রবিউল আখির ১৪৪০   ||   জানুয়ারি ২০১৯

একটি মুযাকারা মজলিস : কিছু জিজ্ঞাসা ও জবাব

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

الحمد لله وسلام على عباده الذين اصطفى، وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له، وأشهد أن محمدا عبده ورسوله، أما بعد!

তাবলীগ জামাতের বন্ধুরা বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন ও নানা জিজ্ঞাসা নিয়ে লাগাতার আসছেন। এই অধম সামর্থ্য অনুযায়ী আলোচনা-মুযাকারার চেষ্টা করি। গত ১ ডিসেম্বর শনিবার টঙ্গির ময়দানে যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়েছে তাতে অন্ততপক্ষে বাংলাদেশে বিষয়টি একেবারেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। তদুপরি এখনও জিজ্ঞাসার ধারা অব্যাহত আছে।

গত শনিবার (৮-১২-২০১৮) তাবলীগের কিছু সাথী তাদের হালকার এতাআতী ভাইদের কিছু প্রশ্ন নিয়ে এসেছিলেন। কিছু প্রশ্ন তাদের নিজেদেরও ছিল। প্রশ্নের ব্যাপারটা তো এমন যে, যার কাছে যে বিষয়টি বেশি মুশকিল বা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সে সেই প্রশ্নই পেশ করে। তাদের মত আরো অনেকেরও এধরনের প্রশ্ন থাকতে পারে। তাই প্রশ্নগুলোর জওয়াব দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যেহেতু এই সাথীরা তাদের এতাআতী ভাইদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসার জবাব শোনাবে, তাই মুনাসিব মনে হল, আলোচনার সারসংক্ষেপ লিখে ফেলাই ভালো। এক্ষেত্রে জবাবি কথাগুলোতে আমি ‘নযরে ছানী’ করারও সুযোগ পাব। এর প্রেক্ষিতে এক-দুইজন সাথী আলোচনার সারসংক্ষেপ প্রস্তুত করেন। আমার নযরে ছানীর পর তা এখানে পেশ করা হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা এর মাধ্যমে তাঁর বান্দাদের উপকৃত করুন। আমাদের মাঝে ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি করুন। উম্মতকে সকল অনিষ্ট এবং সব ধরনের বিভেদ-বিসংবাদ থেকে হেফাযত করুন- আমিন।

বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক

০৩-০৪-১৪৪০ হি.

২৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪০ হিজরী মোতাবেক ৮-১২-২০১৮ ঈসায়ী শনিবারের এই মজলিস খুতবায়ে মাসনূনার মাধ্যমে শুরু হয়। খুতবার পর সাথীরা বলেন :

* আমাদের এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল, আমাদের ইউনিভার্সিটিতে মেহনতের সাথী প্রায় সবাই উলামায়ে কেরামের নির্দেশনা অনুযায়ী মেহনত করছি। কিন্তু হঠাৎ কয়েকজন বড় ভাই আমাদেরকে ভিন্নরকম বোঝাতে শুরু করেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা ৪০ জন ময়দানে আমলে ছিলাম। আমাদের মধ্যে অনেকে আহত হয়েছে। ওখানে পরে যে এতাআতী ভাইরা গিয়েছিল -সবাই জানে বিষয়টা- সেখানে আমাদের বড় ভাইদের একজন ছিলেন। যার ব্যাপারে আমরা এমনটা আশাও করিনি। আমরা যখন ‘জোড়’ করেছি তখন তিনি আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। হঠাৎ করে তিনি ঐদিকে চলে  গেছেন। তো তিনিসহ আরো দুই একজনকে এখানে নিয়ে আসার কথা ছিল। তারা আমাদের সঙ্গে আসবেন বলেছিলেন, কিন্তু গতকাল রাতে তারা কতগুলো শর্ত জুড়ে দিয়েছেন।

ক. মজলিসের স্থান হবে নিরপেক্ষ। কোনো মাদরাসায় হবে না। আমাদের এখানেও হবে না, তাদের ওখানেও হবে না। নিরপেক্ষ একটি স্থানে বসতে হবে।

খ. মজলিসে আমাদের পক্ষ থেকে দশ জন থাকবে। তাদের পক্ষ থেকে দশ জন থাকবে।

গ. আমাদের নির্ধারিত আলেম থাকবেন। তাদেরও নির্ধারিত আলেম থাকবেন।

ঘ. পুরো মজলিস ভিডিও হবে।

ঙ. তারা যদি আমাদের (এতাআতীদের) প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারেন, তাহলে তাদেরকে তওবা করে আমাদের দিকে ফিরে আসতে হবে।

হঠাৎ করে নতুন এসব শর্ত জুড়ে দেওয়ার কারণে আমরা তাদেরকে নিয়ে আসতে পারিনি। তাছাড়া আমাদের একজন স্যার আছেন, যিনি খুব জোরালোভাবে ওদের পক্ষে মেহনত করছেন। তিনি আমাদেরকে কিছু প্রশ্ন করেছেন। যেগুলোর উত্তর আমাদের জানা নেই। আমরা ওগুলোর সঠিক উত্তর জানতে চাই। এই উদ্দেশ্যেই আজ আমাদের এখানে আসা। আর তারা দশ জন দশ জন করে বসার বিষয়ে যা বলেছেন সেই বিষয়ে যদি কোনো রাহবরি থাকে...

** দশ জন দশ জন করে বসার কথা কে বলেছে?

* যিনি হঠাৎ করে ওদের পক্ষে চলে গেছেন।

** তিনি কি ময়দানে মারপিটের সময় উপস্থিত ছিলেন?

* জী।

** তো মারপিটের আগে কি তার বসা দরকার হয়নি? এটা কি তার বোঝা প্রয়োজন ছিল না? ওখান থেকে এসে এখন তিনি দশ জন দশ জন করে বসবেন! সুবহানাল্লাহ!! কয় চিল্লার সাথী তিনি?

* তিন চিল্লার সাথী।

** তিন চিল্লার সাথী, কিন্তু এতটুকু দ্বীনের বুঝ আসেনি যে, আমি আমার আরেক মুসলিম ভাই, মুবাল্লিগ ভাইয়ের গায়ে হাত উঠাব বা যারা হাত উঠাচ্ছে তাদের সঙ্গ দেব- এটা বৈধ হবে কি না? এটা তার জানার দরকার হয়নি! আগে তো তিনি বুঝবেন বিষয়টা, বুঝতে চাইবেন। তার যদি বুঝার ইচ্ছা থাকে তাহলে বুঝার পদ্ধতি তো এটা না যে, দশ জন দশ জন করে বসবেন। এটা কি বোঝার পদ্ধতি? আপনার যদি বোঝার প্রয়োজন হয়, তাহলে এটা তো বোঝার পদ্ধতি নয়। আর যদি বলেন, আমার বোঝার কোনো প্রয়োজন নেই, আমার বোঝাপড়া হয়ে গেছে; আমি বরং বোঝাতে চাচ্ছি, তাহলেও আসুন। তবে বোঝানোর জন্য আসতে চাইলেও তো দশ জন দশ জন করে আসার শর্ত দেয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা তো কারো কাছে কোনো কিছু বুঝতে চাইলে এই শর্ত লাগাব না যে, দশ জন দশ জন করে বসতে হবে। কারণ এটা তো বোঝার পদ্ধতি না।

আচ্ছা যাক, সে প্রসঙ্গ পরে। এখন বলুন আপনাদের কী প্রশ্ন?

 

(প্রশ্নোত্তর পর্ব)

 

প্রশ্ন : মাওলানা সা‘দ সাহেব কি কাফের বা গোমরাহ? এই বিষয়ে দেওবন্দ কী বলে? দেওবন্দ থেকে সারাসরি বলেনি যে, নিযামুদ্দিন বা সা‘দ সাহেবের এতাআত নিষিদ্ধ। তাহলে বাংলাদেশের উলামায়ে কেরাম এত কঠোর হচ্ছেন কেন? মাওলানা সা‘দ সাহেবের এতাআত বৈধ নয় কেন?

উত্তর  : মাওলানা সা‘দ সাহেব কাফের কি না এই প্রশ্ন কেন আসল? নাউযুবিল্লাহ, কেউ কাফের বলেছে? না উনাদের সন্দেহ হচ্ছে এ বিষয়ে? (নাউযুবিল্লাহ)। একজন সাধারণ মুসলমানের ব্যাপারেও তো এ প্রশ্ন মানুষ উঠাতে পারে না যে, উনি কি কাফের? সা‘দ সাহেবের ব্যাপারে এ প্রশ্ন কেন?

 

(*হুযুর এই বিষয়টা আসছে এজন্য যে, ঐ যে এতাআত করা নিষেধ, কেন নিষেধ, উনি কি কাফের যে, এতাআত নিষিদ্ধ?)

তাহলে তো প্রথমে এই প্রশ্ন করবেন যে, শরীয়তে কার এতাআত বৈধ? কোনো ব্যক্তি কাফের না হলেই কি তার এতাআত বৈধ হবে? এরকম কোনো মাসআলা কি আছে যে, কাফের না হলেই তার এতাআত বৈধ? একজন লোক মুসলিম কিন্তু বেদআতী, তার এতাআত বৈধ নয়। মুসলিম, কিন্তু গোমরাহ, তার এতাআত বৈধ নয়। মুসলিম, তাকে সরাসরি গোমরাহ বলা হয়নি, কিন্তু তার অনেক কথায় গোমরাহী, এই লোকেরও এতাআত করা জায়েয নয়। তো এটা তো কোনো কথা না যে, তিনি কি কাফের? এই প্রশ্ন উঠবে কেন ভাই?

প্রশ্ন : তাহলে কি মাওলানা সা‘দ সাহেবের এতাআত এজন্য অবৈধ যে, তিনি গোমরাহ? আমাদের দেশের আলেমরা কেউ তো উনাকে সরাসরি গোমরাহ বলেন, আবার কেউ স্পষ্টভাবে এটা বলেন না; বরং শুধু এতটুকু বলেন যে, উনার বক্তব্যের মধ্যে অনেক গোমরাহীর কথা আছে এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ইজমা পরিপন্থী কথা আছে। বিষয়টা তাহলে কী?

উত্তর : ফলাফলের বিচারে এই দুই বক্তব্যে কোনো পার্থক্য নেই। কারণ যার বক্তব্যে অনেক গোমরাহী থাকে এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ইজমা পরিপন্থী বিষয় থাকে সে তো গোমরাহ (বিপথগামী) বটেই। এমন ব্যক্তিকে সরাসরি গোমরাহ নাম দেওয়া না হলেও তার এতাআত করা বৈধ হবে না। এমন ব্যক্তি কোনো দ্বীনী জামাতের দ্বীনী যিম্মাদারও হতে পারে না।

মাওলানা সা‘দ সাহেব সম্পর্কে দারুল উলূম দেওবন্দের ফতোয়া বা মুত্তাফিকাহ মাওকিফে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, তিনি জুমহুর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত-এর রাস্তা থেকে সরে যাচ্ছেন- যা নিঃসন্দেহে গোমরাহীর রাস্তা। তাই তার ঐসব বক্তব্যের ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করা যায় না। ফতোয়ার উর্দূ পাঠের সংশ্লিষ্ট অংশ এই-

جماعت تبلیغ ایک خالص دینی جماعت ہے، جو عملا ومسلکا جمہور امت اور اکابر رحمہم اللہ کے طریق سے ہٹ کر محفوظ نہیں رہ پائے گی، انبیاء کی شان میں بے ادبی، فکری انحرافات، تفسیر بالرائے، احادیث وآثار کی من مانی تشریحات سے علمائے حق کبھی متفق نہیں ہو سکتے اور اس پر سکوت اختیار نہیں کیا جا سکتا ؛ اس لئے کہ اسی قسم کے نظریات بعد میں پوری جماعت کو راہ حق سے منحرف کردیتے ہیں، جیسا کہ پہلے بھی بعض اصلاحی اور دینی جماعتوں کے ساتھ یہ حادثہ پیش آچکا ہے۔

اس لئے ہم ان معروضات کی روشنی میں امت مسلمہ بالخصوص عام تبلیغی احباب کو اس بات سے آگاہ کرنا اپنا دینی فریضہ سمجھتے ہیں کہ مولوی محمد سعد صاحب کم علمی کی بنا پر اپنے افکار ونظریات اور قرآن وحدیث کی تشریحا ت میں جمہور اہل السنۃ والجماعۃ کے راستے سے ہٹتے جارہے ہيں، جو بلا شبہ گمراہی کا راستہ ہے، اس لئے ان باتوں پر سکوت اختیار نہيں کیا جا سکتا، اس لئے کہ یہ نظریات اگر چہ ایک فرد کے ہیں؛ لیکن یہ چیزیں اب عوام الناس میں تیزی سے پھیلتی جارہی ہیں۔

جماعت کے حلقے میں اثر ورسوخ رکھنے والے معتدل مزاج اور سنجیدہ اہم ذمہ داران کو بھی ہم متوجہ کرنا چاہتے ہیں کہ اکابر کی قائم کردہ اس جماعت کو جمہور امت اور سابقہ اکابر ذمہ داران کے مسلک ومشرب پر قائم رکھنے کی سعی کریں اور مولوی محمد سعد صاحب کے جو غلط افکار ونظریات عوام الناس میں پھیل چکے ہیں، ان کی اصلاح کی بھر پور کوشش کریں، اگر ان پر فوری قدغن نہ لگائی گئی، تو خطرہ ہے کہ آگے چل کر جماعت تبلیغ سے وابستہ امت کا ایک بڑا طبقہ گمراہی کا شکار ہو فرقہ ضالہ کی شکل اختیار کرلے۔

 

তরজমা : তাবলীগ জামাত একটি খালেস দ্বীনী জামাত, যা কাজে-কর্মে ও মতাদর্শে জুমহূর উম্মত ও আকাবিরের মত ও পথ থেকে দূরে সরে নিরাপদ থাকতে পারবে না। আম্বিয়ায়ে কেরামের শানে বেআদবী, চিন্তাগত বিচ্যুতি, তাফসীর বির-রায়, হাদীস-আছারের মনগড়া ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সঙ্গে হক্কানী উলামায়ে কেরাম কখনো একমত হতে পারেন না। এসব বিষয়ে চুপ থাকা যায় না। কারণ, এ ধরনের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গিই পরবর্তীতে পুরো জামাতকে হক পথ থেকে সরিয়ে দেয়। যেমন অতীতে কিছু ইসলাহী ও দ্বীনী জামাতের ক্ষেত্রে এটা ঘটেছে।

তাই উপরিউক্ত বিষয়াবলির আলোকে গোটা মুসলিম উম্মাহ বিশেষত সাধারণ তাবলীগী ভাইদের এ বিষয়ে অবগত করা আমরা আমাদের দ্বীনী দায়িত্ব মনে করছি :

মওলবী মুহাম্মাদ সা‘দ সাহেব ইলমের স্বল্পতার দরুন নিজের চিন্তাধারা ও মতাদর্শ এবং কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে জুমহূর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পথ থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছেন; যা নিঃসন্দেহে গোমরাহীর পথ। তাই এ বিষয়ে নিরব থাকা যায় না। কারণ, এ চিন্তাধারাগুলো যদিও এক ব্যক্তিবিশেষের, কিন্তু বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের মাঝে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

তাবলীগী হালকায় প্রভাবশালী, ভারসাম্যপূর্ণ মেযাজের অধিকারী, বিচক্ষণ ও গুরুত্বপূর্ণ যিম্মাদারগণেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যে, আকাবিরের প্রতিষ্ঠিত এই জামাতকে জুমহূর উম্মত এবং অতীত আকাবির যিম্মাদারগণের মত ও পথের উপর  রাখার চেষ্টা করুন। এবং মওলবী মুহাম্মাদ সা‘দ সাহেবের যে ভুল চিন্তা- চেতনা ও মতাদর্শ সাধারণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে তা সংশোধনের যথাসম্ভব চেষ্টা করুন। যদি এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয় তাহলে প্রবল আশংকা আছে যে, আগামীতে তাবলীগ জামাতের সাথে সম্পৃক্ত মুসলিম উম্মাহর একটি বড় অংশ গোমরাহীর শিকার হয়ে একটি ‘গোমরাহ ফেরকা’র রূপ নিবে।

মনে রাখবেন, দারুল উলূম দেওবন্দের সেই ফতোয়া এখনও বহাল আছে। কারণ এই বিষয়ে দারুল উলূমের সর্বশেষ লেখার ফলাফলও তাই যা এখানে উদ্ধৃত হল।

প্রশ্ন : এখন দেওবন্দ তাঁর ব্যাপারে কী বলে?

উত্তর : দেওবন্দ তো বলেছে তার মধ্যে চিন্তাগত বিপথগামিতা রয়েছে। এ কথা দেওবন্দের শেষ লেখার মধ্যে আছে। فکری بے راہ روی  ফিকরী বে-রাহ রবী। তিনি রুজু করেছেন, যে বিষয়ে রুজু করেছেন, ধরলাম এ রুজু যদি গ্রহণ করার মতও হয় কিন্তু উনার মূল সমস্যা ফিকরী বে-রাহ রবী। বে-রাহ মানে রাস্তার বাইরে, রাস্তা নয় এমন। ‘রবী’ মানে চলা, ফিকরী মানে চিন্তাগত। চিন্তাগত বিপথগামিতা। যেটা আমরা আগে বলেছি সেটা এখনও বহাল।

কারণ তার বয়ানের মধ্যে দেখা যাচ্ছে মুজতাহিদসূলভ আলোচনা। তিনি তো মুজতাহিদ না। মুজতাহিদ নয় এমন ব্যক্তি যদি ইজতিহাদ শুরু করে তাহলে কি দশা হয়! ডাক্তার নয় এমন ব্যক্তি যদি অপারেশন শুরু করে দেয় তাহলে! আচ্ছা আপনাদেরকে পুরো লেখাটাই শুনাই। দারুল উলুম দেওবন্দের সর্বশেষ লেখাটি ৩১/০১/২০১৮ ঈসায়ী তারিখের লেখা :

...

(তরজমা)

মাওলানা মুহাম্মাদ সা‘দ সাহেবের রুজু সম্পর্কে

(দারুল উলূম দেওবন্দের পক্ষ থেকে)

জরুরি ওয়াজাহাত

তারিখ : ৩১/০১/২০১৮

কিছুদিন আগে জনাব মাওলানা মুহাম্মাদ সা‘দ সাহেব কর্তৃক হযরত মূসা আলাইহিস সালাম (সম্পর্কে প্রদত্ত আপত্তিকর বক্তব্য) থেকে রুজুর ঘোষণা দেওয়ার পর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি এ সম্পর্কে দারুল উলূম দেওবন্দের অবস্থান জানার জন্য প্রশ্ন করে যাচ্ছেন।

এমতাবস্থায় পরিষ্কার হওয়া আবশ্যক যে, তার রুজুকে এই এক ঘটনার ক্ষেত্রে ইতমিনানযোগ্য বলা গেলেও দারুল উলূম দেওবন্দের মাওকিফে মূলত মাওলানার চিন্তাগত যে বিপথগামিতার ব্যাপারে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়েছিল তা উপেক্ষা করা যায় না। কারণ কয়েকবার রুজু করার পরও বিভিন্ন সময় মাওলানার এমন সব নতুন নতুন বয়ান পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে তার সেই মুজতাহিদসুলভ উপস্থাপন, দলীল-প্রমাণের ভুল প্রয়োগ এবং দাওয়াত সম্পর্কে তার নিজস্ব বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণের জন্য শরয়ী নুসূসের অপপ্রয়োগের বিষয়গুলো স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে। যার কারণে শুধু দারুল উলূমের যিম্মাদারগণই নন, অন্যান্য হক্কানী উলামায়ে কেরামেরও মাওলানার সামগ্রিক ফিকিরের ব্যাপারে কঠিন ধরনের অনাস্থা রয়েছে।

আমাদের মানতে হবে যে, আকাবিরের চিন্তা-চেতনা ও মতাদর্শ হতে সামান্য বিচ্যুতিও কঠিন ক্ষতির কারণ হয়। তাই বয়ান-বক্তব্যের ক্ষেত্রে মাওলানার সতর্কতাপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করা উচিত। সেইসাথে আকাবির ও আসলাফের পথ ও পন্থার উপর অটল-অবিচল থেকে শরঈ নুসূস তথা কুরআন-হাদীস হতে ব্যক্তিগত ইজতিহাদের ধারা বন্ধ করা উচিত। কেননা, মাওলানার এজাতীয় অবান্তর ‘ইজতিহাদ’ থেকে এমন মনে হয় যে, আল্লাহ না করুন তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতাদর্শ, বিশেষত স্বীয় আকাবিরের মাসলাক ও আদর্শ থেকে ভিন্ন কোনো নতুন জামাতের রূপ দিতে যাচ্ছেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে আকাবির ও আসলাফের নীতি ও আদর্শের উপর দৃঢ়পদ রাখুন- আমীন।

যারা দারুল উলূম দেওবন্দের শরণাপন্ন হচ্ছেন তাদের প্রতি আবারো নিবেদন, তাবলীগ জামাতের অভ্যন্তরীন ইখতিলাফ ও মতানৈক্যের সাথে দারুল উলূমের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রথম দিন থেকেই এই ঘোষণা করা হচ্ছে। তবে ভুল চিন্তাধারা ও ভ্রান্ত মতবাদ সম্পর্কে উম্মত যখনই দারুল উলূমের শরণাপন্ন হয়েছে, দারুল উলূম উম্মতের সঠিক রাহবরী করার চেষ্টা করেছে। দারুল উলূম একে তার দ্বীনী ও শরঈ দায়িত্ব বলে মনে করে।

(এতে যারা স্বাক্ষর করেছেন :)

১. (মাওলানা) আবুল কাসেম নোমানী গুফিরা লাহু (দামাত বারাকাতুহুম) [মুহতামিম, দারুল উলূম দেওবন্দ]

১৩ জুমাদাল উলা, ১৪৩৯ হি.

২. (মাওলানা) আরশাদ মাদানী (দামাত বারাকাতুহুম) [মুহাদ্দিস, দারুল উলূম দেওবন্দ]

৩. (মাওলানা মুফতী) সাঈদ আহমদ আফাল্লাহু আনহু (পালনপুরী দামাত বারাকাতুহুম) [শাইখুল হাদীস ও সদরুল  মুদাররিসীন, দারুল উলূম দেওবন্দ]

তিনি মূসা আ.-এর ব্যাপারে অন্যায় কথা বলেছেন না? কঠিন কঠিন কথা। সেই কথা শুধু মূসা আ.-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, আল্লাহ তাআলার হুকুমের উপরও হাত পড়ে। কিন্তু তিনি রুজু করেছেন, ৪ বার লিখিত রুজু, তারপর পঞ্চমবার নিযামুদ্দিনের রুজু এবং ষষ্ঠবার কাকরাইলে রুজু করেছেন। রুজু কয়বার করা লাগে, বলেন আপনারা? আমি অমুক কথা ভুল বলেছিলাম, ঐটা প্রত্যাহার করে নিলাম, এটা ভুল, সহীহ কথা এই...। এটাকে বলে রুজু। রুজু কয়বার করতে হয়। রুজুর মত রুজু হলে তো একবারই যথেষ্ট। উনি ৬ বার রুজু করছেন কেন? প্রশ্ন হয় কি হয় না? রুজুর বিবরণ এবং এর প্রকৃতি সম্পর্কে মুন্সিগঞ্জের বয়ানে বিস্তারিত বলেছি। মাসিক আলকাউসারেও এসেছে। ওটা দেখে নিয়েন। (আলকাউসার, রবিউস সানী ১৪৪০ হি.; ডিসেম্বর ২০১৮ ঈ.)

তো এখন মূসা আ.-এর ব্যাপারে রুজু, দেওবন্দ বলেছে যে, এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, এটা ইতমিনানযোগ্য (قابل اطمینان قرار دیا جاسکتا ہے)। এর মানে আসলে পুরো ইতমিনানযোগ্য নয়। কিন্তু তারপরও যেহেতু উনি বারবার বলেছেন আমি রুজু করেছি, রুজু করেছি, ঠিক আছে ধরে নেওয়া হল। কিন্তু এটা তো একটা ঘটনা। এটার ব্যাপারে আপনি রুজু করেছেন। কিন্তু বিষয় তো এই না যে, তিনি একটা-দুইটা ভুল করেছেন, তা থেকে রুজু করে নিলেন। বিষয় তো হল উনার ফিকির এবং মেযাজের মধ্যে পরিবর্তন এসে গেছে। দেওবন্দ এটাই বলছে, সাদ সাহেবের যে ‘ফিকরি বে- রাহরাবি’ চিন্তাগত বিপথগামিতা সেটা দূর হয়নি। ওটা এখনো বহাল আছে। কোনটা? ‘ফিকরি বে-রাহরাবি’- চিন্তাগত বিপথগামিতা।

একজন দাঈ বিশেষ করে যিনি একটা কেন্দ্রীয় জায়গায় যিম্মাদারি পালন করছেন; তার চিন্তাচেতনা তো ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের’ চিন্তাচেতনার মত হতে হবে। কিন্তু উনার চিন্তার রাস্তা ভিন্ন। চিন্তার জগতে উনি ভিন্ন রাস্তায় চলছেন। এই চিন্তা দুনিয়াবি চিন্তা না, দ্বীনি বিষয়গুলোর চিন্তার ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত-এর রাস্তায় চলার পরিবর্তে তিনি ভিন্ন রাস্তায় চলা শুরু করেছেন। এই চলা এখনও অব্যাহত আছে। এক্ষেত্রে তার পক্ষ থেকে এমন কোনো বিষয় আসেনি, যা দেখে আশ্বস্ত হওয়া যায় যে, তিনি সঠিক রাস্তায় চলে এসেছেন।

একটা হল রাস্তায় আছি, কিন্তু ভুল হচ্ছে। এটা এক জিনিস। আরেকটা হল ভিন্ন রাস্তায় হাঁটা শুরু করেছি। দু’টি কি এক কথা? রাস্তায় আছি, কিন্তু হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই, কাত হয়ে পড়ে যাই, কখনো বসে যাই- এটা এক ধরনের ভুল। আরেক ভুল হল আমি রাস্তার বাইরে হাঁটা শুরু করেছি, অন্য রাস্তায় চলা শুরু করেছি। দুইটা কি এক কথা?

এ কথাই বলছে দারুল উলূম দেওবন্দ, ফিকরি বে-রাহরবী। কেন দেওবন্দের এ ব্যাপারে ইতমিনান হচ্ছে না? অনেকবার রুজু করার পরও কিছুদিন পরপর এমন নতুন নতুন বয়ান আসছে, যে বয়ানগুলোর মধ্যে সেই মুজতাহিদানা আন্দায, মুজতাহিদসুলভ মতামত প্রকাশ।

কোনো ‘মুজতাহাদ ফীহ’ বিষয়ে দলীলের আলোকে নিজস্ব মতামত হতে পারে। কিন্তু কার? মুজতাহিদের। আপনি তো মুজতাহিদ না। আপনি তো কোনো কথা বলার আগে চিন্তা করবেন আরো দশ আলেম কী বলে। আমি যেটা বুঝলাম আমার বুঝ ঠিক কিনা মশওয়ারা করে দেখি। মুজতাহিদরাও তো মশওয়ারা করে ফিকির করে বলতেন। কিন্তু তিনি যেন নিজেকে এত বড় মুজতাহিদ মনে করেন (দিলের হালাত আল্লাহই ভালো জানেন) যে, ব্যস, মাথায় একটা আসল আর বলে দিলেন। পূর্বের কোনো নির্ভরযোগ্য হাওয়ালার প্রয়োজন নেই। কোনো মশওয়ারার দরকার নেই। কারণ তিনি তো নীতি আবিষ্কার করেছেন যে মশওয়ারা শুধু ইনতিজামী বিষয়ে হয়। শরয়ী বিষয়ে হয় না! খেয়াল করেছেন? এটাকে বলে মুজতাহিদানা আন্দায।

দ্বিতীয় বিষয়, গলত ইস্তিদলালাত (দলীল প্রমাণের ভুল প্রয়োগ)। আয়াত-হাদীস-সীরাতের ঘটনা, এগুলো দিয়ে দলীল পেশ করতে হয় সঠিক পদ্ধতিতে। তিনি দলীল পেশ করেন গলত পদ্ধতিতে। অর্থাৎ আয়াত দ্বারা যেটা প্রমাণিত হয় না সেটা প্রমাণ করতে চান। হাদীস দ্বারা যেটা প্রমাণিত হয় না সেটা প্রমাণ করতে চান। সীরাতের এ ঘটনা দিয়ে যেটা প্রমাণিত হয় না সেটা প্রমাণ করতে চান। এটাকে বলে গলত ইস্তিদলাল।

তৃতীয় হল, দাওয়াতের বিষয়ে উনি নিজস্ব সীমিত গণ্ডির একটা নকশা ঠিক করেছেন। শরীয়ত দাওয়াতের রাস্তাকে রেখেছে প্রশস্ত। দাওয়াতের অনেক পদ্ধতি রয়েছে, ছিল, আছে,  দাওয়াতের সকল মুবাহ পদ্ধতির ইবাহাত তথা বৈধতার হুকুম বলবৎ থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। তিনি নিজের মতো করে একটা নকশা দাঁড় করিয়েছেন। হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর নকশাও ঠিক রাখেননি। ওটার মধ্যে সংযোজন-বিয়োজন করে নিজস্ব একটা নকশা দাঁড় করিয়েছেন। এখন শরীয়তের নুসূস অর্থাৎ কুরআন এবং হাদীসকে এই বিশেষ নকশার উপর غلط انطباق তথা ভুল প্রয়োগ করেন। যেমন, কুরআন যে দাওয়াতের কথা বলেছে সেটা এটা, শুধু এটা। হাদীস ও সীরাত যে দাওয়াতের কথা বলছে, সেটা কেবল এটা। দাওয়াত ও তাবলীগের ব্যাপারে যে আয়াত ও হাদীস আছে তার উদ্দেশ্য কী? শুধু এটা। এটা হচ্ছে দাওয়াতের বিশেষ পদ্ধতির উপর আয়াত-হাদীসের ভুল প্রয়োগ।

এখানে একটি কথা বুঝতে হবে। শরীয়তে যেখানে এক পদ্ধতি নির্ধারিত সেখানে পদ্ধতি একটাই। সেটিতে ভিন্নতা করা যাবে না। যেমন, সালাতের কথা কুরআনে বলা হয়েছে। মসজিদে যে সালাত পড়ছে মানুষ, শুধু এটাই সালাত। ভা-ারীরা আরেক সালাত আবিষ্কার করেছে। তারা বা তাদের কেউ কেউ বলে, দিলের নামায বড় নামায! সেই সালাত কিন্তু সালাত নয়। যেহেতু সালাতের নির্ধারিত কাঠামো কুরআন হাদীস নির্ধারণ করে দিয়েছে কাজেই সেটিই নির্ধারিত। এখন যদি কেউ প্রতি রাকাতে দুই রুকু করে, চার সিজদা করে তো আপনি কী বলবেন? আরে কুরআন-হাদীসে যে সালাতের কথা বলা আছে সেটা এক রুকু, দুই সিজদাওয়ালা। তুমি যে নতুন আবিষ্কার করছ এটা সালাত নয়।

কিন্তু শরীয়ত যেখানে একাধিক পদ্ধতি রেখেছে, সেখানে আপনি এক পদ্ধতি নির্বাচন করলেন আর বললেন যে, কুরআন-হাদীসে দাওয়াতের ব্যাপারে যা বলেছে তা কিন্তু এটা। এর বাইরে গেলে দাওয়াত হবে না। এটা বিকৃতি কি বিকৃতি না? তো দেওবন্দ শেষ রুজুনামায় বলেছে তার রুজুর পরও নতুন নতুন বয়ানে তিনটা জিনিস দেখা যায়।

১. ইজতিহাদের যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও মুজতাহিদের মত মতামত প্রকাশ।

২. আয়াত-হাদীস দিয়ে দলীল-প্রমাণ দিতে গিয়ে তার ভুল প্রয়োগ।

৩. দাওয়াতের বিশেষ পদ্ধতির উপর নুসূসে শরীয়ত তথা আয়াত-হাদীস ও সীরাতের ঘটনাসমূহের ভুল প্রয়োগ।

এই তিন ধরনের সমস্যা তার নতুন নতুন বয়ানগুলোর মধ্যে বারবার দেখা যাচ্ছে। তাহলে বুঝা গেল তার চিন্তাগত যে সমস্যা সেটা এখনো বহাল আছে। এজন্য ইতমিনান হচ্ছে না। শুধু আমাদের ইতমিনান হচ্ছে না তা না, বরং অন্যান্য উলামায়ে হকেরও তার ব্যাপারে বে-ইতমিনানি রয়েছে।

এরপর দেওবন্দ নসীহত করেছে যে, আমরা যদি আকাবিরের তরীকা ও চিন্তা-চেতনা থেকে একটুও দূরে সরে যাই তাহলে আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হবে। তাই মাওলানা সা‘দ সাহেবের বয়ানের মধ্যে সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। সালাফের তরীকার উপরে তার মজবুতির সাথে থাকা দরকার। সালাফের রাস্তায় চলতে হবে তাকে। এজন্য আমরা চাই তিনি নুসূসে শরীআহ অর্থাৎ কুরআনের আয়াত ও হাদীস এবং সীরাতের ঘটনা থেকে ‘ব্যক্তিগত ইজতিহাদের ধারা’ বন্ধ করুন।

এ কথা দেওবন্দ কেন বলছে? কারণ, উনি মুজতাহিদ না। ব্যক্তিগত ইজতিহাদ করতে গিয়েই তিনি গোমরাহির নতুন নতুন কথা আবিষ্কার করছেন। দারুল উলূম দেওবন্দ আরো সতর্ক করেছে যে, মাওলানার এরকম অনর্থক ইজতিহাদের কারণে আশংকা হয়, আল্লাহ না করুন, তিনি এমন একটা নতুন জামাত বানাতে যাচ্ছেন যেটা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত থেকে ভিন্ন। আকাবিরের তরীকা থেকে ভিন্ন।

এই বিষয়টা কাউকে সরাসরি গোমরাহ বলার চাইতে কম নয়। এখন আশা করি বুঝতে পেরেছেন যে, দেওবন্দ শেষ লেখায় শুধু এ কথা বলেনি যে, মূসা আ.-এর বিষয়ে তার রুজু ইতমিনানযোগ্য; বরং দেওবন্দ আরো দুটি বিষয়ে সতর্ক করেছে।

১. ‘ফিকরী বে-রাহরাবী’ যার দলীল তার পরবর্তী বয়ানগুলোতে উপস্থিত:-

ক. ইজতিহাদের যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও মুজতাহিদের মত মতামত প্রকাশ।

খ. গলদ ইসতিদলাল।

গ. শরীয়তের নুসূসের অপপ্রয়োগ ।

২. আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত ও আকাবিরের তরীকা থেকে আলাদা নতুন একটি জামাত বানানোর আশংকা।

আর এটা তো জানা কথা যে, তিনি রুজুর পর আগের বিভিন্ন গলত কথা আবারো বলে যাচ্ছেন। আর নতুন নতুন গলত কথা তো আবিষ্কার করছেনই।

হাঁ, কিছু জিনিস আছে, যা রুজুর পর আবার বলেছেন বলে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। যেমন পকেটে মোবাইল ফোন রাখলে নামায হবে না। এ থেকে তিনি রুজু করেছেন। রুজু করার পরে এই ব্যাপারে আমার জানা মতে আর বলেননি যে, নামায হবে না। অবশ্য এ সংক্রান্ত নতুন কিছু ভুল কথা বলেছেন। কিন্তু ‘নামায হবে না’ এই কথা আমার জানা মতে আর বলেননি। রুজু করার পর যদি আর না বলেন, তাহলে আমরা ধরে নিব যে, ঐ বিষয়ে রুজু ঠিক আছে।

এখন কথা হল, তার রুজুর ব্যাপারে যেহেতু যৌক্তিক কারণে ইতমিনান হচ্ছে না, তাই দেখা যায় অনেকে রুজুর আগের ঐ কথাগুলোকেও বয়ানে উল্লেখ করেন, যেগুলো রুজুর পর পুনরায় তিনি বলেননি। কিন্তু আমি বলি, এই ধরনের কথাগুলো উল্লেখ করার দরকার নেই। যেটা হতে তিনি রুজু করেছেন এবং দ্বিতীয়বার বলেননি সেটাকে তার গোমরাহির তালিকায় আনার দরকার নেই। আমরা তার ভ্রান্ত দিকগুলোর মধ্যে ঐ জিনিসগুলোই আনব, যা রুজুর পরও বলেছেন বা আগে বলেননি এখন নতুন করে বলছেন। এছাড়া বাকিগুলো আনার দরকার নেই।

আচ্ছা একজন দুইটা ভুল করেছেন, দুইটা ভুল থেকে রুজু করেছেন, তো এই দুই ভুল থেকে রুজুর কারণে কি তার তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ভুলও শুদ্ধ হয়ে যাবে? না। এক ভুল থেকে রুজুর কারণে অন্য ভুল শুদ্ধ হয়ে যাবে না; বরং বুঝতে হবে যে, আসলে তার নীতিই এরকম।

প্রশ্ন : দেওবন্দ আশংকা করেছে যে, এরা মনে হয় বাতিল একটা ফেরকা তৈরি করতে যাচ্ছে। এটা জানা সত্ত্বেও যদি কেউ তার এতাআত করে, এক্ষেত্রে তার জন্য আমরা কী করব?

উত্তর : আমরা তার জন্য দুআ করব। বুঝানোর চেষ্টা করব।

প্রশ্ন : জনৈক মাওলানা সাহেব বলেন, তার ভুলের ব্যাপারে আমি একমত। তিনি তো সেগুলো থেকে রুজু করেছেন। আর আশংকার ব্যাপার যেটা, সেটা তো যে কারো ব্যাপারে করা যেতে পারে। কিন্তু ঐ তিনটা জিনিস গোপন রাখছেন। এ ব্যাপারে আপনি কী বলেন?

উত্তর : আমরা তাদের জন্য দুআ করব। তারা বলেন যে, দেওবন্দ যতটুকু বলেছে এর থেকে বেশি আমরা না বলি। তো এর চেয়ে কম বলবেন কেন? বেশি বলবেন না, কমও তো বলবেন না, তাই না! কিন্তু আপনি তো কম বললেন। ঐ তিনটা মারাত্মক জিনিস আপনি উহ্য রাখলেন। তাছাড়া এ কথাও ঠিক নয়, যে কারো ব্যাপারে আশংকা করা যায়। আপনি নিজের মুহাসাবা যত ইচ্ছা করুন, কিন্তু কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া কারো ব্যাপারে এমন আশংকা করা জায়েয নয়। আর যৌক্তিক কারণ, শক্তিশালী আলামত ও লক্ষণের কারণে আশংকা করা হলে সেই আশংকাকে উপেক্ষা করা যায় না কোনোভাবেই।

احتمال ناشئ عن دلیل এবং احتمال ناشئ عن غیر دلیل-এর পার্থক্য আলেমরা বুঝেন। আর রুজুর হাকীকত বুঝার জন্য মাসিক আলকাউসারের (ডিসেম্বর ২০১৮) সংখ্যা দেখুন। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, যেন কারো বিভ্রান্তিমূলক কথায় প্রতারিত না হই। আল্লাহ তাআলা রক্ষা করার মালিক।

প্রশ্ন : দেওবন্দকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের উলামায়ে কেরাম দাওয়াত তাবলীগের মত এত বড় একটা মেহনতের ব্যাপারে কোনো ধরনের ফতোয়া দেওয়ার স্বাধীনতা রাখে কি না?

উত্তর : দেওবন্দকে উপেক্ষা করার অর্থ বুঝলাম না আমি। এর অর্থ কি দেওবন্দের হুকুম অমান্য করা? এমন কিছু তো এখানে ঘটেনি। এখানের আলেমরা তো দেওবন্দের ফতোয়ারই ব্যাখ্যা করেছেন এবং ঐ ফতোয়ার প্রয়োগের দিকে দৃষ্টি আকষর্ণ করছেন। থাকল কোনো বিষয়ে ফতোয়া দেওয়া। তো কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য ফতোয়া দেওয়ার ব্যাপারে যে শর্তগুলো রয়েছে বা ফতোয়া দেওয়ার যোগ্য কে- এক্ষেত্রে শরীয়তের যে নীতিমালা রয়েছে, ঐ নীতিমালা অনুসারে যার মধ্যে ঐ যোগ্যতা আছে সে-ই ফতোয়া দিতে পারে। দারুল উলূম দেওবন্দ কখনো এই ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। করার কথাও না।

জানি না আপনারা জানেন কি না। মাওলানা সা‘দ সাহেব হাফিযাহুল্লাহ-এর মারাত্মক ভুলগুলোর ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর এখানকার উলামায়ে কেরাম কাকরাইলের শুরার নিকট দরখাস্ত নিয়ে গিয়েছিলেন যে, সা‘দ সাহেবকে আপাতত ইজতিমায় দাওয়াত না দেওয়া হোক। এটা কিন্তু দারুল উলূম দেওবন্দের ফতোয়া আসার আগে উলামায়ে কেরাম করেছেন। এতে দারুল উলূমের জিম্মাদারগণ কিন্তু নারাজ হননি; বরং যারা জানতে পেরেছেন তারা নাহি আনিল মুনকারের দায়িত্ব পালন করাতে খুশি হয়েছেন।

প্রশ্ন : মাওলানা সা‘দ সাহেব অন্যান্য মেহনতকে খাটো করেন এবং বলেন যে, এই মেহনতের সাথেই আল্লাহ তাআলার ওয়াদা এবং দাওয়াতের ব্যাপারে যে সমস্ত কুরআনের আয়াত ও হাদীস আছে সেগুলোকে এ মেহনতের সাথে খাছ বলেন, এটা কি শরীয়তের বিকৃতি হবে?

উত্তর : হাঁ, বিকৃতি তো বটেই। দেখুন, তালীম বা দ্বীনের শিক্ষাদান ছিল সাহাবাদের আমল। কিন্তু এমন লম্বা একটা ঘর হতে হবে, ঘণ্টাভিত্তিক ও ক্লাসভিত্তিক পড়াশোনা হতে হবে এটা তো ছিল না। দশ বছরের কারিকুলাম হতে হবে, এটাও তো ছিল না। কিন্তু তালীম ছিল। এগুলো স্পষ্ট কথা। দাওয়াতও এ রকম। মূল দাওয়াতের কাজ, আর তার বিশেষ পদ্ধতি এক কথা নয়। আল্লাহ তাআলা দাওয়াতকে ফরয নামাজের মতো করে দেননি যে, একটা নির্ধারিত বিশেষ পদ্ধতিতে করতে হবে। কারণ এটা হলে সংকীর্ণ হয়ে যাবে। মানুষের জন্য আল্লাহ তাআলা ইবাদতের পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন যেমন হজ¦, বিশেষ জায়গায় বিশেষ দিনে পালন করতে হয়। কিন্তু তালীম, দাওয়াত ও তাবলীগ, নুসরতে দ্বীন ও ইশাআতে দ্বীন- এসব কাজ এবং এগুলোর মতো অনেক কাজ আছে, যার জন্য আল্লাহ তাআলা মূলনীতি দিয়ে দিয়েছেন, এই মূলনীতিগুলো অবলম্বন করে দ্বীনের এসব কাজ করো। এখন যদি কেউ বিশেষ একটি মুবাহ পদ্ধতিকেই কুরআন-হাদীস ও সীরাতের নির্ধারণকৃত অবধারিত পদ্ধতি মনে করে তাহলে সেটা তাহরীফ তথা বিকৃতি কেন হবে না?

সারকথা হল, দ্বীনের যে কাজগুলোর পদ্ধতি আল্লাহ তাআলা প্রশস্ত রেখেছেন, সেই কাজের মধ্যে আপনি একটা পদ্ধতিকে নির্দিষ্ট করে দিতে পারেন না। আপনি যে কোনো বৈধ পদ্ধতি অবলম্বন করুন, কিন্তু বলতে পারেন না, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এটাই হুকুম। তাহলে কি আগের ওয়ালারা ভুল করেছেন? নাউযুবিল্লাহ। আর সামনে? সামনেও তো একাধিক পদ্ধতি হতে পারে। এখনও একাধিক পদ্ধতি চলতে পারে। চলছেও। দুনিয়ার সবাই কি নিযামুদ্দিনের তরীকায় দাওয়াত দেয়? ওদের দাওয়াত যদি শরীয়তের নীতিমালা অনুযায়ী হয়, তাহলে কি আপনি নাজায়েয বলবেন? কেবলই এই জন্য যে, এটা নিযামুদ্দিনের সাথে যুক্ত নয়। এ কথা বলা  কি জায়েয আছে? যদি কেউ বলে তাহলে বিকৃতি হবে কি হবে না?

হয়ত আপনারা জানেন, দাওয়াতকে বিশেষ কোনো পদ্ধতিতে সীমাবদ্ধ করে দেওয়ার এই মারাত্মক ভুল থেকে কিন্তু তিনি রুজু করেছেন; কিন্তু রুজু করার পরও তা একাধারে বলে যাচ্ছেন।

প্রশ্ন : মাওলানা সা‘দ সাহেবের এতাআতে যারা আছেন, অনেক সময় তারা বিভ্রান্তিকর কথা বলেন, ইখতিলাফী বিষয়ে তর্ক জুড়ে দেন বা কাউকে গলত বুঝাতে থাকেন, তাদেরকে আমলে জোড়ানোর ব্যাপারে কী বলেন?

উত্তর : কেউ আমলে বসতে চাইলে নিষেধ করা তো আমি মুনাসিব মনে করি না। যে ব্যক্তি এরকম করে, বিভ্রান্তি ছড়ায় তাকে হাতে-পায়ে ধরে বলে দেওয়া যে, ভাই মেহেরবানি করে এমন না করলে ভালো হয়। কিন্তু একজন কেবলই এতাআতী বলে তাকে আপনাদের সাথে কাজে জুড়তে দেবেন না, এটা ঠিক না। কেউ সমস্যা সৃষ্টি করলে তার ব্যাপারে তো মাসআলা আছে। মসজিদ তো সবার জন্যই উন্মুক্ত। কিন্তু একজন মসজিদে এসে ফেতনা করে, তো তাকে বলা, ভাই! মসজিদ তো নামাযের জায়গা। ইবাদতের জায়গা। ফেতনার জায়গা না। এমনই যদি করেন তাহলে দয়া করে আপনি এখানে না আসলে ভালো হয়। এতটুকু বলার অবকাশ আছে। কিন্তু প্রথমেই তাকে এ কথা বলে দিতে পারেন না।

প্রশ্ন : সা‘দ সাহেব মাদরাসার শিক্ষকদের বেতনের ব্যাপারে যে মাসআলা দিয়েছেন এবং মাদরাসা (এর উপযুক্ত খাতে) যাকাত না দেওয়ার যে কথা বলেছেন এটা মাদরাসা শিক্ষাকে বন্ধ করার কোনো চক্রান্ত কি না?

উত্তর : এটার একটা আশঙ্কা আছে। কিন্তু তার বিষয়ে এই দাবি করতে হলে স্পষ্ট দলীল দরকার। তিনি অন্য দিকে এটাও বলেছেন যে, সাধারণ অর্থে বা নিজের অর্থ দিয়ে মাদরাসা পরিচালনা করো। যাকাতের টাকা দিয়ে নয়। বেতন-ভাতার বর্ণনার বিষয়ে এরা বারবার উমর রা.-এর উদ্ধৃতি দেয়। এ বিষয়ে আপনারা আলকাউসারে হয়তো পড়েছেন যে, বর্ণনাটা ঠিক নয়। এবং বর্ণনার যে পাঠ, সে পাঠের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। আবার বর্ণনাটির যে মর্ম তার সাথে তাদের কথিত মাসআলার কোনো মিল নেই। (বিস্তারিত জানার জন্য মাসিক আলকাউসার যিলহজ্ব ১৪৩৯ হিজরী মোতাবেক সেপ্টেম্বর ২০১৮ ঈসায়ী সংখ্যা দেখুন।)

তো এ ব্যাপারে উমর রা.-এর দিকে সম্বন্ধ করে যে বর্ণনা উল্লেখ করা হয় তা উমর রা. থেকে প্রমাণিত নয়। কিন্তু মাওলানা সা‘দ সাহেব নিজেই অন্য এক জায়গায় এ বিষয়ে সঠিক কথা বলেছেন। সেখানে বলেছেন

যে, মাদরাসাওয়ালারা যে সম্মানী নেয়, তা হাবসে আওকাতের বিনিময়ে, তা‘লীমের বিনিময়ে নয়। মানে তারা যে নিজেদের পুরো সময়টা এ কাজে দিয়ে দিচ্ছেন, এ কাজের মধ্যেই ব্যস্ত থাকছেন, নিজেদের কামাই রোজগারের জন্য সময় পাচ্ছেন না, তাই এ সময় প্রদানের বিনিময়ে সম্মানী ভাতা নিচ্ছেন। যেহেতু এ বিষয়ে মাওলানা সা‘দ সাহেবের এ ধরনের বক্তব্যও রয়েছে সেজন্য আমরা তার নিয়তের উপর হামলা করতে পারি না। গায়েবের মালিক আল্লাহ। বাকী তার এতাআতীরা বা তাদের অনেকে যে মাদরাসা দেখতেই পারে না তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

প্রশ্ন : যারা এতাআত করছে তারা তো চাচ্ছে ভাগাভাগী। এটা কেমন?

উত্তর : তারা যদি এ কথা বলেন যে, ভাই তোমরা আমাদের ইসলাহের আশা করো না। আমাদের সা‘দ সাহেবেরও ইসলাহের আশা করো না। যেমন, একজন বলে দিয়েছে যে, মাইজভাণ্ডারীরা এদেশে আছে, তো আমরাও আছি। আরেকজন বলেছে, সা‘দ সাহেব জাহান্নামে গেলে আমরাও জাহান্নামে যাব। নাউযুবিল্লাহ। যদি ওরা বলে যে, আমাদেরকে ভিন্ন ফেরকা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। তাহলে তাদেরকে প্রথমে বলতে হবে যে, ইলিয়াস রাহ. যে তাবলীগ করেছেন, তারা সেই তাবলীগের ওপর নাই। তারা যদি বলে, আমাদেরকে ভিন্ন ফেরকা হিসেবে থাকতে দাও, তাহলে এটা তাদের বিষয়। আমার তো এটা ভাবতেই কষ্ট লাগে। আমরা চাই সবাই হকের ভিত্তিতে এক হয়ে যাক। কিন্তু এ কথা বলা যে,  আমরাও তাবলীগ ওরাও তাবলীগ, ওদের একদিন আমাদের একদিন- এ কথা বলা চলবে না। এটা হয় না। কারণ, তুমি যখন ইলিয়াস রাহ.-এর তাবলীগের কথা বলছ তাহলে তোমাকে সেই আদর্শের ওপর চলতে হবে। তুমি যখন দ্বীনের তাবলীগের কথা বলছ, তাহলে তোমাকে প্রথমে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা, মানহাজ এবং তরীকা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। এটা থেকে সরে তাবলীগের নাম নিলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। আরে ভাই! ভাগাভাগি তো হয় ধন-সম্পদের মধ্যে। হক আর বাতিলে ভাগাভাগি হয় নাকি?

প্রশ্ন : টঙ্গির ময়দানে যে হাঙ্গামা ওরা করল, এরপরে তাদেরকে কি বাতিল ফেরকা বলা যাবে?

উত্তর : তারা তো নিজেদেরকে নতুন ফেরকার রূপ দিয়ে দিয়েছেই মনে হচ্ছে। এটা তো তাদের কাজ। আমরা না বলি। আমরা চাই না- ফেরকা থাকুক। ফেরকা থাকা যে কত বড় মুসিবত! ফেরকা থাকলে তো যতদিন ঐ ফেরকা থাকবে ততদিন তাতে না-বুঝে না-শুনে লোক যুক্ত হতেই থাকবে। আমরা চাই ফেরকা না হোক, হাতে-পায়ে ধরে আমাদের চেষ্টা আমরা অব্যাহত রাখব যাতে ওরা হক পথে চলে আসে।

প্রশ্ন : যদি কারো বাবা-মা এতাআতে থাকেন তাহলে তাদের প্রতি ছেলের আচরণ কেমন হতে পারে?

উত্তর : মা-বাবার সাথে আদব রক্ষা করা এবং হকের ওপর মজবুত থাকা। আদব ও ইকরামের সাথে তাদের বুঝানোর চেষ্টা করা।

প্রশ্ন : আমাদের হলের মধ্যে দেখা যায় যে, আমরা বেশির ভাগ সাথি আলেমদের সাথে আছি। কিছু কিছু সাথি আছে, যারা এতাআতী। যদি এমন হয় যে, একই রুমে আমরা তিন-চারজন আলেমদের সাথে আর দুয়েকজন থাকে এতাআতী, তাহলে তাদের ব্যাপারে আমাদের ফিকির কী হবে?

উত্তর : কথা তো একটাই, আশা ছাড়বেন না। দুআ করতে থাকবেন, বোঝাতে থাকবেন।

প্রশ্ন : যদি এমন হয় যে, আমাদের তাবলীগের রুমগুলো আলাদা। একই রুমে সব তাবলীগের ভাইয়েরাই থাকে, যেহেতু ওরা ফেতনা ছড়াচ্ছে, এ ক্ষেত্রে তাদেরকে আমাদের রুমে রাখা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? উত্তর : রাখলে তো ভাল। তাহলে তারা আপনাদের সোহবতে হয়তো এদিকে আসতে পারে। যদি তারা খুব বেশি সমস্যা না করে, তাহলে তাদেরকে সাথে রাখাই ভালো।

প্রশ্ন : মুনতাখাব হাদীস তালীম করা হয় না কেন?

উত্তর : মাশওয়ারা ছাড়া সা‘দ সাহেব এটা শুরু করেছেন। মাশওয়ারা করতে হবে না? একটি কিতাব তালীমে যুক্ত করা হবে- মাশওয়ারা হতে হবে তো? তো মাশওয়ারায় সিদ্ধান্ত না করে এটার তালীম শুরু করে দিয়েছেন। যেহেতু এটা একক ফায়সালায় শুরু করেছেন এবং এটা জোর-জবরদস্তি করে চালিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসার কারণে, তার একক সিদ্ধান্তে যেগুলো চালু হয়েছে, সেগুলো ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই হিসেবে মুন্তাখাব হাদীসের তালীম করছে না অনেকে। কিন্তু কাকরাইল থেকে এর তালীমের প্রতি কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, মনে হয় বিষয়টি এমন নয়। আমার খেয়াল হল, যাই হবে মাশওয়ারার মাধ্যমে হওয়া উচিত।

প্রশ্ন : যে দু-চার জন আলেম ইতাআতের সঙ্গে আছেন তারা বলেন যে, বাংলাদেশের উলামায়ে কেরামের আরো প্রশস্ত মানসিকতা রাখা দরকার। তারা সংকীর্ণ মানসিকতা রাখেন। প্রশস্ত মানসিকতা দেখানো দরকার।

উত্তর : প্রশস্ত মানসিকতার সীমারেখা কী? ‘প্রশস্ত’ মানসিকতার একটি রূপ হল, আপনি বলবেন যে, এ ভুলগুলো ভুল না। আরেকটা হল এ ভুলগুলো থাকা সত্ত্বেও তার এতাআত করতে হবে। তার সাথে ভুলগুলোর পূর্বে যে আচরণ করা হয়েছে সে আচরণই করা হবে। তো এমন প্রশস্ততা তো শরীয়তে অনুমোদিত নয়।

আমরা বুঝতে চাই- প্রশস্ততা মানে কী? এটাও তো প্রশস্ততা যে, তার এতসব সমস্যা সত্ত্বেও শুধু এতটুকু বলা হল যে, তিনি আহলুস্সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের রাস্তা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন, যা গোমরাহীর রাস্তা। তার অনেক বক্তব্য আহলুস্সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের ইজমা পরিপন্থী। তিনি ফিকরী বে-রাহরবীর শিকার। এরচে কঠিন বা কড়া কোনো মন্তব্য করা হল না- এটাও এক ধরনের প্রশস্ততা।

আপনি যদি চান যে, এ ভুলগুলোকে সাধারণ ভুল হিসেবে ধরা হোক- এটাতো হবে না। এমন প্রশস্ততা যদি আশা করা হয় যে, কঠিন ভুলকে আপনি বলবেন হালকা ভুল- এটা তো হবে না। এটা তো অন্যায়। উনারা এ ধরনের প্রশস্ততা চাচ্ছেন।

সংকীর্ণতা ও প্রশস্ততার শরঈ যে সীমারেখা তার মধ্যেই আমাদের থাকতে হবে। নিজেদের থেকে প্রশস্ততা আবিষ্কার করা যাবে না।

প্রশ্ন : টঙ্গির ঘটনার প্রেক্ষিতে এক ভাই আমাকে বলল যে, মুসলমান মুসলমান যদি মারামারি করে তখন যে মারা যায় সে কি শহীদ?

উত্তর : আমি যতদূর জানি টঙ্গিতে মারামারি হয়নি; বরং একতরফা হামলা হয়েছে। যাই হোক যেটা আপনার জানার বিষয়, মযলুম হয়ে যে মারা যাবে সে শহীদ। অর্থাৎ শহীদের ছওয়াব পাবে। যারা জিহাদের ময়দানে কাফেরদের হাতে শহীদ হয় শরীয়তের পরিভাষায় মূল শহীদ তারা। আরেকটি হল শহীদের ছওয়াব পাওয়া। এই অর্থে যে, যে মুসলমান মযলুম হয়ে নিহত হয়েছে, সে শহীদের ছওয়াব পাবে। তাই একথা বলা ঠিক না যে, যারা মযলুম হয়ে মারা গেছে তারা শহীদের ছওয়াব পাবে না।

প্রশ্ন : তারা বলেন হযরত আলী রা. ও হযরত মুআবিয়া রা.-এর বিরোধের সময় আবু হুরাইরা রা. নিরপেক্ষ ছিলেন। একথাটি ঠিক কি না?

উত্তর : তাদের কী বিরোধ ছিল? বিরোধের দুটি স্তর। একটি তো হল যখন এক পক্ষ আরেক পক্ষের মুখোমুখি হয়ে গেছে-তখনকার বিরোধ। আরেকটি হল- খেলাফতের মাসআলা নিয়ে বিরোধ। কোন বিরোধের সময় হযরত আবু হুরাইরা রা. নিরপেক্ষ ছিলেন? বিরোধ বলতে হযরত আলী রা. ও হযরত মুআবিয়া রা. যখন মুখোমুখি হয়েছেন; সে বিরোধে হযরত আবু হুরাইরা রা. নিরপেক্ষ ছিলেন। উভয় দল যখন মুখোমুখি হয়েছে, তখন কিছু কিছু সাহাবী অংশ নেননি। অনেকে ধারণা করেছেন যে, এখানে অংশগ্রহণ করা ঠিক হবে না। সেই হিসেবে তারা অংশগ্রহণ করেননি।

বর্তমান দ্বন্দ্বকে হযরত আলী রা. ও হযরত মুআবিয়া রা.-এর ঘটনার সাথে মিলানো একেবারে অন্যায়। এ চিন্তাটাই ঠিক না। আজকের এতাআতী ভাইয়েরা নিজেদেরকে হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর জামাতের সঙ্গে তুলনা করারও অধিকার রাখে না। এমন করলে অনেক বড় বে-আদবী হয়। কোথায় ‘খাতায়ে ইজতিহাদী’ আর কোথায় বাতিলের অন্যায় পক্ষপাতিত্ব। কিন্তু মৌলিক যে বিষয়টি বোঝা দরকার সেটা হল- আমরা যদি এখানে কোনো সাহাবীর ঘটনা উদ্ধৃত করতে চাই তাহলে দেখাতে হবে- এক ব্যক্তি গলত রাস্তায় চলে গেছে আর অন্য সাহাবী বলেছেন যে, সে গলত রাস্তায় চলে গেলেও তার খান্দান যেহেতু ভালো, সেজন্য তার গলতকে গলত বলা যাবে না। তার এতাআত করতে হবে। এরকম কথা কোনো সাহাবী বলেছেন? কখনো বলেননি। 

***

*তারা যে দশ জন দশ জন বসতে চাচ্ছেন এ বিষয়ে আপনার কী মশওয়ারা?

** যদি শুধু বসার জন্য বসা হয়, বিশেষ কোনো নিয়ত না থাকে তাহলে সময় নষ্ট করব কেন? আর যদি আসলেই বোঝা যায় যে, তারা হার-জিতের বসা বসবে না; বরং উদ্দেশ্য হবে সহীহ রাস্তা কী তা বোঝার জন্য একে অপরের সঙ্গে মুযাকারা করা এবং সহীহ রাস্তায় পৌঁছার চেষ্টা করা। যদি এই উদ্দেশ্য হয় তাহলে ইনশাআল্লাহ বসার চেষ্টা করব। তবে অন্যায় কোনো শর্ত গ্রহণ করব না।

আর মূল বসার আগে আরেকটা বসা আছে। কোথায় বসা হবে এবং আলোচনা কীভাবে হবে- এগুলো ঠিক করতে হবে তো। তাদের দশ জন কারা হবেন আমাদের দশ জন কারা হবেন, কোথায় বসা হবে, কোন তারিখে বসা হবে, আলোচনার আদব ও নিয়মকানুন কী হবে- এইসব নির্ধারণ করে তারপর বসতে হবে। তাই বলেছি মূল বসার আগে আরেকটা বসা আছে।

* আসলে দশ জন দশ জনের শর্তারোপের উদ্দেশ্য হল, এই পক্ষে যে কয়জন থাকবে ঐ পক্ষে ঠিক ঐ সংখ্যক লোক থাকবে। আর মজলিসের মধ্যে কোনো মাদরাসার ছাত্র থাকতে পারবে না। কারণ তাদের আশঙ্কা, মাদরাসার ছাত্ররা থাকলে কখন কী করে, আক্রমণ করে বসে কি না!

** আক্রমণ ছাত্ররা করে না। আক্রমণ তো তারা করেছেন!

* এটা তাদের চিন্তাগত বিষয়। যাইহোক তাদের দাবি হল, মাদরাসার কোনো ছাত্র থাকতে পারবে না। আর যে ভাই আসবেন তার সঙ্গে একজন প্রফেসর তিন জন এতাআতী আলেম আসবেন। তারা যে কয়জন থাকবেন আমাদের পক্ষ থেকে সেই কয়জন থাকতে হবে এবং নিউট্রাল কোনো ভ্যানু অর্থাৎ না আপনার এখানে না তাদের ওখানে, নিউট্রাল কোনো একটা স্থানে তারা মিলিত হতে চায়।

** সেই জায়গাটা ঠিক করবে কে? সেটার জন্যও তো মশওয়ারা দরকার। এজন্য মূল বসার আগে একবার বসতে হবে।

* তাদের আরো কিছু দাবি আছে। ক. পুরো মজলিস তারা ভিডিও রেকর্ড করতে চায়। খ. এই পক্ষ ভুল প্রমাণিত হলে তাওবা করে ঐ পক্ষে ফিরে যাবে।

** আর ঐ পক্ষ ভুল প্রমাণিত হলে কী হবে সেটা বলেনি?! আচ্ছা ভুল প্রমাণিত হলে তাওবা করবে না কেন! কিন্তু ভুল প্রমাণিত হল কি হল না এর ফায়সালা কীভাবে হবে? তারা তিন জন এরা তিন জন। তারাও বলে যাচ্ছে, এরাও বলে যাচ্ছে। হঠাৎ করে কেউ বলে ওঠবে, এই যে আপনাদের কথা ভুল প্রমাণিত হল; তাই আপনারা তাওবা করেন। কেউ এমন বলে বসলেই হবে? সুতরাং ভুল প্রমাণিত হল কি হল না তা নির্ধারণের শরয়ী নীতি আলোচনা করে নিতে হবে। ঐ  নীতির প্রয়োগ কীভাবে হবে সেটাও আলোচনা করে নিতে হবে। এজন্য আমি বলছি, মূল বসার আগে একবার বসতে হবে।

তবে মনে রাখবেন, গোমরাহীর বিষয়গুলোতে তো তাদের ভুলই প্রমাণিত হবে, যারা গোমরাহীকে গোমরাহী বলছে না। এখানে মূল আলোচ্য তো ইজতিহাদী কোনো মতামত নয় যে, এতে যে কোনো পক্ষেরই ভুল প্রমাণিত হওয়া বাস্তবেই সম্ভব। তারপরও সঠিক পদ্ধতিতে হলে বসতে কোনো সমস্যা নেই। আরেকজনকে ভুল প্রমাণ করতে এসে যদি নিজের কাছে নিজের ভুলটাই স্পষ্ট হয়ে যায় তাহলে তো ভালোই হবে ইনশাআল্লাহ।

سبحانك اللهم وبحمدك أشهد أن لا إله إلا أنت أستغفرك وأتوب إليك.

 

(প্রশ্নোত্তরের দ্বিতীয় কিস্তি আগামী সংখ্যায় পড়ুন ইনশাআল্লাহু তাআলা)

 

 

advertisement