এমন কিছু লিখা হয়, যা লিখা জায়েয, তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। যদিও ইমাম তহাবী তাবীযকে তামীমা বলেছেন, তথাপিও তিনি তা ভাগ করেছেন। এক প্রকার তামীমা হল না জায়েয, আরেকটি জায়েয। ঢালাওভাবে নাজায়েয বলেননি।

 

ইমাম বায়হাকী রাহ. (মৃত্যু : ৪৫৮ হিজরী)

ইমাম বায়হাকী من علق تميمة فلا أتم الله له (যে তামীমা ঝুলালো আল্লাহ তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ না করুন) এ যাবতীয় হাদীসের ব্যাখ্যায় লেখেন-

وهذا أيضا يرجع معناه إلى ما قال أبو عبيد، وقد يحتمل أن يكون ذلك وما أشبهه من النهي والكراهية فيمن تعلقها وهو يرى تمام العافية  وزوال العلة منها، على ما كان أهل الجاهلية يصنعون، فأما من تعلقها متبركا بذكر الله تعالى فيها وهو يعلم أن لا كاشف إلا الله ولا دافع عنه سواه، فلا بأس به إن شاء الله.

এ হাদীসের অর্থ হল, যা আবু উবায়দ বলেছেন, (অর্থাৎ যেসব তাবীয অস্পষ্ট অনারবী শব্দে লেখা হয়, যার অর্থ বুঝা যায় না- সেটি নাজায়েয। আর যদি অর্থ বুঝা যায় এবং শিরকমুক্ত হয় তাহলে কোনো অসুবিধা নেই) অথবা এজাতীয় হাদীসের উদ্দেশ্য হল, সেসব লোক, যারা তাবীয ঝুলিয়ে মনে করে এ তাবীযই সুস্থতা দানকারী, রোগ বিদূরণকারী, যেমনটি জাহেলী যুগের লোকেরা মনে করত।

তবে হাঁ, কেউ যদি আল্লাহ তাআলাকেই একমাত্র আরোগ্যদাতা ও রোগপ্রতিরোধকারী হিসেবে জানে ও বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহর নামের বরকতে রোগমুক্তির আশায় তা ব্যবহার করে (ঝুলায়)- ইনশাআল্লাহ তাতে কোনো অসুবিধা নেই। -আসসুনানুল কুবরা ৯/৫৭৯

 

আল্লামা তূরবিশতী রাহ.  (মৃত্যু : ৬৬১)

আল্লামা তূরবিশতী রাহ. মাসাবিহুস সুন্নাহ-এর ব্যাখ্যাগ্রন্থে লেখেন-

والمراد من التميمة ما كان من تمائم الجاهلية ورقاها، فإن القسم الذي يختص بأسماء الله تعالى وكلماته غير داخل في جملته بل مستحب مرجو البركة، عرف ذلك من أصل السنة.

যেসব হাদীসে তামীমাকে শিরক বলা হয়েছে সেখানে তামীমা দ্বারা উদ্দেশ্য হল, জাহেলী যুগের তামীমা (পাথর)। কারণ, যেগুলো আল্লাহ্র নাম-কালাম দিয়ে লেখা তা এতে অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং সেগুলো মুস্তাহাব, তা থেকে বরকত পাওয়ার আশা করা যায়। বিষয়টি সুন্নাহর মৌলিক শিক্ষা থেকে বোঝা যায়। -আলমুয়াস্সার ৩/১০০৮

 

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রাহ. (মৃত্যু : ৮৫৫)

আল্লামা আইনী রাহ. সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থে লেখেন-

فهذا كله في تعليق التمائم وغيره، مما ليس فيه قرآن ونحوه، فـأما ما فيه ذكر الله فلا نهي عنه، فإنه يحمل للتبرك له و التعوذ بأسمائه وذكره.

যেসব হাদীসে তামীমাকে শিরক বলা হয়েছে তা হল, যাতে কুরআনের আয়াত ইত্যাদি নেই। আর যাতে আল্লাহর যিকির আছে তার ক্ষেত্রে নিষেধ নেই। কেননা তা আল্লাহর নামের বরকত লাভের জন্য এবং তাঁর নাম ও যিকির দিয়ে আশ্রয় কামনার জন্য। -উমদাতুল কারী ১২/৮০ (كتاب الجهاد، باب ما قيل فى الجرس ونحوه)

 

হাফেয ইবনে হাজার রাহ. (মৃত্যু : ৮৫২)

হাফেয ইবনে হাজার রাহ. তাঁর প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে লেখেন-

فهذا كله فى تعليق التمائم و غيره مما ليس فيه قرآن ونحوه، فـأما ما فيه ذكر الله فلا نهي عنه، فإنه يحمل للتبرك له و التعوذ بأسمائه وذكره .

-ফাতহুল বারী ৬/১৬৭, হাদীস ৩০০৫ (كتاب الجهاد، باب ما قيل فى الجرس ونحوه)

 

আল্লামা কুরতুবী রাহ. (মৃত্যু : ৬৭১ হিজরী)

প্রসিদ্ধ মুফাসসির আল্লামা কুরতুবী সূরা বনী ইসরাঈলের ৮৫ নং আয়াতের তাফসীরে লেখেন-

والقول الأول أصح في الأثر والنظر إن شاء الله تعالى. وما روي عن ابن مسعود يجوز أن يريد بما كره تعليقه غير القرآن أشياء مأخوذة عن العراقيين والكهان، إذ الاستشفاء بالقرآن معلقا وغير معلق لا يكون شركا، وقوله عليه السلام: من علق شيئا وكل إليه، فمن علق القرآن ينبغي أن يتولاه الله ولا يكله إلى غيره، لأنه تعالى هو المرغوب إليه والمتوكل عليه في الاستشفاء بالقرآن.

(এই আলোচনায় প্রথমে কুরতুবী রাহ. তাবীয সম্পর্কে জায়েয ও মাকরূহ দুটি মত উল্লেখ করেন এরপর বলেন,) জায়েযের মতটি হাদীস ও যুক্তি অনুসারে সর্বাধিক সঠিক আর ইবনে মাসউদ যে তাবীয অপছন্দ করতেন তা হয়ত এ কারণে যে, সেগুলো কুরআন বাদ দিয়ে জ্যোতিষীদের কাছ থেকে গৃহীত কিছু দিয়ে লেখা হত। কেননা কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে চিকিৎসা, তা ঝুলিয়ে হোক বা অন্য কোনোভাবে, তাতে শিরকের কিছু নেই। আর হাদীসে যে বর্ণিত হয়েছে- "من علق شيئا وكل إليه" অর্থাৎ, যে ব্যক্তি কোনো কিছু ঝুলাবে তাকে সেটার হাওয়ালা করে দেওয়া হবে। তো যে ব্যক্তি কুরআনের আয়াত লিখে ঝুলায় তার ক্ষেত্রে তো এটাই হওয়া উচিত যে, আল্লাহ্ই তার রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। কেননা কুরআন দ্বারা সুস্থতা চাওয়ার ক্ষেত্রে তো আল্লাহর উপরই ভরসা থাকে, তাঁর কাছেই সুস্থতা কামনা করা হয়। -আহকামুল কুরআন ১০/ ২৬৬

 

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. (মৃত্যু : ৭২৮ হিজরী)

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. তার ফতোয়ায় লেখেন-

ويجوز أن يكتب للمصاب وغيره من المرضى شيئا من كتاب الله وذكره بالمداد المباح ويغسل ويسقى كما نص على ذلك أحمد وغيره. قال عبد الله بن أحمد قرأت على أبي ثنا يعلى بن عبيد، ثنا سفيان، عن محمد ابن أبي ليلى، عن الحَكَم، عن سعيد بن جبير، عن ابن عباس قال: إذا عسُر على المرأة ولادتها فليكتب بسم الله لا إله إلا الله الحليم الكريم، سبحان الله رب العرش العظيم، الحمد لله رب العالمين، كأنهم يوم يرونها، لم يلبثوا إلا عشية أو ضحاها، كأنهم يوم يرون ما يوعدون، لم يلبثوا إلا ساعة من نهار بلاغ، فهل يهلك إلا القوم الفاسقون. قال أبي ثنا أسود بن عامر بإسناده بمعناه وقال: يكتب في إناء نظيف فيسقى. قال أبي: وزاد فيه وكيع: فتسقى وينضح ما دون سرتها. قال عبد الله: رأيت أبي يكتب للمرأة في جام أو شيء نظيف.

وقال أبو عمرو محمد بن أحمد بن حمدان الحيري: أنا الحسن بن سفيان النسوي، حدثنى عبد الله بن أحمد بن شبّويه، ثنا علي بن الحسن بن شقيق، ثنا عبد الله بن المبارك عن سفيان عن ابن أبي ليلى عن الحكم عن سعيد بن جبير عن ابن عباس قال: إذا عسر على المرأة ولادتها فليكتب: بسم الله، لا إله إلا الله العلي العظيم، لا إله إلا الله الحليم الكريم، سبحان الله وتعالى، رب العرش العظيم، والحمد لله رب العالمين. كأنهم يوم يرونها. لم يلبثوا إلا عشية أو ضحاها. كأنهم يوم يرون ما يوعدون. لم يلبثوا إلا ساعة من نهار بلاغ، فهل يهلك إلا القوم الفاسقون. قال علي: يكتب في كاغذة فيعلق على عضد المرأة. قال علي: وقد جربناه فلم نر شيئا أعجب منه فإذا وضعت تحله سريعا ثم تجعله في خرقة أو تحرقه.

অসুস্থ রোগাক্রান্ত ইত্যাদি ব্যক্তির জন্য পবিত্র কালি দ্বারা কুরআনের আয়াত বা আল্লাহর যিকির লেখা এবং তা দিয়ে রোগীকে গোসল করানো ও পান করানো জায়েয আছে। ইমাম আহমাদ রাহ.-সহ আরো অন্যান্য ইমামগণ একথা স্পষ্টভাবে বলেছেন । যেমন, ইমাম আহমাদ রাহ. হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, যদি কোনো মহিলার প্রসব কঠিন হয় তাহলে যেন নিম্নোক্ত বাক্যগুলো লিখে দেওয়া হয়-

بسم الله، لا إله إلا الله الحليم الكريم، سبحان الله وتعالى، رب العرش العظيم، والحمد لله رب العالمين. كأنهم يوم يرونها. لم يلبثوا إلا عشية أو ضحاها. كأنهم يوم يرون ما يوعدون. لم يلبثوا إلا ساعة من نهار بلاغ، فهل يهلك إلا القوم الفاسقون.

(অন্য সূত্রে এসেছে) ইবনে আব্বাস রা. বলেন, এই দুআটি একটি পরিষ্কার পাত্রে লিখে তাকে পান করানো হবে এবং নাভির নিচে পানি ছিটানো হবে।

আব্দুল্লাহ বলেন, আমি আমার পিতা (ইমাম আহমাদ রাহ.)-কে দেখেছি, তিনি এ বাক্যগুলো এ ধরনের নারীদের জন্য পরিষ্কার পাত্রে লিখতেন।

অন্য বর্ণনায় হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে উক্ত দুআটি একটু ভিন্ন শব্দে বর্ণিত-

بسم الله، لا إله إلا الله العلي العظيم، لا إله إلا الله الحكيم الكريم...إلخ

আলী ইবনে হাসান রাহ. বলেন, এই দুআটি কাগজে লিখে উক্ত মহিলার বাহুতে বেঁধে দিবে।

তিনি আরো বলেন, আমরা এটি পরীক্ষা করে দেখেছি এবং এর চেয়ে অধিক কার্যকরী কোনো কিছু পাইনি। প্রসব হওয়ার সাথে সাথে তা খুলে ফেলবে এবং ঐ কাগজটি কোনো কাপড়ের টুকরায় রেখে দিবে বা জ্বালিয়ে দিবে। -মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ১৯/ ৬৪-৬৫

 

আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রাহ. (মৃত্যু : ৭৫১ হিজরী)

আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রাহ. তাঁর প্রসিদ্ধ সীরাতগ্রন্থ ‘যাদুল মাআদ’-এ নবীজীর চিকিৎসা সংক্রান্ত একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় দাঁড় করান। তাতে খাদ্য, পানীয় বিভিন্ন জিনিস দিয়ে চিকিৎসার সাথে সাথে কুরআনের আয়াত ও দুআ দিয়ে চিকিৎসা বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেন। তাতে ইমাম আহমাদ কর্তৃক তাবীয লেখা ও প্রদানের বিভিন্ন ঘটনা ও বর্ণনা তুলে ধরেন। তার নিজ শায়েখ শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার বিভিন্ন তাবীয উল্লেখ করেন। এরপর নিজ থেকে বিভিন্ন রোগের বিভিন্ন তাবীয ও আমল উদ্ধৃত করেন। যেগুলোর মধ্যে কিছু আছে পান করার, কিছু ঝুলানোর, কিছু আঙ্গুল দিয়ে রোগীর গায়ে লিখে দেয়ার। এক পর্যায়ে তিনি বলেন-

وكل ما تقدم من الرقى فإن كتابته نافعة

পূর্বে যেসব দুআ দিয়ে ঝাড়ফুঁকের কথা বলা হয়েছে সেগুলো লিখে দিলেও উপকার হয়।

বিস্তারিত দেখুন : যাদুল মাআদ ৪/৩২৬-৩২৯

 

ইমাম নববী রাহ. (মৃত্যু : ৬৭৬ হিজরী)

ইমাম নববী রাহ. লেখেন-

قال أبو عمرو بن الصلاح في الفتاوى: كتابة الخروز واستعمالها مكروه وترك تعليقها هو المختار، وقال في فتاوى أخرى: يجوز تعليق الخروز التي فيها قرآن على النساء والصبيان والرجال، ويجعل عليها شمع ونحوه، ويستوثق من النساء وشبههن بالتحذير من دخول الخلاء بها. والمختار أنه لا يكره، إذا جعل عليه شمع ونحوه، لأنه لم يرد فيه نهي، ونقل ابن جرير الطبري عن مالك نحو هذا، فقال: قال مالك: لا بأس بما يعلق على النساء الحيض والصبيان من القرآن، إذا جعل في كن، كقصبة حديد أو جلد يخرز عليه، وقد يستدل للإباحة بحديث عمرو بن شعيب عن أبيه عن جده، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم (كان يعلمهم من الفزع كلمات- أعوذ بكلمات الله التامة من غضبه وشر عباده ومن همزات الشياطين أن يحضرون) قال: وكان عبد الله بن عمرو يعلمهن من عقل من بنيه، ومن لم يعقل كتبه فعلقه عليه.

আবু আমর ইবনুস সালাহ তার এক ফতোয়াতে লেখেন, তাবীয লেখা, ব্যবহার করা এবং ঝুলানো মাকরূহ। কিন্তু আরেক ফতোয়ায় লেখেন, কুরআন দ্বারা লিখিত তাবীয নারী, শিশু, বয়স্ক পুরুষ সকলের জন্য জায়েয। তবে নারীদের কঠোরভাবে বলে দিবে যেন তারা হাম্মামে যাওয়ার সময় তা খুলে রাখে। (ইমাম নববী বলেন,) তবে গ্রহণযোগ্য মত হল, যদি তাতে মোম ইত্যাদি দিয়ে মুখ এঁটে দেওয়া হয় তাহলে তা মাকরূহ নয়। কেননা (কুরআন-হাদীসে) এ বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। ইবনে জারীর তাবারী  ইমাম মালিক থেকেও এমন বর্ণনা করেন। ইমাম মালেক বলেন, ঋতুমতি নারী, শিশু কুরআনের আয়াত লিখিত তাবীয পরিধানে কোনো অসুবিধা নেই; যদি তা কোনো কবচে রাখা হয় অথবা চামড়া ইত্যাদির ভিতর সেলাই করে দেওয়া হয়। আর এটা বৈধ হওয়ার ব্যাপারে সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস-এর হাদীস দ্বারা দলীল দেওয়া যেতে পারে; যাতে বলা হয়েছে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে রাতে ভয় না পাওয়ার জন্য এ দুআ শিখাতেন-

أعوذ بكلمات الله التامة من غضبه وشر عباده ومن الشياطين أن يحضرون.

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস এ দুআ তার বড় সন্তানদেরকে শিখিয়ে দিতেন। আর যারা ছোট তিনি দুআ লিখে তাদের গায়ে ঝুলিয়ে দিতেন। -আল মাজমূ‘ ২/৮৮, কিতাবুত তাহারাত

 

শাহ ওয়ালিউল্লাহ রাহ. (মৃত্যু : ১১৭৬ হি.)

ভারতবর্ষের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস শাহ ওয়ালিউল্লাহ রাহ. القول الجميل নামে তাসাওউফ সম্পর্কিত একটি কিতাব রচনা করেন। তাতে তিনি তাবীয সংক্রান্ত একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ই দাঁড় করান এবং সেখানে বিভিন্ন রোগ ও সমস্যার বিভিন্ন তাবীয লিপিবদ্ধ করেন। তন্মধ্যে কিছু পান করার এবং কিছু ঝুলানোর। -আল কাওলূল জামীল, পৃ. ১৪০-১৭৯

 

আহলে হাদীস আলেম মাওলানা সায়্যেদ সিদ্দীক হাসান খান ভূপালী রাহ. ( মৃত্যু : ১৩০৭ হি.)

ভারতবর্ষের প্রসিদ্ধ আহলে হাদীস আলেম সায়্যেদ সিদ্দিক হাসান খান ভূপালী সকল আহলে হাদীস ভাইদের কাছে প্রসিদ্ধ। ভারতবর্ষে আহলে হাদীস মতবাদ প্রচারে যাদের ভূমিকা বেশ প্রসিদ্ধ তাদের একজন হলেন মাওলানা ভূপালী। এ মাওলানা ভূপালী স্বয়ং তাবীযের একটি কিতাবই রচনা করেছেন, যা সে সময়ই ছাপা হয়। আর তা ছেপেছেন আরেক প্রসিদ্ধ আহলে হাদীস মাওলানা সানাউল্লাহ অমৃতসরী। এখানে সে কিতাবের ভূমিকার কিছু অংশ পেশ করা হল। তিনি বলেন-

এই সংক্ষিপ্ত সংকলনে হাদীসে বর্ণিত কিছু দুআ আর সহীহ ও যথার্থ কিছু আমলের কথা আলোচনা করা হয়েছে, যার সম্পর্ক বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি ও বিপদাপদের সাথে। এ ব্যাপারে আমার শায়েখদের পক্ষ থেকে অনুমতি মিলেছে। আর এই পরিস্থিতিগুলো বনি আদমের বড় ছোট অধিকাংশের ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। আর তাদের সমস্ত রোগের মহৌষধ হতে পারে এ দুটি পদ্ধতি। তাই হাদীসের কিতাবগুলোতে নববী চিকিৎসার আলোচনা পাওয়া যায়। কিন্তু লোকেরা উদাসীনতা ও ঈমানের দুর্বলতার শিকার হয়ে তার উপর আমল ছেড়ে দিয়েছে।...

যাই হোক! সবচে উন্নত স্তর হল যে, মানুষ ঝাড়ফুঁক করবেও না করাবেও না, কারণ না করার উপর বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশের ওয়াদা হাদীসে এসেছে, যা সঠিক সূত্রে প্রমাণিত। আর যদি ঝাড়ফুঁক করতেই হয় তাহলে তা কুরআন ও হাদীস থেকে (বা) আরবীতে হতে হবে এবং তার অর্থ জ্ঞাত থাকতে হবে।

এজন্যই যারা আহলে ইলম তারা এই ধরনের ঝাড়ফুঁকের আলোচনাই করেছেন। আর মানুষের মধ্যে তার উপকারের বিষয়টিও স্পষ্ট। আমিও বাচ্চাদের অসুস্থতার সময় এর অধিকাংশ আমল ব্যবহার বা প্রয়োগ করে থাকি, যা শাহ ওয়ালিউল্লাহ রাহ.-এর কিতাব القول الجميل -এর মধ্যে উল্লেখ আছে। আমার এই কিতাবের ইজাযত মিলেছে শাহ আব্দুল আযীয দেহলভীর নাতি মৌলভী মুহাম্মাদ ইয়াকুব রাহ.-এর মাধ্যমে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-

أحب عباد الله تعالى إليه أنصحهم  لعباده

অর্থাৎ আল্লাহর কাছে সবচে প্রিয় সে, যে তার বান্দাদের জন্য সর্বাধিক কল্যাণকামী। তিনি আরো বলেন,

إذا مات ابن آدم انقطع عمله إلا من ثلاث، صدقة جارية، أو علم ينتفع به، أو ولد صالح يدعو له.

মানুষ যখন মারা যায় তখন তার তিনটা আমলই বাকি থাকে, সদকায়ে জারিয়া, অথবা এমন ইলম, যা মানুষ শিখছে বা আমল করছে অথবা এমন সৎ সন্তান যে তার জন্য দুআ করে।

উলামায়ে কেরাম এই বিষয়ে একমত যে, নফল ইলম নফল ইবাদতের চেয়েও উত্তম। কারণ ইলমের উপকার অন্য মানুষ পর্যন্ত পৌঁছে আর ইবাদতের উপকার  শুধু ইবাদতকারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

এরই উপর ভিত্তি করে আমি এই সংক্ষিপ্ত পুস্তিকাতে কিছু দুআ এবং ঝাড়ফুঁকের কিছু আমলের কথা লিখেছি (যা বিশুদ্ধ পন্থায় বিজ্ঞ আলেমদের থেকে প্রমাণিত)।

(এতে আমার মাকসাদ হল) যাতে করে ঘরে এই কিতাবটি বিদ্যমান থাকে। আর বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আল্লাহর মহিমায় তার দ্বারা উপকার নেওয়া যায়। আমি আমার পরিবার সন্তান-সন্ততি ও নাতি নাতনিদেরকে এই দুআ ও আমলগুলোর ইজাযত দিচ্ছি। কিন্তু তাদের কাছে আমার এই আবেদন যে, এ মহান বিষয়কে সহজলভ্য মনে করে এই কাজকে খেলার পাত্র না বানানো। বরং উন্নত বিশ্বাস আর পূর্ণ আদবের সাথে প্রত্যেকটা দুআকে তার আপন বিন্যাস ও নিয়ম পদ্ধতি ঠিক রেখে কম করে হলেও ব্যবহারে আনবে।

তারপর আল্লাহ তাআলাকে শাফী (আরোগ্যদাতা) অনিষ্ট দূরকারী ও উপকারী হিসাবেই বুঝবে। -কিতাবুত তাবীযাত, সিদ্দীক হাসান খান ১১-১৩

আপাতত আমরা এখানে এ কয়জন উলামায়ে কেরামের বক্তব্য পেশ করলাম, ফিকহ-ফতোয়ার ও হাদীসের শরহের কিতাবাদিতে এ ধরনের আরো বহু বক্তব্য বিদ্যমান। প্রতিটি মাযহাবের বহু ফতোয়ার কিতাবাদিতে এ ধরনের কথা সহজেই মিলে, তাই সেগুলো উদ্ধৃত করলাম না। এখানে যে কয়জনের নাম এসেছে তারা প্রত্যেকেই ইলম, তাহকীক ও শরীয়তের জ্ঞানে প্রসিদ্ধ। তো এদের সকলে তাবীয বৈধ বলেছেন। কেউ সেটাকে শিরক বলেননি। এবার আমরা একটু ভাবি, তাবীয যদি শিরক হয় তাহলে শিরকের মত এত জঘন্য একটি বিষয় কীভাবে তাদের কাছে অস্পষ্ট রইল। আর তারা কীভাবে এ ‘শিরক’-এর বৈধতা দিলেন। আর বিষয়টিও কি এত সূক্ষ্ম যে, এদের মত ব্যক্তিদের সকলের জ্ঞানের আওতার বাইরে।

পূর্বে সাহাবা-তাবেয়ীনের বহু বক্তব্য ও ফতোয়া উদ্ধৃত করা হয়েছে। আর এখানে তাদের পরবর্তী প্রতি যুগের ইলমী জগতের বড় বড় বিদ্বানগণের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হল। তো যে বিষয়টি সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে নিয়ে পরবর্তী যুগের বড় বড় সকল বিদ্বানগণের কাছে বৈধ সেটি শিরক হয় কীভাবে। আমরা যারা সরাসরি আরবী কিতাবাদি পড়ার যোগ্যতা রাখি না, দ্বীনের কোনো মাসআলা শত শত কিতাব ঘাঁটাঘাঁটি করে তাহকীক করার যোগ্যতা রাখি না, বরং কোনো আলেমের শরণাপন্ন হতে হয়, তাদের কোনো বিষয়ের সংশয় নিরসনের তো এটাই স্বাভাবিক ও বাস্তব পদ্ধতি যে, যুগ যুগ ধরে দ্বীনের বিদ্বানগণ যা বলেছেন সে হিসেবে চলা। তারা যদি বৈধ বলেন তাহলে সেটা কী করে ভুল হতে পারে। আর তাদের সকলের বিপরীতে গিয়ে বর্তমানের স্বল্পজ্ঞানের কোনো ব্যক্তির কথা কীভাবে সঠিক হয়ে যেতে পারে। কোথায় সায়ীদ ইবনুল মুসায়্যিব, মুজাহিদ, মালেক, আহমাদ, ইবনে হাজার, নববী রাহিমাহুমুল্লাহ-এর মত ইলমের পাহাড় ও জ্ঞানের সাগর, আর কোথায় বর্তমানের কোনো গবেষক। কখনো এমন হতে পারে যে, কোনো একটি বিষয় পূর্বের কোনো এক বিদ্বানের জানার বাইরেও থেকে যেতে পারে। কিন্তু কোনো বিষয় সকল বিদ্বানের জানার বাইরে থাকবে ইলমী ইতিহাসে এমন কোনো বিষয় নেই।

যারা কুরআনের আয়াত-দুআ-যিকিরের তাবীযকেও শিরক বা নিষিদ্ধ বলতে চান সঙ্গত মনে হচ্ছে এখানে তাদের প্রমাণাদি নিয়ে কিছু আলোচনা করি, যাতে তাদের প্রমাণাদির সাথে জুমহুর আলেমগণের প্রমাণাদির সাথে তুলনামূলক পর্যালোচনা সহজ হয়। তাই নিম্নে এ প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা করা হল।

 

যারা তাবীযকে নিষিদ্ধ বলতে চান এক্ষেত্রে তাদের মৌলিক কথা হল :

এক. হাদীসে তামীমা পরিধানের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা এসেছে আর তামীমার অর্থ ব্যাপক- তাবীযকেও তামীমা বলা হয়। তাবীযকে তা থেকে ‘খাছ’ করার কোনো যুক্তি নেই।

দুই. এতে আল্লাহ্র নাম ও তাঁর কালামের অসম্মান হয়। কেননা তাবীয নিয়ে পেশাব-পায়খানায় যাওয়া হয় ।

তিন. কুরআনের আয়াত বা যিকিরের তাবীয বৈধ মেনে নেওয়া হলেও তা দ্বারা কুফরী তাবীয ব্যবহারের পথ উন্মুক্ত হয়। তাই অবৈধ তাবীযের রোধকল্পে বৈধকেও নিষিদ্ধ করতে হবে।

চার. কয়েকজন সাহাবী-তাবেয়ীও এসব তাবীয ব্যবহারে নিষেধ করেছেন।

 

পর্যালোচনা :

প্রথম যুক্তি সম্পর্কে আমরা পূর্বে দীর্ঘ আলোচনা করেছি যে, হাদীসে বর্ণিত তামীমা অর্থ তাবীয নয়। বরং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথরের মালা এবং এক্ষেত্রে বড় বড় ভাষাবিদ ও হাদীস ব্যাখ্যাতাদের সুস্পষ্ট অনেক বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে।  তামীমা বলতে এসব পাথরকেই বুঝানো হত, তাবীয নয়। তাবীযকে পরবর্তী সময়ে কেউ কেউ তামীমা বললেও নবীজী তাবীযকে তামীমা বলেননি, সুতরাং হাদীসে যে তামীমার কথা এসেছে তা দ্বারা তাবীয উদ্দেশ্য নয়। আর যেহেতু পাথরমালা ও কুরআন-হাদীসের তাবীয নাম, প্রকৃতি ও সত্তাগতভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন তাই তামীমার মধ্যে তাবীয অন্তর্ভুক্ত হবে না। সুতরাং তামীমা থেকে তাবীযকে খাছ করার কোনো প্রসঙ্গও আসবে না।

দ্বিতীয় যুক্তির ক্ষেত্রে সহজ কথা হল, কুরআন-হাদীস ও আল্লাহ্র নামের সম্মানের ক্ষেত্রে আমাদের তুলনায় সবচে বেশি সচেতন ছিলেন সাহাবা-তাবেয়ীন ও পুর্বসূরি উলামাগণ। পূর্বে উদ্ধৃত বক্তব্যগুলোতে আমরা দেখেছি যে, সাহাবা-তাবেয়ীন ও পরবর্তী প্রসিদ্ধ প্রসিদ্ধ আলেমগণ তাদের প্রায় বক্তব্যে স্পষ্টভাবে বলে গিয়েছেন যে, এসব লেখা যদি কোনো কবচে রেখে মুখ পূর্ণ এঁটে দেওয়া হয়, অথবা এসব লেখার উপর চামড়া দিয়ে  সেলাই করে দেওয়া হয় তাহলে এসব  বহনে কোনো অসুবিধা নেই। এখন সাধারণভাবে যা বুঝা দরকার তা হল সাহাবা-তাবেয়ীন ও পরবর্তী প্রতি যুগের বড় বড় বিদ্বানগণ কুরআনের সম্মানের প্রতি অন্যদের তুলনায় সচেতন হওয়া সত্ত্বেও এভাবে, তাবীয ব্যবহারের ফতোয়া দিলেন কেন, যদি তাতে আল্লাহর নাম-সিফাতের সম্মানহানী হয়? তাবেয়ী সায়ীদ ইবনুল মুসায়্যিব, মুুজাহিদ, আতা ইবনে আবী রাবাহ, ইমাম মালেক রাহ.-সহ এসব ইমামগণ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, কবচের ভিতর পরিধানে কোনো অসুবিধা নেই। তাঁরাই তো এ কুরআনের বাহক ছিলেন এবং এর সম্মান তাদের চেয়ে বেশি আর কে বুঝত। আর তাঁরাই এমন ফতোয়া দিয়েছেন।

তৃতীয় যে যুক্তি, তার ক্ষেত্রে কথা হল, আমরা ঝাড়ফুঁকের আলোচনায় দেখেছি, যে হাদীসে তামীমাকে শিরক বলা হয়েছে একই হাদীসে ঝাড়ফুঁককেও শিরক বলা হয়েছে। আরব জাহেলী যুগে তামীমার প্রচলন যেমন ছিল, ঝাড়ফুঁকের প্রচলনও তেমন ছিল। আর সবই ছিল শিরকী পন্থায় ও শিরকী যাদুমন্ত্রে। তাই নবীজী উভয়টিকে শিরক বলেছেন। কিন্তু অপরদিকে স্বয়ং নবীজী ও সাহাবায়ে কেরাম কুরআনের আয়াত ও বিভিন্ন দুআর মাধ্যমে ঝাড়ফুঁক করেছেন ও শিখিয়েছেন, যা বহু হাদীস ও আসারে বর্ণিত। এ কারণেই কুরআনের আয়াত ও হাদীসে বর্ণিত বিভিন্ন দুআর মাধ্যমে ঝাড়ফুঁক বৈধ। এ ব্যাপারে কোনো মতভেদ নেই। মতভেদ থাকার কথাও নয়। আর জানা কথা, এ বৈধ ঝাড়ফুঁকের দোহাই দিয়ে বা পথ ধরে মানুষ তো হারাম ঝাড়ফুঁকেও প্রবেশ করতে পারে এবং বর্তমানে অনেকে তাতে লিপ্তও বটে। তাহলে  কি বলা হবে, যেহেতু কিছু মানুষ অবৈধ ঝাড়ফুঁকে লিপ্ত, তাই শিরকমুক্ত বৈধ ঝাড়ফুঁকও এখন আর করার সুযোগ নেই? 

কিছু মানুষ বৈধ তাবীযের দোহাই দিয়ে হারাম তাবীযের পথে চলে যায় বলে যদি বৈধ তাবীযকে ঢালাওভাবে নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে শিরকমুক্ত ঝাড়ফুঁকও তো নিষিদ্ধ করতে হবে। এই বৈধ ঝাড়ফুঁককে হারাম বলার হিম্মত কি কারো আছে? 

চতুর্থত যেসকল সাহাবী থেকে তাবীয নিষিদ্ধ হওয়ার মন্তব্য তারা পেশ করেন তাঁরা হলেন, হযরত হুযাইফা, আব্দুল্লাহ ইবনে উকায়ম, উকবা ইবনে আমের, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.। যে সকল বর্ণনা দ্বারা তারা দলীল দেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন আমরা নিচে তা পেশ করলাম-

 

হযরত হুযায়ফা রা.-এর বর্ণনা :

হযরত হুযায়ফা রাযিয়াল্লাহু আনহু একদিন একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যান। তখন তিনি অসুস্থ ব্যক্তির বাহুতে একটি তাগা বাঁধা পান। হযরত হুযায়ফা তাকে জিজ্ঞেস করেন এ কী? লোকটি উত্তর দেন, এ তাগাটিতে ঝাড়ফুঁক করা হয়েছে। হযরত হুযায়ফা তা ছিঁড়ে ফেলেন এবং বলেন-

لو مت وهو عليك ما صليت عليك.

যদি তুমি এটি পরিহিত অবস্থায় মারা যেতে তাহলে আমি তোমার জানাযার নামায পড়তাম না। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, বর্ণনা ৩২৯২৮

এখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, লোকটির বাহুতে যা বাঁধা ছিল তা তাবীয ছিল না, তা ছিল ঝাড়ফুঁক করা তাগা বা সুতা। আর হতে পারে এ ঝাড়ফুঁকের ক্ষেত্রে সাহাবী হুযায়ফার সংশয় ছিল যে, তা শিরকমুক্ত ছিল কি না। তাই তিনি লোকটির জানাযায় শরীক হবেন না বলে তিরষ্কার করেছেন।

 

আব্দুল্লাহ ইবনে উকায়ম রা.-এর বর্ণনা

ঈসা ইবনে আব্দুর রহমান বলেন, আমরা সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উকায়ম অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাই। তখন কেউ বলল-

لو تعلقت شيئا؟

যদি আপনি কিছু ঝুলাতেন। জবাবে তিনি বলেন-

أتعلق شيئا، وقد سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: من تعلق شيئا وكل إليه.

আমি কিছু ঝুলাব? অথচ আমি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে কোনো কিছু ঝুলালো তাকে সে ঝুলানো জিনিসের উপর ছেড়ে দেওয়া হবে। (অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা তাকে সে ঝুলানো জিনিসের হাতে ছেড়ে দিবেন।) -জামে তিরমিযী, হাদীস ২০৭২

আব্দুল্লাহ ইবনে উকায়ম-এর এক ধরনের রোগ হয়েছিল, আরব দেশে যাকে (حمرة) হুম্মারা বলে। শরীরের বিভিন্ন স্থান লালচে হয়ে ব্যথা করে এবং তীব্র জ্বর আসে।

আরব দেশে এ রোগের জন্য বিশেষ এক কাষ্ঠ গায়ে ঝুলানো হত। এখানে সেটিই তাকে ঝুলানোর কথা বলা হয়েছে। এ রীতি জাহেলী যুগ থেকে চলে আসছে। জানা কথা, এসব জড়বস্তুর রোগ সারানোর কোনো ক্ষমতা নেই। তাই নবীজী বলেছেন, যারা এসব জড়বস্তু ঝুলাবে আল্লাহ তাদেরকে নিজের দায়িত্ব থেকে বের করে দিয়ে এসব বস্তুর দায়িত্বে ছেড়ে দিবেন। আর এসবের যে কোনো ক্ষমতা নেই তা তো জানা কথা। তো এখানে ঐ ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনে উকায়মকে সে কাষ্ঠখণ্ড ঝুলাতে বললেন, কুরআনের আয়াত বা আল্লাহ্র নাম সম্বলিত তাবীয নয়। বিস্তারিত ঘটনার জন্য দেখুন, ইতহাফুল খিয়ারা (মুসনাদে ইবনে আবি শায়বার বরাতে), মুহাদ্দিস শিহাবুদ্দীন বূছিরী রাহ., হাদীস ৩৯৫১ (দারুল ওয়াতন, রিয়ায)

 

উকবা ইবনে আমের-এর মত

উকবা ইবনে আমের থেকেও যে নিষেধাজ্ঞা পাওয়া যায় তা হল, তামীমার ক্ষেত্রে, তাবীয নয়। আবুল খায়র তার থেকে বর্ণনা করেন-

موضع التميمة من الإنسان والطفل شرك

(বড়) মানুষ ও শিশুদের গায়ে তামীমা ঝুলানো শিরক। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, বর্ণনা ২৩৯৩১

 

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর মত

হাঁ, সাহাবী ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি কুরআন সম্বলিত তাবীয ঝুলানোকেও অপছন্দ করতেন। ইবরাহীম নাখায়ী বলেন-

أنه كره تعليق شيء من القرآن.

তিনি (আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.) কুরআনের কোনো অংশ (দ্বারা তাবীয) ঝুলানোকে অপছন্দ করতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, বর্ণনা ২৩৯৩০

মূলত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এসব ক্ষেত্রে খুব শক্ত মনোভাবের ছিলেন।

আর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের এ মনোভাব তার ছাত্ররা ও ছাত্রের ছাত্ররাও গ্রহণ করেন। ইবরাহীম নাখায়ী বলেন-

كانوا يكرهون التمائم كلها من القرآن وغير القرآن [1]

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের ছাত্রগণ সব ধরনের তাবীয অপছন্দ করতেন, চাই তা কুরআন দিয়ে হোক অথবা অন্য কিছু দিয়ে।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর ছাত্রগণের একজন বিশিষ্ট শাগরেদ হলেন ইবরাহীম নাখায়ী। তিনিও কুরআনের আয়াত বা যিকির সম্বলিত তাবীয ঝুলানোকে অপছন্দ করতেন। কিন্তু তাকে জাহেলী যুগের তামীমা কক্ষনো মনে করতেন না। এমন হলে তো তারা তাকে শিরকই বলতেন। অথচ সহীহ রেওয়ায়েতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, তারা এটিকে অপছন্দ করতেন মাত্র।

মুগিরাহ রাহ. বলেন, আমার জ্বর হয়েছিল। আমি ইবরাহীম নাখায়ীকে বললাম, আমি কি  یٰنَارُ كُوْنِیْ بَرْدًا وَّ سَلٰمًا عَلٰۤی اِبْرٰهِیْمَ এই আয়াতটি লিখে আমার বাহুতে ঝুলাব? তিনি তা অপছন্দ করলেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, বর্ণনা ২৩৯৩৫

তো কুরআনের আয়াত বা দুআ সম্বলিত তাবীযও ইবনে মাসউদ রা. ও তাঁর ছাত্ররা অপছন্দ করতেন। কিন্তু আমরা পূর্বে দেখেছি, সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে আমরসহ অনেক বড় বড় সাহাবী-তাবীয়ীই কুরআন-হাদীসের তাবীযকে বৈধ বলেছেন। আর এদের পরবর্তীতে প্রতি যুগের বড় বড় বিদ্বানগণও তাবীযকে বৈধ বলেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও তাঁর শাগরেদগণও তাবীযকে একেবারে ‘নাজায়েয’ মনে করতেন না। শিরক মনে করার তো প্রশ্নই আসে না। তবে তারা তা পছন্দনীয় কিছুও মনে করতেন না। অর্থাৎ অন্যান্য সাহাবী ও তাবেয়ীগণ যেমন এটিকে ‘মুবাহ’ মনে করতেন এবং এটি ব্যবহার করাতে কোনো অসুবিধা নেই বলে মনে করতেন- তারা সেরূপ মনে করতেন না। তারা বরং মনে করতেন, ‘মুবাহ’ হলেও তাবীয ব্যবহার পছন্দনীয় কিছু নয়।

তো এই ব্যাপারে তাঁরা সবাই একমত যে, শিরক ও মুনকার বিষয়মুক্ত তাবীয বৈধ। অতপর একদল মনে করতেন যে, এতে অপছন্দের কিছু নেই। অপরদল এটিকে বৈধ মনে করলেও পছন্দনীয় মনে করতেন না। বৈধ তাবীয ব্যবহার পছন্দনীয় না অপছন্দীয় তা নিয়ে যেহেতু সাহাবীদের মাঝেই মতভেদ হয়েছে তাই কোন মতকেই অকাট্যভাবে ভুল বলা সম্ভব নয়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও তাঁর শাগরেদ তাবেয়ীদের অনুসরণে তাবীয আদান-প্রদান থেকে বিরত থাকা যেতে পারে। আবার অন্যান্য সাহাবী ও তাবেয়ীগণের অনুসরণে শরয়ী সীমারেখার মাঝে থেকে শিরক ও মুনকার বিষয়মুক্ত বৈধ তাবীয আদান-প্রদান করাও যেতে পারে। কিন্তু যে বিষয়টির সুযোগ নেই তা হল, শরয়ী সীমারেখার প্রতি পূর্ণ লক্ষ রেখে প্রদত্ত ও গৃহীত তাবীযকে ঢালাওভাবে ‘শিরক’ বলে দেওয়া। আবার শরয়ী সীমারেখা লঙ্ঘন করে শিরক ও মুনকার বিষয়সম্বলিত কিংবা বাতিল আকীদা-বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রদত্ত ও গৃহীত তাবীযকে বৈধতার ছাড়পত্র দেওয়া। উভয়টিই বাড়াবাড়ি। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও তার শাগরেদদের অনুসরণে যারা তাবীয আদান-প্রদান থেকে বিরত থাকবে তাদের কর্তব্য হবে, যারা শরয়ী সীমারেখার মাঝে থেকে তাবীয আদান-প্রদান করে তাদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ না করা। আর শরয়ী সীমারেখার মাঝে থেকে প্রদত্ত তাবীযকে অবৈধ বা শিরক বলা থেকে তো অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, কোনো বিষয় সম্পর্কে ‘শিরকে’র হুকুম আরোপ করা অত্যন্ত নাযুক একটি বিষয়। এক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা অতীব জরুরি।

আর যারা অন্যান্য সাহাবী ও তাবেয়ীগণের অনুসরণে শরয়ী সীমারেখার মাঝে থেকে তাবীয আদান-প্রদান করবে তাদেরও কর্তব্য যারা (বুঝে-শুনে) তাবীয আদান-প্রদান থেকে বিরত থাকে তাদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ না করা। আর তাবীযকে ঘিরে যেহেতু নানা অনাচার ও বাতিল আকীদা-বিশ্বাসের চর্চা হয়, শিরক ও মুনকার বিষয়ে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষত দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ ও বেখবর মানুষের মাঝে এ সম্পর্কে যথেষ্ট শিথিলতা লক্ষ্য করা যায় তাই তাবীয আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা ফরয। মনে রাখতে হবে শিরক ভয়ানক পাপ। শিরকের চেয়ে নাযুক ও স্পর্শকাতর বিষয় আর কিছু নেই। শরয়ী সীমারেখা রক্ষা করে তাবীয আদান-প্রদান করা হলে তো একটি ‘মুবাহ’ কাজ করা হবে। কিন্তু এতে শরয়ী সীমারেখা রক্ষা করা না গেলে শিরকে জড়িয়ে পড়ে ঈমান হারানোর আশঙ্কা থাকবে। (আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন)

আরও একটি বিষয় দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রয়োজন। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনে কেরামের যুগে মুসলিম জনসাধারণের মাঝে ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের ও ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার যে প্রসার ছিল এখন মুসলিম জনসাধারণের মাঝে তা নেই। তাই আগের তুলনায় এখন তাবীয আদান-প্রদানের  বিষয়টি অনেক বেশি সতর্কতার দাবিদার। তাবীযের সাথে আকীদা-বিশ্বাসের গভীর সংযোগ রয়েছে। তাবীয আদান-প্রদানকারীর আকীদা-বিশ্বাস সহীহ থাকা ফরয।

কুরআন-হাদীস সম্মত তাবীযের বৈধতা ও শিরক না হওয়ার বিষয়ে আমরা আলোচনা করলাম। তবে এক্ষেত্রে খুব আবশ্যকীয়ভাবে লক্ষ্য রাখা দরকার যে, শুধু মাছুর ও মুবাহ তাবীযই বৈধ, এর বাইরে বৈধ নয়।

কিন্তু ঝাড়ফুঁকে যেমন অনেক লোককে দেখা যায়, সীমালঙ্ঘন করে শিরকে লিপ্ত হয়ে যায় তেমনিভাবে তাবীযের ক্ষেত্রেও অনেকে শিরকে ঢুকে পড়ে। বিধর্মীদের থেকে তাবীয নেয়, কুফরী কালাম দিয়ে তাবীয লেখে। অস্পষ্ট কথা বা লেখা দিয়ে তাবীয তৈরি করে। এগুলোর সবই হারাম এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঈমান বিধ্বংসী।

ঠিক তেমনিভাবে অন্যায় ও পাপের জন্যও তাবীযের লেনদেন করা হয়। যেমন, যুবক-যুবতীর সম্পর্ক, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি, আরেকজনকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেওয়া ইত্যাদি। তেমনিভাবে এ তাবীয আনতে গিয়ে নারীরা তাবীয লেখকের কাছে বেপর্দা হওয়া, তাদের সাথে একান্তে বসা, এমন লোকদের কাছ থেকে তাবীয নেওয়া, যে শরীয়তের হুকুম-আহকাম মেনে চলে না, এমনকি নামায-রোযাও করে না। সে যে কুফরী কথা দিয়ে তাবীয লিখবে না- তার নিশ্চয়তাও নেই। আবার তাবীয লিখতে বা ব্যবহার করতে এমন নিয়ম পালন করা হয়, যা শরীয়তসম্মত নয়। যেমন (আল্লাহ মাফ করুন) রক্ত দিয়ে আল্লাহ্র নাম কালাম লেখা, ব্যাঙের গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। এগুলো সবই হারাম।

আল্লাহ্র হুকুমের বিপরীত করে তাঁর কালাম দিয়ে কীভাবে সুস্থতা কামনা করা যেতে পারে। তাই কুরআনের আয়াত, হাদীসে বর্ণিত দুআ-যিকির দিয়েই তাবীয লেখা ও গ্রহণ করা এবং সম্পূর্ণ শরীয়তসম্মত পন্থায় তা আদান-প্রদান ও ব্যবহার করা।

অনুরূপভাবে জাহেলী যুগে যেমন বিভিন্ন কুসংস্কার ও বাতিল আকীদা-বিশ্বাসের ভিত্তিতে পাথর কড়ি ইত্যাদি পরিধান করা হত আজো আমাদের সমাজে সেসব রীতি পরিলক্ষিত হয়, বাচ্চাদের (অথবা বড়দেরও) নানা কুসংস্কার ও বাতিল আকীদা-বিশ্বাসের ভিত্তিতে পুঁতির মালা পরানো হয়। শামুক, কড়ি গায়ে ঝুলানো হয়। গাড়ী, রিক্সায় এমনকি ঘরের দরজায় পুরাতন জুতা ঝুলানো হয়। অনেক যুবক বিধর্মীদের ধর্মীয় চিহ্নসম্বলিত বিভিন্ন লকেট ইত্যাদি গলায় পরে। এগুলোর প্রায় সবই জাহেলী যুগের রীতি। অনেকেই এ বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ রাখে না। অথচ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক্ষেত্রে কত কঠোর ছিলেন।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সহীহ সমঝ দান করুন- আমীন। (সমাপ্ত)

وصلى الله وسلم على سيدنا محمد وآله وأصحابه أجمعين، والحمد لله الذي بنعمته تتم الصالحات.

في ليلة الثاني والعشرين من جمادى الأولى سنة ১৪৩৮هـ

 

 

 


[1] ১. ইবরাহীম নাখায়ীর উদ্দেশ্য ইবনে মাসউদ ও তার ছাত্রগণ, সকল সাহাবী নয়। আরবের প্রসিদ্ধ আলেম মুহাম্মদ বিন সালেহ আলউছাইমীন বলেন-

قوله: ‘"كانوا" الضمير يعود إلى أصحاب ابن مسعود، لأنهم قرناء إبراهيم النخعي.

(দেখুন : আলকাওলুল মুফীদ আলা কিতাবিত তাওহীদ ১/১৯৬)

 

 

advertisement