রবিউল আউয়াল ১৪৪০   ||   ডিসেম্বর ২০১৮

‘ইসলামী রাজনীতি করতে হলে জনগণের কাছে পৌঁছতে হবে’

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

[বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সব মহলেই বিরাজ করছে নির্বাচনী আবহ। ইসলামী দলগুলোতেও দেখা যাচ্ছে নানামুখী রাজনৈতিক তৎপরতা। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরও এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা বেড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে মাসিক আলকাউসারের তরফ থেকে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর মুদীর ও আলকাউসারের সম্পাদক হযরত মাওলানা মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ছাহেব এবং মারকাযের আমীনুত তা‘লীম ও আলকাউসারের তত্ত্বাবধায়ক হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেবের সাথে একটি কথোপকথনের আয়োজন করা হয়েছিল। তাঁরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন। তাঁদের মূল্যবান আলোচনা আলকাউসারের পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করতে পেরে আমরা আল্লাহ তাআলার শোকরগোযারি করছি। আল্লাহ তাআলা একে সবার জন্য সঠিক চিন্তা ও কর্মের পাথেয় বানিয়ে দিন। মুসাজ্জিলা থেকে আলোচনাটি পত্রস্থ করেছেন মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম সরসপুরী। -সহ সম্পাদক]

 

ম সামনে নির্বাচন আসছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে। ইসলামী দলগুলোকে দেখা যাচ্ছে জোটবদ্ধ হতে...

হ এভাবে জোটে যাওয়ার কী অর্থ? কেউ কেউ কোনো জোটে না গিয়ে সরাসরি করছে। আজ থেকে প্রায় দেড় দশক আগে যখন একজন আলেম বিএনপি থেকে ধানের শীষে দাঁড়িয়ে নির্বাচন করেছিলেন তখনই আমার খারাপ লেগেছিল। তাঁর মত মানুষ সরাসরি ধানের শীষ থেকে কীভাবে দাঁড়ালেন? হয়তো তাঁর কোনো ওযর থেকে থাকবে। এতে তো ঐ দলের নীতি-আদর্শগুলোকে একপ্রকার মেনে নেওয়া হয়। এখনও কেউ আওয়ামী লীগ/বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে প্রার্থী হতে চাচ্ছেন। আর কেউ জোটবদ্ধ হচ্ছেন। যারা জোটবদ্ধ হচ্ছেন তারা কিসের ওপর জোটবদ্ধ হচ্ছেন; সেটা তো জাতি জানতে পারছে না। যে জোটের শরীক তারা হচ্ছেন ঐ জোট কি কোনো কমিটমেন্ট দিয়েছে যে, ধর্মীয় কিছু তারা করবে? সংবিধান থেকে ইসলামের খেলাফ জিনিসগুলো সরাবে? সেটা তো জাতিকে জানানো হচ্ছে না। তাহলে এ জোটের কী অর্থ?

দ্বিতীয় কথা হল, নির্বাচনের সময়ে জোট করে দু-এক জায়গায় দাঁড়ানো, কয়েকটা আসনে নির্বাচিত হয়ে যাওয়া- এটাতে কোনো ফায়দা আছে কি?

হ এ দেশের চিন্তাধারা হল ইলেকশনে দাঁড়ানোটাই সিয়াসাত।

ম আগেও তো এরকম জোট হয়েছিল। যেমন ২০০১-এর নির্বাচনের আগে...

হ ২০০১-এর নির্বাচনের পূর্বে যে জোটটা হয়েছিল, সেখানে রাজনীতি করেন না, এমন অনেক আলেমও নীরব থেকেছেন। একটা মৌন সমর্থন ছিল জোটের ব্যাপারে। তার পেছনে কারণও ছিল। ৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আলেম-ওলামার সাথে যে বৈরী আচরণ করা হয়েছিল, দেশের বড় বড় আলেমদেরকে জেলে ঢোকানো হয়েছিল, মাদরাসার কুরবানীর ছুরিগুলোকে অস্ত্র হিসেবে প্রচার করা হয়েছিল। সেই পরিস্থিতিতে তখন আলেম-উলামারা চার দলীয় জোটভুক্ত হয়েছিলেন। সেটা একটা তাৎক্ষণিক ব্যাপার ছিল। তার একটা ফলাফলও দেখা গেছে।

নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা চার দলীয় জোট পেয়ে গিয়েছিল। বলা যায় এটার মূল কারণই ছিল ধর্মীয় লোকদের সাথে পূর্বের ক্ষমতাসীনদের বৈরী আচরণ। কাজেই ওই সময় জোট হয়েছিল বিশেষ প্রেক্ষাপটে। কিন্তু এখন কী এমন জরুরত দেখা দিয়েছে যে, জোটবদ্ধ হতে হবে?

ম অর্থাৎ রাজনৈতিক তৎপরতার ক্ষেত্রে একটা প্রয়োজন বা আদর্শ থাকতে হবে...।

হ ইসলামী রাজনীতি কি আদর্শ ছাড়া হয়? ইসলামী রাজনীতি বলতে খুব সহজ-সরলভাবেই মানুষ যেটা বোঝে তা হচ্ছে, তাঁরা দেশে কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক সরকার কায়েম করতে চান। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক সরকার কায়েমের কোন্ রাস্তাটা উদ্ধার হচ্ছে এভাবে জোটের মধ্যে গিয়ে? আর এভাবে  নমিনেশন চাওয়াতে মান-ইজ্জত কিছু কি থাকছে? বলা হচ্ছে যে, আমরা পঞ্চাশ আসনে তৈরি আছি, চল্লিশ আসনে তৈরি আছি। এরপর দুটো-তিনটা আসন পাচ্ছে। এভাবে উদ্দেশ্যহীন চলার আখের ফায়দাটা কী?

نہیں معلوم منزل ہے کدھر کس سمت جاتے ہیں

مچا ہے قافلے ميں شور ہم بهى غل مچاتے ہیں

হ সে প্রশ্নে না-ই গেলাম যে, আদৌ পশ্চিমা রাজনীতির আদলে ইসলাম কায়েম করা সম্ভব কি না।

ম এই উপমহাদেশে তো আলেমদেরও রাজনীতির একটা ধারা ছিল। দেওবন্দের বড় বড় আলেম হযরত মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী রাহ., হযরত মাওলানা শাব্বীর আহমদ উছমানী রাহ. প্রমুখ ব্যক্তিত্বগণও রাজনীতির ময়দানে ছিলেন। তারা কিসের ভিত্তিতে করেছেন, কী লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে করেছেন?

হ আগেও আলেম-ওলামার মধ্যে মতানৈক্য ছিল যে, আলেমদের প্রচলিত ধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা উচিত কি না। তাদের মধ্যে এমন অনেকে ছিলেন, যারা হয়ত কিছুদিন রাজনীতিতে ছিলেন, পরে সরে গেছেন। যেমন মুফতী শফী রাহ.। তিনি একসময় শাব্বির আহমদ উসমানী রাহ.-এর সাথে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামে ছিলেন। পরে ঐ ময়দান থেকে সরে এসেছেন। মনে করেছেন যে, তালীম, দাওয়াত ও এসলাহের অঙ্গনেই কাজ করতে হবে। এরকম মাওলানা যফর আহমদ উসমানী ছাহেব রাহ.-ও ছিলেন। পরে সরে এসেছেন। তো এগুলো আগে থেকেই ছিল। কিন্তু যেটা বলতে চাচ্ছি, সেটা হল আপনি প্রেক্ষাপট এক পাবেন না। প্রেক্ষাপটটা যথেষ্ট পরিমাণে ভিন্ন।

আর বৃটিশ আমলে এ দেশে রাজনীতির অর্থ ছিল ভিন্ন কিছু। সেটা ছিল আসলে স্বাধীনতা আন্দোলন। আগ্রাসন থেকে মুক্তি। রাজনীতির মূলকথাটা সেখানে ওটাই ছিল। সেখানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেয়েও বড় কথা ছিল আগ্রাসন থেকে মুক্তি। যারা রাজনীতি করেছেন, তারা আগ্রাসন থেকে মুক্তি চেয়েছেন। কারণ তাঁরা মনে করেছেন, আগ্রাসন থেকে মুক্ত হওয়া গেলে অন্তত আমরা স্বাধীনভাবে আমাদের দ্বীন চর্চা করতে পারব। এরপর বৃটিশ বেনিয়াদের এই ভূখ- ছেড়ে যাওয়ার সময় সবারই জানা আছে যে, দুটো মত হয়েছে। অখ- ভারত এবং মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র। বিভিন্ন গণভোট ও নানাকিছুর পর ভারত বিভক্ত হল। সবারই বাস্তবতা জানা আছে। মুসলমানদের জন্য ভিন্ন রাষ্ট্র হল। আমাদের এই ভূখ- যেটা আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ, এখানকার লোকেরাও তখন তাদের পরিচিতি অর্থাৎ মুসলিম হওয়ার সম্মান ও মর্যাদাটাকে বড় করে দেখেছে। এজন্যই তারা আরেকটা ভূখ- যেটা ১৫শ মাইল দূরে, সেটার সাথেই একত্র হয়েছেন।

আমাদের এখানের বড় বড় রাজনীতিক নেতারা তখন যদিও ইসলামী রাজনীতি করতেন না, কিন্তু মুসলমান ছিলেন বিধায় পাকিস্তানের সাথেই যোগ দিয়েছিলেন। এমনকি আমাদের দেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মজিবুর রহমান সাহেবও তখন ছাত্রনেতা হিসেবে সে আন্দোলনের সাথে ছিলেন (যদিও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারপ্রধান হওয়ার পর তাঁর দল আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কারণে মুসলমানদের বিরাগভাজন হয়েছিল)। এই ভূখ-ের অধিবাসীরা যে ঐতিহাসিকভাবেই ধর্মপ্রাণ, এটাও কিন্তু তার একটা প্রমাণ।

তো, পাকিস্তান হওয়ার পরে, পাকিস্তান যেহেতু হয়েছেই ইসলামের নামে, এজন্য স্বাভাবিক কারণে আলেম-ওলামাদের সেখানে ভূমিকা রাখাটা প্রয়োজনীয় ছিল। একটা রাষ্ট্র ইসলামের নামে হয়েছে, যদি ইসলাম অনুযায়ী সে রাষ্ট্রটা চালাতে হয়, সেটা তো আলেমদের রাহনুমায়ী ছাড়া সম্ভব না। কিন্তু আমরা দুঃখজনকভাবে দেখেছি যে, পাকিস্তান হওয়ার পর এর নেতৃত্বে তারাই এসেছে, যারা ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত নয়। এ কারণে এবং আরো বিভিন্ন কারণে তখন বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। কেউ কেউ বাঁকা প্রশ্নও করতে চেয়েছে যে, আলেম-ওলামা এত দলে ভাগ, মুসলমানরা এত মতে বিভক্ত, তাহলে কীভাবে তারা ইসলাম কায়েম করবে? কোন্ ইসলাম কায়েম করবে? সেটার সমুচিত জবাব তখনকার আলেমরা দিতে পেরেছেন। এজন্য এটা মনে রাখা উচিত যে, এখন আমরা ইসলামী রাজনীতি নামে যে রাজনীতি করি আর তখনকার আলেমরা যে ইসলামী রাজনীতি করেছেন দুটোর মাঝে আকাশ-পাতাল ফরক।

ম ঐ সময়ের আলেমদের রাজনীতির ধারা ও সুফল সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।

হ যেমন ধরুন, মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী রাহ.। তিনি মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.-কে নিয়ে ‘কারারদাদে মাকাসিদ’ তৈরি করেছেন। যা পাকিস্তানের সংবিধানের ভূমিকা; বরং পরবর্তীতে একে মূল সংবিধানের অংশ ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর তাঁদের স্থলাভিষিক্তরা পাকিস্তানের বিভিন্ন শ্রেণি ও মতের লোকদেরকে এক করেছেন। আজকে যেটা আমরা কখনো আমাদের বড় বড় ইসলামী মুভমেন্টগুলোতে করতে পারি না, তারা সেটা করেছেন। বেরলভী, সালাফীসহ যতগুলো গোষ্ঠী ছিল সবাইকে নিয়ে একত্রে বসেছেন এবং ‘বাইস নেকাতী প্রোগ্রাম’ বিন্যস্ত করেছেন। ইসলাম বিদ্বেষীরা বলেছিল-

کونسا اسلام قائم کروگے

কোন্ ইসলাম কায়েম করবেন?

ওনারা বলেছেন-

یہ اسلام قائم کرینگے.

এই যে, এই ইসলাম কায়েম করব।

এতে কোনো ইখতেলাফ নেই। এখানে সকল গোষ্ঠী, সকল ফিরকা, সকল দল-উপদল একমত।

তাহলে দেখতেই পাচ্ছেন, তাঁদের রাজনীতি আর আমাদের রাজনীতির মাঝে ফরকটা কত? তারা কত বড় অবদান রাখতে পেরেছেন। সেটার ফল এখনো ভোগ করছে পাকিস্তানের লোকেরা। ‘করারদাদে মাকাসিদ’ শিরোনামে পাকিস্তানের সংবিধানের প্রস্তাবনাতে সে নেকাতগুলো এখনো লেখা আছে। সেক্যুলার লোকেরা সেটা এখনো বাতিল করতে পারেনি।

এরপরে আসুন, যখন একসময় কাদিয়ানীদের প্রশ্ন এল, তারা যখন  মানুষের ঈমান ধ্বংস করা শুরু করল, তখন যারা রাজনীতি করতেন তারাই ভূমিকা রেখেছেন। মুফতী মাহমুদ ছাহেবের নেতৃত্বে তখন বড় কাজ হয়েছে। তিনি সংসদে ছিলেন। বাইরে ছিলেন হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ বিন্নুরী রাহ.-সহ অন্যান্য উলামা-মাশাইখ। ক্ষমতাসীন পিপলস পার্টি ছাড়া পুরো পাকিস্তানের সকল দলকে তারা এক মঞ্চে নিয়ে এসেছেন। যে দলগুলোর মধ্যে ন্যাপের মত দলের লোকেরাও ছিল। বামপন্থীরাও ছিল। তাদেরকে এক মঞ্চে এনেছেন। সবাইকে পার্লামেন্টে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে উৎসাহিত করেছেন। সবাই একসাথে বলেছে যে, হাঁ, কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষিত করা  হোক। কিন্তু আজকে আমাদের দেশে দেখবেন যে, ঐসমস্ত বাম দলগুলোর থেকেই যারা শাখা হয়ে এসেছে, তারা কাদিয়ানীদের ধর্মীয় সভাগুলোতে গিয়ে গিয়ে লেকচার দেয়। এটা সেটা বলে। তারা তাদের পূর্বসূরিদের ইতিহাস দেখে না। তাদের পূর্বসূরিরা কাদিয়ানী বিরোধী মঞ্চে যোগ দিয়েছিল।

তাহলে এক মুফতী মাহমুদ ছাহেব, তার দলে সংসদসদস্য সংখ্যা তখনো অনেক বেশি ছিল না, অথচ তিনি এক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা রেখেছেন। এজন্য যদি ইসলামী রাজনীতি করতেই হয়, তাহলে তো আপনার কোনো একটা অবস্থান থাকতে হবে। একটা আদর্শ-উদ্দেশ্য থাকতে হবে। একটা ভূমিকা থাকতে হবে।

ম এখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যারা ইসলামী রাজনীতি করছেন, তাদের মৌলিকভাবে কী কী উদ্দেশ্য সামনে রাখা উচিত? তাদের অবস্থানের মধ্যে মৌলিক কী কী বিষয় থাকা উচিত বলে মনে করেন।

হ যদি রাজনীতি করতেই হয়, তো সহজ কথাটা হল রাজনীতিটা নির্বাচনমুখী নয়। বরং গণমুখী হতে হবে। শুধু নির্বাচনের সময়ই আপনি তাজা হয়ে গেলেন এবং কারো কাছে আসন চাইলেন, এভাবে আসন চাওয়ার মত কোনো কাজ নয় রাজনীতি। এটা চাইলে এমন লোকেরা চাইতে পারে, যাদের কোনো জাতীয় ভিত্তি নেই। যারা জনগণের কাছে গেলে ভোট পাবে না। তারা গিয়ে বিএনপিকে বলতে পারে, আওয়ামী লীগকে বলতে পারে যে, আপনাদের সাথে আমাদেরকে গ্রহণ করুন। তারা অন্যের কাঁধে সাওয়ার হয়ে পাশ করতে পারে।  যেমন বিগত দুটি নির্বাচনে কোনো কোনো বামদল করেছে, তাদের নেতারা মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন। এমনিভাবে এবারো দুদিকের জোটেই নতুন নতুন লোকেরা যোগ দিচ্ছেন। সম্ভবত শুধু এমপি হওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু এদেশের জনগণ যেখানে ধর্মপ্রাণ, ইসলামী রাজনীতি কেউ করতে হলে তাকে জনগণের কাছে পৌঁছতে হবে। জনগণের কাছে যখন সে যাবে, তাদের কাছাকাছি হবে এবং সে প্রেক্ষাপটটা তৈরি করতে পারবে, তখন তো কারো ওপর সওয়ার হতে হবে না। উল্টো তার সাথে অন্যরা জোট করতে চাইবে। তো ইসলামী রাজনীতি যদি করতে হয়, ইসলামকে তাবে‘ বা অধীন বানানো যাবে না। ইসলামী রাজনীতি করতে গিয়ে কেউ যদি ইসলামকে তাবে‘ বানিয়ে ফেলে তাহলে এটার হক আদায় করতে পারছে বলা যায় না।

ইসলামী দল আরেকজনের সঙ্গে জোটে যাবে, তার তাবে‘ হবে এবং সে জোটটা হবে উদ্দেশ্যহীন, সেখানে কোনো কমিটমেন্ট থাকবে না যে, জোটের সাথে ক্ষমতায় গেলে সামনে ইসলামের এই এই খেদমত করবে, এমন উদ্দেশ্যহীন জোট যদি হয়, তাহলে খুব স্বাভাবিক কারণেই মানুষ- (বিরোধীরা হোক, আর আপন লোকেরা হোক)- সন্দেহে পড়ে যাবে যে, এটা কি আসলে ইসলামের জন্য হচ্ছে, না শুধু এমপি হওয়ার জন্য হচ্ছে? এটা কি ইসলামের জন্য হচ্ছে, নাকি নিজের পরিচিতি বাড়াবার জন্য হচ্ছে। সে রাজনীতি নিয়ে এ ধরনের আরো বহু প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়া স্বাভাবিক।

তো প্রথম কথা হল, রাজনীতি যদি করতেই হয়, তাহলে আদর্শ-উদ্দেশ্য স্পষ্ট করতে হবে। একথা স্পষ্টভাবে বলতে হবে যে, প্রচলিত গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামো এবং আরো অনেক কিছুই শরীয়া পরিপন্থী। আমরা এজন্য রাজনীতি করছি, যাতে সংবিধান থেকে গলত জিনিসগুলো সরিয়ে এটাকে ইসলামী পদ্ধতিতে ঢেলে সাজানো যায়। এ কমিটমেন্ট থাকতে হবে।

আর দ্বিতীয় কথা হল, জনগণের কাছে গিয়ে জনগণকে সাথে নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। এরপর যখন দেখা যাবে যে, হাঁ, একটা দল হয়েছে এবং সে দলের প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে, কোনো জায়গা থেকে এখন একক নির্বাচন করার মত অবস্থান হয়েছে তাহলে একটা কিছু হল। কিন্তু আমরা দেখছি, কেউ জোটবদ্ধ হচ্ছে, আকছার তো জোটবদ্ধ হয়েই গেছে। আর যারা জোটবদ্ধ হয়নি, তাদের মধ্যে একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যে, কেউ হয়ত ৩০০ আসনেই প্রার্থী দিয়ে দেয়। তিনশ আসনে প্রার্থী দেওয়ার পর দেখা যায়, হয়ত এক-দুই জায়গা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে জামানতই বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। এটা মানুষের কাছে একটা হাস্যকর বিষয় হয়ে দাঁড়ায় যে, শুধু প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এটা এমনই কথা যে, শুধু প্রতিযোগিতার জন্য খেলায় অংশগ্রহণ করা। জেতাটা উদ্দেশ্য নয়। এটা অন্য দল করতে পারে। কিন্তু কোনো ইসলামী দল যখন এরকম করে তখন মানুষের কাছে একটা ভুল বার্তা যায় যে, মনে হয় এদেশের মানুষ ইসলাম পছন্দ করে না। অথচ আসল কথা এটা নয়, আসল কথা হল, এদেশের লোকেরা এ দলগুলোর উপর আস্থা রাখতে পারছে না; এরা যে ইসলাম কায়েম করতে পারবে, রাষ্ট্র চালাতে পারবে- সেই আস্থা মানুষের নেই। না হয় আমরা তো দেখি, বিদেশীরাও এসে এখানে জরিপ করে যায় যে, জনগণ বলে, ইসলামী আইনটা ভালো। ইসলামী শাসন হলে ভালো হয়। জনগণ তো দেখা যায় ইসলামের পক্ষেই আছে এবং এটা একাধিকবার প্রমাণিতও হয়েছে যে, জনগণ ইসলামের পক্ষেই সাড়া দিয়েছে। কিন্তু ভোটের সময় ইসলামী দলগুলো ভোট পায় না কেন? এর কারণ হচ্ছে, আমরা যথাযথভাবে জনগণের কাছে যেতে পারিনি। তাদের কাছে নিজেদের আদর্শ-উদ্দেশ্য এবং অবস্থান পরিষ্কার করতে পারিনি। আর আমাদের অনাকাক্সিক্ষত বিভক্তি তো আছেই।

এই কথাগুলো আমি অনেক আগে থেকেই বলি। যখন জামেয়া মুহাম্মাদিয়ায় ছিলাম, তখন অনেকেই আন্দোলন করার জন্য, মিটিং মিছিল করার জন্য ছাত্র নিতে আসত। আমি তখন চেপে ধরতাম যে, আমরা তো আপনাদের সমর্থক আছিই। এ ছেলেগুলো তো আপনাদের ভোটার আছেই, আপনারা এদেরকে নিয়ে মিটিং করলে কী লাভ হবে? কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে যান। সাধারণ লোকদের কাছে যান। আমাদেরকে টেনে নিয়ে লাভ কী?

হ এটা কেমন ব্যর্থতা? শুধু মাদরাসার ছাত্রদের প্রতিই সবার নজর এবং তারা মাদরাসার ছাত্র-নির্ভর। অথচ ছাত্রদের জন্য সক্রিয় রাজনীতি তো একধরনের প্রাণঘাতী বিষ।

হ আরেকটি বিষয়, যা অনেক আগেই আমরা বলেছি যে, নিজেদের কর্মীদেরকে প্রশিক্ষিত করা দরকার। আগে নিজে ইসলামী সরকার, ইসলামী রাষ্ট্র, নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য এগুলো সম্পর্কে জানতে হবে। এগুলো সবার আগে দরকার। এগুলো না হলে তো মানুষের আস্থা হবে না। আর ওটা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না যে, একজন সাধারণ রাজনীতিক দলের নেতার মধ্যে হুব্বে মাল, হুব্বে জাহ সংক্রান্ত বিষয়ে মানুষ যে ছাড় দেয়, ইসলামী রাজনীতির কোনো ব্যক্তির ব্যাপারে মানুষ কখনো এভাবে ছাড় দিবে না। কারণ তারা এটাকে আদর্শিক মনে করে। ওটাকে আদর্শিক মনে করে না। কাজেই এইসকল বৈশিষ্ট্য যদি না হয়, মানুষকে কখনোই আপনি আপনার পক্ষে নিয়ে আসতে সক্ষম হবেন না। এবং আপনাকে যদি সে ভোট না দেয়, আপনি কখনোই এটা বলতে পারেন না যে, সে ইসলামের পক্ষে না। আসল কথা হল, আপনি যে ইসলাম কায়েম করবেন, এটাতে তার আস্থা নেই।

ম এক্ষেত্রে মাদরাসার ছাত্রদের করণীয় কী? মাদরাসাগুলোতেও তো বিভিন্ন রাজনীতিক দলের কর্ম-তৎপরতা পরিচালিত হয়, এ অবস্থায় মাদরাসার ছাত্ররা কি ওসবের সাথে জড়িত হয়ে যাবে?

হ বিলকুল হবে না। তারা তাদের ইলমী ইনহেমাক বাকি রাখবে। দেওবন্দের উস্তাযদের কাছে আমি সুওয়াল পাঠিয়েছি, হযরত মাদানী রাহ.-সহ আমাদের আকাবিররা কি ছাত্র রাজনীতির কায়েল ছিলেন? এ বিষয়ে বক্তব্য দরকার।

তাঁরা বলেছেন যে, এটা তো তখন চিন্তাতেও ছিল না। আপনি বক্তব্য পাবেন কোত্থেকে? এটার বিপক্ষে বলার প্রশ্ন তো তখনই আসে, যখন এটার ইমকান বা কোনো তাসাওউর থাকে। কিন্তু তখন তো এটার কোন তাসাওউরই ছিল না যে, তালিবে ইলমরা আমলী সিয়াসাত তথা সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হবে। কাজেই এটা আমাদের আকাবিরের উসূলের খেলাফ।

হ আমাদের দেশেও এর নজির আছে। আমরা যখন লালবাগে পড়ি। আমাদের মেশকাতের বছর দেশে তখন এরশাদের সামরিক শাসন। এজন্য যদিও মূলত রাজনীতিক সভা ছিল, কিন্তু নাম দেওয়া হয়েছিল বিরাট ওয়াজ ও দুআর মাহফিল। কারণ সামরিক আমলে রাজনীতিক সভা চলে না। কামরাঙ্গির চরে তিন দিনব্যাপী আলেমদের সম্মেলন ছিল। খেলাফত আন্দোলন সবেমাত্র গঠিত হয়েছে। এ দলের বড় ব্যক্তি শাইখুল হাদীস ছাহেব। উনি আমাদের দরসে এসে বললেন, তোমরা কি গতকাল ওখানে গিয়েছ? খুব রাগত স্বরে। কেন গিয়েছ? তো ছেলেরা যে সেখানে যোগ দিয়েছে, কামরাঙ্গিরচরের সভায় গিয়েছে, সেটাও দরসের সময় ছিল না, গিয়েছে বিকেলে বা সন্ধ্যায়, সেটাতেই হুজুর খুব নারাজি প্রকাশ করেছেন। অথচ তিনিই দলের নায়েবে আমীর ছিলেন। হাফেজ্জী হুযুরের পরেই উনি দলের প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। এটা একটা দলিল যে, তারা নিজেরা রাজনীতি করেছেন, কিন্তু ছাত্রদেরকে রাজনীতিতে নামিয়ে দিতে চাননি এবং কোনো দরস বন্ধ করেননি। নিজেরা রাজনীতিক কোনো প্রোগ্রামে যেতে হলে দরস পুরো করে বিকেলে যেতেন।

হ এ দুটো মেছাল খুবই আহাম। ছাত্ররা ইলমী ইনহেমাকে থাকবে। তাদের মা-বাবাও তাদেরকে এ কাজের জন্য মাদরাসায় দেয়নি। দিয়েছে ইলম অর্জনের জন্য।

হ মুফতী আমিনী ছাহেবেরও একটা মেছাল আছে। তখন তিনি লালবাগের উস্তায ছিলেন। যেহেতু বড় বড় হুজুররা তখনো হায়াতে ছিলেন, এজন্য আমিনী ছাহেব বড় ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও তখন মাঝারি পর্যায়ের উস্তায ছিলেন। কিন্তু তিনি খুব প্রভাবশালী ছিলেন লালবাগে। কোনো ছাত্রের ব্যাপারে যদি তিনি জানতেন যে, সে কোনো ধরনের দলীয় কার্যক্রমের সাথে জড়িত, তো প্রিন্সিপাল পর্যন্ত সেটা যাওয়া লাগত না। আমিনী ছাহেবের এ পাওয়ার ছিল যে, তিনি নিজেই তাকে বহিষ্কার করে দিতেন এবং কঠোর কঠোর কথা বলতেন। আমাদের সময়ও এরকম ঘটনা ঘটেছে। বলতেন যে, ‘আমার বুঝে আসে না, একজন তালিবে ইলম কীভাবে ‘বিপ্লবী’ হতে পারে।’

ম মাসিক আলকাউসার একটা ইসলামী পত্রিকা। সাধ্যমত মুসলমানদের দ্বীনী রাহনুমায়ী করার চেষ্টা করে। তো যারা সামনে নির্বাচন করছেন এবং তাদের কোনো না কোনো দল বা জোট ক্ষমতায় আসবে, তাদের কাছে আলকাউসার আপনাদের পয়গাম পৌঁছে দিতে চায়।...

হ এ দেশে যারাই ক্ষমতায় আসতে চাইবে, যত তাড়াতাড়ি তারা নিজেরা গণমুখী হবে, জনগণের মনের কথা বুঝবে, ততই তারা ভালো করবে। এটা দেশের জন্য মঙ্গল হবে। দশের জন্যও মঙ্গল হবে। 

এ দেশের জনগণের মনের ভাষা হল, তারা ইসলামপন্থী ও ইসলামপ্রিয়।  যে কোনো জরিপের মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হবে। পেছনেও প্রমাণিত হয়েছে। আমরা নগদ দেখতে পাচ্ছি যে, যারা আগে থেকেই ধর্মের কথা অত বলতেন না, নিজেদের মেনিফেস্টোর মধ্যে বা রাষ্ট্রীয় মেনিফেস্টোর মধ্যে যারা ধর্মনিরপেক্ষতা রেখেছেন তারাও কিন্তু এখন ধর্মের কথা বলেন। তারা বলছেন যে, আমরা ধর্মের পক্ষে। এটা ইতিবাচক। হাঁ, তবে এটা শুধু মুখে না বলে মনেপ্রাণে বলা দরকার। বাস্তবিক অর্থে দেখানো দরকার এবং আমরা মনে করি, আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় দলেরই এ কমিটমেন্টগুলো করা দরকার যে, আমরা সামনে ক্ষমতায় গেলে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেব। শুধু একথা বলা যথেষ্ট নয় যে, আমরা কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন করব না; বরং তাদের নির্বাচনী ইশতিহারে একথা থাকা দরকার যে, ধর্মনিরপেক্ষতাসহ সংবিধানে আরো যা যা কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন আছে, সবগুলোকে বাদ দিয়ে দেব এবং ক্রমান্বয়ে দেশের আইন-আদালত ইসলামী ধাঁচে সাজাবো। এমনটি না করা হলে কেবলমাত্র নিজেদেরকে ইসলামপন্থী দাবি করলে অথবা ইসলাম বিরোধী নয় বলে ঘোষণা দিলে এবং বিভিন্ন ইসলামী নামধারী দলের সাথে জোটবদ্ধ হলেই ধর্মপ্রাণ মানুষের আস্থা অর্জন করা যাবে বলে মনে হয় না।

 

 

advertisement