সফর ১৪৪০   ||   নভেম্বর ২০১৮

বার্ধক্য : প্রবীণ দিবস

আবদুল্লাহ মুযাক্কির

১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। অন্য অনেক দিবসের মতো এ দিবসটিও নানা বাণী ও অনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হয়ে থাকে। প্রতিটি দিবসের থাকে একেকটি প্রতিপাদ্য। এবারের প্রতিপাদ্য- পবষবনৎধঃরহম ড়ষফবৎ যঁসধহ ৎরমযঃং পযধসঢ়রড়হ. বাংলাতে এর কাব্যময় অনুবাদ করা হয়েছে- ‘মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায়, প্রবীণদের স্মরণ পরম শ্রদ্ধায়’। এসব শ্লোগান ও আনুষ্ঠানিকতা বাস্তব জীবনে কতটুকু প্রভাব রাখছে, আদৌ কোনো প্রভাব রাখছে কি না- সে আলোচনা এখন করছি না। বিষয়টি যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ তাই এ উপলক্ষে দু-একটি কথা বলাই এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

বার্ধক্য মানবজীবনের এক অনিবার্য বাস্তবতা। কুরআন মাজীদে খুবই সংক্ষেপে এর স্বরূপ সম্পর্কে বলা হয়েছে-

اَللهُ الَّذِیْ خَلَقَكُمْ مِّنْ ضُؔعْفٍ ثُمَّ جَعَلَ مِنْۢ بَعْدِ ضُؔعْفٍ قُوَّةً ثُمَّ جَعَلَ مِنْۢ بَعْدِ قُوَّةٍ ضُؔعْفًا وَّ شَیْبَةً یَخْلُقُ مَا یَشَآء وَ هُوَ الْعَلِیْمُ الْقَدِیْر.

আল্লাহ, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন দুর্বল অবস্থায়, দুর্বলতার পর তিনি দেন শক্তি, শক্তির পর আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনিই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। -সূরা রূম (৩০) : ৫৪

শৈশবেও মানুষ দুর্বল থাকে, বার্ধক্যেও দুর্বলতার দিকেই ফিরে আসে। বার্ধক্য মানেই নানাবিধ দুর্বলতা। এক বৃদ্ধ ব্যক্তি কী করুণভাবেই না দিয়েছেন বার্ধক্যের বিবরণ। ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন- “আমার অবস্থা তো হচ্ছে, যা কালো থাকা আমার পছন্দের ছিল তা সাদা হয়ে গেছে, আর যা সাদা থাকা পছন্দের ছিল তা কালো হয়ে গেছে। যা শক্ত থাকা পছন্দের ছিল তা নরম হয়ে গেছে আর যা নরম-কোমল থাকা পছন্দের ছিল তা শক্ত-খসখসে হয়ে গেছে। পথ চলতে গেলে দেখি সাথের লোকেরা আগে চলে যাচ্ছে আর পিছনের লোকেরা আমাকে ধরে ফেলছে। নতুন কথা ভুলে যাই, পুরনো কথা মনে পড়ে। লোকের মাঝে ঝিমুই আর বিছানায় গেলে ঘুম আসে না। যখন দাঁড়াতে চাই ভূমি আমাকে টেনে ধরে রাখে আর যখন বসতে চাই ভূমি যেন দূরে চলে যায়!”

এই বার্ধক্যপীড়িত মানুষের প্রতি তাই সচেতনতা ও সহানুভূতি অতি প্রয়োজন। কিন্তু তা তো শুধু বছর বছর দিবস পালন ও শ্রুতিমধুর শ্লোগান রচনার দ্বারা সৃষ্টি হবে না। এর জন্য প্রয়োজন গভীর মানবিক শিক্ষা। বর্তমান পুঁজিবাদী চেতনায় তার স্থান কোথায়?

এই মানবিক বোধ ও চেতনার জন্য আমাদের ইসলামী শিক্ষা ও আদর্শের দিকেই ফিরে যেতে হবে। ইসলাম যেহেতু রব্বানী দ্বীন এজন্য এর সকল শিক্ষা একে অপরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কুরআন-হাদীসের শিক্ষা একজন মানুষকে এই চেতনা দান করে যে, বার্ধক্য জীবনের একটি পর্ব, বেঁচে থাকলে যে পর্ব প্রত্যেকের জীবনেই আসছে। বার্ধক্যের দৃষ্টান্তগুলো তাকে বৃদ্ধের প্রতি অবহেলার নয়; বরং নিজের পরিণাম সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে কী মর্মস্পর্শী ভাষায় বলেছেন-

بَادِرُوا بِالأَعْمَالِ سَبْعًا هَلْ تُنْظَرُونَ إِلاّ إِلَى فَقْرٍ مُنْسٍ، أَوْ غِنًى مُطْغٍ، أَوْ مَرَضٍ مُفْسِدٍ، أَوْ هَرَمٍ مُفَنِّدٍ، أَوْ مَوْتٍ مُجْهِزٍ، أَوِ الدّجّالِ فَشَرّ غَائِبٍ يُنْتَظَرُ، أَوِ السّاعَةِ فَالسّاعَةُ أَدْهَى وَأَمَرّ.

সাত বিষয়ের আগেই আমল করে নাও। তোমাদের অবকাশ তো ঐ দারিদ্র্য, যা আত্মবিস্মৃত করে, কিংবা ঐ প্রাচুর্য, যা দাম্ভিক করে তোলে কিংবা ঐ রোগ-ব্যাধি পর্যন্ত, যা জরাগ্রস্ত করে কিংবা ঐ বার্ধক্য পর্যন্ত, যা বুদ্ধিহীন করে...। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩০৬

কাজেই বার্ধক্যের দুর্বলতাসমূহের দৃষ্টান্তগুলো থেকে নিজের পরিণাম স্মরণ করা এবং সেই অবস্থা আসার আগে আগে সৎকর্ম করে নেওয়ার প্রেরণা ও সংকল্পই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ।

এ তো হল নিজের দিকে তাকানো। বৃদ্ধের প্রতি একজন মুসলিমের দৃষ্টিভঙ্গি কী হয়? আগেই বলেছি, ইসলামের শিক্ষাগুলো পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ, এক শিক্ষা অপর শিক্ষার পরিপূরক। এক একটি শিক্ষা অসংখ্য শিক্ষার ধারক। ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থার সাথে বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজ-ব্যবস্থার আকাশ-পাতালের পার্থক্য।

ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থার একটি মৌলিক অনুষঙ্গ পরস্পর প্রীতি ও সৌহার্দ্য। এজন্য গোটা মুসলিম জাতিকে হাদীস শরীফে এক দেহের মতো বলা হয়েছে, যার একটি অঙ্গ রোগাক্রান্ত হলে গোটা দেহ আরাম-নিদ্রা ত্যাগ করে।

ইসলামী সমাজের আরেক বৈশিষ্ট্য পরস্পর সহযোগিতা, একে অন্যের সেবা ও প্রয়োজন পূরণে এগিয়ে আসা। যে আল্লাহর কোনো বান্দার প্রয়োজন পূরণে ব্যস্ত থাকে হাদীস শরীফের বর্ণনা অনুযায়ী স্বয়ং আল্লাহ ঐ বান্দার প্রয়োজন পূরণে মশগুল থাকেন।

ইসলামী সমাজের আরেক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বড়কে মান্য করা। অনেক হাদীসে বড়কে মান্য করার, শ্রদ্ধা ও সম্মান করার তাকীদ এসেছে। এমনকি যে বড়কে সম্মান করে না এবং ছোটকে স্নেহ করে না, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে- ‘সে আমাদের নয়’ বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারিত করেছেন।

ইসলামী সমাজের আরেক বৈশিষ্ট্য, তার পরিবার-ব্যবস্থা ও পারিবারিক আদব-আখলাক। ইসলামে মা-বাবার সেবা ও সদাচারের যে তাকীদ রয়েছে, এই সেবা ও সদাচারকে যে অনন্য মর্যাদা দেওয়া হয়েছে তা কার না জানা আছে? মা-বাবার প্রতি উদাসীন হয়ে কেউ তো ভালো ঈমানদারও হতে পারবে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَ قَضٰی رَبُّكَ اَلَّا تَعْبُدُوْۤا اِلَّاۤ اِیَّاهُ وَ بِالْوَالِدَیْنِ اِحْسَانًا  اِمَّا یَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ اَحَدُهُمَاۤ اَوْ كِلٰهُمَا فَلَا تَقُلْ لَّهُمَاۤ اُفٍّ وَّ لَا تَنْهَرْهُمَا وَ قُلْ لَّهُمَا قَوْلًا كَرِیْمًا وَ اخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَ قُلْ رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّیٰنِیْ صَغِیْرًا.

তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করতে ও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে উফ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বলো। মমতাবশে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত কর এবং বল, ‘হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া কর যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।’ -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ২৩-২৪

একজন বিখ্যাত মনীষী মুহাম্মাদ ইবনে মুনকাদির রাহ.-এর একটি ঘটনা আছে। এক রাতে তিনি রাতভর তার মায়ের পা টিপেছেন আর তার ভাই রাতভর তাহাজ্জুদ পড়েছেন। দুইজনের দুই রাতের মধ্যে তুলনা করে ইবনে মুনকাদির বলেছেন-

وما أحب أن ليلتي بليلته

‘আমার রাতের চেয়ে তার রাত আমার কাছে বেশি পছন্দের নয়।’

ইসলামে মা-বাবার সাথে সদাচারের একটি দিক এটাও বলা হয়েছে, মা-বাবার বন্ধু-স্থানীয়দের সাথে সদাচার ও সুসম্পর্ক রাখা। বলা বাহুল্য যে, এটা নবীন ও প্রবীণের মাঝে সুসম্পর্ক ও দেখা-সাক্ষাতের এক অতুলনীয় ব্যবস্থা।

ইসলামের  এই মহান শিক্ষাগুলো আমাদের পূর্বসূরীদের বাস্তব জীবনে বিদ্যমান ছিল বলেই তাদের জীবন মানবতা ও মানবিকতায় উদ্ভাসিত ছিল। তারা যেমন বৃদ্ধের সেবা ও সম্মান করেছেন তেমনি নিজের বার্ধক্যেও তারা পেয়েছেন নবীন প্রজন্মের অপরিমেয় সম্মান ও সেবা। আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে যে সুন্দর প্রত্যাশাগুলো উচ্চারিত হয় তা সত্য হওয়ার উপায় হচ্ছে সর্বস্তরে ইসলামী চেতনার বিস্তার, ইসলামী আদর্শের অনুশীলন। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।

 

 

advertisement